স্বপ্নপাখির ডানা পুড়লো হতাশার আগুনে

বার্মিংহামে মাহমুদউল্লাহ খুব দরদ দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে চলেছেন। চোখ বন্ধ, মুখে গান; অভিব্যক্তিটা সফেদ দেশপ্রেমের। ওই অবস্থায় যে কেউ মাহমুদউল্লাহকে দেখলেই বুঝতে পারবে, লোকটাকে যেন কিছু একটা পোড়াচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত সত্যিই পুড়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার। বিশ্বকাপের স্বপ্ন বাঁচানোর লড়াইতে আবারও তীরে গিয়ে তরী ডুবিয়েছে দল, ভারতের বিপক্ষে ৪৮তম ওভারে গিয়ে সবক’টি উইকেট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরেছে মাত্র ২৮ রানের ব্যবধানে।

খুব করেই খেলতে চেয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ইনজুরিতে ক্র্যাচে ভর দিয়ে তার হোটেলে ফেরার ছবি পুড়িয়েছিল কোটি সমর্থকদের হৃদয়। তারপরও কাফ-মাসলের ইনজুরি থেকে নিজেকে বের করে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা তিনি করেছেন। ব্যাটিংও শুরু করেছিলেন। কিন্তু অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে থাকল, যখন রান নিতে গেলেন। শেষ পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ফিটনেস পরীক্ষায় হেরে গেলেন দলের অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার, তাই বদলি হিসেবে মাঠে নামানো হলো সাব্বির রহমানকে।

বাংলাদেশ ডুবেছে রোহিত শর্মার ইনিংসে; Image Source: AFP

ওয়ানডেতে বার্মিংহামে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ৩৩৭ রান, এসেছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ডের ব্যাটে। লক্ষ্য তাড়ার রেকর্ড আছে ভারতের, ৩০৬ রান। কিন্তু রেকর্ড তৈরি হয় রেকর্ড ভাঙবার জন্য। যেহেতু এবারের বিশ্বকাপে দুইবার ৩০০ রানের বেশি তাড়া করে ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ, তাই এই জায়গায় ভাবনার সুযোগ খুব বেশি ছিল না।

বলা হচ্ছিল, উইকেট সময়ের সাথে ভাঙবে, টার্ন পাবে স্পিনাররা। টস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো ম্যাচে। নিজেদের বাঁচামরার ম্যাচে তো আরও বেশি। কিন্ত এবারে শুরুতেই হারতে হল মাশরাফিকে, আগে ব্যাটিং নিল ভারত।

বারবার জয়ের খুব কাছে গিয়েও হেরে আসার ব্যাপারটি মাথায় ছিল বাংলাদেশের। শুরু থেকেই তাই সতর্ক সবাই। কিন্তু ভাগ্য যদি শুরুতেই মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাতে কার কি? হলোও তাই। সাকিবের দৃষ্টিকটু ফিল্ডিং দিয়ে শুরু, পঞ্চম ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানের বলে রোহিত শর্মার সহজ ক্যাচ ছেড়ে দিলেন তামিম ইকবাল। এতটাই সহজ ক্যাচ ছিল যে সেটি মিস করার পর তামিম ইকবালের অভিব্যক্তিও ছিল পাংশুটে। 

ভারতের দলীয় রান ছিল তখন কেবল ১৮। ক্যাস মিসের মাশুল বাংলাদেশকে এমনভাবেই দিতে হয়েছে যে, রোহিত শেষ পর্যন্ত থেমেছিলেন ১০৪ রানের ইনিংস খেলে। যখন ফিরলেন, ভারতের সংগ্রহ তখন ১ উইকেটে ১৮০। দিনশেষে ভারত ৯ উইকেটে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৩১৪ রান তুলেছিল।

শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে নিজের স্টক বল আর কাটারের শিকারে ফেলেছিলেন বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজ। একাই তুলে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। এর বাইরে সাকিব, মোসাদ্দেক আর সৌম্য সবাই নিয়েছেন একটি করে উইকেট।

