৬ এপ্রিল, ২০১৭। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের করা ফুল লেন্থ ডেলিভারিটা বাউন্ডারির ওপারে আছড়ে ফেলতে চাইলেন ভিকুম সঞ্জয়া। ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে লং অফে ধরা পড়লেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে। আরেকটা টি-টোয়েন্টি জয় সিলগালা হলো বাংলাদেশের নামে।
তবে জয় উদযাপন ছাপিয়ে সবার মধ্যমণি হয়ে রইলেন একজন। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাঠ ছাড়তে ছাড়তে তার দু’হাত আকাশপানে, এক হাতে ক্যাপ। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে মুখটা তুললেন। যেন অনুযোগ করলেন বিধাতার কাছে, টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারটা থেমে যাওয়ায়। তবে অভিযোগ তিনি কখনোই করেননি।
হাতেগোনা ক’জন বাংলাদেশি সমর্থকদের মাঝে দেখা গেল, মাশরাফির ছবি সম্বলিত ‘উই উইল মিস ইউ মাশরাফি’ লেখা একটি প্ল্যাকার্ড ধরা বিখ্যাত সমর্থক টাইগার শোয়েবের হাতে।
বাংলাদেশের সদ্য সাবেক টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সম্বিৎ ফিরে পান অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজের আলিঙ্গনে। দু’জনকে একসাথে দেখে একটি কথাই যেন উড়ে বেড়াচ্ছিল তখন, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’
২০১৪ সালে পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ডটা মাশরাফির বাহুতে ততক্ষণে খানিকটা ঢিলে হয়ে গেছে। কমে গেছে অধিনায়কত্বের পরিধি। টসের সময় ডিন জোন্সের ধরা টিভি চ্যানেলের বুমে জানান, ক্রিকেটের ছোট্ট এই ফরম্যাটে নিজের ইতি টানার কথা। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের আরেকটি অধ্যায়ের এপিটাফটাও তখনই লেখা হয়েছিল। তার আচমকা এমন সিদ্ধান্ত ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’ হয়ে ঝরেছিল দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মনে।
তবে এবার কোনো আচমকা সিদ্ধান্ত নয়। দেশের ক্রিকেটপাড়ার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশ অনুমিতই ছিল ওয়ানডে ‘অধিনায়ক’ মাশরাফির অবসর। সংবাদ সম্মেলনে ধরে আসা গলায় জানান, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ওয়ানডেটাই তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশের শেষ। ‘দুটি পাতা, একটি কুড়ি’র দেশখ্যাত পূণ্যভূমি সিলেটেই থামলেন অধিনায়ক মাশরাফি।
২০১৪ সালে একের পর এক ম্যাচ হেরে তখন টালমাটাল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সাথে যোগ হয় সাকিব আল হাসানের দুই দফা নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। পুরো দল তখন একটা তীরহারা, মাস্তুলভাঙা জাহাজ। সেই জাহাজ মেরামত করে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন মাশরাফি। সকল ঝড়-ঝাপটা পাড়ি দিয়েছেন বুক চিতিয়ে, হয়েছেন পাঞ্জেরী!
তার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। জিতেছে টানা ছয়টি ওয়ানডে সিরিজ। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে। আয়ারল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজে ঘুচেছে একটি ট্রফির আক্ষেপও।
পরিসংখ্যান বলছে, মাশরাফির নেতৃত্বে ৮৮টি ওয়ানডে খেলে ৫০টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। হেরেছে ৩৬টি, ফলাফল আসেনি দুটি ম্যাচে। ২৮ ম্যাচে দশ জয় নিয়ে টি-টোয়েন্টিতেও আছেন শীর্ষে। বিপরীতে ১৭ হারের সাথে আছে একটি পরিত্যক্ত ম্যাচও।
