দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ২০১৯। ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই আসরের ১২তম সংস্করণে সর্বোচ্চ শক্তির দল ঘোষণা করেছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। রাউন্ড-রবিন লিগ ফরম্যাটের এবারের আসরে লড়াইটা যে হবে অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শক্তির বিচারে দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ছেড়ে কথা বলবে না কেউই, তা বলাই যায়।
স্বাগতিক ইংল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ডের সাথে এবার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছে বাংলাদেশকেও। কিন্তু ‘১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকু? কতদূরই যাবে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়ারদের সমন্বয়ে গড়া দলটি?
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত পাঁচটি বিশ্বকাপ খেললেও ২০১৫ এর আগ পর্যন্ত অংশগ্রহণই যেন ছিল বড় ব্যাপার। এর মধ্যে ২০০৭ সালে সুপার এইট খেললেও টুর্নামেন্টে ফেভারিট তকমা পায়নি। মূলত মাশরাফির নেতৃত্বে ‘১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পর থেকেই অন্য এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করে সবাই।
এরপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওডিআই সিরিজ হারিয়ে ক্রিকেটবিশ্বে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় টাইগাররা। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে #RiseofTheTigers হ্যাশট্যাগও। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল, ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে গড়া অন্যতম ভারসাম্যপূর্ণ দল হিসেবেই ‘১৯ বিশ্বকাপের মঞ্চে এবারের বাংলাদেশ। বারবার ফাইনাল খেলেও অধরা শিরোপা না ছোঁয়ার দুঃখ ভুলে জিতে নিয়েছে সর্বশেষ ত্রিদেশীয় সিরিজটিও। সব মিলিয়ে সকল টেস্টে জিপিএ-৫ পেয়েই যেন বোর্ড পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন মাশরাফির দল।
প্রতি আসরে ‘তারুণ্যনির্ভর দল’ উপাধি পাওয়া টাইগাররা এবারের আসরের অন্যতম অভিজ্ঞ দল। ‘পঞ্চপাণ্ডব’দের মধ্যে মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক চারজনই এবার খেলবেন নিজেদের ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ। পরিসংখ্যান বলছে, ম্যাচসংখ্যার বিচারেও এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ঝুলিতে। ঘোষিত স্কোয়াড অনুযায়ী, একমাত্র বাংলাদেশেরই আছে ১৫০+ ওডিআই খেলা পাঁচজন ক্রিকেটার!
দেড়শ’র বেশি ওয়ানডে খেলা মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহ্ এবং মুশফিকই বাংলাদেশের প্রাণভোমরা। এই পাঁচ স্তম্ভের সাথে সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ মিঠুন, লিটন দাস, মোসাদ্দেক হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী মিরাজের মতো তরুণরা জ্বলে উঠলে যেকোনো দলকেই পাড়ার দলের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে দলটি।
৩০ মে থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপে পুরো বাংলাদেশ যাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তাদের মধ্যে প্রথমেই আছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ব্যাটে-বলে তিনিই বর্তমানে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিকেটার। সর্বশেষ ত্রিদেশীয় সিরিজে একটু চোট পেলেও যে কয়টি ম্যাচ খেলেছেন, তাতে ছিলেন দারুণ ছন্দে। আর বিশ্বকাপের মাঠের লড়াই শুরুর ঠিক আগে প্রকাশিত ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিং তাকে করবে আরও উজ্জীবিত। সময়ের সেরা এই অলরাউন্ডার ফিরে পেয়েছেন তার হারানো মুকুট। এরই মধ্যে সাকিব সম্পর্কে অন্য দলগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশ্বখ্যাত সব ক্রিকেটবোদ্ধারা। পাঁচবার বিশ্বকাপ খেলা সাবেক অজি ক্যাপ্টেন রিকি পন্টিং তো রীতিমতো বাজিই ধরেছেন সাকিবের পক্ষে! তার মতে, এবারের আসরের বাজির ঘোড়াদের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবেন এই অলরাউন্ডার।
