ইউরো ২০২০: গ্রুপ ‘এফ’ ব্যবচ্ছেদ

গ্রুপ অফ ডেথ! আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়, যেকোনো একটা গ্রুপ মৃত্যুকূপে না পড়লে যেন গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো জমতে চায় না। তবে ইউরো ২০২০ গ্রুপপর্বের লটারির পর গ্রুপ ‘এফ’ যে রূপ ধারণ করেছে, তা বেশ রীতিমতো ভীতিজাগানিয়া। জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল – এক গ্রুপেই শিরোপাজয়ের জন্য ফেভারিট অন্যতম তিন দল। তার মধ্য থেকে দুই দল আবার ২০১৬ ইউরোর ফাইনালও খেলেছে। এছাড়াও পুঁচকে দল হিসেবে হাঙ্গেরিকে ধরা হলে তারাও চাইলে ফেভারিট তিন দলের শিরোপা স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে দিতে পারে যেকোনো দিন। কারণ, এই গ্রুপে একটা পয়েন্টও দিনশেষে দলের ভাগ্য পালটে দেবার জন্য যথেষ্ট। তাই এই গ্রুপে যেমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইও হবে, তেমনই চোখ কপালে তোলার মতো অঘটনও ঘটতে পারে।

প্লে-অফ জিতে মরণ গ্রুপে ঠাই হয়েছে হাঙ্গেরির ; Image Credit: UEFA

জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও হাঙ্গেরি। গ্রুপ-এফ থেকে এই চার দলের ভেতর ফেভারিট ধরা হচ্ছে ফ্রান্স ও পর্তুগালকে। এই দু’টি দলকে এগিয়ে রাখার মূল কারণ তাদের শক্তিশালী স্কোয়াড ও সাম্প্রতিক ফর্ম। জার্মানির স্কোয়াডও বেশ ভারসাম্যপূর্ণ হলেও বেশ কয়েক বছর ধরেই তাদের পারফরম্যান্স তাদের পক্ষে কথা বলছে না। আর পরাশক্তিদের তালিকা থেকে হাঙ্গেরি নিজেদের নাম উঠিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। তাই এই গ্রুপে তাদের পথ চলা হবে সব থেকে কঠিন।

প্রথমে শুরু করা যাক জার্মানিকে নিয়ে। গোলবারের নিচে নয়্যার। রক্ষণে চেলসির হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম পার পরা রুডিগার ছাড়াও আছেন অভিজ্ঞ ম্যাট হামেলস। মধ্যমাঠে ক্রুস, গোরেজকা, কিমিখ। আক্রমণে মুলার ও হাভার্টজের পাশে সানে ও ন্যাব্রির মতো খেলোয়াড়। কে নেই এই জার্মান দলে! দুর্বলতা কিছুটা আছে ফুলব্যাকে। কিন্তু এখানে যারা খেলবেন, ফর্মে থাকলে তারা ঠিকই সামাল দিতে পারবেন। সমস্যাটা তাহলে কোথায়?

সমস্যা মূলত কোচে। রাশিয়া বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর জোয়াখিম লো চেয়েছিলেন এই দলকে ঢেলে সাজাতে। দলের পুরনো অনেক খেলোয়াড়কে উপেক্ষা করে একঝাঁক তরুণদের দলে ডেকেছিলেন বিশ্বকাপের পরপরই। গত দুই বছর তারাই খেলছেন নিয়মিত। কিন্তু যে পরিবর্তন আসা উচিত ছিল, সেটা আর আসেনি।

ইউরোর মঞ্চে জার্মানির সাফল্য নেই অনেক বছর। ২০১৬ ইউরোতে যে দল তাদের হারিয়ে ফাইনালের টিকেট কেটেছিল, সেই ফ্রান্সের সাথেই তাদের ইউরো মিশন শুরু হচ্ছে। ফ্রান্সের বিপক্ষে জার্মানি মাঠে নেমেছে মোট ৩০ বার, যার ভেতর তারা হেরেছে ১৪ ম্যাচে। ১০টি জয় এবং বাকি ৭টি ম্যাচ ড্র। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেই ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর থেকে ফ্রান্সের বিপক্ষে একবারও জিততে পারেনি জোয়াখিম লো’র শিষ্যরা। আর রাশিয়া বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্স নিজেদের শেষ ছয় ম্যাচে কোনোটিতেই হারেনি। তাই ইউরোর শুরুর ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে আনা সহজ হবে না জার্মানদের জন্য। তবে ফরাসিদের বিপক্ষে জার্মানরা লড়বে ঘরের মাটিতে। তাই এই ম্যাচে একমাত্র এইদিকে এগিয়ে থাকবে জোয়াখিম লো’য়ের শিষ্যরা।

