পাকিস্তানের ক্রিকেটের নতুন সেনসেশন ফখর জামান। সম্প্রতি তিনি বিশ্বের দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক হাজার ওয়ানডে রান করেছেন। পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন।
ফখর জামান এখনও অপেক্ষায় আছেন টেস্ট অভিষেকের। সেই টেস্ট ক্রিকেট, নিজের ওয়ানডে কীর্তি ও পাকিস্তানের ২০১৯ বিশ্বকাপের সম্ভাবনা নিয়ে স্কাই স্পোর্টসের সাথে কথা বলেছেন ফখর।
‘পিসিবি আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স-২০১৮’ জিতেছেন আপনি। আপনার কাছে এই পুরষ্কার কী অর্থ বহন করে?
আমি সত্যিই রোমাঞ্চিত এবং আমাকে এই সম্মানের যোগ্য মনে করায় পিসিবিকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমাকে এই পুরষ্কারটা দেওয়া হয়েছে আমি ওয়ানডে ইতিহাসে দ্রুততম এক হাজার রান করার পর এবং ওয়ানডেতে পাকিস্তানের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করার পর। আমি এই মাইলফলকগুলোতে পৌঁছাতে পেরে খুবই খুশি। সেই সাথে আমি দ্রুততম এক হাজার রান করতে পেরে খুব সম্মানিত বোধ করেছি। কারণ, এই রেকর্ডটা আগে যৌথভাবে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের দখলে ছিলো।
সামনের দিকে তাকালে আপনার স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে লক্ষ্যটা কী?
সত্যি কথা বলতে, একজন পাঠান হিসেবে আমি জীবনে খুব বেশি সামনে তাকিয়ে লক্ষ্য ঠিক করি না। এই মুহুর্তে আমি সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া কাপে ভালো করার ব্যাপারে মনোসংযোগ করছি। অবশ্যই ২০১৯ বিশ্বকাপ একটা গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট। কিন্তু এর আগে আমার অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সিরিজ আছে, যা নিয়ে আমার ভাবতে হবে। ফলে এখনই বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবাটাও দ্রুত হয়ে যায়।
আপনি সমারসেটের হয়ে ইংল্যান্ডে একটা মৌসুম মিস করলেন। ভবিষ্যতে কি কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে চান?
আমি ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষে আগামী বছর ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। আমার প্রতিনিধি এরই মধ্যে কয়েকটা কাউন্টির সাথে আলাপ করছে। আশা করি, আগামী বছর আমি ইংল্যান্ডে খেলার একটা সুযোগ পাবো। আমার মনে হয় যেসব খেলোয়াড় তার খেলাটা উন্নত করতে চায় এবং ক্রিকেটের মান বাড়াতে চায়, তাদের জন্য কাউন্টি খেলাটা খুবই জরুরি। ওখানে যে মানের ক্রিকেট হয়, সেই সাথে যে মানের উইকেট হয় এবং যে মানের সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়; তা বিশ্বমানের। কাউন্টি ক্রিকেটের আরেকটা আকর্ষনীয় দিক হলো এখানে খেলোয়াড়রা একসাথে তিনটে ফরম্যাটেই খেলতে পারে। ফলে আমি কাউন্টিকে খেলার জন্য মুখিয়ে আছি। আমি সেইরকম কোনো দলকে বেছে নিতে চাই যারা আমাকে চার দিনের ফরম্যাটেও খেলার সুযোগ দেবে। আমি বুঝি, আমাকে সামনের দিনগুলোতে সিপিএলের মতো টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতেও প্রস্তাব দেওয়া হবে। কিন্তু আমার অগ্রাধিকার থাকবে কাউন্টি ক্রিকেটেই। কারণ, সেটা আমার খেলার উন্নতি করবে, যাতে আমি পাকিস্তানের হয়ে দীর্ঘ মেয়াদে খেলতে পারি।
আপনি কী বিশ্বাস করতেন যে, আপনি ওয়ানডেতে ২০০ রানের ইনিংস খেলে ফেলতে পারবেন?
