১.
শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট দল সুনীল গাভাস্কারদের যুগ থেকেই প্রসিদ্ধ ছিলো। বর্তমানেও বিরাট কোহলি, চেতেশ্বর পূজারা এবং আজিঙ্কিয়া রাহানেদেরকে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের মিডল অর্ডার বেশ শক্তিশালী। ঘরের মাটিতে ভারতের ওপেনাররাও দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আসছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতীয় ওপেনাররা নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না। এই দেশগুলোতে ভারতীয় ওপেনাররা আট বছর আগে শেষবারের মতো উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে শতরান যোগ করেছিলেন। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেঞ্চুরিয়ান টেস্টে বীরেন্দর শেহওয়াগ এবং গৌতম গম্ভীর উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১৩৭ রান যোগ করেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐ সিরিজ শেষ হওয়ার পর এই দেশগুলোতে বক্সিং-ডে টেস্টের আগপর্যন্ত ভারতীয় ওপেনাররা ৬২ বার ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে মাত্র সাতবার অর্ধশতাধিক রানের জুটি গড়তে সক্ষম হয়েছেন। সর্বোচ্চ রানের জুটি ছিলো মাত্র ৬৩ রানের। এই সময়ে ভারতীয় ওপেনাররা উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে মাত্র ২১.০৩ গড়ে রান তুলেছেন। গড়ে তাদের জুটির স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র ৩৯ বল কিংবা ৬.৩ ওভার। গত ৮ বছরে এই দেশগুলোতে ভারত নয়টি টেস্ট সিরিজ খেলেছে। এই নয় ম্যাচের মধ্যে মাত্র এক সিরিজে ভারতীয় ওপেনাররা গড়ে ৫০ বল করে খেলেছেন এবং গড়ে ৩০ রান করে সংগ্রহ করেছেন।
এই পরিসংখ্যানগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতীয় ওপেনাররা গত প্রায় আট বছর ধরে দলকে শুভসূচনা এনে দিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তারা শুধুমাত্র প্রতিকূল পরিবেশে ব্যর্থ হয়েছেন। চেনা পরিবেশে তারা ঠিকই দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছেন। এই একই সময়ে এশিয়ার মাটিতে ভারতীয় ওপেনাররা ৭৫ ইনিংস গোড়াপত্তন করে ৪৮.২৭ গড়ে রান তুলেছেন। শত রানের জুটি গড়েছেন আটবার। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, ভারতীয় ওপেনাররা শুধুমাত্র প্রতিকূল পরিবেশে নতুন বল সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সময়ের হিসেবে সেটা প্রায় আট বছর। শেষ দুই উইকেট ব্যতীত যেকোনো উইকেটে গড়ে ভারতের সবচেয়ে কম রানের জুটির রেকর্ড তাদের ওপেনারদের দখলে।
২.
এই সময়ে ভারতের হয়ে নয়টি ভিন্ন জুটি ইনিংস উদ্বোধন করেছে। এদের মধ্যে কোনো জুটিই বেশিদিন টিকতে পারেনি। প্রায় প্রতি সিরিজেই রদবদল করতে হয়েছিলো ম্যানেজমেন্টকে। ৬২ ইনিংসের মধ্যে মাত্র তিনবার ভারতীয় ওপেনাররা ১৫ ওভারের বেশি উইকেটে টিকেছিল। ৬২ বারের মধ্যে ৩০ বার ইনিংসের প্রথম পাঁচ ওভারেই ওপেনিং জুটি ভেঙেছিল, যার মধ্যে নয়বার ইনিংসের প্রথম ওভারেই উইকেট খুইয়েছে ভারত। মাত্র ১৬ বার দশ ওভারের বেশ টেকসই হয়েছিলেন ভারতীয় ওপেনাররা। এবং মাত্র ২৫ বার উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে বিশোর্ধ্ব রান করেছিলেন ওপেনাররা।
পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, এশিয়ার মাটিতে ইনিংস উদ্বোধন করার চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইনিংস উদ্বোধন করা বেশি কঠিন। কারণ এসব দেশে পেসাররা নতুন বলে বাড়তি সুইং এবং পেস আদায় করে নেয় পিচ থেকে, যার কারণে ওপেনাররা শুরু থেকেই চাপে থাকেন, যে চাপটা এশিয়ার মাটিতে অনুভব করতে হয় না।
