দেখতে দেখতে আইপিএল চলে এসেছে তার ১৩তম আসরের অন্তিমলগ্নে। কোয়ালিফায়ার, এলিমিনেটর আর ফাইনাল ছাড়া বাকি ৫৬ ম্যাচ ইতঃমধ্যেই হয়েছে সম্পন্ন। রোর বাংলার হয়ে আমরা ফিরে তাকাতে চেয়েছি আইপিএলের দলগুলোর গ্রুপপর্বের যাত্রাতে। কেমন হলো এই আসর, কেন হলো চেন্নাই সুপার কিংসের আইপিএল কর্তৃত্বের অবসান, কিংবা মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের একাধিপত্যের রহস্য কোথায় লুকিয়ে, এত সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁড়ে আনবার চেষ্টা করা হয়েছে এবারের আয়োজনে।
চেন্নাই সুপার কিংস
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: সপ্তম
শেষ তিন ম্যাচে টানা তিন জয়ের দরুন আইপিএলের ১৩তম মৌসুমটা সাত নম্বরে থেকে শেষ করলেও এবারকার আইপিএলের লড়াই থেকে সবার আগে ছিটকে গিয়েছিল ধোনির চেন্নাই সুপার কিংসই। আগের দশ আসরের সাফল্যের মালা এবার ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে যেতেই দেখা দিয়েছে প্রশ্ন, চেন্নাই আসলে হারলো কোথায়?
সহজ কথায় বলতে গেলে, চেন্নাইর হার শুরু হয়েছিল মাঠে প্রথম বল গড়ানোর আগে থেকেই। স্কোয়াডের সাতজন সদস্য আইপিএল ছাড়া ২০২০ সালে কোনো ক্রিকেটই খেলেননি। দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় সুরেশ রায়না আর হরভজন সিং নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই। কোভিড-১৯ এর আঘাতে আমিরশাহীতে চেন্নাই অনুশীলনও শুরু করেছিল বাদবাকি দলগুলির চাইতে দেরিতে।
ক্রিকেট-ঘাটতির এই প্রভাব সিএসকের ওপর পড়েছে পুরোদমে। মহেন্দ্র সিং ধোনি প্রথমবারের মতোন পুরো একটা আইপিএল সিজন কাটিয়েছেন পঞ্চাশ ছাড়া। শেন ওয়াটসন, কেদার যাদবরাও ছিলেন নিজেদের ছায়া হয়ে। অভিজ্ঞতাকে বরাবরই প্রাধান্য দেয়া চেন্নাইর বিষফোঁড়া হয়ে বসেছিল সিনিয়ররাই, বারেবারে তারা ব্যর্থ হলেও একই পরিকল্পনায় আটকে ছিলেন স্টিভেন ফ্লেমিং আর ধোনি। চেন্নাইয়ের সাফল্যের বিরাট অংশজুড়ে থাকা স্পিনাররাও এবার পারেননি অবদান রাখতে। ৫৩ গড় আর ৮.৭৩ ইকোনমির রবীন্দ্র জাদেজা কাটিয়েছেন নিজের সবচেয়ে বাজে আইপিএল মৌসুম।
এত এত নেতিবাচকতার ভিড়েও অবশ্য আশার আলো খুঁজে নিতে পারে চেন্নাইর ম্যানেজমেন্ট, আশা দেখাচ্ছেন এবারে স্পার্ক না দেখানো নতুনেরাই। স্যাম কারেন কাটিয়েছেন স্বপ্নের এক আইপিএল মৌসুম, প্রথম সুযোগ নিজের করে নিতে না পারলেও দ্বিতীয় সুযোগে টানা তিন ইনিংসে পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন রুতুরাজ গায়কোয়াড়ও। ব্যাট হাতে রবীন্দ্র জাদেজাও সমর্থন জুগিয়েছেন দারুণ। ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’, মৌসুমশেষে বুঝতে পেরেছেন ধোনিও:
“It’s time to hand it over to the next generation.”
