শেষ বলের ছক্কায় রোমাঞ্চকর জয়

মানুষ বরাবরই রোমাঞ্চপ্রিয়। যে কাজটা বেশি কঠিন, সেই কাজটা করতে পারলেই মানুষ আনন্দটা বেশি পায়। তবে কঠিন কাজ করাটা কঠিন বলেই সেটার পরিমাণটাও সবসময় কমই হয়।

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করা ম্যাচের সংখ্যা একেবারে কম নয়। কখনও হয়তো ব্যাটিংপক্ষ জয়ী হয়েছে, কখনও হয়তো বোলিংপক্ষ। তবে শেষ বলে ছয় মেরে জয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। ওয়ানডে ক্রিকেটে এই পর্যন্ত মাত্র পাঁচবার এই ঘটনা ঘটেছে, টি-টোয়েন্টিতে একবার।

একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ম্যাচ গুলোর দিকে। 

জাভেদ মিঁয়াদাদ – ভারত বনাম পাকিস্তান, ১৯৮৬

২৪৫ রানের লক্ষ্যমাত্রাটা বড়ই ছিল পাকিস্তানিদের জন্য। বিশেষ করে ম্যাচটা ফাইনাল হওয়ায় চাপটা নিঃসন্দেহে আরেকটু বেশি ছিল। শেষ ১০ ওভারে যখন ৯০ রানের প্রয়োজন হয়, তখন ম্যাচটা আরও কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের ব্যাটিং-নির্ভরতা জাভেদ মিঁয়াদাদ ম্যাচ ধরে রাখেন। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১১ রান, বোলিং করতে এলেন চেতন শর্মা। সেই ওভারেই চেতন শর্মা দু’টি উইকেট ফেলে দেন এবং শেষ বলে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন পড়ে ৪ রানের। শেষ বলটা চেতন শর্মা করতে চেয়েছিলেন ইয়র্কার, কিন্তু হয়ে যায় ফুলটস। স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে ছক্কা মারতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি জাভেদ মিঁয়াদাদ।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ জয়ের প্রথম ব্যক্তি জাভেদ মিঁয়াদাদ ; Image Source: Dawn

সেটাই ছিল আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো শেষ বলে ছক্কা মেরে কোনো দলের জয়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল শারজাহ কাপ ফাইনাল। অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংসের পাশাপাশি শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ এবং টুর্নামেন্ট জেতানোয় জাভেদ মিঁয়াদাদ পরিণত হন জাতীয় বীরে।

ল্যান্স ক্লুজনার – দক্ষিন আফ্রিকা বনাম নিউজিল্যান্ড, ১৯৯৯

ম্যাচটা ছিল সিরিজের চতুর্থ ম্যাচ। আগের ৩ ম্যাচের দু’টি জিতে সিরিজে এগিয়ে ছিল নিউজিল্যান্ডই। সিরিজে ফিরে আসার জন্য তাই ম্যাচটা জরুরী ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য। বৃষ্টির কারণে ইনিংসের আয়ু কমে নির্ধারিত হয় ৪০ ওভার, যাতে নিউজিল্যান্ড করতে পারে মাত্র ১৯১ রান। ১৯২ রানের লক্ষ্যে নেমে প্রথম বলেই উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানোর পর ৮৮ রানের জুটি গড়ে তোলেন গিবস এবং কালিনান। তবে এরপরই দ্রুত কয়েকটি উইকেট ফেলে দিয়ে ম্যাচে ফেরত আসে নিউজিল্যান্ড। ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ক্লুজনার যখন নামেন, তখন আফ্রিকার প্রয়োজন ৪২ বলে ৪৮। বেশ কিছু নাটকীয়তার পর শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন হয় ১১ রানের। প্রথম বলে ১ রান নিয়ে ক্লুজনার অপর পাশে গেলে ওভারের দ্বিতীয় বলেই বাউচার আউট হন, পাল্লাটা তখন নিউজিল্যান্ডের দিকেই ঝুঁকে গেলো কিছুটা। নতুন ব্যাটসম্যান এলওয়ার্দির কাজ ছিল স্ট্রাইকটা কোনোক্রমে ক্লুজনারকে দেওয়া, প্রথম বলেই রানটা নিয়ে কাজটা ভালোভাবেই সম্পন্ন করলেন এলওয়ার্দি। সমীকরণ, ৪ বলে প্রয়োজন ১০ রান। ক্লুজনারের জন্য কাজটা তখন একটু কঠিন, কারণ রানটা করার সাথে সাথে স্ট্রাইকটাও তাকে ধরে রাখতে হতো। প্রথম তিন বলে ৬ রান তুলে নেওয়ার ফলে শেষ বলে প্রয়োজন পড়ে ৪ রানের। লং অনের উপর দিয়ে সীমানা পার করে ম্যাচটা জেতান ক্লুজনার। পরবর্তীতে সিরিজটাও জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