লোকেশ রাহুল; Image Source: Getty Image

ভারতের বিপক্ষে মাশরাফির রেকর্ড বরাবরই ভালো। কিন্তু এবার ব্যর্থ তিনি। অবশ্য পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই সময়টা ভালো যাচ্ছে না তার। এখন পর্যন্ত পেয়েছেন মাত্র এক উইকেট, নাম লিখিয়েছেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বোলিং পারফরম্যান্সের সবচেয়ে উপরে। ভারতের বিপক্ষে ৫ ওভারে ৩৬ রান খরচ করার মধ্যে দিয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে খরচ করেছেন ৭ ইনিংসে ৩১৫ রান, সাথে একটিমাত্র উইকেট, যা যেকোনো বিশ্বকাপে সবচেয়ে বাজে বোলিং পারফরম্যান্স।

এই তালিকায় আরও আছেন শ্রীলঙ্কার অর্জুনা রানাতুঙ্গা (৬ ইনিংসে ২৪০ রান, ১ উইকেট; ১৯৮৭ বিশ্বকাপ), শ্রীলঙ্কার ভিনোথেন জন (৬ ইনিংসে ২২৬, ১ উইকেট; ১৯৮৭ বিশ্বকাপ), কেনিয়ার আসিফ করিম (৫ ইনিংসে ১৯৯, এক উইকেট; ১৯৯৯ বিশ্বকাপ) এবং শ্রীলঙ্কার থিসারা পেরেরা (৫ ইনিংসে ১৭৩ রান, ১ উইকেট; ২০১৯ বিশ্বকাপ)।

একাই পাঁচ উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ; Image Source: AFP

বাংলাদেশের বোলিং ব্যর্থতা বিশ্বকাপে নতুন নয়। দলের ব্যাটিং নিয়ে যতটা সন্তুষ্টির জায়গা রয়েছে, বোলিংয়ে রয়েছে ঠিক ততটাই দুশ্চিন্তা। এক রুবেল হোসেন ছাড়া দলে নেই আর কোনো জোরে বল করতে পারা বোলার। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মাশরাফিরা কেবল ন্যাড়া উইকেটে ব্যাটসম্যানদের জন্য শাপে বর হয়েছেন। আলাদা কেবল মুস্তাফিজুর রহমান। তার বলেও যে খুব গতি, তা নয়। তিনি টিকে আছেন নিজের বোলিংয়ে বৈচিত্র্যের জন্য। মোদ্দা কথা, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ভালো পেস বোলার সঙ্কটে ভুগছে।

এই সবকিছু মিলিয়েই রোহিত শর্মার সেঞ্চুরি, লোকেশ রাহুলের ৭৭ রানের ইনিংসে ভর করে ভারত ৩১৫ রানের ইনিংস শেষ করে।

২.

দুই ম্যাচে ৩০০ রান তাড়া করে জয়ের স্বাদ নেওয়া, দলে একাধিক অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান; সব মিলিয়ে জয়ের জন্যই মাঠ নেমেছিল বাংলাদেশ। বোলিংয়ে একের পর এক করা ভুলগুলো শুধরিয়ে নিয়ে ব্যাটে প্রতিফলন ঘটবে, সে আশায় বুক বেঁধেছিলেন তামিম ইকবালরা।

এই ম্যাচেও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি তামিম; Image Source: AP

কিন্তু এখানেও হতাশা। হার্দিক পাণ্ডিয়া, ভুবনেশ্বর কুমার, জাসপ্রিত বুমরাহ, যুযুবেন্দ্র চাহালদের সামনে বাংলাদেশ লড়েছে বটে, কিন্তু ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে পরিকল্পনাবিহীন। হতাশার শুরুটাও শুরু থেকেই। তামিম এবারও পারেননি বড় কোন ইনিংস খেলতে। ২২ রানে আউট হওয়ার পর সৌম্যের ইনিংস গড়িয়েছে ৩৩ অবধি। বরাবরের মতো এই ম্যাচেও হাফ সেঞ্চুরি পার করেছেন সাকিব আল হাসান। পুরো টুর্নামেন্টে ‘ওয়ান ম্যান শো’ দেখিয়ে চলা সাকিবকে বড়ই প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু ঠিক এদিনই… যতটুকু চাওয়া, তা হয়নি সাকিবের ব্যাটে। ৬৬ রানে থেমেছে তার ইনিংস। দলের অন্যান্য অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানরা যখন ফিরতি পথ ধরছে, তখন সাকিব কিছু একটা করবেন, সেই আশায় বুক বেঁধেছিল সবাই।