কেবল সংখ্যা দিয়ে মাশরাফিকে বিচার করাটা সমীচীন নয় বোধ করি। পরিসংখ্যান তার পক্ষেই রায় দিবে। কিন্তু বিখ্যাত ক্রীড়ালেখক নেভিল কার্ডাস তো বলে গেছেন, ‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা।’
পরিসংখ্যানের খেরোখাতা খুলে দেখা যাবে, অধিনায়ক মাশরাফির এই অর্জন। দেখা যাবে ক্রিকেটার মাশরাফির অর্জনও। তবে পরিসংখ্যান কখনোই বলবে না, কতটা দারুণ অধিনায়ক ছিলেন তিনি। বলবে না, মাঠ ও মাঠের বাইরে কীভাবে সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে সকল সতীর্থদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের আগলে রেখেছেন দুঃসময়ে। সংখ্যার যোগফলে মিলবে না, কত ম্যাচে ইঞ্জুরি নিয়ে দৌঁড়েছেন, হাতে ছয় আউন্সের বল আর কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্বটা নিয়ে। মিরপুর থেকে কার্ডিফ, অকল্যান্ড থেকে কেনিংটন ওভাল।
গাজী আশরাফ লিপু থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যে কয়জন অধিনায়ক এসেছেন এদেশের ক্রিকেটে, তাদের মধ্যে ক’জনই বা এত জনপ্রিয় হয়েছে? ক’জনের নামই বা মুখে মুখে ফিরেছে? দিন বদলের গান শোনাতে পেরেছেন ক’জন? একটু পেছনে ফেরা যাক।
জিম্বাবুয়েকে ঘরের মাঠে ৫-০ তে হারিয়ে জয়খরা কাটানোর গল্পটা তো সবার মনে থাকারই কথা। তবে আলাদা করে এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে ২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেড ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই গ্রুপপর্বের ম্যাচ।
রুবেল হোসেনের রিভার্স সুইংয়ে ছত্রখান জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট। জিং বেলস আর এলইডি স্টাম্পের বাতিগুলো জ্বলে উঠতেই রুবেলের বাঁধনহারা ছুট। তার পেছনে বাকিরা। ততক্ষণে মিড অনে শুয়ে পড়েছেন একজন। ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে না কাটতেই বাকিরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর। কমেন্ট্রি বক্সে নাসের হুসাইন শোনালেন বাংলার বাঘের থাবায় ইংল্যান্ডের সিংহ বধের গল্প।
মাথায় দেশের জাতীয় পতাকা বেঁধে মিড-অনে শুয়ে পড়ে লোকটা গেলেন ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে। অধিনায়ক মাশরাফি ঐতিহাসিক সেই জয় উৎসর্গ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের খেটে খাওয়া মানুষজনকে। এমন নজির স্থাপন করেছেন আর ক’জন ক্যাপ্টেন? একজনও নয়।
বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে দেশে ফিরে ঘরের মাঠে একে একে হারালেন পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা , আফগানিস্তানকে। দারুণ সময় কাটালো বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে গেল বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে সবাইকে চমকে দিয়ে মাশরাফি বিদায় বললেন। দেশে ফিরে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন,
‘এখনো তো ওয়ানডে খেলছি, মজা হবে ওখানেই।’
হ্যাঁ, মজা হয়েছে এর কিছুদিন পরই, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে ৩৩ রানে চার উইকেট হারানোর পর সাকিব-মাহমুদউল্লাহর ২২৪ রানের মহাকাব্যিক এক জুটিতে নিউ জিল্যান্ডকে হারায় বাংলাদেশ। সেই জয়ের পর ড্রেসিং রুমের বারান্দায় টিমমেটদের সাথে দাঁড়ানো মাশরাফির হাত ছুঁড়ে উচ্ছ্বাস, উল্লাস, বিজয়ের চিৎকার সেই ‘মজার’ কথাই বলে যায়।
অধিনায়ক হিসেবে সতীর্থদের ঠিক কত কাছের মাশরাফি?
