খেলায় হারতে থাকা কোন দলকে হঠাৎ করে খেলায় ফিরতে দেখা রোমাঞ্চকর বটে। সেটি যদি আরো হয় বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে, তাহলে তো তা আরো বাড়িয়ে দেয় উন্মাদনা। যেকোনো খেলাতেই এই কামব্যাক বা ফিরে আসাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করে দর্শক। অন্য খেলাগুলোর তুলনায় ফুটবল যেমন আনপ্রেডিকটেবল থাকে, তাতে যেকোনো মুহূর্তেই ম্যাচের মোড় ঘুরে যেতে পারে।
ফুটবল বিশ্বকাপের এই কামব্যাকগুলো সমর্থকদের মনে নতুন আশার সঞ্চার ঘটায়। ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকা দল যখন ১ গোল দেয়, তখন তাদের সমর্থকেরা আশায় বুক বাঁধেন এই ভেবে যে তাদের দল ৪-৩ গোলে জিততে পারবে। এমন মুহূর্তে পাল্টে যায় দলগুলোর ক্রীড়াকৌশলও। এগিয়ে থাকা দলটি তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেদের রক্ষণ রক্ষা করে, আর পিছিয়ে থাকা দল উপর্যুপরি আক্রমণের মাধ্যমে খেলায় ফিরতে চেষ্টা করে।
কোনো কোনো সময় কোনো এক নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের একক ক্রীড়ানৈপুণ্য কিংবা নিজেদের টিমওয়ার্ক, কিংবা বিপক্ষ দলের কোনো ভুল একটি দলকে খেলায় ফিরতে সাহায্য করে। এ সকল কারণে কামব্যাকগুলো ইতিহাসে আলাদা করে নিজেদের পদচারণা রেখে যায়।
২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আসতে আর সময় বাকি নেই। আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব ফুটবল বিশ্বকাপের ঘটা কিছু অবিশ্বাস্য কামব্যাককে।
বিশ্বকাপ ১৯৫৪, কোয়ার্টার ফাইনাল, সুইজারল্যান্ড বনাম অস্ট্রিয়া
১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে বিশ্ব দেখেছিল স্মরণকালের বিখ্যাত দুই কামব্যাকের। তার প্রথমটি ছিল কোয়ার্টার ফাইনালে সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মধ্যকার ম্যাচে। ১২ গোলের এই খেলায় অস্ট্রিয়া ৭-৫ গোলে হারায় সুইজারল্যান্ডকে। সেই সাথে দিনে মাঠে তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তীব্র গরম খেলোয়াড়দের একদম নাভিঃশ্বাস হয়ে উঠে।
সেই টুর্নামেন্টের স্বাগতিক সুইজারল্যান্ড মাত্র ১৫ থেকে ১৯ এই ৪ মিনিটের ব্যবধানে এগিয়ে যায় ৩-০ গোলে। সুইসদের ৩ গোলের জবাবে অস্ট্রিয়া প্রথমার্ধের ২৫,২৬, ২৭, ৩২ ও ৩৪ মিনিটে দেয় ৫ গোল। হুট করে এগিয়ে থাকা সুইসরা যখন পিছিয়ে পড়ে তখন তারা আবার আক্রমণের ধার বাড়িয়ে দেয়। এবং সেই আক্রমণে ৩৯ মিনিটে আরেকটি গোল আদায় করে নেয়।
বিরতির পর মাঠে নেমে ৮ মিনিটের মাথায় আবারও ব্যাবধান দ্বিগুন করে অস্ট্রিয়া। থিওডোর ওয়াগনারের হ্যাটট্রিকে ম্যাচ মোটামুটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেয় তারা। তবে খেলায় ফেরার চেষ্টা করছিল সুইজারল্যান্ড। ৬০ মিনিটে সুইসদের হয়ে পঞ্চম এবং নিজের ৩য় গোল করেন হুগি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। ৭৬ মিনিটে প্রোবোস্ট সুইসদের পরাজয় নিশ্চিত করেন।
