সানিয়া মির্জা। ছয়টি ডাবল শিরোপা জিতেছেন। জিতেছেন ২০১৫ সালের উইম্বলডনে; মার্টিনা হিঙ্গিসের সাথে। ভারতের অন্যতম সেলিব্রিটি এই টেনিস খেলোয়াড়। খুব আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন প্রতিবেশী ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের ক্রিকেটার ও সাবেক অধিনায়ক শোয়েব মালিককে বিয়ে করে।
আট বছর ধরে সুখে সংসার করছেন শোয়েব ও সানিয়া। অবশেষে তারা সুখবর দিয়েছেন। এই অক্টোবরে মা হতে চলেছেন সানিয়া মির্জা। শোয়েব-সানিয়ার ঘরে আসছে নতুন অতিথি।
আর সব টেনিস খেলুড়ে মায়ের মতো সানিয়াকেও যেতে হচ্ছে অভিনব কিছু চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে। সেসব চ্যালেঞ্জ, নিজেদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা এবং নিজের দৃঢ়তা নিয়ে কথা বলেছেন সানিয়া মির্জা।
এই সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে একজন ভবিষ্যত মায়ের জীবন পরিকল্পনা।
মা হতে যাচ্ছেন, অভিনন্দন। কেমন চলছে সব?
বিস্ময়করভাবে, আমি খুব ভালো আছি। কোনো সকালের শরীর খারাপ বা এ ধরনের সমস্যা নেই। এখন অবধি স্বপ্নের মতো কাটছে সময়টা। এমন নারী হিসেবে, মা হওয়াটা তো এমন একটা ব্যাপার যেটার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকি; সে আমি টেনিস খেলোয়াড় হই আর না হই। এটা জীবনের নতুন একটা শুরু।
এখন তো জীবনে কিছু পরিবর্তন আসছে, তাই না?
মিষ্টি, বিশেষ করে চকলেট খাচ্ছি না। এটা ভালো। কারণ তাহলে আমার ওজন আরও বেড়ে যেতো। তবে ঝাল খাবার ইচ্ছেটা এখন অনেক বেড়ে গেছে। ভেল পুরি জাতীয় খাবার খেতে খুব ইচ্ছে করে। লাল মাংসও বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমি একজন পুষ্টিবিদের সাথে কাজ করছি, যাতে ওজন বেশি বেড়ে না যায়। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব আবার খেলায় ফিরতে হবে। ফলে আমাকে ওজনটাও নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
সেরেনা উইলিয়ামস তার মাতৃত্বকালীন এই সময়ে আন-সিডেড হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, টেনিসের আইন কানুন মায়েদের প্রতি খুবই কঠোর। আপনি কী মনে করেন, নারী টেনিস খেলোয়াড়দের জন্য আইন বদলানোটা এখন জরুরি হয়ে গেছে?
এই কিছুদিন আগেও নারীদের জন্য কোনো মাতৃত্বকালীন ছুটি ছিলো না। এটা কিন্তু একটা পরিবর্তন হয়েছে। হয়তো সময় লাগছে। কিন্তু আমি মনে করি, এগুলো বদলাবে। কারণ, এখন অনেক বেশি মায়েরা বাচ্চা হওয়ার পর আবার খেলায় ফিরে আসছে। আগে তো যেটা হতো, একবার অবসর নিয়ে ফেললে তবে মেয়েরা মা হতো। কিন্তু এখন আর ব্যাপারটা তেমন নেই। এখন আপনি অন্তত ২০ জন মাকে খুঁজে পাবেন, যারা নিয়মিত টেনিস খেলছে। এটা তো বিস্ময়কর। এর মধ্যে কিম ক্লাইস্টার্সও আছেন। উনি মা হওয়ার পর ফিরে এসে একটা বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন।
সেরেনা আমাদের ইতিহাসের সেরা টেনিস খেলোয়াড়। তারপরও তার জন্য এই লড়াইটা সহজ ছিলো না। দেড় বছর ধরে খেলার বাইরে থাকার পর আবার ফিরে আসা এবং সেই আগের লেভেলে পৌঁছানো, এটা মোটেও সহজ একটা ব্যাপার নয়। আপনি খেলায় তো ফিরতেই পারেন। কিন্তু আগের লেভেলে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে। একটা অপশন এখন আছে, প্রোটেক্টিভ র্যাংকিং পাওয়া যায়। চাইলে ওটা ব্যবহার করে ফেরার সময়টা সহজ করা যায়। এতে আপনি আপনার র্যাংকিং স্থির রাখতে পারবেন। আমি সেটা করেছি। কিন্তু এখনও তো অনেক দিন সময় লাগবে। এখন ২০১৮ সাল। আমার ইচ্ছা ২০২০ অলিম্পিকে ফেরার চেষ্টা করা। এটা একটা বাস্তবসম্মত লক্ষ্য। কারণ, আমার বাচ্চা হওয়ার পর ততদিনে এক বছর কেটে যাবে।
আপনার কী মনে হয়, নারীরা চাইলেই সব পারে?