যেকোনো সময় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম এই আসরে বাংলাদেশের ব্যাটিং সেনসেশন তামিম ইকবাল। স্বভাবত মারকুটে হলেও এবার দলের প্রতি নিজের দায়িত্বটা যেন ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছেন সব ধরনের ক্রিকেটে দেশের হয়ে সর্বাধিক রানসংগ্রাহক এই ব্যাটসম্যান। দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যান হিসেবে বদলে যাওয়া তামিম এখন যেন ধৈর্য্যের প্রতীক। বলে বলে ছক্কার ফুলঝুড়ি না ছুটিয়ে ইনিংস গড়ার দিকে নজর দেয়া তামিমের কারণে অন্য প্রান্তে সৌম্য-লিটনরাও ব্যাট চালাতে পারছেন নির্ভার হয়ে। এবার প্রতিযোগিতার মাঠেও এমন দায়িত্বশীল তামিমকেই চাইবে টাইগার ড্রেসিংরুম। ‘রানমেশিন’ খেতাব পাওয়া ইংল্যান্ডের মাঠে বড় সংগ্রহের জন্য বা রান তাড়ায় এই ড্যাশিং ওপেনারই দলের নেতৃত্ব দেবেন বলেই সকলের অনুমান।
ভারতের ‘দ্য ওয়াল’ যদি হন রাহুল দ্রাবিড়, শ্রীলংকার ক্ষেত্রে সে নামটা যদি হয় কুমার সাঙ্গাকারা, তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ‘দ্য ওয়াল’ মুশফিকুর রহিম। অসংখ্য ম্যাচে খাদের কিনারা থেকে দলকে টেনে তুলেছেন তিনি। চমৎকার ছন্দে থাকা মুশফিকও মুখিয়ে আছেন নিজের সেরাটা দিতে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে অনেকটা খোলামেলাই জানিয়েছেন তার দলের অবস্থান, ব্যাখ্যা করেছেন কী চায় তার দল। আসন্ন বিশ্বকাপে যে টুর্নামেন্টসেরা হওয়ার লড়াইয়েই খেলতে যাচ্ছেন, তাও বলেছেন পরিষ্কার ভাষায়। আর এসব করার জন্য তিনি নিজেই যে থাকবেন অগ্রণী ভূমিকায়, তার ব্যাট থেকেই পাওয়া যাচ্ছে সে বার্তা। মিডল অর্ডারে মুশফিকের সাথে মিথুন, সাব্বিররা নিজের কাজটা ঠিকভাবে করতে পারলে সম্ভাব্য হাই স্কোরিং ম্যাচেও পথ হারাতে হবে না বাংলাদেশকে। মাঠের খেলায় প্রতিরক্ষা দুর্গ হয়েই আবির্ভূত হবেন মিডল অর্ডারে বাংলাদেশের মূল ভরসা ‘লিটল মাস্টার’ খ্যাত মুশি, এমনটাই আশা টাইগার ফ্যানদের।
বিশ্বকাপে এবার সব দলের মতো বাংলাদেশও সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বোলারদের নিয়ে। একে তো ইংল্যান্ডের সিমিং কন্ডিশনে খেলা, তার উপরে বোলিংয়ে স্পিনই এখনও বাংলাদেশের প্রধানতম অস্ত্র। উপমহাদেশে স্পিনে সাফল্য এলেও ইউরোপে সে আশা হয়তো টিম ম্যানেজমেন্টও করছে না।
তবে স্বস্তির বিষয়, গত এক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ে পেসাররাই ছিলেন এগিয়ে; সেরা পাঁচ বোলারের তিনজনই পেসার। এই পাঁচ বোলারের সংগৃহীত ৯৭ উইকেটের ৬৪টি নিয়েছেন পেসাররা। এর মধ্যে মুস্তাফিজ সর্বাধিক ৩২টি উইকেট নিয়ে আছেন সবার উপরে, তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মাশরাফি ২৭টি এবং চতুর্থ অবস্থানে থাকা রুবেল হোসেনের দখলে ১৬টি উইকেট। তালিকার বাকি দু’জন স্পিনার হলেন মেহেদী মিরাজ ও সাকিব আল হাসান। তারা দু’জন নিয়েছেন যথাক্রমে ২২টি ও ১৮টি উইকেট।
