ক্রিস জর্ডানকে শেষের ওভারগুলোতে বল দেয়া কতখানি যৌক্তিক?

ক্রিস জর্ডান সেদিন শেষ ওভারে ৩০ রান দিয়েছেন।

আরে মশাই, তা তো দিতেই পারেন। আইপিএলে তো এক ওভারে ৩৭ রান দেবার রেকর্ডও আছে। এই দিনদুয়েক আগেই তো লুঙ্গি এনগিডি ২ বলে ২৭ রান হজম করেছিলেন, তা-ও কি ভুলে গিয়েছেন সাততাড়াতাড়ি? জর্ডানের বেলায় তো ব্যাটিংপ্রান্তে তা-ও মার্কাস স্টইনিস ছিলেন, লুঙ্গি এনগিডি তো হয়েছিলেন জফরা আর্চারের শিকার। বুমরাহও সেদিন শেষ ওভারে চার ছক্কা খেলেন প্যাট কামিন্সের সূত্রে। শেষ ওভারে মার কে না খায়! আর এমনও তো না যে ক্রিস জর্ডান শেষের ওভারগুলোতে নিয়ম করেই খারাপ করছেন, বরং তাকে তো ডেথ ওভারে সময়ের সেরাদেরই একজন বলা চলে।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। এর পূর্ব অব্দি যা বলছিলেন, তার সঙ্গে আমার মতের কোনো বিরোধ নেই, ডেথ বোলিংয়ে কে কোনদিন উদোম কেলানি খাবেন, এর নিশ্চয়তা এই দৈবলোকের কে-ই বা দিতে পারেন! কিন্তু আপনি জর্ডানকে ‘ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট’ বলেই তো বাঁধিয়ে দিলেন বিতর্ক। ক্রিস জর্ডানকে স্লগ ওভার বিশেষজ্ঞ মানতে যে আমার ভয়াবহ আপত্তি! শেষের ওভারগুলোতে তাকে ভরসা করাটা ঠিক যৌক্তিক নয় আমার চোখে।

এমন সোয়া নয় ইকোনমি যার, তাকে আপনি ডেথ ওভারে বল করাবেন? Image credit: Cricviz

ধৈর্য্যহারা হবেন না পাঠক, যুক্তিগুলো পেশ করছি আপনার সামনেও। জর্ডানকে ভালো মানবেন কি খারাপ, সে নাহয় এরপরই বিচার করবেন!

***

সব ছেড়েছুড়ে নজরটা যদি প্রথমে সরল কিছু পরিসংখ্যানেই দিই, তবে পাচ্ছি, সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এক ডোয়াইন ব্রাভোই শেষ পাঁচ ওভারে বল করেছেন জর্ডানের চেয়ে বেশি। সময়সীমা যদি ছোট করে এঁটে ফেলা হয় ২০১৯-য়ের শুরু হতে এখন পর্যন্ত ফ্রেমে, জর্ডানের চাইতে বেশি বল করেননি আর কেউ। মানেটা যা দাঁড়াচ্ছে, শেষের ওভারগুলোতে জর্ডানকে ভরসা করছেন প্রায় সব অধিনায়কই। কিন্তু এই ভরসার প্রতিদান কি জর্ডান দিতে পারছেন?

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে শেষ পাঁচ ওভারে ওভারপ্রতি রান উঠেছিল ৯.১১ করে, জর্ডানের ক্ষেত্রে যা বেড়ে যাচ্ছে ০.২২ রান করে। ২০১৯ থেকে হিসেব করলে জর্ডানের নিম্নগামী গ্রাফটা স্পষ্ট হচ্ছে আরও। এ সময়টায় কমপক্ষে ১৫০ বল করেছেন এমন বোলাররা শেষের ওভারগুলোতে ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৮.৯৯ করে, জর্ডানের ক্ষেত্রে যা বেড়ে হয়ে যাচ্ছে ৯.৮১। যে ৮২ বোলার দেড়শ’র বেশি বল করেছেন, তার ভেতরে জর্ডানের চাইতে বেশি খরুচে ছিলেন মাত্র ১৮ জন।

Image credit: Cricviz

কিন্তু আজকাল তো টি-টোয়েন্টি খেলছে ১০৬ দেশ, সঙ্গে যোগ করুন নানা প্রান্তের টি-টোয়েন্টি লিগ। বিপিএলের মতো কোথাও কোথাও খেলা হচ্ছে খুবই ধীরগতির উইকেটে, রান তোলা যেখানে ভীষণ দুরূহ। আবার কেউ কেউ শেষ ওভারে বল করছেন লেজের ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে, রান তোলার কাজটা যাদের পক্ষে দুরূহ। জর্ডানকে তাই ইকোনমির মতো সরল পরিসংখ্যান দিয়ে যাচাই করাটা অনুচিতই হবে।