বিশ্বকাপ ১৯৫৪, ফাইনাল, পশ্চিম জার্মানি বনাম হাঙ্গেরি
ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ফাইনাল ম্যাচ ছিল এটি। এই হাঙ্গেরি ছিল ইতিহাসে বিখ্যাত সেই হাঙ্গেরি, যার সামনে পাত্তাই পেত না ছোটবড় কোনো দল। ১৯৫০ থকে ‘৫৪ সাল অব্দি ৩০টি ম্যাচের ২৬টিতেই তারা জয়লাভ করে, বাকি ৪টি ম্যাচ হয় ড্র। এমনকি তারা অলিম্পিকের সোনাও নিজেদের করে নেয়।
ফাইনালের পথে ৪ ম্যাচে তারা প্রতিপক্ষের জালে ২৫ বার বল ঢোকায়। তার মধ্যে সেসময়ের অন্যতম পরাশক্তি ব্রাজিলকে ‘ফিজিক্যাল’ খেলে হারিয়ে পরের ম্যাচেই তারা হারায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে। এবং এই শেষ ৩টি খেলা তারা জিতে নেয় তাদের সেরা ফুটবলার ফেরেঙ্ক পুসকাসকে না নামিয়েই।
পুসকাস নামেন একদম ফাইনালে, পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে, যাদের তারা গ্রুপপর্বেই হারিয়েছিলেন ৮-৩ গোলে বিদ্ধস্ত করে। সেই ফাইনালেও মাত্র ৮ মিনিটে পুসকাস আর শিবোরের গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। হাঙ্গেরি ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বকাপ জিতবে, তা ছিল সবার কল্পনার বাইরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ম্যাক্স মরলক হাঙ্গেরীয় ডিফেন্ডারদের ভুলে বল পেয়ে গোল করে ফেলেন। ‘নার্ভাস’ হাঙ্গেরি এরপর ৩০ মিনিটের মাথায় আরো একটি গোল খায়।
খেলা সমতায় আসার পর হাঙ্গেরির কী যেন হয়। পরবর্তী ৬০ মিনিট তারা জার্মান পোস্টে একের পর এক সুযোগ মিস করে। পুসকাস, কচসিস, শিবোর কেউই বলকে লক্ষ্যে পাঠাতে পারছিলেন না। নার্ভাসনেস বেড়ে গিয়ে খেলা অগোছালো হতে শুরু করে হাঙ্গেরির। ফলে সুযোগ হাতছাড়া না করে ৮৪ মিনিটে জার্মানির হয়ে তৃতীয় গোল করেন হেলমুট রান। তার এই জয়সূচক গোলেই সেবার শিরোপা যায় জার্মানদের ঘরে।
বিশ্বকাপ ১৯৬৬, কোয়ার্টার ফাইনাল, পর্তুগাল বনাম উত্তর কোরিয়া
কামব্যাকের ইতিহাসে এই ম্যাচটি কিছুটা আলাদা করে সমাদৃত হবে। কেন? কারণ কেবল এই ম্যাচেই কোনো দল ৩ গোলে পিছিয়ে গিয়েও খেলায় জিতেছিল। ম্যাচটি ছিল সেই বিশ্বকাপে অভিষিক্ত দুইটি দল পর্তুগাল ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে। উত্তর কোরিয়ার খেলোয়াড়দের কেউ সেভাবে চিনত না। বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের খেলোয়াড়েরা কেমন খেলত, তা-ও সবাই জানত না।