সত্যি কথা বললে, আমি কখনো ভাবিনি, আমি এই ধরনের একটা মাইলফলক স্পর্শ করবো। হ্যাঁ, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় কখনো কখনো ভেবেছি, ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারবো। কারণ, জানতাম যে, ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব বেশি খেলোয়াড় ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারে না। আমি একবার ৫০ ওভারের একটা ঘরোয়া ম্যাচে ২০০ রানের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচে এটা করার কথা কখনো আমার মনে আসেনি। আমার অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ ও প্রধান কোচ মিকি আর্থার অবশ্য আমাকে বলতেন যে, আমার ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করার যোগ্যতা আছে। তবে আমার ধারণা, ওনারা তেমন কিছু বিচার না করেই আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য এটা বলতেন।
ওই ম্যাচের ঠিক কোন সময়ে আপনি বিশ্বাস করলেন যে, ২০০ করা সম্ভব?
আমি যখন ১০০ করে ফেললাম, তখন আমি নিজেকে বললাম, এখন আমার জোরে মারা দরকার এবং যত বেশি সম্ভব রান করা দরকার। আমার মনে হয়, আমি একটু ভাগ্যবান। কারণ ওই সময় থেকে আমার বেশ কিছু শট ফিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে বাউন্ডারিতে চলে গেছে। আমি যখন ১৭০ রানের ওখানে, তখন সরফরাজ আহমেদ ও মিকি আর্থার বার্তা পাঠালেন যে, খুব বেশি ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই। কারণ অনেক ওভার বাকি আছে এবং আমার ২০০ করার সম্ভাবনা আছে। তখন থেকেই ওই ২০০ সংখ্যাটা প্রথম মাথায় ঢুকলো।
এরপর নিশ্চয়ই আপনার টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করার একটা লক্ষ্য তৈরি হবে?
হ্যাঁ। একেবারেই সেরকম। আমি এরই মধ্যে একটা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করেছি। আমি এখন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও সেঞ্চুরি করতে চাই। আশা করি, খুব দ্রুত এই লক্ষ্যটা পূরণ হবে।
আপনি কী মনে করেন, আপনার টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য যথেষ্ট ধৈর্য্য ও টেকনিক আছে?
যদিও সম্প্রতি শেষ হওয়া আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফরে আমার টেস্ট অভিষেক হয়নি, কিন্তু এই দুটি সফর থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমি আমার ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে অনেক পরিশ্রম করছি। যেটা আমি মনে করি, টেস্টে আমাকে উপকৃত করবে। আমি জানি না, ভবিষ্যতে টেস্টে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। তবে আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, আমি নিজেকে তৈরি রাখছি এবং আমাকে যদি টেস্টে সুযোগ দেওয়া হয় আমি ভালো করতে প্রস্তুত।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আরব আমিরাতে সামনের সিরিজগুলোতেই কি আপনি অভিষেকের আশা করছেন?
আমাকে আমার প্রথম টেস্ট খেলার সুযোগ দেওয়াটা আমার জন্য অনেক সম্মানের হবে। কোন দলের বিপক্ষে খেললাম, সেটা ব্যাপার নয়। ঘটনা হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে সেই ফরম্যাট যেখানে খেলোয়াড়ের স্কিলের চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়। আর এই ফরম্যাটে খেলাটা আমার স্বপ্ন। যখন এই সুযোগটা আসবে, আমি আমার সেরা যা করতে পারি, সেটাই করার চেষ্টা করবো।
আপনাদের ব্যাটিং কোচ গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারকে নিয়ে আপনার ধারণা কী? আর তিনি আপনার সাথে কতটা কাজ করেন?
আমি এই অবধি যত কোচের সংস্পর্শে এসেছি, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার তার মধ্যে সবচেয়ে পরিশ্রমী কোচ। কোনো খেলোয়াড় যত খারাপই করুক না কেন, তিনি (ফ্লাওয়ার) কখনো তার ব্যাপারে হাল ছাড়েন না। আরেকটা ব্যাপার হলো, তিনি কারো টেকনিক উন্নত করার ব্যাপারে জোরাজুরি করেন না। বরং সে খেলোয়াড়দের তার নিজস্ব সহজাত খেলার ওপর জোর দিতে বলেন। তিনি কখনোই কাউকে কারো টেকনিক পরিবর্তন করতে বলেন না। আমার ক্ষেত্রে তিনি আমাকে শট বাছাইয়ের অনেক ক্ষেত্র ঠিক করে দিয়েছেন, যেগুলো অবশ্যই উপকারী ছিলো।
আপনি কি মনে করেন, মিকি আর্থারের ফিল্ডিং ও ফিটনেসে জোর দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে পরিবর্তন এসেছে?
