ফুটবল জগতে মোটামুটি বিচরণ আছে এমন কে আছেন যিনি ফ্রান্সেসকো টট্টিকে না চেনেন? ইতালির সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন, এমনকি ফুটবল ইতিহাসেও তিনি অনন্য। বাল্যকালের ক্লাব রোমার প্রতি ভালবাসার কারণে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও ২৫টি বছর একই ক্লাবে খেলে অবসরে গেছেন। ২০০৬-এর বিশ্বকাপজয়ী এই তারকাকে পাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল সব বড় ক্লাব। কিন্তু তিনি রোমা ছাড়বেন না। ফুটবল মানেই তার কাছে রোমা। খুব সহজেই বড় কোনো ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারতেন। ছেড়ে যাননি। বুটজোড়া তুলে রাখার পরেও রোমার সাথে সংশ্রব ত্যাগ করেননি, থেকে গেছেন রোমার টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে।
এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের মৌসুম শুরুর আগে সাবেক এই ইতালিয়ান তারকা ফরোয়ার্ড ফ্রান্সেসকো টট্টি ক্লাবের নিজস্ব চ্যানেলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। রোমার প্রথম ম্যাচ রিয়াল মাদ্রিদের সাথে হওয়ায় স্বভাবতই উঠে আসে খেলোয়াড়ি জীবনে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে তাঁর বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কাহিনীর কথা। চলুন আজ দেখে নেয়া যাক সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ।
গতবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগটা তো রোমার জন্য স্বপ্নের মতো ছিল। আবারো কি সেই সাফল্যের পুনরাবৃত্তির স্বপ্ন দেখছেন?
হ্যাঁ, তা তো বটেই। রোমার লক্ষ্যই থাকবে গতবার যেখানে গিয়েছিলাম এবারও অন্তত তা করা বা আরো ভালো করা। ক্লাবের সবাই এটা চাচ্ছেন, বিশেষ করে সমর্থকেরা। অনেক দিন পরে আমরা গতবার ভালো কিছু করেছিলাম। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো এমন প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে এটা আবার করা এতটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।
প্রথম ম্যাচ তো রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। সত্যি কথা বলতে কেমন আশা করছেন?
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মৌসুমের শুরুতেই যদি আপনাকে বার্নাব্যুতে যেতে হয়, তা তো অবশ্যই একটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কেননা বার্নাব্যু অন্য পাঁচটা স্টেডিয়ামের চেয়ে অনেক দিক দিয়েই আলাদা আর আমরা মুখোমুখি হতে যাচ্ছি টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়নদের।
খেলোয়াড় হিসেবে আপনি বার্নাব্যুতে অনেকবার খেলেছেন। কেমন অনুভূতি হতো? উদ্দীপনা, নাকি ভয়?
দেখুন, বার্নাব্যু আপনাকে ভীতও করতে পারে, আবার জাগিয়েও দিতে পারে। এমন পরিবেশে আপনি মৌসুমে অহরহ খেলার সুযোগ পাবেন না, হয়তো ক্যারিয়ারে গুটিকয়েকবার। তাই আমি তেঁতে থাকতাম নিজের জাত চেনানোর জন্যে।
বার্নাব্যুর সাথে আপনার বিশেষ সম্পর্ক ছিল খেলোয়াড় হিসেবে। আপনার খেলোয়াড়ি জীবনের অনেক বলার মতো ঘটনাও আছে সেই মাঠে। ২০০২ সালের কথা মনে আছে?
হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। আমার ক্যারিয়ারের বলার মতো একটা দিন ছিল। অসম্ভব শক্তিশালী এক রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ১-০ গোলের জয় পেয়েছিলাম। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, জয়সূচক গোলটি আমারই করা ছিল। এর আগে দীর্ঘদিন কোনো ইতালিয়ান দল রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে জিতে আসতে পারেনি। আমাদের রোমা পেরেছিল। ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে ওদের মাঠে ভাল-মন্দ মিলিয়ে অনেক মুহূর্ত ছিল। আমি বলবো ভালোটাই বেশি ছিল। আর ঐ ম্যাচটাও ‘স্পেশাল’ ছিল আমার জন্য।
আর ২০১৬ সালে তো বার্নাব্যুতে আপনি বিপক্ষের খেলোয়াড় হয়েও দর্শক অভিবাদন পেলেন। সেটা নিয়ে কি বলবেন?