ফিনিশার হিসেবে পরিচিত ক্লুজনারের আরেকটি ছোট কিন্তু কার্যকরী ইনিংস ; Image Source: Ross Kinnaird /Allsport

ব্রেন্ডন টেইলর – জিম্বাবুয়ে বনাম বাংলাদেশ, ২০০৬

আগের দুই ম্যাচে জয়-পরাজয় সমান হওয়ায় এই ম্যাচটা ছিল পাঁচ ম্যাচের সিরিজে দুই দলের জন্যেই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। প্রথমে ব্যাটিং করা বাংলাদেশ দলের জন্য সূচনাটা বাজে হলেও শেষ পর্যন্ত ২৩৬ রানের একটা লড়াই করার মতো স্কোর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। বোলিংয়েও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানেই ছিল। শাহাদাত হোসেনের হ্যাটট্রিকের সুবাদে শেষ দুই ওভারে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন পড়ে ২৮ রানের।  ৪৯তম ওভারে জিম্বাবুয়ে রান তুলে নেয় ১১, ফলে শেষ ওভারে জয়ের জন্য জিম্বাবুয়ের দরকার পড়ে ১৭ রান।

বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে ম্যাচটা জিতিয়েছিলেন টেইলর Image Source: CricTracker.com

বল করতে আসেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ওভারের দ্বিতীয় বলেই ৬ মারলে ম্যাচজয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে জিম্বাবুয়ে। তবে নাটকীয়তা জমে উঠলো, যখন পঞ্চম বলে মুপারিওয়া রান আউট হলেন। শেষ বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন তখন ৫ রান। মিড উইকেটের উপর দিয়ে বিশাল একটা ছক্কা মেরে ম্যাচটা জেতালেন ৭২ বলে ৭৯ রান করা ব্রেন্ডন টেইলর। পরবর্তীতে সিরিজটাও জিতে নেয় জিম্বাবুয়ে।

শিবনারায়ন চন্দরপল – ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম শ্রীলংকা, ২০০৮

ম্যাচটাতে বোলাররা কিছুটা সুবিধা পাচ্ছিল, সেটা একটা তথ্য দিলেই বোঝা যায়। ক্রিস গেইলের মতো ব্যাটসম্যানকেও ৫২ রান করতে বল খেলতে হয়েছিল ৮১টি। এর আগে ৪৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়েও সিলভা এবং কাপুগেদারার ১৫৯ রানের একটা জুটিতে ভর করে শ্রীলংকা দাঁড় করায় ২৩৫ রানের একটা মাঝারি স্কোর। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে উইন্ডিজও শুরুতে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ২১৯ রানে যখন তাদের নবম উইকেট পড়ে, তখনও প্রয়োজন ১৭ রানের। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৩ রানের, স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে আছেন শিবনারায়ন চন্দরপল, যার কিনা ধীরগতিতে ব্যাটিং করার জন্যেই কিছুটা দুর্নাম রয়েছে। শেষ ওভারটা করার জন্য এগিয়ে এলেন সেই ম্যাচে ৯ ওভারে মাত্র ১৭ রান দেওয়া চামিন্দা ভাস। প্রথম ৪ বলে মাত্র ৩ রান দিয়ে চামিন্দা ভাস দুর্দান্তই ছিলেন। কিন্তু পঞ্চম বলে মিড অফ অঞ্চল দিয়ে চার মেরে শেষ বল পর্যন্ত উত্তেজনাটা ধরে রাখলেন চন্দরপল।

শেষ দুই বলে ১০ রান নিয়ে ‘স্বভাববিরুদ্ধ’ ব্যাটিংয়ে জয় ছিনিয়ে আনেন চন্দরপল Image Source: Sportskeeda

শেষ বলে প্রয়োজন ৬ রান। ম্যাচের এই মুহূর্তে ভাস একটা ভুল করে ফেললেন। দিয়ে ফেললেন একটা ফুলটস বল, মিড উইকেটের উপর দিয়ে সেটাকে ছয় বানাতে বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না চন্দরপল। নখকামড়ানো ম্যাচটা জিতিয়ে ফিরলেন চন্দরপলই।

রায়ান ম্যাকলারেন – দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নিউজিল্যান্ড, ২০১৩