মুশফিক ২৪, লিটন ২২ রানে ফিরেছেন। বলা চলে মুশফিক, লিটন, সাকিব, মোসাদ্দেক ফেরার পরই জয় হাতছাড়া হওয়ার কথা ভাবতে থাকে বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ দলে নেই, তার বদলি সাব্বির আগে এক ম্যাচ সুযোগ পেয়ে শূন্য রানে ফিরেছিলেন। পুরনো বাজে অভিজ্ঞতা আবার এই ম্যাচে ফিরে যেন না আসে, সাব্বির সে কথা মনে রেখেই কি না খেললেন দেখেশুনে। সাইফউদ্দিনের সাথে গড়লেন ৬৬ রানের জুটি। ম্যাচে এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ৫০ রানের জুটি। সাব্বির ৩৬ রান করে আউট হয়েছিলেন। অন্যপ্রান্তে তখনও সাইফ একাই এগিয়ে নিচ্ছেন দলকে। সত্যি বলতে, বলের সাথে প্রয়োজনীয় রানের সঙ্গতি রেখেই এগোচ্ছিল সাইফের ব্যাট। প্রয়োজন ছিল শুধু অন্যপাশের সমর্থনের।

ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি পার করেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন; Image Source: Getty Image

দলের বাকি ব্যাটসম্যানরা সেটাই দিতে পারেননি তাকে। অভিজ্ঞ মাশরাফি এক ছক্কা হাঁকিয়ে পরের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন। অথচ চাইলেই উইকেটে সঙ্গ দিতে পারতেন। সেই জায়গা থেকে রুবেলকে অনেকটাই সফল বলা যায়, গড়েছিলেন ২৯ রানের জুটি। আর সাইফ পেয়ে গেলেন প্রথম আন্তর্জাতিক হাফসেঞ্চুরি। ইনিংসশেষে অপরাজিত ছিলেন এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার। 

শেষতক রক্ষা হয়নি। ৪৮তম ওভারে বাংলাদেশের ইনিংস থেমেছে ২৮৬ রানে। শেষ হয়েছে বিশ্বকাপের স্বপ্ন। ৫ জুন পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতার।

ম্যাচ হারের পিছনে কাজ করেছে অনেকগুলো ‘যদি’। সবগুলো যদি’র উপরে আছে তামিমের ক্যাচ মিস। তবে মাশরাফি বরং পক্ষেই সাফাই গাইলেন তার। ম্যাচ শেষে মাশরাফি বললেন,

‘আমরা চেষ্টা করেছি, ম্যাচটা আমাদের জিততেই হতো। একটা যদি ৮০-৯০ রানের জুটি আসতো, তাহলে ফল বদলে যেতে পারতো। আমাদের আসলে কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা দরকার ছিল। সাকিব দারুণ ফর্মে আছে, কাজেও লাগিয়েছে। মুশফিকও ভালো করেছে। রোহিত শর্মার ক্যাচ যখন তামিম ছেড়ে দিল, তখন সবাই হতাশ হয়েছে। এটা হতাশাজনকই। কিন্তু এই ধরণের ব্যাপারগুলো ক্রিকেটে হয়, মেনে নিতে হয়। আমরা ভালো খেলার চেষ্টা করেছি, আমাদের সেরাটা দিয়েছি। সমর্থকরা অনেকখানি সাহায্য করেছে।’

বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটি ছিল সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই, ভারতের জন্যও তাই। বাংলাদেশের বিপক্ষে জিতে অস্ট্রেলিয়ার পর দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে তারা। তবে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়টাও সহজ ছিল না, মানছেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি

বলেছেন,

‘এবারের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ খুব ভালো খেলেছে। আজকে শেষ বল পর্যন্ত তারা চেষ্টা করে গেছে। অবশ্যই সেমিফাইনালে কোয়ালিফাই করতে পেরে ভালো লাগছে। আজ দলের বোলাররা নিজেদের কাজটা করেছে বলেই কাজটা সহজ হয়েছে।’

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হবে আজ পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। যে স্বপ্নের পাখি উড়ে এসেছিল ইংল্যান্ডে, তা পুড়ে গেল হতাশার আগুনে।

This is an article based on Bangladesh vs India match in WC2019. All necessary link has been hyperlinked. 
Feature Photo: 

Related Articles

Exit mobile version