ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের ভবিষ্যত মনে করা হতো একসময় ক্রিস লুইসকে। এই পেস বোলিং অলরাউন্ডারকে লোকে ‘ভবিষ্যতের ইয়ান বোথাম’ মনে করতো।
গায়ানায় জন্ম নেওয়া লুইস ইংল্যান্ডে বড় হয়ে উঠেছেন। ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। কিন্তু নানা কারণেই নিজেকে বোথাম করে তুলতে পারেননি। ক্রিকেট ছাড়ার পর জড়িয়ে পড়েছিলেন মাদক চোরাকারবারিতে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন তরুণ ক্রিকেটারদের অপরাধ থেকে দূরে রাখা নিয়ে কাজ করছেন। সেই অভিজ্ঞতা আর নিজের জীবন উপলব্ধি নিয়ে কথা বলেছেন ক্রিস লুইস।
‘আমি একটা ক্রিকেট খেলায় অংশ নিয়েছিলাম। একটা জিমের মধ্যে খেলা হচ্ছিলো। কিন্তু ওরা আমাকে খেলতে দেয়নি। আমাকে আম্পায়ার হতে হয়েছিলো। কারণ, ওরাও মনে করেছিলো, আমি খেলাটাকে নোংরা করে ফেলতে পারি। মনে হচ্ছিলো, আমি ২০ বছর আগে অবসর নেওয়া টাক, নোংরা একটা লোক; যে ঠিকমতো দেখতে পায় না এবং যার পা আছে একটা।’
ক্রিস লুইসের সাথে এমন করার কারণ ছিলো অন্য কয়েদীদের।
একসময় তাকে মনে করা হতো ‘ভবিষ্যত ইয়ান বোথাম’। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে এবং নব্বই দশকের প্রায় পুরোটা জুড়ে ক্রিকেট খেলেছেন এই অলরাউন্ডার। ইংল্যান্ডের হয়ে ৩২টি টেস্ট ও ৫৩টি ওয়ানডে খেলেছেন।
সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন ১৯৯৬ সালের আগস্টে, ওভালে। আর এর দুই বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের শেষ ওয়ানডে খেলেছেন। ঠিক এক দশক পর গ্যাটউইক বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ডের কোকেন চোরাচালান করতে গিয়ে। ১৩ বছরের জেল হয়েছিল। ২০০৯ সালে জেলে গিয়েছিলেন।
২০১৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এখন ইংল্যান্ডের প্রফেশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে মিলে একটি ভালো কাজ করছেন। তরুণ ক্রিকেটারদের সতর্ক করছেন যে, তারা যেন এরকম অন্ধকার ও অন্যায় কোনো কাজের সাথে জড়িত না হন এবং ক্রিকেটাদের বোঝাচ্ছেন যে, অবসরের পর কোনো একটা কাজের সাথে জড়ানোটা কেন খুব জরুরি।
লুইস বলছিলেন,
‘খেলা ছাড়ার পর আমি একটা সাগরের মাঝখানে পড়েছিলাম। আমার আড়াই বছরের চুক্তি বাকী থাকতে আমি লিস্টার ছেড়ে দিলাম। কোনো পরিকল্পনা ছিলো না আমার। শুধু মারাত্মক হতাশ ছিলাম। আমি স্রেফ এই জায়গা থেকে (ক্রিকেট থেকে) বের হতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি কখনো কোনো পরিকল্পনা করিনি। শুধু খেলা ছেড়ে দিলাম।’
২০০৮ সালে একবার ক্রিকেটে ফিরে এসেছিলেন। কিছু ক্যামিও আবির্ভাব ছিলো। সারেতে ‘খেলার বিনিময়ে টাকা’ এমন চুক্তিতে কয়েকটা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছিলেন। আসলে তিনি ততদিনে ইংলিশ ক্রিকেট থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর জেলে যাওয়ার পর তিনি সবার রাডার থেকেও যেন হারিয়ে গেলেন।
লুইস বলছিলেন,
‘আমাকে জেলে পাঠানোর পর কোনো ক্রিকেটার কি যোগাযোগ রেখেছিলো? আমি মনে করি, সহজ উত্তর হলো, না। কিন্তু ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, আমি একটা মিষ্টির প্যাকেট চুরি করেছিলাম। আমরা এমন একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে কথা বলছি, যে একসময় দেশের মানুষের আবেগ ছিলো, ভালোবাসা ছিলো। লোকেরা তাদের কাজ করেছে। কিন্তু আমি মনে করি না, এমন কোনো ক্রিকেটার দুনিয়ায় আছে, যে আরেকজন ক্রিকেটারকে এমন খারাপ জায়গায় দেখবে বলে আশা করে।’