এই অপরিচিত দলটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইতালিকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয় প্রথম রাউন্ডে। কোয়ার্টার ফাইনালের তারা মুখোমুখি হয় পর্তুগালের। কাগজেকলমে পর্তুগালই ফেভারিট ছিল, কারণ তাদের দলে সেসময় খেলতেন তাদের ইতিহাস বিখ্যাত স্ট্রাইকার ইউসেবিও। তা সত্ত্বেও মাত্র ২৫ মিনিটেই ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় উত্তর কোরিয়া। ১ম মিনিটেই পার্ক সিউং-জিন দূরপাল্লার এক শটে গোলের বন্যা শুরু করেন। আক্ষরিক অর্থে সেখানেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বাকিরা সেখানেই খেলায় ফেরায় মানসিকতা হারিয়ে ফেললেও হারাননি ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-খ্যাত ইউসেবিও।
দুর্দান্ত এক শটে পর্তুগালের হয়ে প্রথম গোলটি করেন। এরপর বিরতির আগে পেনাল্টি থেকে করেন দ্বিতীয় গোল। লিড বাঁচাতে মরিয়া উত্তর কোরিয়া দ্বিতীয়ার্ধে গোল বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও হার মানেন ইউসেবিওর নৈপুণ্যের কাছে। এখানেই শেষ নয়, তিন মিনিট পর আবারও আঘাত করেন তিনি। মাঝমাঠ থেকে বল একা টেনে নিয়ে একদম গোলরক্ষকের বক্স পর্যন্ত চলে আসেন। সেখানে এক ডিফেন্ডার তাকে ফাউল করলে পেনাল্টি থেকে এবার নিজের ও দলের চতুর্থ গোলটি করেন। কোরিয়ার কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন হোসে অগুস্তো। এর মাধ্যমে ৫-৩ গোলে হেরে উত্তর কোরিয়া বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে, এবং পরবর্তী ৪৪ বছর তাদের আর এই বড় মঞ্চে দেখা যায়নি।
বিশ্বকাপ ১৯৭০, কোয়ার্টার ফাইনাল, পশ্চিম জার্মানি বনাম ইংল্যান্ড
১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড তাদের ঘরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা তোলে। সেই ম্যাচে পশ্চিম জার্মানিকে তারা হারায় ৪-২ গোলে। শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে তাদের সামনে পড়ে জার্মানি। এই ম্যাচেই ইংল্যান্ডের নতুন করে দুর্ভাগ্যের সূচনা হয়। এরপর তারা আর বিশ্বকাপ তো যেতেই পারেনি, তার উপর বেশ কয়েকবার বিদায় নিতে হয় এই জার্মানির কাছে হেরেই।
অ্যালান মুলারি ও মার্টিন পিটার্সের গোলে শুরুতে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। জার্মানিকে ম্যাচে ফেরান ইতিহাস বিখ্যাত ডিফেন্ডার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার। ইংল্যান্ডের একজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত এক গোল করেন। নির্ধারিত সময়ের একদম শেষের দিকে জার্মানিকে সমতায় ফেরান স্ট্রাইকার উয়ি সিলার। এতে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে ইউর্গেন গ্র্যাবোভস্কির ক্রসে মাথা ছুইয়ে বলকে জালে পাঠান জার্ড মুলার। তার এই গোলেই ৩-২ ব্যাবধানে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিদায় করে জার্মানি।
বিশ্বকাপ ১৯৭০, সেমিফাইনাল, ইতালি বনাম পশ্চিম জার্মানি
ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি ম্যাচ ছিল এটি। অনেকের মতে একে ‘গেম অফ দ্য সেঞ্চুরি’ বলা উচিৎ। কী হয়েছিল সেখানে?