অন্যান্য এশীয় দলগুলোর চেয়ে ভারত একটু বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। কারণ এই চার দেশে ভারত নিয়মিত সফর করে। ফলে ক্রিকেটাররা মানসিক এবং শারীরিকভাবে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার বাড়তি সময় পেয়ে থাকেন। ২০১১ সালের জুনের পর থেকে ভারত এই চার দেশে ৩১টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে, যেখানে শ্রীলঙ্কা খেলেছে ১৯ ম্যাচ, পাকিস্তান ১৪ ম্যাচ এবং বাংলাদেশ মাত্র ৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ পেয়েছে।
কম সুযোগ পাওয়ার পরেও এই চার দেশে ভারতীয় ওপেনারদের চেয়ে শ্রীলঙ্কার ওপেনাররা ভালো নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। এই সময়ে তাদের ওপেনাররা উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে গড়ে ২৯.৩১ রান সংগ্রহ করেছেন এবং গড়ে প্রতি ইনিংসে ৬৩ বল মোকাবেলা করেছেন। ভারতীয় ওপেনারদের থেকে প্রতি ইনিংসে ২৪ বল বেশি খেলেছেন শ্রীলঙ্কার ওপেনাররা। পাকিস্তানী ওপেনারদের গড় রান কম হলেও তারা প্রতি ইনিংসে ৫৩ বল মোকাবেলা করেছিলেন। পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার ওপেনাররা কমপক্ষে এমন একটি সিরিজ খেলেছেন, যেখানে তাদের ওপেনাররা গড়ে ৪৫ রান করে সংগ্রহ করেছেন, যেখানে এক সিরিজে ভারতীয় ওপেনারদের সর্বোচ্চ গড় ৩১ এর কাছাকাছি।
৩.
দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয় ওপেনাররা সবসময় ব্যর্থ হয়েছেন তা কিন্তু না। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতীয় ওপেনাররা এই চার দেশে ৪০ ইনিংস ব্যাট করে ৪৩.১২ গড়ে রান সংগ্রহ করেছেন। শতরানের জুটি গড়েছিলো পাঁচবার। সেইসময় ওয়াসিম জাফর-দীনেশ কার্তিক, আকাশ চোপড়া-বীরেন্দর শেহওয়াগ এবং গৌতম গম্ভীর-বীরেন্দর শেহওয়াগের জুটির কল্যাণে ভারত শুভসূচনা পেতো।
ওয়াসিম জাফর এবং দীনেশ কার্তিক সাতবার ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে দুবার শতরানের এবং একবার অর্ধশত রানের জুটি গড়েন তারা। সাত ইনিংসে ৬৭.৮৫ গড়ে তারা ৪৭৫ রান তুলেছেন। সর্বোচ্চ ১৫৩ রানের জুটি গড়েছিলেন তারা।
আকাশ চোপড়া এবং বীরেন্দর শেহওয়াগ আটবার ইনিংস উদ্বোধন করে দুবার শতরানের এবং দুবার অর্ধশত রানের জুটি গড়েছিলেন। সর্বোচ্চ ১৪১ রানের জুটি গড়েছিলেন তারা। আট ইনিংসে ৫৭.৩৭ গড়ে তারা ৪৫৯ রান যোগ করেছিলেন। এছাড়া এ সময়ে শেহওয়াগ এবং গম্ভীর নয়বার ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে ৪২.৮৮ গড়ে ৩৮৬ রান সংগ্রহ করেছেন।
২০১১ সালের জুলাইয়ের পর থেকে এই চার দেশে ভারতের হয়ে বেশিরভাগ সময় ইনিংস উদ্বোধন করেছেন মুরালি বিজয়, শিখর ধাওয়ান এবং লোকেশ রাহুল। কিন্তু কেউই ধারাবাহিকভাবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিতে পারেননি। সবচেয়ে বেশি ২৪ বার শিখর ধাওয়ান এবং মুরালি বিজয় ইনিংস উদ্বোধন করেছেন। এই ২৪ ইনিংসে তারা মাত্র তিনবার অর্ধশত রানের জুটি গড়েছেন তারা। এই দুজন মাত্র ২৬.২০ গড়ে রান তুলেছেন।
এছাড়া লোকেশ রাহুল এবং মুরালি বিজয় ১১ বার ইনিংস উদ্বোধন করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চলতি টেস্ট সিরিজের প্রথম দুই টেস্টেও এই দুজন ইনিংস উদ্বোধন করেছিলেন। আশানুরূপ শুরু এনে দিতে না পারার কারণে দুজনকে বক্সিং-ডে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই দুজন ১১ বার ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে মাত্র ১৫.০৯ গড়ে ১৬৬ রান তুলেছিলেন।
৪.
