আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ১৮৭৭ সালে। বেলায় বেলায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বয়স বেড়ে এখন ১৪১ বছর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এখন তিনটি ফরম্যাট। টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি। শুরুর লগ্ন হতে এখন পর্যন্ত কয়েক সহস্রাধিক ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এখন যদি জিজ্ঞেস করা হয় সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কে? তখন একজনের নাম আলাদা করে বলা মুশকিল হয়ে যাবে। সর্বকালের নয়, বর্তমানের সেরা ক্রিকেটার কে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতেও ক্রিকেট অনুরাগীরা হিমশিম খেয়ে যাবে। সর্বকালের সেরা একজন নির্বাচন করাটা তো আরো দুঃসাধ্য।
সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের নাম কথা বললে দুটি নাম বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। এরা হলেন, স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান এবং শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। যদি এই শতাব্দীর ক্রিকেট অনুরাগীদেরকে দুজনের মধ্যে একজনকে বাছাই করতে বলে তাহলে বেশিরভাগই শচীন টেন্ডুলকারকে সর্বকালের সেরা বলে আখ্যায়িত করবে। একই প্রশ্ন গত শতাব্দীর ক্রিকেট অনুরাগীদের করলে তারা ডন ব্রাডম্যানের নাম বলবে।
তবে ‘সর্বকালের সেরা’ প্রশ্নে দুজনের মধ্যে তুলনা করাটা জুতসই হয় না। শচীন টেন্ডুলকার আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে ব্যাটিং করেছেন। তেমনি ব্রাডম্যানও আধুনিক যুগের কঠিন সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ব্যাটিং করেননি। দুইজনেই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই যুগে ক্রিকেট খেলেছেন। তাই তাদের মধ্যে তুলনা করে কে সেরা সেটা নির্ণয় করা যায় না। তবে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের যদি একটা লম্বা তালিকা করা হয় তখন দুজনের নাম উপরের দিকেই থাকবে।
১৪ই আগস্ট ১৯৪৮
১৯৪৮ সালের ১৪ই আগস্ট লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম এবং শেষ টেস্ট ম্যাচে মাঠে নামে অস্ট্রেলিয়া। ডন ব্রাডম্যান আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, এটিই তার শেষ আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ। নিজের শেষ টেস্ট ইনিংসে মাত্র চার রান করতে পারলেই ব্রাডম্যানের ব্যাটিং গড় ১০০ হতো। কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা সেটা চাননি। তাইতো পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা ব্রাডম্যান নিজের শেষ ইনিংসে রানের খাতা খুলতেই পারেননি। যার দরুন তার ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইন ফোর।
সর্বজয়ী ব্যাটসম্যান ডন ব্রাডম্যানের ক্যারিয়ারেও কিছুটা অপূর্ণতা থেকে যায় ঐ শূন্য রানের ইনিংসের কারণে। এমন অপূর্ণতা অনেক নামকরা ক্রীড়াবিদদের নামের পাশে আছে। বিশ্বসেরা দৌড়বিদ উসাইন বোল্ট নিজের শেষ ১০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় হয়ে শেষ করেছেন। যেখানে তিনি ২০০৮ সাল থেকে কখনো দ্বিতীয় স্থান লাভ করেননি, সেখানে তিনি নিজের শেষ দৌড়ে তৃতীয় হয়েছেন। তিনি তার ক্যারিয়ারে শেষবার ট্রাকে নেমেছেন দলীয় চারশো মিটার দৌড়ে। সেখানে তিনি মাঝপথে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির কারণে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই গতিদানবের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষটা ছিল বিবর্ণময়।
ডন ব্রাডম্যানের শেষ টেস্ট ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৪২.১ ওভারে ৫২ রানে গুটিয়ে যায়। ফলে ম্যাচের প্রথম দিনেই ব্রাডম্যানের রেকর্ড গড়ার সুযোগ এসে যায়। ইংল্যান্ডের ৫২ রানের মধ্যে ওপেনার লেন হাটন একাই করেন ৩০ রান।
স্বাগতিকদের জৌলুসহীন ব্যাটিং নৈপুণ্যের পর ব্যাট করতে নেমে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১১৭ রান যোগ করে অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার সিড বার্নস এবং আর্থার মরিস। সিড বার্নস ৬১ রান করে সাজঘরে ফিরে গেলে ১১৭ রানের জুটি ভাঙে।