রাজস্থান রয়্যালস
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: অষ্টম
ঠিক কোথা থেকে শুরু করা যায়? পুরো আইপিএলে তারা ইনিংসের গোড়াপত্তন করিয়েছে পাঁচ ভিন্ন জুটিকে দিয়ে, তাদের অধিনায়ক রান খুঁজে ফিরেছেন এ মাঠ থেকে ও মাঠে, ম্যাচ উইনাররা এক-দুই ম্যাচ জিতিয়েই খালাস, স্পিনাররাও পারেননি যোগ্য সঙ্গ দিতে; আইপিএলের ১৩তম আসরে রাজস্থান রয়্যালসের সমস্যার তো অন্ত নেই।
শারজায় শুরুর দুই ম্যাচ অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভিন্ন কিছুরই। অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ রান পেয়েছিলেন, সঞ্জু স্যামসন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ধারাবাহিক হবার, চমক জাগিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটেছিল রাহুল তেওয়াটিয়ারও। শারজা থেকে অন্য ভেন্যুতে পা রাখতেই রাজস্থানের নিম্নগামিতার সূচনা। প্রথম দুই ম্যাচে পঞ্চাশ পেরোবার পর বাকি ১২ ম্যাচে স্মিথ পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন আর মাত্র একবার, মৌসুমের শুরু আর শেষে রান পেলেও মধ্যিখানে স্যামসন রান করছিলেন এক অঙ্কের ঘরে। বাবার অসুস্থতায় বেন স্টোকস যোগ দিয়েছিলেন প্রায় অর্ধমৌসুম পর, জস বাটলারও পারেননি প্রত্যাশার পুরো প্রতিদানটা দিতে। ব্যাটসম্যানদের এই ধারাবাহিকতার অভাব রাজস্থান রয়্যালসকে ভুগিয়েছে বেশ ভালোভাবেই।
দলের মূল স্পিনার শ্রেয়াস গোপাল বল হাতে হারিয়ে খুঁজছিলেন নিজেকে। মধ্য ওভারে রান আটকে রাখাটাই যেখানে স্পিনারদের দায়িত্ব, সেখানে উনি রান দিয়েছেন প্রতি ওভারে ৮.৫৪ করে। অন্য লেগ স্পিনার তেওয়াটিয়ার জন্যে এবারকার আইপিএল অবশ্য হাজির হয়েছিল সান্তাক্লজের বাক্স হাতে, একমাত্র ভারতীয় হিসেবে ২৫০ রান এবং ১০ উইকেটের ডাবলের কৃতিত্বটা এবারই গড়েছেন তিনি।
রয়্যালসের মৌসুমসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কারটি অবশ্য যাচ্ছে জোফরা আর্চারের ঘরে। মৌসুম শেষে ১৭৯ স্ট্রাইকরেটে ১১৩ রান কিংবা ১৪ ম্যাচে ৬.৫৫ ইকোনমি রেটে ২০ উইকেট তার দুর্দমনীয়তার সামান্য অংশই বলে। এবারের আসরের শুরুর ছয় ওভারে সবচেয়ে বেশি ১০ উইকেট নিয়েছেন, একই সময়ে ওভারপ্রতি সবচেয়ে কম ৪.৩৫ রেটে রান দিয়েছেন আর্চার।
তার সতীর্থ অন্য পেসাররা কেমন করেছেন, অনুগ্রহ করে তা জানতে চাইবেন না পাঠক। আর্চারের পাশে অন্তত একজনও যদি ন্যূনতম পারফর্মটুকু করতেন, তবে তো আর রাজস্থান রয়্যালসকে টুর্নামেন্টের শেষ দল হয়ে আসর শেষ করতে হয় না!
কলকাতা নাইট রাইডার্স
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: পঞ্চম
আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন, ইয়োন মরগানের মতোন বিধ্বংসী ক্রিকেটাররা খেলেন যে দলে, সে দল কি না বাদ পড়লো নেট রান রেটের খড়্গে পড়ে! তা-ও কি না টানা দ্বিতীয় মৌসুমের মতো!