২০১৫ বিশ্বকাপটা একেবারেই ভালো যায়নি তামিম ইকবালের। ব্যাট হাতে ধুঁকছিলেন দেশসেরা ওপেনার। চারপাশে তীর্যক বাক্যবাণ, সমালোচনার তীব্র ঢেউ। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো তার জন্য। তামিমকে তখন ঠিকই আগলে রাখেন তার ‘মাশরাফি ভাই’। এক সাক্ষাৎকারে তামিম বলেন,
‘আমি হয়তো আরো ভালো অধিনায়কের অধীনে খেলব, কিন্তু মাশরাফি ভাইয়ের মতো করে আর কেউ আমার খেয়াল রাখবে না।’
২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসে ভারত। অনুশীলনে এক বাঁহাতি পেসারকে দেখে মনে ধরে মাশরাফির। টিম ম্যানেজমেন্টে জানিয়ে ‘সারপ্রাইজ প্যাক’ হিসেবে সেই বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমানকে জাতীয় দলে নিয়ে আসেন মাশরাফি। সেই টোটকাটা দারুণভাবে কাজে লেগে যায়। মুস্তাফিজের কাটারেই ধরাশায়ী ভারত। টানা দুই ম্যাচে পান এগারো উইকেট।
এরপর অনেক এগিয়েছে মুস্তাফিজের ক্যারিয়ার। সময়ের সাথে সাথে কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে কাটারের ধার। লড়েছেন ইঞ্জুরির সাথে। কথা উঠেছে, ‘মুস্তাফিজ শেষ’। কিন্তু অন্য সবার মতো মুস্তাফিজও পাশে পেয়েছেন মাশরাফিকে।
লিটন কুমার দাস, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে এসেছেন জাতীয় দলে। প্রতিভার ঝলকানি অল্পবিস্তর দেখা গেলেও বাজি হয়ে ফাটছিল না কিছুতেই। প্রায় প্রতি ম্যাচেই শুরুটা হচ্ছিল ভালো, তবে খেই হারাতেও সময় নেননি। চারপাশে কত সমালোচনা। তবুও লিটনের কাঁধে মাশরাফির ভরসার হাত।
২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দারুণ একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন লিটন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেটি তার প্রথম। দারুণ স্বস্তি নেমে এসেছিল তার চেহারায়। তখন ড্রেসিংরুমের বারান্দা থেকে দুই হাতে ‘থাম্বস আপ’ আর বুকে হাত রেখে মাশরাফি ইশারা করছিলেন, ‘বুকে সাহস রেখে ইনিংস বড় করে আয়।’
মাশরাফির সেই ভরসা, আস্থার প্রতিদান লিটন দিয়েছেন বেশ ক’বারই। ২০১৯ বিশ্বকাপে উইন্ডিজকে উড়িয়ে দেয়া অপরাজিত ৯৪*, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১২৬ রানের ঝকঝকে ইনিংস তো সেই সাক্ষ্যই দেয়। কে জানতো, লিটন সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন অধিনায়কের শেষ ওয়ানডের জন্যেই?
অধিনায়ক মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে লিটন খেলেছেন এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস, ১৪৪ বলে ১৭৬ রান। দুঃসময়ে তার পক্ষে ব্যাট ধরা সেই মাশরাফির ভরসার প্রতিদান বোধহয় লিটন এর চেয়ে ভালোভাবে দিতে পারতেন না!
তামিম-লিটনের জন্য মাশরাফিকেও অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে অনেক কথা। পেয়েছেন কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট, বোর্ডের বাধা। তবুও তাদের জন্য নিজের অবস্থান থেকে সরেননি তিনি। যাদের ওপর মাশরাফির এই অগাধ বিশ্বাস, বিদায়বেলায় প্রতিদানে তারাও কি এমন কিছু উপহার না দিয়ে থাকতে পারেন?
শুধু তামিম, লিটন কিংবা মুস্তাফিজই নন। ক্যারিয়ারের খারাপ সময়ে, মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে; তাসকিন, সৌম্য, সাব্বির, মিরাজরাও পেয়েছেন ‘মাশরাফি’ নামক এক মহীরুহের ছায়া।
অধিনায়ক মাশরাফির সফলতা তো অনেক আছে। এর উল্টো পিঠে আছে ব্যর্থতাও। অধিনায়কত্বের এই বর্ণিল উপন্যাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিবর্ণ অধ্যায়টা হয়ে থাকবে ২০১৯ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা দলটা নিয়েই ইংল্যান্ড গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি, বদলায়নি চিত্র। মাশরাফিও ছিলেন নিষ্প্রাণ। আট ইনিংসে বল করে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র একটি। আট ম্যাচে তিন জয় নিয়ে অষ্ঠম অবস্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করে বাংলাদেশ।
দিনবদলের গান…