জার্মানি স্কোয়াড; Image Source: Footxero

পর্তুগালের সাথে জার্মানির পারফরম্যান্স তুলনামূলক ভালো। সেই ২০০০ সালের পর থেকে পর্তুগিজদের সাথে হারের মুখ দেখেনি জার্মানি। মোট ১৮ বারের মুখোমুখি দেখায় জার্মানি জিতেছে ১০ বার। এছাড়াও, শেষ চারবারের দেখায় একটি ম্যাচেও হারেনি তারা।

কিন্তু এ সবই পুরনো কথা। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর থেকে পর্তুগাল দলে যে পরিবর্তন এসেছে, এবং তারা যেভাবে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে, জার্মান দলে তার ছিটেফোঁটাও হয়নি। তাই কাগজে-কলমে দল শক্তিশালী থাকলেও পর্তুগালের বিপক্ষেও জার্মানি ঠিক সেই অর্থে ফেভারিট নয়। পর্তুগালের বিপক্ষে জার্মানির অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে রুবেন দিয়াজ ও ফন্তের পর্তুগিজ দেয়াল। কারণ, দুই দলেরই আক্রমণভাগ দারুণ শক্তিশালী। নিজের ফেভারিট দিনে যেমন ব্রুনো, রোনালদো ও ফেলিক্সদের ঠেকানো মুশকিল হবে। তেমনই ফর্মে থাকলে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ত্রাসের সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে ভার্নার, মুলার, ন্যাব্রিরা। তাই দৃঢ় রক্ষণভাগই বদলে দেবে এ ম্যাচের ভাগ্য।

ইউরোর সবচেয়ে কঠিন গ্রুপ হলেও পর্তুগাল ও ফ্রান্সের ফ্রান্সের বিপক্ষে জার্মানিকেই পিছিয়ে রাখছেন ফুটবলবোদ্ধারা। তাই সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে ইউরোর মাঠে নিজেদের সেরা প্রদর্শনী উপস্থাপন ছাড়া বিকল্প নেই জার্মানদের হাতে।

হাঙ্গেরির সাথে জার্মান কেন, এই গ্রুপের বাকি দুই দলের সাথেও হাঙ্গেরিয়ানদের ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। ককসিস-পুসকাসদের হাঙ্গেরি যেমন ছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই বর্তমান দলে। তাই সে ইতিহাস এখন কেবল মধুর অতীত। জার্মানির সাথে হাঙ্গেরির শেষ কোনো বড় প্রতিযোগিতার দেখা হয়েছে সেই ১৯৫৪ সালে। ফ্রান্সের সাথেও গত ২০ বছর হাঙ্গেরির দেখা হয়নি। শুধুমাত্র পর্তুগালের সাথে ২০১৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দেখা হলেও তারা জয়ের মুখ দেখেনি। 

হাঙ্গেরি কি ঘটাবে কোনো অঘটন? Image Source: Footxero

তবে তাদের একমাত্র শক্তি, গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচের দুই ম্যাচেই তারা খেলবে ঘরের মাঠে। এছাড়াও গোলমুখ ও ডিফেন্সে পিটার গুলাকসি ও উইল অরবানের উপস্থিতি তাদের রক্ষণ আরও মজবুত করে তুলবে। তাই বাকি তিন পরাশক্তির বিপক্ষে একটি ড্র-ই হতে পারে তাদের বড় সাফল্য। আর পর্তুগাল, জার্মানি অথবা ফ্রান্স থেকে কেউ যদি হেরেই যায়, তবে তা হবে চূড়ান্ত অঘটন; যদিও এমন অঘটন ঘটলে এই গ্রুপের পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে আরও জটিল।

তবে ফ্রান্সের বিপক্ষে পর্তুগালের ম্যাচে কাউকে এগিয়ে রাখা দুষ্কর। এই দুই দলের যে কোনো দিক থেকেই কোনো কমতি নেই! 

ফুটবল মাঠে ফরাসিদের সাথে পর্তুগিজদের লড়াই হয়েছে মোট ২৭ বার। তাতে পর্তুগাল হেরেছে ১৯ ম্যাচ। তাই ইতিহাস ঘাটলে যে তথ্য পাওয়া যাবে, তাতে এগিয়ে আছে ফ্রান্স। তবে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আর কী লাভ বলুন? গতবার যে দীর্ঘদিন পর ফ্রান্সের ইউরো জয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছিল এই পর্তুগালই! এরপর অবশ্য উয়েফা ন্যাশনস কাপের ফাইনালে ফ্রান্সই পর্তুগালকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে। কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? ২০১৬ সালের ফাইনালের হার এখনও তাদের কাছে জলজ্যান্ত দুঃস্বপ্ন। তাই এবার গ্রুপ পর্বে দেখা হয়ে যাওয়াতে ফ্রান্সের অন্যতম চাওয়া থাকবে পুরনো বদলা আগেভাগেই নিয়ে ফেলা।