কেকেআরের এমন দুর্দশার প্রধানতম কারণ, নারাইন-রাসেলদের কেউই ফর্মে ছিলেন না আইপিএলজুড়ে। বোলিংয়ে দলকে কিছুটা সমর্থন দিলেও ব্যাটিংয়ে রাসেল হতাশ করেছেন পুরোপুরি, ১৩ গড়ে রান করেছেন মাত্র ১১৭। ওপেনিংয়ে নামা নারাইনের কাছে প্রত্যাশা ছিল ঝড়ো সূচনা এনে দেবার, যা দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন পুরোপুরি। তার যে মূল দায়িত্ব, সেই বোলিংয়েও পারেননি প্রত্যাশার সিকিভাগ পূরণ করতে, ৬০.৪০ গড় আর ওভারপ্রতি প্রায় ৮ ছুঁইছুঁই রান খরচায় উইকেট নিয়েছেন মাত্র ৫টি। অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন দলের ভারসাম্যও।
কেকেআরের আরেক দুর্বলতা ধরা পড়েছিল শুভমান গিল আর দীনেশ কার্ত্তিকের ব্যাটে। একপ্রান্ত ধরে খেলার নামে গিল ব্যাট করেছেন মারাত্মক ধীরলয়ে, প্রতি ১০০ বল খেলে রান করেছেন মাত্র ১১৭ করে। আবুধাবির বাইরে দীনেশ কার্ত্তিকও হারিয়ে খুঁজেছেন নিজেকে।
এর মধ্যেও কেকেআর স্বপ্ন দেখতে পারে মরগান আর বরুণ চক্রবর্তীকে ঘিরে। মাঝপথে দীনেশ কার্ত্তিক নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়াতে দলের দায়িত্ব বর্তেছিল মরগানের কাঁধে। নেতৃত্বের সঙ্গে তার ব্যাটও ঝলসেছিল পুরোদমে, ১৪ ম্যাচে রান করেছেন ৪১৮, দলীয় সর্বোচ্চ ২৪টি ছয়ও এসেছে তার ব্যাটে। বাদবাকিদের ব্যর্থতার মিছিলে বেশ কয়েক ম্যাচে কেকেআর তার কল্যাণেই পেয়েছিল লড়াই করবার মতো পুঁজি। বোলিংয়ে কলকাতার ‘মরগান’ হয়েছিলেন বরুণ চক্রবর্তী। ১৭ উইকেট আর ৬.৮৪ ইকোনমিতে দারুণ এক আসর কাটানোর পুরষ্কার পেয়েছেন প্রথমবারের মতো ভারতীয় জাতীয় দলে।
অবশ্য বর্তমান যা পরিস্থিতি, তাতে কলকাতা নাইট রাইডার্স বরুণকে অভিনন্দন জানাবার মতো পরিস্থিতিতেই তো নেই।
কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: ষষ্ঠ
পথ হারাবার গল্পগুলো পাঞ্জাবের জন্যে পুরনো। ২০১৯ কিংবা ২০১৮ মৌসুমের কথা ধরুন! দু’বারেই মৌসুমের শুরুর অর্ধে রাজত্ব করে শেষ পাঁচ ম্যাচের একটিতেও জয় পায়নি দলটি, ফলতঃ জায়গা পায়নি প্লে-অফেও। এবার পথ হারিয়েছিল শুরুর অর্ধেই, শুরুর সাত ম্যাচে জয় পেয়েছিল মাত্র ১ ম্যাচ। সেখান থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়ে যে মৌসুমের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত লড়াইতে ছিল প্রীতি জিনতার দল, তা-ই তো বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সঙ্গে জন্ম দেয় পাঞ্জাবের ক্রিকেটারদের জন্যে আফসোসও, হাতের মুঠো থেকে ম্যাচের পর ম্যাচ ছিটকে না ফেললে নিশ্চয়ই আর এমন আক্ষেপের অনলে পুড়তে হতো না।
