ঈশ্বর,
ছেলেবেলার সবটুকু মনে নেই, জীবনের সবকিছু মনে রাখবার ক্ষমতা তো তুমি মানুষকে দাওনি। প্রশ্নটা তাই তোমাকেই করছি, কখনো কি আমি পাখি হতে চেয়েছিলাম? ঝড়ের পরমুহূর্তে আশ্চর্য নীরব শূন্য প্রান্তরে, গাছের ভাঙা ডালে স্থির হয়ে বসে থাকা পাখি? চেয়েছিলাম বোধহয়, নইলে অমন ঘূর্ণিঝড়ে আমায় তুমি ফেলবে কেন! নাকি তুমি আমায় একটু বেশিই ভালোবাসো? বারেবারে তাই পরীক্ষায় ফেলে দাও।
আরও একবার তোমার ফেলা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, ইংলিশ সামারে ৭৭৪ রানে ক্রিকেট দর্শকদের আবিষ্ট করে, আমি ফিরলাম তোমার কাছে৷ তোমায় চিঠি লিখতে। তোমার পরীক্ষা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত।
স্রষ্টা,
প্রথম যখন ডানা মেলে উড়বার চেষ্টা চালিয়েছিলাম, তখন থেকেই তো পরীক্ষায় ফেলছো। বয়সভিত্তিক কিংবা রাজ্যদলে আমার লেগ স্পিন দেখে নামের আগে‘শেন ওয়ার্নের উত্তরসূরী’ তকমা লাগিয়েছিল অনেকে। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, স্বয়ং ওয়ার্নই তো আমার টেস্ট অভিষেকের ঠিক পূর্বে আমায় নিয়ে উচ্ছ্বাস ঝরিয়ে এক লেখা লিখে ফেললেন! আমার বোলিং কেমন হচ্ছে, কী করলে আরও ভালো হবে, আমায় নিয়ে তিনি কতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, এসব নিয়েই লিখেছিলেন আরকি। তিনি তো আর জানতেন না, তার কথা মাথায় এলে আমার সবকিছু ছাপিয়ে ওই এক সংখ্যাতেই জীবন ঘুরপাক খায়, ৭০৮!
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ারও বোধহয় আরেকজন ওয়ার্ন পাওয়ার অপেক্ষায় তর সইছিল না। নইলে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে আমার চার সেঞ্চুরি ছাপিয়ে তারা কেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমার সাত উইকেট প্রাপ্তিকেই আমলে নেবেন? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অমন ৪৮ ছাড়ানো স্পিনারকে দলের এক নাম্বার স্পিনার হিসেবে মাঠে নামানোর জন্যে তারা এত তাড়াহুড়ো করবেন কেন?
অত প্রত্যাশা আর চাপ নিয়ে খেলতে গিয়ে আমি যেন স্পিন বোলিংটাই ভুলে গিয়েছিলাম। মাত্র যৌবনে পা রাখা ২১ বছরের আমি কতটুকুই আর চাপ নিতে শিখেছিলাম বলো! টেস্টের আঙিনায় প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নিলেও পরের চার ইনিংসে যখন আমি রইলাম উইকেটশূন্য, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও বুঝে গিয়েছিল, আমার লেগ স্পিনটা দিয়ে তাদের হচ্ছে না। ফলাফল, একদিবসী বিশ্বকাপ খেলা হলো না তেমন করে, টেস্ট দল থেকে নির্বাসন! অথচ, হেডিংলিতে কিন্তু আমার ৭৭ রানের এক ইনিংসও ছিল!
বেশ বড়সড় এক ধাক্কাই খেয়েছিলাম তখন। আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি, সে তো এই খেলাটার কারণেই। অথচ, শুরু হতেই তা শেষ হয়ে যাবার উপক্রম। সেই থেকেই তো শুরু আমার ভালোবাসার পরীক্ষা!