ইতালি বরাবরের মতোই রক্ষণাত্মক একটি দল। পশ্চিম জার্মানির সাথে মাত্র ৮ মিনিটেই তারা এগিয়ে যায় রবার্তো বনিনসেনিয়ার গোলে। এরপর আর তেমন আক্রমণে না গিয়ে পরবর্তী ৮২ মিনিট তারা তাদের এই একমাত্র গোলের লিড ধরে রাখে। জার্মানির মুহূর্মুহূ আক্রমণকে তারা ঠেকিয়ে রাখে ইনজুরি টাইম পর্যন্ত। এই ম্যাচে হাতের হাড় সরে গিয়ে ইনজুরড হন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার, কিন্তু তখন জার্মানির আর কোনো বদলি করার সুযোগ অবশিষ্ট ছিল না। তাই কোনোমতে হাতটিকে বেঁধে খেলা চালিয়ে যান। এরকম পরিস্থিতিতে ৯০ মিনিটের পর যোগ করা সময়ে গোল করে খেলায় সমতায় আনেন লেফটব্যাক কার্ল হাইঞ্জ শ্নেলিঞ্জার।
খেলা যখন অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়, সেখানে হয় আরেক নাটক। এবার জার্ড মুলারের গোলে এগিয়ে যায় জার্মানি। ৯৮ মিনিটে আবারও খেলা সমতায় নিয়ে আসে ইতালি তারকিসিও বার্গনিচের গোলে। এর ৬ মিনিট পরেই লুকা রিভার গোলে আবারো খেলায় এগিয়ে যায় তারা। কামব্যাকের পর কামব্যাক হতে থাকে এই খেলায়।
কিছু সময় পরই আবারও জার্ড মুলার সমতাসূচক গোল করেন। কিন্তু তা বাঁচাতে পারেনি জার্মানিকে। জিয়ান্নি রিভেরা এবার খেলায় জয়সূচক গোল করেন খেলার শেষ বাঁশি বাজার কিছু সময় আগে। এর মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক খেলায় ইতালি ৪-৩ গোলে হারায় পশ্চিম জার্মানিকে।
বিশ্বকাপ ১৯৮২, সেমিফাইনাল, পশ্চিম জার্মানি বনাম ফ্রান্স
প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপেই জার্মানি নতুন নতুন কামব্যাকের জন্ম দেয়। ১৯৮২ সালের এই সেমিফাইনালটি ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে পেনাল্টিভাগ্যে নির্ধারিত হওয়া প্রথম ম্যাচ। সেই ম্যাচে মাত্র ১৭ মিনিটে এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। জবাবে ফ্রান্স সেই গোলটি শোধ দেয় ২৭ মিনিটে পেনাল্টি থেকে। নির্ধারিত সময়ে খেলা ১-১ এ শেষ হলে খেলা চলে যায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। সেখানে ২ মিনিটের মাথায় মারিউস ট্রেসর এক দুর্দান্ত ভলির মাধ্যমে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন। ৯৮ মিনিটে আরো ১ গোল করে তারা এগিয়ে যায় ৩-১ গোলে। জার্মান অধিনায়ক কার্ল-হাইঞ্জ রুমানিগে এই ম্যাচে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির জন্য শুরুর একাদশে ছিলেন না। কিন্তু এই অতিরিক্ত সময়ে মাঠে নেমে তিনি জার্মানিকে খেলায় ফিরতে সাহায্য করেন।
১০২ মিনিটে এই রুমানিগে এ ব্যবধান কমিয়ে আনেন ৩-২ গোলে। এরপর ১০৮ মিনিটে ফিশার বাইসাইকেল কিকে ৩-৩ গোলের সমতায় নিয়ে আসেন ম্যাচটিকে। খেলার ভাগ্য নির্ধারণে তাই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যেতে হয় টাইব্রেকারে।