কিন্তু পরিসংখ্যানে পেসারদের এই সাফল্যও দেখেও খুব একটা সন্তুষ্ট হওয়া যাচ্ছে না৷ ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটবিশ্বে পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে কম ২৪.৬৭ এভারেজে ৪৪ ইনিংসে ৮৩ উইকেট নেয়া ‘দ্য ফিজ’ মুস্তাফিজুর রহমানেরই যে সাম্প্রতিক সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না! অথচ ব্যাটিংস্বর্গ বনে যাওয়া ইংল্যান্ডে টাইগার পেস অ্যাটাকের নেতৃত্ব দিতে হবে তাকেই। তবে কথায় আছে, সেরাদের নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য বড় প্লাটফর্মকেই বেছে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। মুস্তাফিজই বা তা না চাইবেন কেন? ইতঃমধ্যে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন মুস্তাফিজ, অধিনায়ক মাশরাফিও সেটা নিয়ে দারুণ উৎফুল্ল।
স্পিনে দেশসেরা সাকিবের কাছেই প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ‘১৫ বিশ্বকাপের পর গত চার বছরে ইউরােপের মাটিতে তার বলার মতো কোনো সাফল্য চোখে পড়ে না। এ সময় ৯ ইনিংসে ৮৪.৪ গড়ে মাত্র ৫টি উইকেট নিয়েছেন সাকিব, যার প্রতিটির জন্য খরচ করতে হয়েছে প্রায় ১০০ বল! আরেক স্পিনার মিরাজ এ সময় নিয়েছেন ৫ ইনিংসে ৩ উইকেট। পরিসংখ্যানের এই চোখরাঙানি সাকিব, মিরাজরা কতটুকু ফিরিয়ে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের কোর্টে, সেটাই এখন দেখার। তবে দলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার মাশরাফি যদি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি আর নিখুঁত লাইনলেন্থে প্ৰতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করতে পারেন, তাহলে স্বপ্ন দেখতেই পারেন ক্রিকেট-আমুদে দর্শকরা। মুস্তাফিজ-মাশরাফির সাথে রুবেল-মিরাজ-রাহিরা ঠিক সময়ে জ্বলে উঠবেন, এই আশাই করছেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
শ্রীলংকা, পাকিস্থান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে অভিজ্ঞদের অবসর অথবা ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে কিছুটা কোণঠাসা, তখন পঞ্চপাণ্ডবের সাথে একঝাক তরুণের আত্মবিশ্বাসী টাইগাররা নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন রূপকথা লেখতে মরিয়া। এক্ষেত্রে গত বিশ্বকাপের পর সব বড়বড় টুর্নামেন্টে সাফল্যও এগিয়ে রাখছে টাইগারদের। তাছাড়া পঞ্চপাণ্ডবেরও একসাথে খেলা এটিই হয়তো শেষ বিশ্বকাপ। আর এই উপলক্ষটিও যে রাঙিয়ে রাখতে চাইবে মাশরাফির দল তা কে না জানে?
প্রায় একই দল নিয়ে খেলা সর্বশেষ বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলা বাংলাদেশের আরেকটু কিছু চাওয়াটা অযাচিতও কিছু না। সেই রূপকথা লিখতে বাংলাদেশ এবারই হয়তো শেষবার পাচ্ছে মাশরাফির মতো নেতাকে। বদলে যাওয়া টাইগারদের কাণ্ডারি যে তিনিই, বলাই বাহুল্য। প্রতিভার প্রতিফলন না ঘটাতে পারা, প্রত্যাশার চাপে বারবার ভেঙে পড়া দলটিই যে তার প্রেরণা-উদ্দীপনায় আজ ত্রাস হয়ে উঠেছে যেকোনো দলের জন্য! অধিনায়ক হিসেবে পাওয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যও কথা বলছে তার হয়ে। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পাওয়া প্রায় সব সাফল্যই এসেছে ক্যাপ্টেন ম্যাশের হাত ধরে। তার নেতৃত্বে খেলা ৭৭ ম্যাচের ৪৪টিতেই জয় পেয়েছে টাইগাররা, যার মধ্যে ৩টিই এসেছে গত চার বছরে৷ ৫৮.৬৬ শতাংশ উইনিং রেকর্ডেও বাকিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ম্যাশ৷ তার পেছনে থাকা সাকিবের জয়ের গড় প্রায় দশ শতাংশেরও কম!
অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে গড়া এই বাংলাদেশ দল মাঠের ২২ গজে রচনা করবে নতুন মহাকাব্য, মাশরাফি তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বগুণকে নিয়ে যাবেন আরও অনন্য উচ্চতায়, প্রতি ম্যাচেই টাইগাররা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য বয়ে আনবে উদযাপনের নতুন নতুন উপলক্ষ, সে প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছে টাইগার সমর্থকরা। বাকিটা ভবিষ্যতের হাতেই, অপেক্ষা কেবল আর ক’দিনের!