২০০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই চার দেশে ভারত ২০টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ছয়টি টেস্টে জয় পেয়েছিলো এবং ছয়টিতে পরাজিত হয়েছিলো। জয়-পরাজয়ের হার সমান ছিলো ঐ সময়। কিন্তু বর্তমান সময়ে ৩১ টেস্টের মধ্যে ভারত মাত্র চারটিতে জয় পেয়েছে এবং ২২টি টেস্টে পরাজিত হয়েছে।
শুধুমাত্র উদ্বোধনী উইকেট জুটির উপর ভর করে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান এত বেশি হয়েছে তা বলা যায় না। ক্রিকেট একটি দলগত খেলা। এখানে যেমন শুধুমাত্র একটি দিক ভালো করে জয় পাওয়া যায় না, তেমনি মাত্র একটি জুটির জন্য পরাজিত হয় না।
কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ওপেনাররা ভালো শুরু এনে দিলে মিডল অর্ডারে নামা ব্যাটসম্যানদের জন্য ব্যাটিং করাটা তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। শেহওয়াগ-গম্ভীরদের যুগে ভারত যে ছয়টি টেস্ট জিতেছিল তার মধ্যে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে গড়ে ৫৫ রান এসেছে। পরাজিত হওয়া ম্যাচগুলোতেও তারা খারাপ করেননি। তখন তারা গড়ে ৪১.৯১ রান সংগ্রহ করেছিলেন, যা বর্তমানে চারটি জয় পাওয়া ম্যাচ থেকেও বেশি। সময়ের হিসাবে গত সাড়ে সাত বছরে এই চার দেশে ভারত যে চারটি টেস্ট জিতেছিলো, ঐ ম্যাচগুলোতে ভারতীয় ওপেনাররা গড়ে ৩২.৬২ রান সংগ্রহ করেছেন। এবং পরাজিত হওয়া ২২ ম্যাচে তাদের ব্যাটিং গড় মাত্র ১৮.২৭।
যখন কোনো দলের ওপেনাররা উইকেটে বেশি সময় কাটান, তখন দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা পিচের গতিবিধি বোঝার জন্য বেশি সময় পান। সেই সাথে নতুন বল পুরাতন হওয়ার বিষয়ও আছে। বিজয়, রাহুলরা যেসব ম্যাচে দশ ওভারের বেশি ব্যাটিং করেছেন, সেসব ম্যাচে অন্যান্য উইকেট জুটিতে গড়ে ২৯.২৫ রান তুলেছিল ভারত। আর যেসব ম্যাচে তারা দশ ওভার অতিবাহিত হওয়ার আগেই সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন, সেসব ম্যাচে অন্যান্য উইকেট জুটিতে ভারতের রান সংখ্যা ২ রান করে কম এসেছিল।
মুরালি বিজয় এবং লোকেশ রাহুল অ্যাডিলেড টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ৬৩ রান যোগ করলেও পার্থ টেস্টে দুজনেই বড় ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হন। ফলে বক্সিং-ডে টেস্টের জন্য একাদশে ডাক পান মায়াঙ্ক আগারওয়াল। তার সাথে ইনিংস উদ্বোধন করেন হনুমা বিহারী। এই দুজনের জুটি রানের দিক থেকে বেশি বড় ছিলো না ঠিকই, কিন্তু নতুন বল সামলানোর দায়িত্বটা ভালোভাবেই পালন করেছিলেন তারা। প্রথম ইনিংসে এই জুটি ১১৩ বলে ৪০ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৮ বলে ২৮ রান যোগ করেছিলেন। মায়াঙ্ক আগারওয়াল দুই ইনিংসেই যেভাবে ব্যাট করেছেন, তাতে ভারত কিছুটা আশার আলো দেখছে। কারণ তিনি বেশ কয়েকবছর ধরেই ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। সেই সাথে ইনজুরি কাটিয়ে পৃথ্বী শ’ এই চার দেশে কীরকম নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, সেদিকেও চোখ থাকবে সবার।