প্রথম ৫টি পেনাল্টিতে দুই দলই একটি করে মিস করে। ফলে পেনাল্টি চলে যায় সাডেন ডেথে। সেখানে ম্যাক্সিম বোসিসের শট ফিরিয়ে দেন জার্মান কিপার হারাল্ড শ্যুমাখার, যিনি এই খেলায় খুব মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন প্যাট্রিক ব্যাটিস্টোনের সাথে ধাক্কা খেয়ে। সেই ধাক্কায় ব্যাটিস্টোন নিজেও অজ্ঞান হয়ে যান, তার দু’টি দাঁত পড়ে যায়, মেরুদণ্ডে আঘাত পান, এবং পাঁজরের ৩টি হাড় ভেঙ্গে যায়। তবে রেফারি সেখানে কোনো ফাউল দেননি। অনেকের মতেই শ্যুমাখার সেখানে লালকার্ড পাওয়ার মতো ফাউলই করেছিলেন। তবে এ যাত্রায় রেফারির বদান্যতায় বেঁচে গিয়ে তিনি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পেনাল্টি ফিরিয়েছিলেন টাইব্রেকারে। ফ্রান্স মিস করার পর হর্স্ট হ্রুবেশের কাছে সুযোগ আসে খেলায় দলকে জেতানোর। পেনাল্টি থেকে গোল করে তিনি দলকে ফাইনালে পৌছে দেন।
বিশ্বকাপ ১৯৯০, কোয়ার্টার ফাইনাল, ইংল্যান্ড বনাম ক্যামেরুন
১৯৬৬ সালের পর সেমিফাইনালের উঠার সুযোগ ছিল ইংল্যান্ডের সামনে। কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হয় ক্যামেরুন। সেবার প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে তারা।
১৯৯০ সালের ক্যামেরুন দলটি ভালোই হুংকার দিয়েছিল ফুটবল বিশ্বে। ৩৮ বছর বয়সী দুর্দান্ত স্ট্রাইকার রজার মিলাসহ আরো অনেকে ছিলেন এই দলে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডের সাথে তেমন সুবিধা করতে পারছিল না তারা। সাথে ডেভিড প্ল্যাটের গোল তাদের আরো পিছিয়ে দেয়।
বিরতির পর ৬০ মিনিটে মাঠে নামেন রজার মিলা, এবং নেমেই একটি পেনাল্টি আদায় করে নেন। পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান এমানুয়েল কুন্দে। ক্যামেরুনের লিড পেতে এরপর দেরি হয়নি। আরেক বদলি খেলোয়াড় ইউজিন একেক বোকা বানান গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে। লিড ধরে রাখার চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়। ৮৩ মিনিটে এবার পেনাল্টি আদায় করেন গ্যারি লিনেকার, এবং নিজেই সেই পেনাল্টি থেকে গোল করে ম্যাচকে নিয়ে যান অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে আরো একটি গোল করে ইংল্যান্ডকে সেমিফাইনালে তোলেন তিনি।
এরই সাথে শেষ হয়ে যায় প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে ক্যামেরুনের সেমিফাইনালে উঠার স্বপ্ন, যে স্বপ্ন এখনো পূরণ করতে পারেনি কোনো দল।
বিশ্বকাপ ১৯৯৪, দ্বিতীয় রাউন্ড, ইতালি বনাম নাইজেরিয়া
সেবারের বিশ্বকাপে আফ্রিকার ঈগলেরা রীতিমতো উড়ছিল। হৃস্টো স্টোইচকোভের বুলগেরিয়া ও আর্জেন্টিনার সাথে একই গ্রুপে থাকা নাইজেরিয়া সেবার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে ওঠে। কিন্তু কপাল মন্দ যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাদের খেলা পরে ব্যাজিওর ইতালির সাথে।