আক্ষেপ তো সঙ্গী ছিল মৌসুমের প্রথম ম্যাচ থেকেই। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে শেষ তিন বলে ৩ রান তুলতে ব্যর্থ হয়ে ম্যাচ হার সুপার ওভারে; পরের ম্যাচে তাদের বিপক্ষে ফিনিক্স পাখি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রাহুল তেওয়াটিয়া, কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে হার ৭ উইকেট হাতে রেখে ১৭ বলে ২১ রানের সমীকরণ মেলাতে ব্যর্থ হয়ে। পুরো ম্যাচ আয়ত্ত্বে রেখে শেষ তুলির আঁচড় দেবার অক্ষমতাই মৌসুম শেষে পাঞ্জাবকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ‘কী হলে কী হতো’ প্রশ্নের সামনে।
পাঞ্জাবকে ডুবিয়েছে নিলামের টেবিলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে কেনা তারকারাও। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, যাকে পাঞ্জাব কিনেছিল ১০.৭৫ কোটি রুপিতে, তিনি কি না ১৩তম মৌসুমে ১৩ ম্যাচ খেলে ১৫.৪২ গড়ে রান করেছেন ১০৮! মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বল খেলে ছয় না মারার অনাকাঙ্ক্ষিত কীর্তিটিও এবারই গড়েছেন তিনি। সাড়ে ৮ কোটি রুপি খরচায় কেনা শেলডন কটরেল ওভারপ্রতি রান বিলিয়েছেন প্রায় নয় করে। ডেথ বোলিংয়ের দায়িত্ব ছিল যার কাঁধে, সেই ক্রিস জর্ডান মৌসুমের শেষাংশে এসে ফিরে পেয়েছেন নিজেকে। তবে জট যা বাঁধানোর, তা বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন আগেই; তাই তো ইকোনমি রেটটা সিজন শেষে ৯.৬৫।
পাঞ্জাবের থিংক ট্যাংককে তাই আইপিএলের ১৪তম আসরকে ঘিরে পরিকল্পনা সাজাতে হবে এই ছিদ্রগুলো মেরামত করার লক্ষ্য নিয়ে। লোকেশ রাহুলের টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৬৭০ রান, তার উদ্বোধনী জুটির অংশীদার মায়াঙ্ক আগারওয়ালের ৩৮.৫৪ গড়ে ৪২৪ রান, দুই ক্যারিবিয়ান নিকোলাস পুরান-ক্রিস গেইলের ঝড়, বোলিংয়ে মোহাম্মদ শামির ২০ উইকেট সঙ্গে তরুণ তুর্কি রবি বিষ্ণইয়ের ৭.৩৭ ইকোনমিতে ১২ উইকেট — মৌসুমে পাঞ্জাব আশাজাগানিয়া অনেক কিছু তো পেয়েছেই।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: তৃতীয়
মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই দলটি হারিয়েছে প্রথম পছন্দের অলরাউন্ডার মিচেল মার্শকে, কয়েক ম্যাচ পরে বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব দেয়া পেসার ভুবনেশ্বর কুমারকে। অনভিজ্ঞ মিডল-অর্ডারকে পথ দেখাবেন যিনি, সেই কেন উইলিয়ামসনও চোট নিয়ে দলের বাইরে থেকেছিলেন কিছু ম্যাচ, টুর্নামেন্টের শেষার্ধে এসে দলটি হারিয়ে ফেলেছে বিজয় শঙ্করকেও। এত সমস্ত হারের মাঝেও সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ঠিকই প্লে-অফের টিকিট পেয়েছে।