‘সবারই একটা ভালোবাসা আমার প্রতি একসময় ছিলো। কারণ, একসময় আমরা একসাথে খেলেছি। কিন্তু এই সবকিছুই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কারণ, লোকেরা চায়, অন্যরা যেন ভালো থাকে; খুব ভালো না হোক, যেন অন্তত স্বচ্ছন্দে থাকে। লোকেরা কাউন্টি ঘুরে বেড়াবে, সাবেক খেলোয়াড়দের সাথে দেখা করবে; এটাই তো জীবন। কিন্তু আমার এই জীবন, কী বলবো এটাকে? অভিশপ্ত একটা অধ্যায়? আমার বন্ধুরা এখন অন্তত খুশি যে, এই ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। এখন অন্তত আমি একটু ভালো একটা জীবনযাপন করছি।’
‘আমি এখনও এমন কারো দেখা পাইনি, যে আমাকে নেতিবাচক কিছু বলেছে। তার মানে এই নয় যে, সবাই একই চিন্তা করছে। তবে এটা ঠিক যে, সবাই এটা মানে যে, আমি একটা বড় অন্যায় করেছি এবং এটার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। একবার এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলে সবাই আমার শুভকমানাই করেছে। তারা বলেছে, তারা আমার কথা ভেবেছে এবং আমাকে রক্ষা করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে, কিভাবে এটা করা সম্ভব। অনেক রকম আবেগ দেখেছি এই সময়ে। এককথায় বলতে পারি, খারাপ কিছু দেখিনি।’
লুইস তার এই ইংলিশ ক্রিকেটের শীর্ষ থেকে জেলে যাওয়ার গল্প নিয়ে একটা বই লিখেছেন-ক্রেজি: মাই রোড টু রিডেম্পশন। লর্ডসের ড্রেসিংরুম থেকে ছোট্ট একটা জেল প্রকোষ্ঠে যাওয়ার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা আছে এই বইয়ে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যে কান্ড করেছিলেন, এরপর থেকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে; সেগুলো নিয়ে পড়ে না থেকে লুইস এখন সামনে তাকাতে চান। এখন তিনি জীবন নিয়ে আরেকবার আশাবাদী হতে চান। তিনি চান, তার জীবনের বার্তাগুলো যেন তরুণ ক্রিকেটারদের কাজে লাগে।
লুইস বলছিলেন,
‘আমি সবসময়ই কোচিংয়ের মতো ব্যাপারগুলো উপভোগ করি। কিন্তু আমি সবসময় তরুণদের পছন্দ করি। আমি তাদের যে বার্তাটা দিতে চাই, সেটা সম্ভবত আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ক্রিকেটের বার্তা নয়, জীবনের অভিজ্ঞতা। তুমি যখন একজন ভালো ক্রিকেটারে পরিণত হবে, তখন তোমাকে জীবন পরিচালনা করার ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আমি যখন কাউন্টিগুলোতে ঘুরে তরুণ ক্রিকেটারদের সাথে কথা বলি, তখন আমি এটাই বলতে চাই।’
‘এটা সবসময়ই আমার মনে হয় যে, আমি তাদের মধ্যে কিছু তথ্য প্রবেশ করাতে পারলে আমার এই সময় ব্যয় করাটা অর্থপূর্ণ হবে। কেউ যদি মনে করে, আমার কথাবার্তা দিয়ে কাজ হবে না, তারপরও শেষ অবধি সে কোথাও না কোথাও আমার এই কথাবার্তার কিছু অর্থ খুঁজে পাবে।’
লুইসের জীবনের শিক্ষা আপনাকে এটা শেখাবে না যে, তিনি ১৯৯২ বিশ্বকাপে কিভাবে লারাকে আতঙ্কিত করে ফেলেছিলেন। কিংবা এটাও বলবে না যে, কিভাবে ভারতের বিপক্ষে এক বছর পর চেন্নাইতে ১১৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তিনি বরং তার ৫০ বছরের জীবন থেকে পাওয়া রোমাঞ্চকর কিছু শিক্ষা দিতে পারবেন আপনাকে।
‘দেখুন, জীবন অসাধারণ। চলুন শুরুতে ফিরে যাওয়া যাক। আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া এক তরুণ ছিলাম, যার স্বপ্ন ছিলো ক্রিকেট খেলা। আমি ইংল্যান্ডে এলাম এবং আমার স্বপ্ন পূরণ করলাম। আমি ইংল্যান্ডের হয়ে অনেকবার ক্রিকেট খেললাম।’
‘আমি একসময় সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছি। নানারকম লোকের আতিথ্য নিয়েছি, অসাধারণ সব লোকেদের সাথে মিশেছি। আমি শুরুতে এসব স্বপ্নও দেখতে পারতাম না। কেউই পারে না। যে জীবন কাটিয়েছি, সেটা অসাধারণ ছিলো। এরপর আমার জীবনে যা ঘটেছে, জেলে গেলাম, ক্রিকেটকে অনেক পেছনে ফেলে এলাম, সেই যে ‘ভবিষ্যত ইয়ান বোথাম’ সেটাও হারিয়ে গেলো। তারপরও আমি এখানে শান্ত হয়ে বসেছি এবং নতুন করে আশাবাদী হতে চাচ্ছি।’