নামে-ভারে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সন্দেহাতীত। কিন্তু সমস্যাটা বাধে দ্বিতীয় সেরা কে, তা নির্ধারণ করতে গিয়ে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (সিপিএল) প্রতিটি টুর্নামেন্টের আয়োজকরাই নিজ নিজ টুর্নামেন্টকে এগিয়ে রাখতে চান। ফলে এই বিষয়টি এতদিন অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছিল।
তবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই সাথে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিপিএল ও বিবিএল। বলাই বাহুল্য, ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ তাদের পছন্দের টুর্নামেন্টটিকে বেছে নেয়ার। এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে দ্বিমুখী লড়াইয়ে বিবিএলের চেয়ে বেশ অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে বিপিএল, এবং তা স্বীকার করে নিচ্ছে স্বয়ং অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যমই!
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের কারণে বিপিএলের ষষ্ঠ আসর গত বছরের অক্টোবর থেকে পিছিয়ে নিয়ে আসা হয় ২০১৯ এর জানুয়ারিতে। ৫ জানুয়ারি থেকে মাঠে গড়াতে চলেছে বিপিএল। এতে করে বেশ ধন্দেই পড়ে গিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি যুগে ক্রিকেটের ফেরিওয়ালারা। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, কোন টুর্নামেন্টের অংশীদার হবেন। তবে শেষ পর্যন্ত সিংহভাগ তারকা ক্রিকেটারের প্রথম পছন্দে পরিণত হয়েছে বিপিএলই। ফলে বিপিএল-বিবিএলের মধ্যকার ইঁদুরদৌড়ে এ যাত্রা জয় হয়েছে বিপিএলের।
আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু স্মিথ-ওয়ার্নার
এবারের বিপিএলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অবশ্যই দুই অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার স্টিভেন স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার। গত বছর বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে ১২ মাসের জন্য আন্তর্জাতিক ও অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলো (শেফিল্ড শিল্ড ও বিবিএল) থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন তারা। ফলে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে চলতি ভারত সিরিজে তো তারা খেলতে পারছেনই না, এমনকি খেলতে পারছেন না বিবিএলেও। তাই তারা শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত থাকার লক্ষ্যে বেছে নিয়েছেন বিপিএলকে।
অবশ্য স্মিথের বিপিএলে অংশগ্রহণ নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। অনেক নাটকীয়তা শেষে নিশ্চিত হয়েছে তার বিপিএলে খেলার বিষয়টি। ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ঘোষণা দেয় তারা শ্রীলংকান ক্রিকেটার আসেলা গুনারত্নের বদলী হিসেবে দলে নিয়েছে স্মিথকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেঁকে বসে বিপিএলের অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। তাদের বক্তব্য ছিল, যেহেতু স্মিথের নাম প্লেয়ার্স ড্রাফটের তালিকায় ছিল না, তাই কোনো ফ্রাঞ্চাইজি তাকে দলে ভেড়াতে পারবে না। এ কারণে স্মিথের বিপিএলে খেলার পথ একপ্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর বিপিএলের টেকনিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস জানান, বিপিএলে খেলতে কোনো বাধা নেই স্মিথের। যেই ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো আপত্তি জানিয়েছিল, বিপিএলের ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ তারা স্মিথের অংশগ্রহণ মেনে নিয়েছে। তবে তাদের একটি শর্ত ছিল যা বিপিএল কর্তৃপক্ষকে মানতে হয়েছে: প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই বদলী হিসেবে ড্রাফট তালিকার বাইরে থেকে একজন খেলোয়াড়কে দলে নিতে পারবে।
বিপিএল হতে যাচ্ছে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা চলাকালে স্মিথের খেলা তৃতীয় কোনো বৈদেশিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। এর আগে কানাডার গ্লোবাল টি-২০ এবং সিপিএলে খেলেছেন তিনি। ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিতব্য পিএসএলেও দেখা যাবে তাকে।