অথচ টুর্নামেন্টের এগারো ম্যাচ শেষে ৮ পয়েন্ট নিয়ে হায়দরাবাদের ফ্র্যাঞ্চাইজিটি প্লে-অফের রেস থেকে ছিটকে যাবার জন্যে ছিল এক হার দূরত্বে। সেখান থেকে টানা তিন জয় নিয়ে তারা প্রবেশ করেছে এলিমিনেটরে। সেই তিন জয়ও এসেছে প্লে-অফের বাকি তিন দল দিল্লি ক্যাপিটালস, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু আর মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে; তাও কী দুর্দান্ত দাপটে! দিল্লির সঙ্গে তাদের জয় ৮৮ রানে, আরসিবিকে তারা হারিয়েছিল ৩৫ বল বাকি থাকতে, মুম্বাইকে তারা স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিল ১০ উইকেটের জয়ের ম্যাচে।
টুর্নামেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হায়দরাবাদের এই ঘুরে দাঁড়ানোর কৃতিত্বের খানিকটা পাবে কেন উইলিয়ামসনের ইনজুরি। রসিকতা মনে হলেও আদতে উইলিয়ামসনের চোটই তো জেসন হোল্ডারকে সুযোগ করে দেয় দলে তার গুরুত্ব বোঝাবার। রাজস্থান রয়্যালসের সঙ্গে ৩ উইকেট আর তার পরের ম্যাচে পাঞ্জাবের সঙ্গে ২৭ রানের বিনিময়ে ২ উইকেট তুলে হোল্ডার জানান, মিচেল মার্শের জায়গায় যে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হায়দরাবাদ ম্যানেজমেন্ট খুঁজছিল হন্যে হয়ে, তিনি ঠিক তা-ই। সেই থেকে এখন অব্দি মাত্র ৫ ম্যাচ খেলেই ১০ উইকেট তুলে নিয়েছেন এই ক্যারিবীয় দানব, সঙ্গে লেট মিডল অর্ডারে ক্যামিও খেলেও নজর কেড়েছেন বেশ।
জেসন হোল্ডার একাদশে এসে দলের ভারসাম্যেও এনেছেন ইতিবাচক পরিবর্তন। নটরজনের পাশে তিনি শেষের ওভারগুলোতে বল করার দায়িত্ব নিচ্ছেন বলে হায়দরাবাদ শুরুর ছয় ওভারের তিন ওভারই করাতে পারছে সন্দীপ শর্মাকে দিয়ে। সুইং বোলার সন্দীপ সেই সুযোগটা লুফে নিয়েছেন দুই হাতে, এখন অব্দি পাওয়ারপ্লেতে তিনি দখলে নিয়েছেন ২০.১১ গড়ে ৯ উইকেট, যার পাঁচটিই এসেছে গ্রুপপর্বের শেষ তিন ম্যাচে।
জেসন হোল্ডারকে সুযোগ করে দিতে গিয়ে হায়দরাবাদের কর্তাদের অবশ্য বাজি ধরতে হয়েছিল একটি। বিদেশি কোটার সামঞ্জস্য রাখতে জনি বেয়ারস্টোর জায়গায় তাদের সুযোগ দিতে হয়েছিল দেশি ঋদ্ধিমান সাহাকে। সৌভাগ্যই বলতে হবে, আগের তিন বছরে, এমনকি এ বছরেও সুযোগ পাওয়া একটি ম্যাচে যিনি ছিলেন চূড়ান্তমাত্রায় ব্যর্থ, সেই ঋদ্ধিই টানা তিন ম্যাচে করলেন ৮৭, ৩৯, আর অপরাজিত ৫৮!
ওয়ার্নারও টুর্নামেন্টের এ পর্যায়ে এসে খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে। শুরুর দশ ম্যাচে যেখানে ব্যাট করছিলেন ১২৪ স্ট্রাইকরেটে, শেষ চার ম্যাচে সেখানে একই সংখ্যাটি ছাড়িয়েছে ১৬৫-এর ঘর। নিজে পারফর্ম করছেন, দলও ভালো খেলছে, ওয়ার্নারের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গেই থাকবার কথা।
দিল্লি ক্যাপিটালস
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: দ্বিতীয়
আইপিএলটা ঠিক কত লম্বা টুর্নামেন্ট, দিল্লির ফ্র্যাঞ্চাইজিটির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবার কথা। টুর্নামেন্টের শুরুর অর্ধে ‘ওদের থামাবে কে’ ভাবা হচ্ছিল যে দল নিয়ে, সেই দলকেই কি না এখন ভাবতে হচ্ছে ‘আমরা জিতবো কীভাবে’!