ইতালির নাইজেরিয়াকে নিয়ে ভয় ছিলই। সেবার বিশ্বকাপে খুব বাজেভাবে শুরু করেছিল তারা। ভয় নিয়ে খেলতে নেমে নাইজেরিয়ার সাথে শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে তারা। কর্নার থেকে পাওয়া বলে গোল করেন এমানুয়েল আমুনিকে। পিছিয়ে পড়ে আক্রমণের ধার বাড়ায় ইতালি। দুই ব্যাজিও ভাইকে খুব ভালোভাবেই সামাল দেয় নাইজেরিয়া। ইতালিকে খেলায় আরো পিছিয়ে দেয় ৭৫ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় জিয়ানফ্রাংকো জোলার লাল কার্ড। ইতালির বিশ্বকাপ সেখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু হয়নি এক ‘ব্যাজিও ম্যাজিক’-এর জন্য।
বক্সের কোণা থেকে নেয়া রবার্তো ব্যাজিওর মাটি কামড়ানো শট খুঁজে পায় নাইজেরিয়ার জাল। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। কিন্তু সেখানেও একজন বেশি থাকায় ফেভারিটের মতো করে খেলছিল নাইজেরিয়া। কিন্তু ব্যাজিও জাদুতে তা হয়ে ওঠেনি। তার দেয়া চিপ পাস বক্সে খুঁজে পায় অ্যান্তোনিও বেনারিভোকে। বক্সে তাকে ফেলে দেন নাইজেরিয়ার ডিফেন্ডার। পেনাল্টি থেকে জয়সূচক গোলটি করেন রবার্তো ব্যাজিও।
বিশ্বকাপ ২০০২, দ্বিতীয় রাউন্ড, দক্ষিণ কোরিয়া বনাম ইতালি
এই ম্যাচটি ছিল অনেকটা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের ইতালি ও নাইজেরিয়ার মধ্যকার খেলার কপি। পার্থক্য এই যে, সেখানে ইতালি জিতেছিল এবং এখানে ইতালি হারে। ২০০২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়া সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তাদের গ্রুপে আরো ছিল যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগাল ও পোল্যান্ড। অন্যদিকে, কোনোমতে দ্বিতীয় পর্বে আসা ইতালি গ্রুপে হেরে বসে ক্রোয়েশিয়ার কাছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার কামব্যাকের চাইতেও এই খেলাটি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে অন্যতম বিতর্কিত এক ম্যাচ হিসেবে।
পেনাল্টি বক্সে ধাক্কাধাক্কির জেরে রেফারি কোরিয়াকে পেনাল্টি উপহার দেন। কিন্তু সেটি মিস করেন অ্যান জুং-হুয়ান। উল্টো পরে ইতালিই এক গোল করে বসে। কোরিয়া লড়াই করছিল খেলায় ফিরতে, কিন্তু তাদের এই লড়াই নোংরা খেলার দিকেই বেশি যাচ্ছিল। এতটাই মেরে খেলছিল তারা যে দুই পক্ষেরই বেশ কিছু খেলোয়াড় ইনজুরির শিকার হন।
এসব সহ্য করে ইতালি ৮৮ মিনিট পর্যন্ত টিকেছিল। কিন্তু এরপর কোরিয়ান উইঙ্গার সিউল কি-হিউনের গোলে খেলায় সমতা নিয়ে আসে। তবে এতে ইতালির রক্ষণভাগের ভুলও সমান দায়ী ছিল। খেলা যখন অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় সেখানে লালকার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন ফ্রান্সেসকো টট্টি এবং ইতালির একটি নিশ্চিত গোলকে বাতিল করেন রেফারি। যখন টাইব্রেকারকে অবধারিত ভাবা হচ্ছিল, তখনই শুরুতে পেনাল্টি মিস করা অ্যান জুং-হুয়ান গোল করেন। এবার তিনি আর ভুল করেননি। তার গোলে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে আসে দক্ষিণ কোরিয়া। তবে এই ম্যাচটি খেতাব পায় অন্যতম বাজে রেফারিংয়ের অভিযোগের।
বিশ্বকাপ ২০১৪, দ্বিতীয় রাউন্ড, নেদারল্যান্ডস বনাম মেক্সিকো
