মধ্য বয়সে আম্পায়ারিংয়ে যোগ দেওয়াটাই এক ধরনের অলিখিত নিয়ম। বিশ্বের বড় বড় আর খ্যাতিমান সব ক্রিকেট আম্পায়ারদের গল্প সে কথারই জানান দেয়। কিন্তু উল্টো পথে হেঁটেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাইমন টফেল। প্রথম যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে আম্পায়ারিং করতে দাঁড়ালেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৯!
শুরু থেকেই নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এগিয়েছেন সায়মন, যার ধারাবাহিকতায় সফলতা পেয়েছেন মুঠোভরে। খুব কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে আইসিসি আম্পায়ার এলিট প্যানেলের অন্যতম অভিজ্ঞ সদস্য হতে পেরেছেন। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা আইসিসির বর্ষসেরা আম্পায়ারের পুরস্কার জিতেছেন। সবমিলিয়ে এই অর্জনে নাম লিখিয়েছেন পাঁচবার। টানা তিনটি বিশ্বকাপে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন, যার মধ্যে ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটিও ছিল।
পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত আম্পায়ার হিসেবে সাইমন টফেলের নেওয়া সিদ্ধান্তের ৯৬.৫ শতাংশই সঠিক। সফল এই অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার নিজের দেশে আম্পায়ারদের জন্য কাজও করেছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি বর্তমান সময়ে আম্পায়ারিংয়ের চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ ও আম্পায়ারিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বাড়াবাড়ি ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছেন। সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
আপনি কি ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব্যাবহার সমর্থন করেন?
প্রযুক্তির কাজটা হওয়া উচিত ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করা, আরও উন্নত করা। আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বকে প্রতিস্থাপন করা নয়। খেলায় প্রযুক্তির ব্যবহারের একটা ভারসম্যও রাখা উচিত ছিল, যা আমরা দেখি না। আমরা যা দেখি তা হলো প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা। অথচ মানুষের মতো প্রযুক্তিও সময়ের সাথে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
ক্রিকেটের সাথে প্রযুক্তি অনেক বেশি জড়িয়ে গেছে, এ কথাটার সাথে আপনি একমত?
সম্প্রচারকদের কথা বাদ দিলে, যেসব প্রযুক্তি ক্রিকেটে ব্যবহার হয় তা এই খেলাটির জন্য অনেক বেশি সহায়ক করতে পারতো। কিন্তু আমরা যেটা দেখছি, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের অধীনে, সেই প্রতিষ্ঠান যাকে নিয়ন্ত্রণ করে আয়োজক দেশ। অর্থাৎ, পুরোটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আদর্শভাবে বলতে গেলে, আইসিসির উচিত ছিল, বিশেষ প্রয়োজনে ক্রিকেটে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। কারণ এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, আমরা শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা এখনও অর্জন করতে পারিনি।
ক্রিকেটে কোন কোন জায়গায় প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তিতে উপকার হয়েছে বলে মনে করেন?
আউটের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দুটি সিদ্ধান্ত হলো লেগ সাইডে কট বিহাইন্ড এবং ব্যাট-প্যাডে বল স্পর্শ করেছে কি না তা বুঝতে পারা। তাছাড়া লেগ বিফোরের সিদ্ধান্ত দেওয়া আম্পায়ারের জন্য তুলনামূলক সহজ। কারণ, এলবিডব্লিউ হয়েছে কি হয়নি তা পুরো স্টেডিয়ামের মধ্যে একমাত্র আম্পায়ারই ভালো বুঝতে পারে তার দাঁড়ানোর পজিশনের কারণে। কখনও কখনও প্রযুক্তি কিছু সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিতে পারে না সেটাও সত্যি।
এখন তো সবকিছুই থার্ড আম্পায়ারের অধীনে চলে যায়…
এটা খুবই বিরক্তিকর প্রবণতা। আম্পায়ারের কাজ হলো তখনই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যখন তাদের প্রয়োজন। প্রযুক্তির অতিব্যবহার কিংবা অপব্যবহার একেবারেই উচিত নয়। আমাদের উচিত আম্পায়ারদেরকে সমর্থন দেওয়া, তাদেরকে উৎসাহিত করা যেন তারা ভালো করতে পারে।
বল যদি ঘাস ও ফিল্ডারের আঙ্গুল ছুঁয়ে ক্যাচ হয়, সেটাকে কি ‘পরিষ্কার ক্যাচ’ বলা যায়?