এদিকে অস্ট্রেলিয়া দলে স্মিথের ডেপুটির দায়িত্ব পালন করা ওয়ার্নারও খেলছেন এবারের বিপিএলে। সিলেট সিক্সার্সের হয়ে মাঠ মাতাতে দেখা যাবে তাকে। এমনকি দলটির অধিনায়কত্বের দায়িত্বেও তিনিই। স্মিথের মত নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ওয়ার্নারেরও এটি তৃতীয় বৈদেশিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। এর আগে তিনিও খেলেছেন কানাডার গ্লোবাল টি-২০ ও সিপিএলে। এছাড়া এ বছরের আইপিএলেও খেলবেন তিনি।
স্বভাবতই স্মিথ ও ওয়ার্নারের অংশগ্রহণে অন্য যেকোনো আসরের চেয়ে এবারের বিপিএলে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে বেশি। এবারই প্রথম বিপিএলে দেখা যাবে তাদের। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার কোনো শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার বিপিএলে খেলেননি। কিন্তু এবার স্মিথ ও ওয়ার্নারের মত বর্তমান সময়ে অস্ট্রেলিয়ার সেরা দুই খেলোয়াড় বিপিএলে থাকায়, স্থানীয় দর্শকরাও তুলনামূলক বেশি হারে মাঠে উপস্থিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তাছাড়া নিজেদের জাতীয় দলের নির্বাসিত দুই খেলোয়াড় কেমন ফর্মে আছেন তা জানার জন্য অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটপ্রেমীরাও নিশ্চয়ই বিপিএলে চোখ রাখবে।
রয়েছেন ডি ভিলিয়ার্স, গেইলরাও
স্মিথ ও ওয়ার্নার ছাড়া এবারের বিপিএলের আরেক বড় আকর্ষণ হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্স। তার ঠিকানা রংপুর রাইডার্স। বাংলাদেশী ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় তিনি। কিন্তু এর আগে কখনও বিপিএলে দেখা যায়নি তাকে। তাছাড়া গত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার ফলে, দর্শকরা তার খেলা খুব কমই দেখতে পায়। সুতরাং বিপিএলের মত একটি আসরে তিনি খেললে, সার্বিকভাবেই যে এই টুর্নামেন্টের অনুসারী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিপিএলে খেলবেন টি-টোয়েন্টি দুনিয়ার আরও বেশ কয়েকজন রথী-মহারথী। প্রথমেই বলতে হয় ক্রিস গেইলের কথা। বিপিএলে তিনি নতুন মুখ নন। তবে তিনি ইতিপূর্বে বিবিএলেও নিয়মিত খেলতেন। কিন্তু এবার বিপিএলের জন্য বিবিএলে খেলবেন না তিনি।
বিবিএলের থেকে বিপিএলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন ইংল্যান্ডের অ্যালেক্স হেলস, পাকিস্তানের ইয়াসির শাহ, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির, এবং ক্যারিবিয়ান তারকা কিয়েরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল, কার্লোস ব্রেথওয়েটরাও। তাছাড়া বিপিএলে খেলার উদ্দেশে বিবিএল থেকে মাঝপথে চলে আসবেন নেপাল ও মেলবোর্ন স্টার্সের স্পিনার সন্দ্বীপ লামিচ্চানেও।
তবে বিবিএলও কিন্তু একেবারে তারকাশূন্য নয়। এই মুহূর্তে বিবিএলে অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্সের হয়ে খেলছেন খেলছেন রশিদ খান, মেলবোর্ন রেনেগেডসে মোহাম্মদ নবী, এবং সিডনি থান্ডারে ইংল্যান্ড অধিনায়ক জো রুট ও জস বাটলার। বিবিএলের আছে কয়েকজন স্থানীয় স্বনামধন্য মুখও, যাদের মধ্যে বিগ হিটার ডার্সি শর্ট ও ক্রিস লিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু তারপরও, সার্বিকভাবে তারকার মেলায় বিবিএলের চেয়ে বিপিএলই যে এগিয়ে, সে কথা অনস্বীকার্য। এর প্রভাব পড়েছে চলতি বিবিএলের জনপ্রিয়তায়ও। প্রতি ম্যাচে গড়ে ২১,৫৯১ জন দর্শক মাঠে উপস্থিত হচ্ছে, যা গত বছর এই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩,২০০ জন কম। তবে ফ্রি-টু-এয়ার ও পে-টিভি দুই মাধ্যমেই খেলাগুলো সম্প্রচারিত হওয়ায়, টিভি রেটিং গত গ্রীষ্মের চেয়ে বেড়েছে ৫%। অপরদিকে বিপিএলের আয়োজকরা আশা করছেন গত কয়েকটি আসরের চেয়ে এবারের আসরে মাঠে উপস্থিত ও টিভির সামনে চোখ রাখা, উভয়ক্ষেত্রেই দর্শকসংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।
বিপিএলের এগিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
তাহলে বিবিএলের চেয়ে বিপিএল যে মাঠে গড়ানোর আগেই এগিয়ে গেছে, তা তো প্রমাণিত হলোই। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো এটি?