আগের দুই ম্যাচ জিতে নিউজিল্যান্ড সিরিজ জিতে যাওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ম্যাচটা ছিল সম্মান বাঁচানোর লড়াই। প্রথমে ব্যাট করে ২৬০ রানের টার্গেট দিয়ে হোয়াইটওয়াশ করার পথে ভালোভাবেই এগোচ্ছিল নিউজিল্যান্ড। তবে গ্রায়েম স্মিথের সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকাও বেশ ভালোভাবেই জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু এক পর্যায়ে খুব দ্রুত কিছু উইকেট ফেলে দিয়ে ভালোভাবেই ম্যাচে ফেরত আসে নিউজিল্যান্ড। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ৮ রানের, হাতে ২ উইকেট। প্রথম ২ বলে ৫ রান তুলে নিলেও ম্যাকলারেনকে নন-স্ট্রাইক প্রান্তে চলে যেতে হয়। সেই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল যত বেশি সম্ভব ম্যাকলারেনকে স্ট্রাইকে রাখা। কিন্তু পরবর্তী ২ বলে ডেল স্টেইন রান নিতে ব্যর্থ হন এবং পঞ্চম বলে আউট হয়ে ফেরত যান। ক্যাচ হওয়ার আগেই প্রান্ত বদল করে ফেলায় স্ট্রাইকে যান ম্যাকলারেন। শেষ বলে তখন তিন রান প্রয়োজন। জেমস ফ্র্যাংকলিনের শর্ট বলে পুল করে ৬ মেরে দেন ম্যাকলারেন, দক্ষিণ আফ্রিকাও বেঁচে যায় হোয়াইটওয়াশের লজ্জা থেকে।

শেষ বলে ৬ মেরে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা থেকে বাঁচান দক্ষিন আফ্রিকাকে ; Image Source: News.com.au

দিনেশ কার্তিক – ভারত বনাম বাংলাদেশ, ২০১৮

প্রথমবারের মতো কোন টুর্নামেন্ট জয়ের খুব কাছাকাছি ছিল বাংলাদেশ। ২০ ওভারে ১৬৯ রানের টার্গেট ভারতের মতো দলের কাছে খুব বেশি না হলেও একটা পর্যায়ে বেশ ভালো ভাবেই ম্যাচে ফেরত আসে বাংলাদেশী বোলাররা। শেষ ৩ ওভারে যখন ৩৫ রানের প্রয়োজন ছিল তখন মুস্তাফিজুর রহমানের দূর্দান্ত একটা ওভারে ( ১ রান, ১ উইকেট) ম্যাচটা জমিয়ে তুলে বাংলাদেশ। শেষ ২ ওভারে ৩৪ রানের সমীকরণটা বাংলাদেশের পক্ষেই ছিল। কিন্তু রুবেল হোসেনের পরবর্তী ওভারে ২২ রান তুলে দিনেশ কার্তিক পরিস্থিতিটাকে আবার ভারতের পক্ষে নিয়ে আসে। শেষ ওভারে ১২ রানের টার্গেটও প্রায় জয় করে ফেলেছিল অনিয়মিত বোলার সৌম্য সরকার। পঞ্চম বলে যখন বিজয় সংকরকে আউট করলেন তখন ভারতের প্রয়োজন ছিল ১ বলে ৫ রান।

অতিমানবীয় ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে কাদানো কার্তিক  Image Source: Zee News – India.com

সংকর আউট হলেও প্রান্ত বদল করে ফেলার কারণে স্ট্রাইক পেলেন দিনেশ কার্তিক। শেষ বলে কাভারের উপর দিয়ে ছক্কা মেরে ম্যাচটা এবং টুর্নামেন্টটা জিতিয়ে ফিরলেন দিনেশ কার্তিক।

আসিফ মুজতবা – পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া ১৯৯২

অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২২৯ রানের টার্গেট সেই সময় যথেস্ট কঠিনই ছিল। ২১২ রানেই ৯ম উইকেটের পতন ঘটিয়ে কঠিন কাজটাকে আরো কঠিন বানিয়ে ফেললো অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা। আগের বিশ্বকাপে দেথ ওভারে বোলিং এর জন্য প্রশংসিত ছিলেন স্টিভ ওয়াহ। কিন্তু ক্রিজে থাকা আসিফ মুজতবারও ফিনিশার হিসেবে সুনাম ছিল।

ফিনিশার হিসেবে আসিফ মুজতবার আলাদা সুখ্যাতি ছিল Image Source: Getty Image

 

 

শেষ ওভারে ১৭ রানের টার্গেট নিয়ে নামা ম্যাচটাতে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে জয়টা স্টিভ ওয়াহরই হবে। শেষ বলে প্রয়োজন ছিল ৭ রানের। আসিফ মুজতবার ছয়ে ম্যাচটা জিততে না পারলেও ম্যাচটা ড্র করে পাকিস্তান। উপরের বর্ণিত ম্যাচগুলোর চাইতে এটা কিছুটা ব্যতিক্রম কারণ এতে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়নি।   

Related Articles

Exit mobile version