২০১৪ বিশ্বকাপের এক বিষ্ময় ছিলেন মেক্সিকোর গোলরক্ষক গুইলহের্মে ওচোয়া। প্রায় একা হাতে ঠেকিয়েছিলেন ব্রাজিলকে। গ্রুপপর্বের পর তারা মুখোমুখি হয় আগেরবারের রানারআপ নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। সেই নেদারল্যান্ডস গ্রুপপর্বে স্পেনকে উড়িয়েছিল ৫-১ গোলে। তবে মেক্সিকোর ডিফেন্স কতটা শক্ত ছিল নেদারল্যান্ডসের জন্য, তা তারা এই খেলায় হাড়ে হাড়ে টের পায়।
মেক্সিকো শুরু থেকেই দাপটের সাথে খেলছিল। তারা এগিয়ে যায় জিওভানি দস সান্তোসের এক দূরপাল্লার শটে। পিছিয়ে পড়ে আক্রমণের ধার বাড়ালেও বারবার নেদারল্যান্ডস পরাস্ত হচ্ছিল মেক্সিকোর ডিফেন্স ও ওচোয়ার কাছে। ৮৮ মিনিটে খেলার ১ম ভুল করে মেক্সিকোর ডিফেন্স। একটি কর্নার ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হওয়ায় সেখানে বল পেয়ে যান ওয়েসলি স্নাইডার। গোল করে দলকে সমতায় ফেরান তিনি।
এরপর অতিরিক্ত সময়ের জন্য বসে না থেকে আক্রমণ চালিয়ে যায় তারা। রাইট উইঙ্গার আরিয়েন রোবেন বল নিয়ে ড্রিবল করে বক্সে ঢুকে পড়েন। এরপর মেক্সিকোর ডিফেন্ডারের আলতো ছোঁয়াতেই মাটিতে পড়ে পেনাল্টি আদায় করে নেন। স্পটকিক থেকে নেদারল্যান্ডসের জয়সূচক গোলটি করেন ক্ল্যাস ইয়ান হান্টলার। তবে এ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের জয়কে ছাপিয়ে উঠে আসে রোবেনের সেই ডাইভ।
বিশ্বকাপ ২০১৮, দ্বিতীয় রাউন্ড, বেলজিয়াম বনাম জাপান
বিশ্বকাপে কামব্যাকের সবচেয়ে নতুন উদাহরণ হচ্ছে বেলজিয়াম ও জাপানের মধ্যকার ম্যাচটি। এর আগে কেবল ২টি দল নাকআউটে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ম্যাচে ফিরতে পেরেছিল। কী ছিল না এই দুইদলের খেলায়! যেমন রক্ষণ, তেমন আক্রমণ, আবার সেইরকম কৌশল।
প্রথমার্ধে জাপান রক্ষণাত্মক খেলা শুরু করলেও হঠাৎ এক কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করে বসেন তাদের জেঙ্কি হামাগুচি। আন্ডারডগরা এরপরই খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। গোল পেতে দেরি হয়নি। টুর্নামেন্টের অন্যতম দর্শনীয় গোল আসে এবার তাকাশি ইনুইয়ের পা থেকে। তবে অন্যদিকে মিসের মহড়া দিচ্ছিল বেলজিয়াম। অধিনায়ক এদেন আজার, রোমেলো লুকাকু, কেভিন ডি ব্রুইনাসহ আরো অনেকেই সহজ সব সুযোগ মিস করতে থাকেন।
দ্বিতীয়ার্ধে রেড ডেভিলদের খেলায় ফেরান ইয়ার ভার্তোঙ্ঘেন, দুর্দান্ত এক হেডে খুঁজে পান জাপানের জাল। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় সুন্দর এক ফিনিশিং দেন মারুয়ান ফেলাইনি। আর জাপানের সব আশা ৯০+৪ মিনিটে শেষ করে দেন নাসের চ্যাডলি। ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়ে মাত্র ২৫ মিনিটের ব্যবধানে ৩ গোল খেয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় জাপান।
***
আগামী ২০ নভেম্বর শুরু হতে যাচ্ছে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ। আমাদের জন্য এখানে কি অপেক্ষা করছে নতুন কোনো ঐতিহাসিক কামব্যাক? আসছে কি আসছে না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে রোর বাংলার সঙ্গে থাকতে ভুলবেন না!