ক্রিকভিজ তাই জর্ডানকে বিচার করতে খুঁজে নিয়েছে বোলিং ইম্প্যাক্ট মডেল। পিচ, ব্যাটসম্যান, বাউন্ডারি তথা গোটা ম্যাচ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জর্ডানকে তারা তুলনা করেছে সমসাময়িক অন্য বোলারদের সঙ্গে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মাঝের কেবল ২০১৬-১৮ সময়সীমাতেই জর্ডান শেষ ওভারগুলোতে ভালো করতে পেরেছিলেন অন্য বোলারদের চেয়ে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে কিংবা সম্প্রতি জর্ডানের ডেথ বোলিং পারফরম্যান্স গ্রাফ হিমাঙ্কের সামান্য নিচে।

Image credit: Cricviz

এমনকি টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে খেলে বেড়ানো অন্য ইংরেজ বোলারদের পরিসংখ্যান টেনেও যদি তুলনা করা হয়, জর্ডানকে মুখ লুকোতে হচ্ছে সেখানেও।  ২০১৮ সালের শুরু থেকে শেষের ওভারগুলোতে কমপক্ষে দেড়শ’ বল করেছেন, এমন বিলেতি বোলারদের মধ্যে জর্ডানের বোলিংই ছিল সবচেয়ে বাজে।

Image credit: Cricviz

এবং এসব পরিসংখ্যান দেখে আপনি অবধারিতভাবেই যে প্রশ্নটা তুলতে পারেন, এসব জিনিস নিশ্চয়ই জর্ডানের অধিনায়ক কিংবা ম্যানেজমেন্টের অজানা নয়। জর্ডানের প্রতি তবুও ওরা ভরসা রাখছে কেন শেষ ওভারে?

একদম পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবনাটি হয়তো বা বলতে পারছি না, তবে কিছুটা অনুমান তো করতেই পারি। ‘শেষের ওভারগুলোতে বল করতে গেলে ইয়র্কার করতে পারতে হবে’, এই চিন্তাধারণাটা চলে আসছে সাদা বলের ক্রিকেট শুরুর সময় থেকেই। আর ইয়র্কার দেবার কাজটা যে জর্ডান বেশ ভালোই পারেন, তা তো তার ৬০ শতাংশ বলকেই ইয়র্কার লেংথে ফেলবার চেষ্টা থেকে বোঝা যায়। স্বীকৃত ডেথ বোলারদের ভেতরে এক লাসিথ মালিঙ্গা আর থিসারা পেরেরাই যে চেষ্টাটি করেছিলেন তার চেয়ে বেশি।

Image credit: Cricviz

কিন্তু, এই চেষ্টায় সঙ্গে সফলতারও তো যোগ থাকা চাই। আর ইয়র্কারের চেষ্টা করা বলগুলো খানিকটা এদিক-ওদিক হলেই বল হয়ে যেতে পারে হাফভলি কিংবা ফুলটস। জর্ডানের বোলিং বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে এবং বেশ ভালোরকমভাবেই হচ্ছে। যে ৬০ শতাংশ বলকে তিনি স্ট্যাম্প থেকে ১-২ মিটারের দূরত্বে (একেই তো আমরা ইয়র্কার লেংথ বলি) ফেলতে চেয়েছিলেন, তার মাত্র ৯ শতাংশেই তিনি সফল হয়েছিলেন। বাকি ১৭ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল ফুলটস এবং এর দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল হাফভলি।

এবং জর্ডানের হাফভলি আর ফুলটস পেয়ে ব্যাটসম্যানরা কী করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরিসংখ্যানে। স্লটের বলগুলোতে রান তুলেছেন ওভারপ্রতি ৯.১০ করে, ফুলটসের বলগুলোতে আরেকটু বেড়ে যা হয়ে গিয়েছে ১০.২১। একদম নিখুঁত ইয়র্কার লেংথে ফেলে যে রান দিচ্ছেন মাত্র ৫.১১ করে, তা তো যোগ্যতা হারাচ্ছে ওই হাফভলি আর ফুলটসের আধিক্যের কারণেই!