- বিবিএলের পিছিয়ে পড়া ও বিপিএলের এগিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো দুই টুর্নামেন্টের দৈর্ঘ্যের মধ্যকার বিস্তর ব্যবধান। ১৯ ডিসেম্বর শুরু হওয়া বিবিএলের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে ১৭ ফেব্রুয়ারি। অথচ ৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে বিপিএল শেষ হয়ে যাবে ৮ ফেব্রুয়ারিই। আর এটি তো কারোই অজানা নয় যে দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো টুর্নামেন্টের আকার ছোট রাখা। একটি টুর্নামেন্টের শুরু ও শেষের তারিখের মধ্যকার ব্যবধান যত বেশি হবে, সেই টুর্নামেন্টের প্রতি অধিকাংশ দর্শকেরই আগ্রহ তত কমবে। তাই শুরুতেই গঠনগত দিক থেকে বিবিএলকে হারিয়ে দিয়েছে বিপিএল।
- টুর্নামেন্ট দীর্ঘস্থায়ী হলে তারকা ক্রিকেটাররাও আগ্রহ হারায়। কেননা একটি এক মাসের টুর্নামেন্ট খেলে তারা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করবেন, দুই মাসের টুর্নামেন্ট খেলে তার চেয়ে খুব বেশি অর্থ তো তারা উপার্জন করবেন না। তাহলে কেন তারা খামোকা দুই মাসের জন্য একটি টুর্নামেন্টে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন, যেখানে মাত্র এক মাসের মত খেলেই তুলনামূলক অনেক বেশি অর্থ পকেটে পোরা যায়?
- বিবিএল সূচির সাথে বড়দিন উৎসব সাংঘর্ষিক হয়ে যাওয়াও একটি বড় কারণ। বড়দিন উৎসবের সময়ে সকলেই চান নিজেদের পরিবারের সাথে কাটাতে। কিন্তু বিবিএলে খেলতে গেলে অনেক বিদেশী তারকা ক্রিকেটারের পক্ষেই বড়দিন উৎসব ও নববর্ষ নিজ দেশে, নিজ আপনজনদের সাথে কাটানো সম্ভব হতো না। অথচ বিপিএলের সূচি সেক্ষেত্রে অনেক সহায়ক। অনেক তারকা বিদেশী খেলোয়াড়ই বড়দিন উৎসব ও নববর্ষ নিজ দেশে উদযাপন করে তবেই ঢাকায় পা রেখেছেন।
- আর বিবিএলের তুলনায় বিপিএলের এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্যই বিদেশী ক্রিকেটারদের বেশি সুযোগ দেয়া। বিবিএলে যেখানে একটি দল তাদের স্কোয়াডে মাত্র দুইজন বিদেশী খেলোয়াড়কে রাখতে পারে, সেখানে বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো সর্বোচ্চ নয়জন বিদেশী খেলোয়াড়কে দলে নিতে পারে, এবং প্রতি ম্যাচের চূড়ান্ত স্কোয়াডে চারজন বিদেশী রাখা বাধ্যতামূলক। সঙ্গত কারণেই তাই বিপিএলে বিদেশী তারকা ক্রিকেটারদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি বিষয়েও আলোকপাত না করলেই নয়। তা হলো, বিবিএলের এই নিয়মের ফলে বিদেশী ক্রিকেটাররা তেমন সুযোগ না পেলেও, অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় ক্রিকেটাররা কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি লাভ করেন। অথচ বিপিএলের ফলে বাংলাদেশী স্থানীয় ক্রিকেটাররা সেই সুযোগ তুলনামূলক কম পান। তাই বেশি বিদেশী খেলোয়াড় খেলানোর ফলে বিপিএল আর্থিকভাবে লাভবান হলেও, দিনশেষে নিজেদের ক্রিকেট কাঠামো উন্নয়নে বিবিএলের নীতিটিই কার্যকরী বেশি। এই ব্যাপারে বিপিএলের আয়োজকদের একটু দৃষ্টিপাত করা জরুরি।
শেষ কথা
মাঠে গড়ানোর আগেই বিবিএলকে হারিয়ে দিচ্ছে বিপিএল, এবং সেই হার অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যম স্বীকারও করে নিচ্ছে, এটি অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ। কিন্তু এখন আমাদের চাওয়া হবে, মাঠের ক্রিকেটেও যেন বিপিএল পেছনে ফেলতে পারে বিবিএলকে। সর্বোপরি এবারের বিপিএল যেন দেশী তরুণ ক্রিকেটারদের মানোন্নয়নের সহায়ক হয়। তা না হলে, জনপ্রিয়তা কিংবা অর্থের ঝনঝনানিতে বিপিএল যতই জয়লাভ করুক না কেন, তাতে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের খুব একটা লাভ হবে না।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/