ম্যাচ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমাকে মাঠে নামানো হয়। মাইকে আমার নাম ঘোষণা করার সাথে সাথেই পুরো স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে অভিবাদন জানায়। এই ঘটনাটা আমার গোটা ক্যারিয়ারের সারাংশ যেন কিছুক্ষণেই দিয়ে দিল। মনে হচ্ছিলো, আমি আসলেই সফল কেউ একজন। মাদ্রিদ সমর্থকরা বহু তারকা খেলোয়াড় তাদের স্বচক্ষে দেখেছে, তাদের নিজেদের হয়ে খেলতে দেখেছে। তবুও আমাকে যেভাবে অভিবাদন জানিয়েছিল আমি তা সারাজীবন মনে রাখব। শুধু তা-ই নয়, আমি যতবার খেলেছি বার্নাব্যু সমর্থকরা আমাকে সাদরে মূল্যায়ন করেছে। আমি সেজন্য তাদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।
শোনা যায়, রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আপনাকে দলে টানতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন?
হ্যাঁ, সত্য। আমার তখন রোমায় ক্যারিয়ারের দারুণ সময়টা চলছে। পেরেজ এহেন কিছু বাদ রাখেননি আমাকে দলে ভেড়াতে। এমনকি রিয়ালের ১০ নাম্বার জার্সিতে আমার নাম লিখে আমার কাছে পাঠালেন। কোনো না কোনো এজেন্ট মারফত আমাকে দলে পেতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে আমি দোটানায়ই পড়ে যাই কী করবো তা নিয়ে। বেশ কিছুদিন দোলাচলে ছিলাম। কীভাবে রিয়াল মাদ্রিদের মতো বিশ্বসেরা ক্লাবকে না করবো? শেষ অবধি এই শহর, রোমা ক্লাবের প্রতি আমার ভালবাসাই জয়ী হলো। আমি থেকে গেলাম।
পেরেজের সাথে আপনার সুসম্পর্কের কথা শোনা যায়। তিনি কি এ নিয়ে কিছু বলেন যখন সাক্ষাৎ হয়?
এমন কোনোবার বাদ যায় না যখন আমার সাথে সাক্ষাতে তিনি এই প্রসঙ্গ না তোলেন। এখনো এ নিয়ে তাঁর মধ্যে আফসোস রয়ে গেছে। এই তো কিছুদিন আগেও মোনাকোতে উয়েফা বর্ষসেরা অনুষ্ঠানে দেখা হলো। সবার সামনেই বললেন, “ফ্রান্সেসকো, আপনিই একমাত্র খেলোয়াড় যার পেছনে এত চেষ্টার পরেও আমাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল!” এমনকি এর আগে একবার দেখার সময় একটি রিয়ালের জার্সি দিয়ে বলেন, “এখানে আপনার অটোগ্রাফ দিন আর নিচে লিখে দিন যে, ‘আমিই এমন একজন যে সরাসরি ফ্লোরেন্তিনোকে ‘না’ বলেছিলাম’! আমি এটি নিজের কাছে রাখবো!” হ্যাঁ, আসলেই তার সাথে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে।
আপনাকে ব্যালন ডি’অর দিতে বললে আপনি কাকে দিতেন?
আমি মদ্রিচকেই দিতাম। ক্রোয়েশিয়ার মতো দলকে নিয়ে এতদূর যাওয়া দারুণ ব্যাপার। আর সে তো চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতেছে। সে এটার যোগ্য। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়।
আপনার খেলোয়াড়ি জীবনের কোনো বিশেষ হতাশা আছে?
আমি এটা অনেকবার বলেছি। অনেকে ভাবতে পারে রোমায় থাকার কারণে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না জেতাটা আমার সবচেয়ে বড় হতাশা। কিন্তু সত্যি বলতে আমার একমাত্র বড় হতাশা হলো, রোনালদোর সাথে খেলতে না পারা। হ্যাঁ, সেই ব্রাজিলিয়ান রোনালদো নাজারিওর সাথে। সেটা আমাদের দুজনের জন্যই স্বপ্নের জুটি হতো। ইন্টারে থাকতে ওর খেলা দেখে ভাবতাম, স্ট্রাইকার হিসেবে ও আর প্লেমেকার হিসেবে আমি! রোনালদোর গোলসংখ্যা আরো বেড়ে যেত! আমি বলছি না ওর গোল কম। ও ভুরিভুরি গোল করেছে ওর সেরা সময়ে, কিন্তু আমার শুধু মনে হয় আমি থাকলে ওর গোলসংখ্যা আরো বাড়তো!
সত্যিই সেটা হলে ফুটবল ইতিহাসে বাঁধিয়ে রাখার মতো একটা জুটি হতো। তাই নয় কি পাঠক?
ফিচার ইমেজ: Pinterest