শুরুর সাত জয়ের ম্যাচে সাতজন ভিন্ন ক্রিকেটার ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার জেতাকে দেখা হচ্ছিল ইতিবাচক দৃষ্টিকোণেই। কিন্তু টুর্নামেন্টের শেষ পাঁচ ম্যাচে চার হারের পরে প্রশ্ন জেগেছে, দিল্লির হালটা ধরছেন কে?
টানা খেলার চাপে দুই মুখ্য ফাস্ট বোলারকে মনে হচ্ছে পিষ্ট। আগের ১১ ম্যাচে ২১ উইকেট নেয়া কাগিসো রাবাদা গ্রুপপর্বের শেষ তিন ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র দুই উইকেট। রান আটকে রেখে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা আনরিখ নোর্খিয়ের ইকোনমিও শেষ পাঁচ ম্যাচে ৮ ছাড়িয়েছে তিনবার। ঋষভ পন্ত, শ্রেয়াস আইয়াররা হারিয়ে খুঁজছেন নিজেদের, মাঝে চার ম্যাচে রান করে শিখর ধাওয়ান আবারও চলে গিয়েছেন শীতনিদ্রায়। ১৪ ম্যাচ খেলে ফেলবার পরও দিল্লি ক্যাপিটালস খুঁজে পায়নি পছন্দের পঞ্চম বোলার।
প্লে-অফের ম্যাচের আগে রিকি পন্টিংয়ের সামনে তাই রাজ্যের দুশ্চিন্তা।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: চতুর্থ
মায়াঙ্ক আগারওয়াল, লোকেশ রাহুল, মনীশ পাণ্ডে, সরফরাজ খান, শচীন বেবি…. প্রত্যেকবার আইপিএলেই ‘দৃষ্টিসুখকর’ ব্যাটসম্যানদের দলে ভেড়ানোটা নিয়ম করে ফেলেছে আরসিবি। এরই ধারাবাহিকতায় এবারে দূত হয়ে এলেন দেবদূত পাড়িকাল। অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্যটা হচ্ছে, ইনি কেবল দর্শনধারীই নন, গুণবিচারীও বটে; বেঙ্গালুরুকে রান এনে দিচ্ছেন পুরোদমে। অভিষেক আইপিএল মৌসুমে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের কীর্তিতে শ্রেয়াস আইয়ারকে দুইয়ে ঠেলে দিয়েছেন ইতঃমধ্যেই, আগাচ্ছেন অভিষেক মৌসুমেই ৫০০ রান করা প্রথম ব্যাটসম্যান হবার দিকে। কোহলি-এবি ডি ভিলিয়ার্স, কর্ণাটকের ফ্র্যাঞ্চাইজির মূল দুই ভরসা যদিও এই দু’জনই, তবে চার নম্বর দল হিসেবে আরসিবির প্লে-অফ নিশ্চিতকরণে অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে দেবদূতেরও।
ভূমিকা রয়েছে ওয়াশিংটন সুন্দর, যুজবেন্দ্র চাহাল আর ক্রিস মরিসেরও। শুরুর পাওয়ারপ্লেতে প্রতিপক্ষের রান আটকে রেখে চাপ সৃষ্টি করেছেন সুন্দর। তার এবারকার আইপিএলের ইকোনমি মাত্র ৫.৭৭, যা কি না রশিদ খানকে হিসেবের বাইরে রাখলে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা। মধ্য ওভারে রান বাড়াতে গিয়ে প্রতিপক্ষ উইকেট দিয়ে এসেছে চাহালকে, এখন অব্দি ২০ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় চাহাল আছেন পাঁচ নম্বরে। চোটের কারণে মরিস খেলতে পারেননি টুর্নামেন্টের শুরুর পাঁচ ম্যাচ, দলে ফিরেই সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন আরসিবি লাইনআপে তার ভূমিকা। ওভারপ্রতি ৬.৬৩ রান খরচে আর ১৯.০৯ গড়ে এখন অব্দি নিয়েছেন ১১ উইকেট। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, মরিসের মধ্যে আরসিবি খুঁজছিল যে ডেথ বোলারকে, মরিস সে চাহিদা পূরণ করেছেন পুরোপুরি। শেষ পাঁচ ওভারে তার ৭.০৩ ইকোনমি রেট এবারকার আইপিএলের সেরা।