এরপর ক্রিজে আসেন স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান। ব্যাটিং গড় তিন অংকে রেখে ক্যারিয়ার শেষ করার জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র চার রান। ক্রিজে নেমে প্রথম বল মিড-অফে খেললেও কোনো রান পাননি। এরপরের বলেই ঘটে যত বিপত্তি। লেগস্পিনার এরিক হোলিসের পরের বলে ডিফেন্সিভ পুস করতে গিয়ে বলের লাইন মিস করেন ব্রাডম্যান।
বোল্ড হওয়ার পর ক্রিজে দাঁড়িয়ে হতাশা প্রকাশ না করে স্বাভাবিকভাবে ব্যাট বগলদাবা করে শেষবারের মতো বাইশ গজ ত্যাগ করেন তিনি। ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড ১৮৮ রানে সবকটি উইকেট হারালে আর ব্যাট করার সুযোগ পাননি ‘দ্য ডন’ ব্রাডম্যান।
১৪ই আগস্ট ১৯৯০
স্যার ডন ব্রাডম্যানের যোগ্য উত্তরসূরি শচীন টেন্ডুলকার ১৯৯০ সালের ১৪ই আগস্ট আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের একশোটি শতকের মধ্যে প্রথম শতক হাঁকান। ব্রাডম্যান ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুব কম সময়েই শচীনের ব্যাটিং মিস করেছেন।
শচীন টেন্ডুলকার নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলেন ১৯৮৯ সালের ১৫ই নভেম্বর। মাত্র ১৬ বছর বয়সী টেন্ডুলকার পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের অভিষেক ইনিংসে ১৫ রান করে সাজঘরে ফেরেন। এরপরের টেস্টে তিনি ১৭২ বল মোকাবেলা করে ৫৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। টেন্ডুলকার তার টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম শতক হাঁকান ১৯৯০ সালের ১৪ই আগস্ট।
৯ই আগস্ট ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে মাঠে নামে ভারত। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড তাদের প্রথম ইনিংসে ৫১৯ রান সংগ্রহ করে। ইংল্যান্ডের হয়ে গ্রাহাম গুছ, মাইক আথারটন এবং রবিন স্মিথ শতক হাঁকান। জবাবে ভারত তাদের প্রথম ইনিংসে ৪৩২ রান সংগ্রহ করে। অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন ১৭৯ রান এবং সঞ্জয় মাঞ্জরেকার ৯৩ ও শচীন টেন্ডুলকার ৬৮ রান করেন।
ইংল্যান্ড তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেটে ৩২০ রান সংগ্রহ করে ইনিংস ঘোষণা করলে জয়ের জন্য ভারতের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪০৮ রান। ম্যাচ বাঁচাতে হলে ভারতকে খেলতে ম্যাচের পুরো শেষদিন।
ব্যাট করতে নেমে ভারতের টপ অর্ডার এবং টপ মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ১৮৩ রানে ছয় উইকেট হারানো পর মনোজ প্রভাকরকে সাথে নিয়ে তরুণ শচীন টেন্ডুলকার প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কোনো উইকেটের পতন ঘটতে না দিয়ে দিনের বাকিটা সময় কাটিয়ে দেন তারা দুজন।
শচীন টেন্ডুলকার ১৮৯ বলে ১৭টি চার মেরে অপরাজিত ১১৯ রানের ইনিংস খেলেন এবং প্রভাকর ৬৭ রানে অপরাজিত থাকেন। শেষ পর্যন্ত ভারত ৯০ ওভারে ছয় উইকেটে ৩৪৩ রান করলে ম্যাচ ড্র ঘোষণা করা হয়।
১৭ বছর বয়সী শচীন টেন্ডুলকার দুর্দান্ত ব্যাটিং করে শুধু ম্যাচই বাঁচাননি, দ্রুত রান তুলে এটা জানান দিচ্ছিলেন যে তিনি জয়ের জন্য ব্যাটিং করেছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৬৮ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১১৯ রানের সুবাদে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন।
টেন্ডুলকার তার টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতক হাঁকিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনিতে এবং পার্থে। চতুর্থ শতক হাঁকান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানসবার্গে। উপমহাদেশের বাইরে পেস সহায়ক উইকেটে নামকরা অনেক এশীয় ব্যাটসম্যান রান করতে সংগ্রাম করেন। সেখানে শচীন টেন্ডুলকার তার বয়স বিশ ছোঁয়ার আগেই ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে শতক হাঁকিয়েছিলেন।
ডন ব্রডম্যান ও শচীন টেন্ডুলকার- এই দুই কিংবদন্তী ক্রিকেটারের মধ্যে কাকতালীয় একটা মিল আছে। ডন ব্রাডম্যান যেই তারিখে নিজের শেষ ইনিংসে ব্যাট করেছেন, শচীন টেন্ডুলকার একই তারিখে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম শতক হাঁকিয়েছিলেন। ১৪ই আগস্ট। একজনের বিদায়, আরেকজনের যাত্রা শুরু। দুজনেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে অতুলনীয়।
ফিচার ইমেজ- Getty Images