পাকিস্তানের মতো একটা দলের জন্য সবসময়ই এরকম একজন প্রধান কোচের দরকার, যিনি নতুন উচ্চতায় ওঠার জন্য তাড়া দেবেন। কারণ, আমাদের ওপর আলস্য ভর করার সমস্যা আছে এবং আমরা অনেক সময় ফিল্ডিং ও ফিটনেসের মতো জরুরি বিষয় নিয়ে কাজ করতে ভুলে যাই। মিকি আর্থারের বড় একটা ব্যাপার হলো, তিনি সবসময় আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে চাপ দেন।
ইনাম-উল-হকের মতো একজনকে আপনার ওপেনিংয়ের সঙ্গী হিসেবে পেয়ে কেমন লাগছে?
ইনাম-উল-হক অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। যদিও পাকিস্তান দলে সে আমার নতুন ওপেনিং সঙ্গী, কিন্তু আমি ওর সাথে আগেই ওপেন করেছি। কারণ, আমরা একসাথে হাবিব ব্যাংকের হয়ে ওপেন করি। আমার ইনামের সাথে খুব ভালো একটা বোঝাপড়া আছে। ওর সাথে ব্যাটিংটা খুব উপভোগ করি। সে খুব পরিশ্রমী একজন খেলোয়াড়। আর আমরা উইকেটে থাকা অবস্থায় বা অনুশীলনে ওকে কোনো পরামর্শ দিলে সেটা গ্রহণের জন্য ও খুব উন্মুক্ত থাকে।
পাকিস্তান ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছে। এটা নিশ্চয়ই আপনাদের ২০১৯ বিশ্বকাপের জন্য আত্মবিশ্বাসটা অনেক বাড়িয়ে দেবে?
এখনকার পাকিস্তান দলের সমন্বয়টা অসাধারণ। আর আমাদের সাম্প্রতিক ফলাফলগুলোই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমরা ইংল্যান্ডে সংখ্যা বাড়াতে যাবো না; যাবো শিরোপা জিততে। আমি মনে করে, আমাদের জন্য এই টুর্নামেন্টের ফেবারিট খেতাব পাওয়াটা সঠিক হবে।
আপনার মতে ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পথে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় হুমকি হবে কারা?
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে কোনো একটা দলকে হুমকি বলে মনে করা যায় না। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ জয়ের জন্য অনেক বেশি যোগ্য দল। আমি মনে করি, বিশ্বকাপে আমাদের খেলা প্রতিটা ম্যাচ ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে।
২০১৯ বিশ্বকাপ ১০ দলে সীমিত করায় এটা কি কঠিন হবে, নাকি সহজ?
যদিও আগামী বিশ্বকাপে দল কম থাকবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে প্রথম পর্বে সবগুলো দল সবার সাথে খেলবে। নয়টা করে ম্যাচ খেলতে হবে প্রত্যেক দলকে। এটা দলগুলোর জন্য নিজেকে সত্যিকারের যোগ্য প্রমাণের দারুন একটা সুযোগ।
ইংল্যান্ড ও ভারত সিরিজের কথা আলাপ করা যাক। বিরাট কোহলির ব্যাটিং কেমন দেখছেন?
কোনো সন্দেহ নেই যে, বিরাট কোহলি একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড়। একটা উদাহরণ হিসেবে তৈরি করছে সে তার কঠোর পরিশ্রম ও ব্যাটিংকে, যাতে বাকিরা অনুসরণ করতে পারে। আমি বিরাট কোহলির ব্যাটিং খুব উপভোগ করি। আমি মনে করি, আমি এই মাস্টার ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দেখে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।