ফ্রান্স স্কোয়াড; Image Source: Footxero

 

খেলোয়াড়ের দিক থেকে ফ্রান্স দলে কোনো কমতি নেই। ইউরোকে সামনে রেখে দেশম উপযুক্ত সব খেলোয়াড়কেই ডেকেছেন। এক পজিশনে খেলার জন্য তার হাতে যেমন দু’টি করে খেলোয়াড় থাকবে, তেমনই ম্যাচের অবস্থা বুঝে ট্যাকটিক্সকে বদলে ফেলার সুযোগও থাকবে তার হাতে।

পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো সান্তোস রোটেশন ও ট্যাকটিক্সে পরিবর্তন আনেন কালেভদ্রে। সাধারণত ৪-৪-২ ছকে তার দলকে দেখা যায় রক্ষণের উপর বিশেষ নজর দিয়ে আক্রমণে যেতে। ফ্রান্স দলে যেমন অভিজ্ঞতা ও তরুণের একটা মিশ্রণ আছে, পর্তুগাল দলেও সেটা নেহায়েত কম নয়। ৪-২-৩-১ ছকে ফরাসি দলের আক্রমণভাগে থাকবেন গ্রিজমান, বেনজেমার মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়; থাকবেন দেমবেলে ও এমবাপের মতো প্রতিভাবান তরুণরাও। ওদিকে পর্তুগাল আক্রমণে রোনালদো আছেন, তার সাথে থাকবেন ব্রুনো ফার্নান্দেজ ও বার্নাদো সিলভার মতো বড় মঞ্চে খেলার মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। সাথে থাকবেন ডিয়েগো জোটা ও জোয়াও ফেলিক্সের মতো তরুণতুর্কি। পর্তুগিজ রক্ষণে যেমন আছেন দিয়াজ ও ফন্ত, ফ্রান্স দলে আছে ক্যুন্দে, কিম্পেম্বে ও ভারানরা। তাই এ ম্যাচে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, সেটা বিশদ করে বলার আর প্রয়োজন নেই।

Image Source: Footxero

 

তাই কোনো অঘটন না ঘটলে বলা যায়, গ্রুপ অফ ডেথ থেকে পরবর্তী পর্বে ফ্রান্স ও পর্তুগালের খেলার সম্ভাবনা বেশি। তৃতীয় হলেও জার্মানি পরের রাউন্ড খেলতে পারবে, কিন্তু সেখানে তাদের ভাগ্য ও মাঠের পারফরম্যান্সের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ, হাঙ্গেরির বিপক্ষে কোনোমতেই হারা চলবে না। বাকি দুই দলের বিপক্ষে অন্তত কোনো ম্যাচে জার্মানির জিততেই হবে। জোয়াখিম লো’র জার্মানি যদি পর্তুগাল ও ফ্রান্স থেকে কোনো দলকে হারাতে পারে, তবে গ্রুপ অফ ডেথ হয়ে উঠতে পারে গভীর মৃত্যুকূপ। আর জার্মানি যদি ফ্রান্স ও পর্তুগালের কাছে হেরে তৃতীয় হয়, তবে তাদের তাকিয়ে থাকবে হবে গ্রুপ ‘এ’, ‘ডি’, এবং ‘ই’-এর দিকে। সেখানে একটি দল ছাড়া বাকিগুলোর শক্তিমত্তা প্রায় কাছাকাছি। তাই পয়েন্ট ব্যবধানের চক্করে পরে জার্মানদের ইউরো স্বপ্ন শেষ হয়ে যেতে পারে গ্রুপপর্বেই।

তবে ৯০ মিনিটের খেলা কখন কোনদিকে মোড় নেয়, তা অনুমান করা মুশকিল। আর গ্রুপ অফ ডেথ তো সবসময়ই থ্রিলার নাটকের মঞ্চ তৈরি করে। সে মঞ্চে মাঝে মাঝেই পরাশক্তিরা নতমুখে বিদায় নেয়, আর অখ্যাত কোনো দল পরের রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নেয় হাসিমুখে। গ্রুপ-এফ কি এমনই কোনো নাটকীয়তা নিয়ে অপেক্ষা করছে? 

This article is in Bangla language. It is about the analysis for group F in EURO 2020. The group includes Germany, France, Portugal, and Hungary. 

Featured Image Credit: UEFA

Background Image Credit: Foot The Ball

Related Articles

Exit mobile version