আইন বলে, মাটি স্পর্শ না করেই বল ফিল্ডারের তালুবন্দী হতে হবে। কিন্তু কোনো দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট সিরিজ পরিচালিত হয় ‘প্লেয়িং কন্ডিশন’ এর মাধ্যমে। তার মধ্য দিয়েই আম্পায়ারদের কাজ করতে হবে। অর্থাৎ, বল যদি ফিল্ডারের হাতে থাকে; সেই বল যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে অবশ্যই আম্পায়ার ব্যাটসম্যানকে আউটের সিদ্ধান্ত দেবেন। যেমনটা পার্থ টেস্টে বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে হয়েছিল।
অন-ফিল্ড আম্পায়ার কোনো সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হতে না পারলে সেটা সেটা সফট সিগন্যলের মাধ্যমে থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠিয়ে দেন। এটা কতটা জরুরি?
কখনও কখনও ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের দেওয়া ছবিগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সহায়ক হয় না। তখন সফট সিগন্যালের প্রয়োজন পড়ে। যতক্ষণ না থার্ড আম্পায়ার ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অন ফিল্ড আম্পায়ারের দেওয়া সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করা উচিত নয়। এলবিডব্লিউয়ের মতো এক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বোলার প্রান্তে থাকা আম্পায়ারের।
কী করলে ম্যাচের সময় নষ্ট রোধ করা সম্ভব?
এ ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞ থার্ড আম্পায়ার নিয়োগের পরামর্শ দেবো। যখন আপনি নির্দিষ্ট কোনো একটি কাজে নিয়োজিত থাকবেন, সেখানে আপনি ভালো করবেন, দ্রুত করবেন এবং কাজের মানের উন্নতি করবেন। কারণ ১০ জনের একটি ছোট দলের চেয়ে ৫০ জনের একটি দল একই কাজ দ্রুত ও ভালোভাবে সম্পন্ন করবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞ থার্ড আম্পায়ার খেলার গতি বাড়াতে পারে, বিশেষ করে রিভিউ আবেদন ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে দ্রুত সময়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
এলবিডব্লিউয়ের আবেনের ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানের ভাগ্য নির্ভর করে ‘আম্পায়ার্স কল’ এর উপর। তো আম্পায়ার যখন নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত নন, তারপরও অনেক সময় নিজের সিদ্ধান্তের উপর কঠোর থাকা কি উচিত বলে মনে করেন?
এটা একটা অনুমান মাত্র। একটি এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ বল উইকেটে লাগবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নির্ভর করে আম্পায়ারের মতামতের উপর। এটা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার করে তাদেরকে নির্ধারণ করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত দিতে গেলে সবসময় নিজের প্রথম সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করা উচিত। নিজের যেটা মনে হয়েছে সেই ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এমনকি আপনার হাতে সেকেন্ডেরও কম সময় আছে, তার মধ্যেই সিদ্ধান্তটা আপনাকে নিতে হবে। যখনই আপনি দ্বিতীয়বার ভাবতে যাবেন, তখনই সমস্যা হবে।
অন-ফিল্ড আম্পায়াররা এখন আর নো বল মনিটরিং করেন না কেন?
আবারো বলছি, এটা কেবল একটা অনুমান। আমি এটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে আম্পায়ারয়ারা এখনও বোলারদের পা ‘ওভার স্টেপিং’ হলে নো বল ডাকে। বর্তমান সময়ে ব্যাপারটা এমন হয় যে, বোলারের পা যদি সীমানা ছাড়িয়ে গেছে এমন মনে হয় কিন্তু মাটি স্পর্শ না করে তাহলে সাধারণত নো বল ডাকা হয় না। কিন্তু ঐ বলে যদি উইকেট পড়ে তাহলে চেক করা হয়।
আপনার কি মনে হয় না, ‘বল ট্র্যাকিং’ প্রযুক্তি একটা চিন্তার বিষয়? ২.৫মিটারের পয়েন্ট অব ইমপ্যাক্টের নিয়ম?
আমি আসলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য এটা যথেষ্ট নয়। এটা কেবল অনিশ্চয়তা আর বিতর্ক তৈরি করে।
ক্রিকেটে আম্পায়ারিং আরও বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে কোন কোন ব্যাপারগুলোতে পরিবর্তন আনা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আমি মনে করি ম্যাচ অফিশিয়ালদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য গভর্নিং বডির চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কাজ করা উচিত। যারা খেলছে তারা অনেক ধরনের সমর্থন পাচ্ছে, তাদের উপর বিনিয়োগও বাড়ছে। আম্পায়ারদেরকে যদি ‘তৃতীয় দল’ হিসেবে ম্যাচে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা উপযুক্ত হবে।