হে ভাগ্যদেবতা,
অতটুকুন বয়সে বেশ বড়সড় এক আঘাতই দিয়েছিলে। মানুষের বদলে যাওয়া স্বভাবের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল তখনই। কিছুদিন পূর্বেই আমায় নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া মানুষগুলোও ভোল পাল্টে বলে ফেললো,
‘ওর(স্মিথ) দৌঁড় এই পর্যন্তই ছিল!’
বোলিংটাকে একপাশে রেখে এগোতে চাইলাম ব্যাটিংয়ে, সেখানেও তাদের আপত্তি। টেকনিকটা নাকি আমার নিখুঁত নয়!
আমিও অবশ্য এই ব্যাপারটায় তাদের সঙ্গে একমত। এই কথা তো সেই শুরুর দিন থেকেই শুনে এসেছি। ক্রিকেটের শেষ কথা মানা হয় যেই এমসিসিকে, সেই এমসিসির শেখানো টেকনিকের কোনো টোটকাই তো দেখা যায় না আমার ব্যাটিংয়ে। এমসিসি বলছে, বল দেখার সময় নড়বে না। আমার তো ইয়া বিশাল এক ট্রিগার মুভমেন্ট ছাড়া ব্যাটিংটাই আসে না। স্ট্যান্স থেকে শুরু করে ব্যাটের গ্রিপ, এমসিসির ব্যাকরণ কোনো জায়গাতেই আমার ক্ষেত্রে খাটে না। কিন্তু আমাকে একেবারেই বাতিল করে দেয়া কি ঠিক হয়েছিল তাদের? প্রত্যেকটি মানুষই স্বতন্ত্র, নিউ সাউথ ওয়েলসের মানুষগুলো কি জীবনের এই পাঠ পাননি তাদের স্কুলে?
বিধাতা,
আমার জীবনে ট্রেন্ট উডহিলকে কি তুমি দেবদূত হিসেবে পাঠিয়েছিলে? স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় থেকে আমার ‘অদ্ভুতদর্শন’ ব্যাটিংকে শাণিত করা, জীবনের সবভাগেই তো এই মানুষটি ছায়ার মতো লেগে ছিলেন আমার সঙ্গে। আজ যেহেতু মনের অর্গল খুলে লিখতেই বসেছি, কখনোই না বলা ধন্যবাদটা কি ওনাকে জানিয়ে দেব এই চিঠিতেই? থাক, তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সাধ্য কোথায় ওই চার অক্ষরের শব্দের!
কিছুদিন আগ অব্দিও ২০১১-১২ সালের সে সময়টাকেই মনে হতো জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়। ঈশ্বর, তোমার কৃপায় তা বেশ সার্থকতার সঙ্গেই উৎরেছিলাম। অমন আনঅর্থোডক্স টেকনিক নিয়েও আমায় তুমি রান করবার ক্ষমতা দিয়েছিলে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে হোমওয়ার্ক কেলেঙ্কারি এনেছিলে!
কোচের দেয়া বাড়ির কাজ কীভাবে নিজের খেলায় আরও উন্নয়ন আনা যায়, সেটা না লেখার কারণে দেশে ফেরত আসতে হয়েছিল ওয়াট্টো(শেন ওয়াটসন), জনসন (মিচেল), প্যাটি (জেমস প্যাটিনসন), আর উসমান খাজাকে। উপায়ান্তর না দেখে আমাকে নামতে হয়েছিল পাঁচে, যা হয়ে গিয়েছিল আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট!
