গ্লেন ম্যাকগ্রা। অস্ট্রেলিয়ান এই বোলার এখন পর্যন্ত সর্বকালের সেরা ফাস্ট মিডিয়াম পেস বোলার। অন্যদিকে আছেন ইংল্যান্ডের জেমস অ্যান্ডারসন। আর মাত্র ৭ উইকেট নিলেই গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকে সর্বকালের সেরা সফল ফাস্ট বোলার হয়ে যাবেন জেমস অ্যান্ডারসন। প্রতিপক্ষ ফাস্ট বোলারের এমন সাফল্য আনন্দিত করছে গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান ম্যাকগ্রাকে। অ্যান্ডারসনের সাফল্য কামনা করে এবং এ যুগের ফাস্ট বোলিং বিশ্লেষণ করে একটি কলামও লিখেছেন ম্যাকগ্রা। সেটি বাংলায় তুলে ধরা হলো এখানে।
জিমি অ্যান্ডারসন যা যা পেয়েছে, তার সবই ওর প্রাপ্য ছিল। যদিও জিমি একজন ইংলিশ ক্রিকেটার, তারপরও সে যখন আমার রেকর্ড পার করে যাবে এবং টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বোলার হবে, আমি ওর জন্য উচ্ছসিত হবো।
আমার ৫৬৩ উইকেটের থেকে জিমি এখন মাত্র ছয় উইকেট পেছনে দাড়িয়ে আছে। আমাকে টপকে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভারতের বিপক্ষে চতুর্থ টেস্টেও তার এটা করে ফেলা উচিত। আর সে যে মুহুর্তে এটা সম্পন্ন করবে, যত দ্রুত সম্ভব আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো।
জিমির প্রতি আমার খুব শ্রদ্ধা আছে। তাকে শুভকামনা। আমি বিশ্বাস করি, একবার আমাকে পার করে গেলে আর তাকে কেউ টপকাতে পারবে না। রেকর্ড সবসময়ই খুব ভালো। আমি টেস্ট ইতিহাসের যেকোনো ফাস্ট বোলারের চেয়ে বেশি উইকেট নিতে পেরে সত্যিই গর্বিত ছিলাম। কিন্তু সব উচ্চতাই তৈরি হয় টপকানোর জন্য। আমারটাও কেউ টপকাবে। জিমি যখন আমাকে পার করে যাবে, তখন আমি একইরকম গর্ব বোধ করব। কারণ, ফাস্ট বোলারদের একত্রিত থাকতে হবে; সে যে দেশ থেকেই আসুক না কেন।
অ্যান্ডারসন অবিশ্বাস্য একজন পারফরমার। বড় একটা সময়ব্যাপী সেটি ধরে রাখছে। আর সে ইতিহাসে যেকোনো ফাস্ট বোলারের চেয়ে অনেক বেশি টেস্ট খেলেছে; ১৪১টি। ফলে তার রেকর্ডই তার হয়ে কথা বলছে।
ফাস্ট বোলার হওয়াটা ক্রিকেটে বেশ কঠিন একটা কাজ। জিমির মতো করে এতদিন ধরে খেলতে হলে মাঠের বাইরে যে পরিশ্রম করতে হয় এবং যে সময় দিতে হয়, সেটা সবাই দেখতে পায় না। অন্য যে কারো চেয়ে ফাস্ট বোলারদেরকে অনেক বেশি যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে হয়।
তাই এখনো এই ১৫ বছর পরেও আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে নিজের সেরা ফর্মে থাকা এবং বিপুল পরিমাণ ওভার করাটাই প্রমাণ করে অ্যান্ডারসনের কাজের প্রতি নিবেদন কত বেশি এবং তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি কেমন দৃঢ়।
যেদিন বোলিং পরিবেশ তার অনুকূলে থাকে তখনই যেন তার বল অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে। কোনো ব্যাটসম্যানই যেন তার বলে সুবিধা করে উঠতে পারে না। যেমনটা আমরা ভারতের বিপক্ষে লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে দেখলাম। তার এই ৩৬ বছর বয়সে এটা করা কঠিন একটা ব্যাপার।
তার বল যখন সুইং করে, সে তখন মাঠে যে কারো চেয়ে ভালো বোলার। তবে যখন যখন সুইং পায় না, তখন হয়তো একটু পিছিয়ে পড়ে। ক্যারিয়ারের শুরুতে এটা তার জন্য একটা সমস্যা ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে নিজেকে অনেক উন্নত করেছে। আর এখন সে নিজের দেশের বাইরেও দারুণ কার্যকর হয়ে উঠেছে।
আমি সবসময় বলি জিমি একজন বিশ্বমানের বোলার। আমি তার বিপক্ষে প্রথম যখন খেলেছিলাম, সেই ২০০৬-০৭ মৌসুমে, যেটা আমার শেষ টেস্ট ছিল, তখন থেকেই আমি এটা বলি। আমি তখন থেকে খেয়াল করেছি, সে কীভাবে দুই দিকেই বল সুইং করাতে পারে। এটা একটা শিল্প। খুব বেশি বোলার এটা করতে পারে না। আমি কেবলমাত্র ওয়াসিম আকরামের কথা মনে করতে পারি; যিনি দারুণভাবে এটা করতে পারতেন।