২০১৪ সালে একটি ওয়ানডেও জিতেনি বাংলাদেশ। ব্যাটিং, বোলিং সবই হচ্ছিল ঠিকমতো। কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটার ঘাটতি। সবকিছু ঠিকঠাক হলেও, আশার ফুলগুলো একইসাথে ফুটলেও, ম্যাচে জেতা হয়ে উঠছিল না, জয়ের মালাগুলোও গাঁথা হচ্ছিল না।
তখন বদল হলো অধিনায়কত্বের ব্যাটন। বদলে গেল বাংলাদেশও।
জাদুর ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া সেই বাংলাদেশের অন্যতম কারিগর মাশরাফি। আশার ফুলগুলো তিনি দক্ষ হাতে গেঁথেছেন এক সুতোয়। সেই জয়ের মালা গলায় তুলেই এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। একটা পরিবারের মতো গড়ে তুলেছেন গোটা দলটাকে। শিখিয়েছেন বুক চিতিয়ে, মাথা উঁচু করে খেলতে।
মাশরাফি সামলেছেন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর মতো তারকাদের। পাশে দাঁড়িয়েছেন তাসকিন, মিরাজ, সাব্বিরদের। দলের সবাইকে উপহার দিয়েছেন সুন্দর একটা ড্রেসিংরুম। জয়ের আনন্দে যেভাবে সবার সাথে ভাগ করেছেন, ঠিক তেমনি হারের দায় মাথা পেতে নিয়েছেন সবার আগে।
আলাদা করে বলতে হবে ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজের কথা। সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখেছিল ক্রিকেটবিশ্ব। ঐতিহ্যগতভাবে উপমহাদেশের উইকেট বরাবরই স্পিন সহায়ক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা বলাই বাহুল্য। তবে ভারত সিরিজের প্রথম ম্যাচে মাশরাফির একাদশে ছিল চার পেসার। প্রথা ভেঙ্গে সেবারই প্রথম সাহসী চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন তিনি। এনে দিয়েছেন সাফল্যও। সাথে শুনিয়েছিলেন দিন বদলের গান।
দিনবদলের নায়ক, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়তে শেখানো, হারার আগেই হার না মানার দৃঢ় সংকল্পের বীজ বুনে দেয়া সেই অধিনায়কই বিদায় বলেছেন। অধিনায়কের শেষ যাত্রার সাক্ষী হয়ে রইলো সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এক মহানায়কের শেষ অ্যাসাইনমেন্টের সাক্ষী হয়ে রইলো স্টেডিয়ামের গ্রীন গ্যালারি, ক্লাব হাউজ, ইস্টার্ন গ্যালারি, আর প্রায় ১৯ হাজার ক্রিকেট পাগল দর্শক।
নিতান্তই কাকতাল। টি-টোয়েন্টি থেকে যেদিন অবসর নেন, সেদিন ম্যাচের আগে প্রেমাদাসার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল, অভিষেক হয়েছিল মিরাজের। আর এবার যখন ওয়ানডে থেকেও অধিনায়কত্ব ছাড়ছেন, খেলোয়াড়ি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন, ম্যাচের আগে না হলেও মাঝে বৃষ্টি এসে বাগড়া দিয়েছে। অভিষেকও হয়েছে দুই তরুণ ক্রিকেটার আফিফ হোসেন ধ্রুব ও নাঈম শেখের।
অধিনায়ক হিসেবে ৫০তম ম্যাচটা জিতে মাঠ ছাড়ছিলেন হেঁটেই। সতীর্থরা এগিয়ে গেলেন প্রিয় অধিনায়ককে বিদায় দিতে। সুসময়, দুঃসময় নির্বিশেষে মাশরাফিকে কাছে পাওয়া তামিম তাকে তুলে নিলেন কাঁধে। সঙ্গ দিলেন মিরাজ-শান্তরা। যে কাঁধ দীর্ঘদিন বয়েছে দায়িত্বের বোঝা, তাকে বাউন্ডারির বাইরে নামিয়ে দিয়ে তামিমরাও কিছুটা প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো তারাও যেন বলতে চাইছিলেন,
O Captain! my Captain! our fearful trip is done,
The ship has weather’d every rack, the prize we sought is won!
ততক্ষণে সময়ের পোস্টারে ছাপা হয়ে গেছে অধিনায়ক মাশরাফির এপিটাফ। সতীর্থের কাঁধে চেপে বাউন্ডারির ওপারে নেমেছেন। ওই ২২ গজের সবুজ গালিচায় রেখে গেছেন একটা লিগ্যাসি। পরিসংখ্যানের অতল সমুদ্রে ডুব দিয়ে কেউ কেউ হয়তো খুঁজবেন তাকে। কিন্তু যে বীরদর্পে, চৌকস সেনাপতির মতো বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছেন এতদিন, সেই চিত্রগুলো কি কেউ পাবেন?
৩৬০ আউলিয়ার শহরের মাঠটা মাশরাফি ছেড়েছেন মাথা উঁচিয়ে। পেছনে রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি, অনেক জয়ের কাব্যগাথা, অনেক ঝড়ঝাপটা সামাল দেয়ার বীরোচিত গল্প। তা দেখে নড়াইলের চিত্রা নদীর প্রতিটি ঢেউ থেকে শুরু করে লাক্কাতুরা চা বাগানের প্রতিটি কুড়িতে হয়তো আলোড়ন তুলেছে, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কয়টা লাইন,
“বল বীর
চির-উন্নত মম শির!”