পাঞ্জাবে করেছিলাম ৯২, বোধহয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সেই প্রথম বুঝেছিল, ‘শেন ওয়ার্ন নয়, চাইলে আমরা একজন ভালো ব্যাটসম্যান পেতে পারি!’ আমার ভাঙা ডানা আবার জোড়া লাগিয়ে দিলে তুমি, আমি যেন এগিয়ে চলতে শুরু প্রথম শতক পেতে অপেক্ষা ছিল ১২ টেস্টের। পরের ২২টি এসেছিল ৪৮ টেস্টে। এর চেয়ে দ্রুতগতিতে ২৩ শতক তুলতে পেরেছিলেন একজনই। ৬০ টেস্ট শেষে গড় পৌঁছেছিল ৬৩.৫৫-তে। এর চেয়ে ভালো গড় নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পেরেছিলেন গোটা ক্রিকেট ইতিহাসেই একজন। ৯৯.৯৪ বললেই তো হলো, নাম বলবার প্রয়োজন আছে কি?
তার ওই গড় যে অবিনশ্বর, ধরার সকলে এ নিয়ে প্রায় নিঃসংশয়। যে সামান্যতম সংশয়টুকু আছে, সে কেবল ওপরে তুমি আছো বলেই! আমি অবশ্য ধরেই নিয়েছি, ৬৩ গড়টাকে ১০০ অব্দি পৌঁছানোর সাধ্যি আমার নেই। তাই বলে ব্র্যাডম্যানকে ছাপিয়ে যাবো, এমন চিন্তা যে করিনি, তা কিন্তু নয়।
খুব কাছে তো পৌঁছেও গিয়েছিলাম। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে যখন টেস্ট ব্যাটসম্যানদের র্যাঙ্কিং জানানো হলো, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! ৯৪৭ রেটিং নিয়ে আমি সবার ওপরে, ব্র্যাডম্যানের ৯৬১ রেটিংকে ছাড়িয়ে যেতে আর ১৫ পয়েন্টের অপেক্ষা!
অপেক্ষা প্রতীক্ষায় মোড় নিল। পৃথিবীতে ২৪ মার্চ, ২০১৮ এল।
তখন আমার মস্তিষ্কে আসলে ঠিক কি চলছিল, আমি জানি না। শুধু জানতাম, ‘জিততেই হবে!’ এই তীব্র জিঘাংসা তো এমন ‘ব্রেইনফেড’-এ আমায় অযাচিতভাবেই ঠেলে দিয়েছিল! পুনের ঘটনাটাও এই ফাঁকে মনের কোণে উঁকি দিয়ে গেল।
আমার এখনো মনে হয়, ওটা নিশ্চয়ই কোনো ‘দুঃস্বপ্ন’ ছিল।
বিধাতা,
নরক দেখা হয়নি কখনো। দেখার ইচ্ছেও জাগেনি জ্ঞান হওয়া থেকে আজ অব্দি। তবে তোমার বোধ করি শখ জেগেছিল আমাকে নরক ঘুরিয়ে আনার।
কখনো শুনলাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষেধাজ্ঞা জুটবে কপালে। শেষ অব্দি করুণা দেখিয়েই বোধহয় ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া’ আমায় নিষিদ্ধ করল এক বছরের জন্যে। এক বছর, জীবনের কঠিনতম ৩৬৫ দিন!
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া ফেরার পরে বিমানবন্দরেই মুখোমুখি হয়েছিলাম ‘প্রতারক’ শব্দটির। পরের কিছুদিন যেখানেই গিয়েছি, জীবন ঘুরেছে ওই এক শব্দেই, ‘প্রতারক!’ অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডা, কানাডা হতে বাংলাদেশ, যেখানেই গিয়েছি, সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে মন হচ্ছিল, ‘পৃথিবী ২৭ মার্চেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে!’
একে তো ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গিয়ে এমনিতেই আমার ভগ্নদশা, তার ওপরে আবার সার্বক্ষণিক একই প্রশ্নবাণে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, আমি কী করে ভালো থাকতাম? মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছিল কনুইয়ের চোট, সব দেখেশুনে তো ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল কখনো কখনো। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটও কি আমায় ছাড়া খুব একটা ভালো ছিল?