দেখুন, আমি প্রচলিতভাবে একটা মেয়ে যেভাবে বড় হয়, সেই পথ অনুসরণ করিনি। আমি সবসময় আলাদা একজন ছিলাম। আর সে জন্য আমি খুশি। আমার বাবা-মা আমাকে সবসময় সমর্থন করেছি। আমি যখন হায়দ্রাবাদে টেনিস খেলেছি, সে সময় ওখানে কেউ গ্র্যান্ড স্লাম খেলা বা উইম্বলডন জয়ের স্বপ্ন দেখতো না। আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকেই বিয়ে করেছি। বিয়ের আট বছর পর এখন সন্তান নিচ্ছি।
আমি সবসময় নিজের মতো করে জীবনে চলতে চেয়েছি। আমি তখনই পরিবার তৈরি করতে চেয়েছি, তখন আমি প্রস্তুত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, মাতৃত্ব নারীকে আরও ক্ষমতাশালী করে। কারণ, এটা এমন একটা ব্যাপার যা মেয়েরা ছাড়া আর কেউ অর্জন করতে পারে না। আমি মনে করি, মাতৃত্ব এমন একটা ব্যাপার, যা কখনোই আপনাকে পিছু টেনে ধরবে না। আমার জীবন এরপরও আমার মতো করে সামনে এগিয়ে যাবে। আমি আমার সন্তানের সামনে এমন একটা দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চাই যে, মাতৃত্ব কখনো তোমার স্বপ্নকে আটকে দেবে না।
এটাও কি নিশ্চিত করতে হবে না যে, আপনি যেন আপনার সন্তানকে এই কিছু সুযোগ হারানোর জন্য দায়ী না করেন?
আজকের দিন ও সময়ে মানুষের স্বাধীন হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি শুধু বড়দের কথা বলছি না। বাচ্চাদের কথাও বলছি। আমি আজকের দিনের বাচ্চাদের দেখেছি। তারা খুবই আত্মবিশ্বাসী এবং তাদের আমার সাথে এসে কথা বলতে কোনো দ্বিধা বা সংকোচ কাজ করে না। আমি নিজের ব্যাপারে এরকম কিছু মনে করতে পারি না। কারণ, আমি খুব লাজুক ছিলাম। আমার সন্তান হবে আমার এক নম্বর অগ্রাধিকার। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, আমাকে ওর সাথে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হবে। ওকে ভালো মানুষ করে তুলতে ওর সাথে সবসময় থাকাটা জরুরি না।
তাহলে আপনারা এখন বাবা-মা হওয়ার জন্য পুরো প্রস্তুত?
আমার স্বামী খুবই সহযোগিতাপূর্ণ মানুষ। সে এমন একজন মানুষ, যে ভোর বেলায় উঠে নিজের নাস্তা নিজে তৈরি করে ফেলতে পারে। তার ক্ষুধা লাগলে সে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না। আমরা এভাবেই বসবাস করছি। আমাদের সন্তান যখন আসবে, তখনও এর ব্যতিক্রম হবে না। আমার টেনিস প্র্যাকটিস থাকলে, ও সময় বের করবে বাচ্চার জন্য। আমার ওর প্র্যাকটিস থাকলে আমি সময় বের করবো। হ্যাঁ, এটা কঠিন হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমার ধারণা বাচ্চা চলে এলে আমরা আনন্দের সাথে এগুলো করবো।
আপনার কী মনে হয়, আপনার স্বামীও ক্রীড়া ক্ষেত্রের মানুষ হওয়াতে আপনার খুব উপকার হয়েছে?
খেলাধুলা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে, আমরা যা অর্জন করতে চেয়েছি, সে জন্য খেলাধুলা আমাদের থেকে অনেক কিছু নিয়েও নিয়েছে। তবে আমরা দুজনই চাপ ব্যাপারটা বুঝি; মাঠে ও মাঠের বাইরে। এমন অনেকদিন গেছে যে, আমরা দুজনই খেলছি। ওর হয়তো দারুন একটা দিন গেছে, আমার খুব বাজে কেটেছে। আমার উচিত ছিলো ওর আনন্দে আনন্দিত হওয়া। কিন্তু আমি সেটা পারিনি। কারণ, আমার নিজের খারাপ দিন গেছে বলে। কিন্তু এতে ও একটুও কষ্ট পায়নি। এটা ওর ক্ষেত্রেও হয়েছে। খেলাধুলা আমাদের শিখিয়েছে, জয় ও পরাজয়কে কিভাবে নিতে হয়। এটা আমাদের শিখিয়েছে, কিভাবে পরাজয়ের পরও ফিরে আসতে হয়। আমাদের জন্য খেলাধুলাটা একটা জীবন যাপনের পথ। আমরা সবসময় বিশ্বাস করি, আগামীকাল নতুন একটা দিন।