প্রসঙ্গত প্রশ্ন চলে আসছে আরেকটি। ইয়র্কার দেবার চেষ্টার সঙ্গে স্লগ ওভার বিশেষজ্ঞকে মিলিয়ে ফেলাটাও আজকের ক্রিকেটে যৌক্তিক হচ্ছে কি? কেননা, আমরা যদি টাইমাল মিলস কিংবা হ্যারি গার্নির দিকে দৃষ্টি দিই, দুজনেই বল করছেন বেশ ভালো ইকোনমিতে, কিংবা ম্যাচে প্রভাব রাখছেন বেশ। ডেথ ওভারে মিলসের ওভারে ব্যাটসম্যানরা রান তুলতে পারছেন কেবল ৭.৫ করে, এক ওয়াহাব রিয়াজের বলেই ব্যাটসম্যানদের রান তুলতে কষ্ট হচ্ছে এর চেয়ে বেশি। আবার ওয়াহাব রিয়াজের সঙ্গে জসপ্রিত বুমরাহকেও যদি হিসেবের বাইরে রাখা হয়, গার্নির চেয়ে শেষের ওভারগুলোতে প্রভাব রাখতে পারেননি অন্য কোনো বোলার। গার্নি আর মিলসের এই সাফল্যই আঙুল তুলছে শেষের ওভারগুলোতে ইয়র্কারের কার্যকারিতার দিকে। কেননা, দুজনেরই মূল অস্ত্র কাটার, নাকল বল, অথবা ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার। দু’জনেই ইয়র্কারের চাইতে বেশি মন দিয়েছেন পেসের বৈচিত্র‍্যের দিকে। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে সবচেয়ে কম সংখ্যক ইয়র্কার দেবার চেষ্টা করেছেন মিলস, সে তালিকায় আছেন কাগিসো রাবাদা, অ্যান্ড্রু টাই কিংবা কেন রিচার্ডসনের মতোন টি-টোয়েন্টির হটকেকরাও।

Image credit: Cricviz

***

জর্ডানকে ডেথ বোলার স্পেশালিস্ট হিসেবে এরপরও যে উঁচুশ্রেণিতে রাখা হচ্ছে, তার কারণ বোধহয় ইংল্যান্ডের হয়ে কিংবা ইংল্যান্ডের লিগে তার পারফরম্যান্স; ঠিক অনেকটাই ডেভিড মালানের মতো। সাসেক্সের পক্ষে তার বোলিং ম্যাচে প্রভাব ফেলছে ১.৯ রান করে, ইংল্যান্ডের হয়ে যা কিছুটা বেড়ে পৌঁছুচ্ছে ২.৩-য়ে। বিশ্বজুড়ে আর যেসব দলের হয়ে ক্রিস জর্ডান কমপক্ষে ৫ ম্যাচ খেলেছেন, কোথাও প্রভাব রাখতে পারেননি এত বেশি; বরং কিছু দল তো তাকে টেনে ভুল করেছিল বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সেসব ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগের ক’টার খবরই বা ইংল্যান্ডের দর্শক-সমর্থকেরা, এমনকি সাংবাদিকেরাও রাখেন?

Image credit: Cricviz

ইংল্যান্ডের হয়ে জর্ডানের পারফরম্যান্স তো তাই ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে না। ইংল্যান্ডের বর্তমান অধিনায়ক নিজেও তো জর্ডানের গুণগ্রাহী। আজকাল ইংল্যান্ড দলে ডাক পাবার যে পূর্বশর্ত ‘ব্যাটিংটা জানাই লাগবে’, জর্ডান সে শর্তও পূরণ করেন বেশ ভালোভাবে। সঙ্গে ফাস্ট বোলারদের বিপরীত চরিত্র হয়ে জর্ডান একজন দুর্দান্ত ফিল্ডারও। কতটা দুর্দান্ত, তা বুঝতে ক্রিকভিজের গবেষণায় পাওয়া ওই ‘বর্তমান বিশ্বের সেরা টি-টোয়েন্টি ফিল্ডার’ লাইনটিই বোধহয় যথেষ্ট। তিনি বরাবরই ফিল্ডিং করছেন হট জোনে; অর্থাৎ তিনি যেখানে দাঁড়াচ্ছেন, ব্যাটসম্যানরা বেশিরভাগ বল মারছেন সেদিকেই। এর অনুবাদ করা যাচ্ছে এমনভাবে, অধিনায়ক তার ওপর ভরসা পাচ্ছেন ব্যাটসম্যানের শক্তিমত্তার জায়গায় দাঁড় করাতে।

এমনই দুর্দান্ত সব ক্যাচ ধরেন জর্ডান; Image credit: Getty Images 

সাত-আটে ব্যাটিং করে খানিকটা রান এনে সক্ষম, সঙ্গে সিমার হয়েও দুর্দান্ত ফিল্ডার, ক্রিকেটার হিসেবে জর্ডানের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। কিন্তু পাঠক, প্রসঙ্গ যদি হয় শুধুই ডেথ বোলিং, ক্রিস জর্ডানকে সেরার কাতারে রাখবার সুযোগটি আছে কি?

This article is in Bangla language. This article is an analysis of Chris Jordan's death-over bowling. Necessary references are hyperlinked inside.

Featured Image © Stu Foster/ Getty Images.     

Related Articles

Exit mobile version