অ্যান্ডারসন তো চালিয়েই যাচ্ছে। ট্রেন্টব্রিজে গত টেস্টখানার কথাই ধরুন। প্রথম ইনিংসে প্রায় ২৬ ওভার করেছে। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে আবার ২২ ওভার। একবার আমাকে টপকে গেলে, এটা দেখাটা খুব মজার হবে যে, জিমি নিজে এই রেকর্ডটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। আজকের দিনের খেলার যে দশা এবং যে পরিমানে টি-টোয়েন্টি খেলা এখন হয়, তাতে আমার বিশ্বাস, কোনো ফাস্ট বোলার আর তাকে টপকে যেতে পারবে না।
আমি এখনো বিশ্বাস করি এবং আশা করি, সব তরুণ ক্রিকেটারই তাদের জীবনে টেস্ট ক্রিকেটকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জিমিকে টপকে যেতে হলে যে পরিমাণ খেলা খেলতে হবে এবং যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে হবে, সেটা কি আজকের দিনে আর সম্ভব? আমার মনে হয় না।
শুনেছি ট্রেভর বেলিস (ইংল্যান্ডের কোচ) বলেছেন, জিমি ৪০ বছর বয়স অবধি টেস্ট খেলে যেতে পারে। নিশ্চিত নই, তেমনটা করার জন্য জিমি কতটা আগ্রহী। তবে আরো কিছুদিন তার চালিয়ে না যাওয়ার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে তার আবেগ ও ভালোবাসা এখনো যেহেতু আছে। তাকে চমৎকার একটা চেহারায় দেখা যাচ্ছে। সে এখনো তরুণ এক ছেলের মতো দৌড়ে বেড়ায়। শরীরে বাড়তি কোনো ওজন হয়নি। তাকে দেখলেই বোঝা যায়, সে আগের মতোই ক্ষুধার্ত ও শক্তিশালী আছে।
আমি সবসময় এটা ভাবি, যদি জানতাম অবসরের সঠিক সময় আসলে কোনটা। ২০০৬ অ্যাশেজের সেই ব্রিসবেন টেস্টের পরও আমার থেমে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমি তখনো খেলায় দারুণ মনযোগী এবং এক হাজার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখছি। তখনো আমি প্রেরণা পাচ্ছি।
তারপর আমি সেই ম্যাচের পর বাড়ি গেলাম, শুয়ে পড়লাম। সকালে যখন উঠলাম, খেলাটা আমার কাছে আর এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না। এটা আমাকে দারুণ আহত করেছিল। আমি সেই সিরিজের পর ১২৪ টেস্ট খেলে অবসর নিয়ে নিলাম। আমি তখন বুঝেছিলাম, আমার বুটজোড়া তুলে রাখার সময় এসেছে।
হয়তো, জিমির সাথেও এরকম কিছু ঘটবে। কিন্তু এখন অবধি তার কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। আর সে যেভাবে খেলছে, তাতে এটা তার ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত সে কতটা লম্বা করতে চায় তার ক্যারিয়ার।
আমি ভাগ্যবান যে, আমি সেরা অবস্থানে থাকা অবস্থাতেই চলে যেতে পেরেছি। তবে অনেকের এই ভাগ্য হয় না। জিমি যখন খেলাটা শেষ করবে, আমরা তখন উৎসব করে দেখাবো যে, সে কতো বড় একটা ক্রিকেটার ছিল। কারণ, ওর মতো একজন আর আসবে না।
তাহলে অ্যান্ডারসন কি আমার ওপরে থাকা তিন গ্রেট স্পিনারকে টপকাতে পারবে? আমি মনে করি, আমাকে টপকানোর পর তার লক্ষ্য হবে ৬০০ উইকেট। আর সেটা হবে অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার।
এরপর সামনে থাকবে অনিল কুম্বলের ৬১৯ উইকেট। সেটা টপকানো হয়তো কঠিন হবে না। তবে আমি নিশ্চিত নই, জিমির পক্ষে শেন ওয়ার্নের ৭০৮ কিংবা মুত্তিয়া মুরালিধরণের ৮০০ স্পর্শ করা সম্ভব হবে কিনা। এটা এমনকি অ্যান্ডারসনের মতো সেরা বোলারের জন্যও কঠিন ব্যাপার।
একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে আমি তোমাকে স্যালুট করছি। জিমি; যদিও তুমি ইংল্যান্ডের, চালিয়ে যাও, বন্ধু। আশা করি, আরো অনেক উইকেট আসবে।
ফিচার ছবি- Getty Images