শুরুটা হয়েছিলো আমাদের আচরণকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে, কালে কালে তা পৌঁছেছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সংস্কৃতিকেই ‘বাজে’ আখ্যাদানে। আমার বেশ হাসিই পেয়েছিল তখন। এর মাসখানেক আগের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে ৪-০ তে বিধ্বস্ত করার সময়েই তো শুনেছিলাম, ‘কী দারুণ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সংস্কৃতি, কী দারুণ অস্ট্রেলিয়া!’
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সও তো নিন্দুকদের পক্ষেই কোরাস গাইছিল। আমরা নিষেধাজ্ঞায় পড়বার পর প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার কপালে জুটেছিল ৪৯২ রানের হার। ক্রিকেট ইতিহাসেই এর চাইতে বড় রানের ব্যবধানে পরাজয়ের ঘটনা আছে মাত্র তিনটি, যার সর্বশেষটি ঘটেছিল সেই ১৯৩৪ সালে!
ডেভিড (ওয়ার্নার) আর ক্যামেরনের জায়গায় এসেছিল জো বার্নস আর ম্যাট রেনশ’। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৬.৫ গড়ে রান করবার পর রেনশ’ তো আর বিবেচনাতেই এল না। জো বার্নসও তো পারল না ভরসা জোগাতে। অভিষেক হয়েছিল অ্যারন ফিঞ্চ আর মার্কাস হ্যারিসের। মার্কাস হ্যারিস তো তা-ও দলে এসেছিল শেফিল্ড শিল্ডের সবশেষ মৌসুমে ৮৭.৪০ গড় নিয়ে, যার মাঝে ওই ২৫০ রানের ইনিংসের কথা আলাদা করে তো বলতেই হয়। কিন্তু অ্যারন ফিঞ্চের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ ওঠে কী করে?
একটু বোধহয় বড়াই-ই শোনাবে, তবে না বলেও পারছি না। চিঠিটা তো তোমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। ডেভিড ওয়ার্নারের ৪৮.৪০ গড় আর ক্যামেরন ব্যানক্রফটের ৮ টেস্টের অভিজ্ঞতাকেই তো ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া পূরণ করতে পারেনি। আমার ব্র্যাডম্যান-উত্তর ব্র্যাডম্যানীয় গড়ে পৌঁছানো তো অসম্ভবই ছিল!
শুধু কি গড়? দলগত খেলা ক্রিকেটকে আমার চেয়ে বেশি দলীয় তো বানাতে পারেনি আর কেউ। ২০১৬ সালের শুরু থেকে গড়ে ইনিংসপ্রতি আমি জুটি গড়েছিলাম ২.৬৮টি। বর্তমান সময়ের আরও তিন মহাতারকা ব্যাটসম্যান রুট-কোহলি-উইলিয়ামসনের ক্ষেত্রে ওই সংখ্যাটি যথাক্রমে ২.২২, ২.৩৭ আর ২.৫২।
আমি ক্রিজে থাকাকালীন সময়ে রানও তো উঠেছিল সবচেয়ে বেশি। ২০১৬ থেকে গড়ে ৪১.৯৮ রান এসেছিল, আমি যতক্ষণ ক্রিজে বিচরণ করেছিলাম, ততক্ষণে। আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কেন উইলিয়ামসনের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৯.৩৮ কম।
আমার চেয়ে বেশি চাপ নিতেও তো কেউ পারেনি। দলের রান ৫০ ছাড়ায়নি, এমন ১৩ ইনিংসে নেমে আমি ব্যাট করেছি ৭২ ছাড়ানো গড়ে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট আমাকে ছাড়া ভালো থাকতো কী করে!
এমন আক্ষেপের পরিসংখ্যানে ডুব দিতে গিয়ে মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল। চিঠিতে তাই বিরতি দিতেই হচ্ছে ঈশ্বর। ওদিকে আবার উইলিসও (স্টিভেন স্মিথের স্ত্রী) ডাকছে, বোলিং মেশিনে বল ভরে দাঁড়িয়ে আছে।