আরসিবি মাঠের চরিত্রও বুঝতে পেরেছে আর সব দলের চাইতে ভালো। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মোহাম্মদ সিরাজের অন্তর্ভুক্তিকে। ২৬ বছর বয়সী এই পেসারকে আরসিবি দলে ডেকেছিল শারজার ছোট মাঠে আর আবুধাবির সুইংবান্ধব পরিবেশে। দু’ক্ষেত্রেই সিরাজ সে চাহিদা মিটিয়েছেন সার্থকতার সঙ্গে।
এরপরও যে বেঙ্গালুরু প্লে-অফ নিশ্চিত করলো সবার শেষে থেকে, তার কারণ মধ্য ওভারে দলটির রান তোলার অপারগতা। পাওয়ারপ্লেতে সপ্রতিভ দেবদূত পাড়িকাল মধ্য ওভার আসতেই হয়ে পড়ছেন নিস্তেজ। টুর্নামেন্টের ৭-১৫ ওভারকালে শম্বুকগতির ব্যাটসম্যানদের একজন এই দেবদূত; তবে তার থেকেও আশ্চর্য বিষয়, তার সঙ্গে এই তালিকায় আছেন বিরাট কোহলি (স্ট্রাইক রেট: ১০৮) আর এবি ডি ভিলিয়ার্সও (স্ট্রাইক রেট: ১০৯)। লোয়ার মিডল অর্ডারে সুন্দর, শিভম দুবে কিংবা গুরকিরাত সিংরা ঠিকঠাক সমর্থন যোগাতে পারছেন না বলে কোহলিরা পারছেন না আক্রমণ করতে। প্লে-অফে আরসিবি কেমন করবে, তার অনেকটাই নির্ভর করছে এই মধ্য ওভারের সমীকরণ মেলানোতে।
মুম্বাই ইন্ডিয়ানস
গ্রুপপর্ব শেষে অবস্থান: প্রথম
তাদের সাফল্যের সূত্রটা অজানা নয় কারও। বরং তা এতটাই খুল্লামখোলা যে মুম্বাইয়ের সাফল্যের রহস্য নিয়ে লিখতে বসলে আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলবেন আপনি। এক দলে খেলেন রোহিত শর্মা, কুইন্টন ডি কক, সূর্যকুমার যাদব, ঈষাণ কিষাণ, হার্দিক পান্ডিয়া, ক্রুনাল পান্ডিয়া, কাইরন পোলার্ড, ট্রেন্ট বোল্ট, রাহুল চাহার আর জসপ্রীত বুমরাহ; শুধু খেলেন বললে ভুল বলবার আশঙ্কা থেকে যায়, তারা পারফর্মও করেন সমানে। ওই দলকে পেরিয়ে অন্য কেউ সেরা হবে!
ব্যাটিং থেকেই শুরু করা যাক। এবারের টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ সাত রানসংগ্রাহকের তিনজনই (ডি কক, কিষাণ, সূর্যকুমার) খেলেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে, তারা প্রতি ১০০ বলে রানও করেন ১৩৯-এর বেশি করে। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেটধারী দু’জন ক্রিকেটারই (পোলার্ড, হার্দিক) ব্যাট করেন মুম্বাইয়ের মিডল-অর্ডারে। রাহুল চাহার এবারকার আইপিএলের সেরা উদীয়মান হবার দৌড়ে এগিয়ে আছেন সবচেয়ে, ট্রেন্ট বোল্টও ইনিংসের শুরুতে উইকেট এনে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আর হ্যাঁ, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে একজন বুমরাহও আছেন; সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির জন্যে বরাদ্দ বেগুনি ক্যাপটা শোভা পাচ্ছে তার মাথাতেই।
আচ্ছা, অতিরিক্ত পাঁচটা দিন বায়ো-বাবলে থেকে এলিমিনেটর-কোয়ালিফায়ার খেলবার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে? রোহিত শর্মার হাতে কাপটা এখনই তুলে দিলে খুব ঝুঁকি আছে কি?