বছর খানেক আগের কথা। কোনো এক আন্তর্জাতিক সিরিজের মাঝখানে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের হয়ে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ কি অর্জন চান, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কোনরকম না ভেবেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিশ্বকাপ ট্রফি’। প্রতিবেদক বোধ হয় একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের এই সফলতম ক্রিকেটারকে। বলেছিলেন, ধরুন আপনার অধীনে দল টেস্টের এক নম্বর র্যাংকিংয়ে থাকল বছরের পর বছর। বলে রাখা ভালো, যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখনো সাদা পোশাকের টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থা সেই মেরেকেটে বছরে দুয়েকটা ম্যাচ ড্র করার মতো।
সাকিব আরও এক কাঠি সরেস। বলে দিলেন টেস্টের এক নম্বর দল হোক বা না হোক, তার বিশ্বকাপই জেতা চায়। এটাই তার পণ।
অধিনায়ক হিসেবে সাকিব আল হাসান যেমন প্রসংশিত হয়েছেন, বিতর্কিতও হয়েছেন। যদিও তার ক্যারিয়ার জুড়ে সাফল্য আর বিতর্ক পাশাপাশি দুই হাতে সমানভাবে জমা হয়েছে। সেই সাকিব এখন দ্বিতীয় দফায় অধিনায়কত্ব পেলেন। শুরুটা যেমনই হোক, সর্বশেষ উইন্ডিজ সফরে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজটি ২-১ এ জিতে নিয়ে নিজের সামর্থ্য মেলে ধরলেন। এই উইন্ডিজই এখন ২০ ওভারের ফরম্যাটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল।
এই মুহূর্তে সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের কেবল টি-টোয়েন্টিই নয়, টেস্টেও অধিনায়ক। দেশের সেরা ও বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডারের উপর অধিনায়কের এই চাপকে তিনি কখনই ‘বাড়তি’ হিসেবে দেখতে চাননি। উল্টো উপভোগ করেছেন। সামনের দিনগুলোতেও করতে চান।
১
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ডেপুটি হিসেবে পেয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু তামিম ইকবালকে। কিন্তু সুবিধা হয়নি। ব্যর্থতার দায় কাঁধে তুলে দিয়ে সময়ের আগেই দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল তাদেরকে।
মুশফিকুর রহিমকে সরিয়ে ছয় বছর পর আবারও দায়িত্ব দেওয়া হল সাকিব আল হাসানকে। টেস্ট ক্রিকেটে। অবশ্য তার আগেই টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরে গেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। অগত্যা, ২০ ওভারের ফরম্যাটেও তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হল। মিশনটা শুরু হতে পারত চলতি বছরের শুরুতে। জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ শেষে লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ছিল ঘরের মাঠেই। নতুন দিন শুরু করার কথা ছিল সেই টেস্ট সিরিজে।
কিন্তু সাকিবের দুর্ভাগ্য। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিল্ডিং করতে গিয়ে পড়লেন ইনজুরিতে। ব্যাটসম্যানের নেওয়া শট এসে লাগল সরাসরি তার হাতের তালুতে। সেখানেই রক্তপাত। ব্যস, ম্যাচ তো শেষ বটেই; শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচেও মাঠের বাইরে। সবমিলিয়ে ১ মাসের বেশি সময় খেলতে পারেননি। হাতে করতে হয়েছে অস্ত্রোপচার।
পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ করে জাতীয় দলে ফিরলেন আফগানিস্তান সিরিজ দিয়ে। তার আগে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খেলে এসেছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটিও ছিল ভারতে। দেরাদুনের সেই সিরিজে মুদ্রার ওপিঠ দেখলেন সাকিব আর তার দল। আফগানদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি সাকিবরা। তিন ম্যাচের তিনটিতেই হেরেছে।
মাঠের এসব পারফরম্যান্সের বাইরে, আরও একটি ব্যাপার ঘটেছে সাকিবের সঙ্গে। সাকিব যে ২০১১ সালের পর অনেকখানি পরিণত হয়েছেন, তার প্রমাণ তিনি দিয়েই চলেছেন। একজন ‘কর্তা’ আরেকজন ‘নেতার’ মধ্যে যে খোলামেলা পার্থক্য থাকে তা তিনি এবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন। যেন হাঁটছেন মাশরাফির দেখানো পথে। অবশ্য সাকিব বারবারই বলে এসেছেন তিনি তার মতো।
আফগানিস্তান সিরিজের জন্য যখন মিরপুরে প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ দল, তখন গণমাধ্যমের আগ্রহে কেবলই সে দেশের লেগস্পিনার রশিদ খান। নিয়ম করে প্রতিদিন ক্রিকেটারদের এসব নিয়েই প্রশ্ন করা হত। ক্রিকেটাররা ‘ভয় পাচ্ছেন’ কিংবা ‘চিন্তিত’; এ ধরনের কথা বলে ফেললেই সেদিনের কাটতি বেড়ে যেত।
আইপিএল শেষ করে যখন সাকিব ফিরলেন, তখন তাকেও একই প্রশ্ন করা হয়েছিল বিমানবন্দরে। ঢাকায় সেদিন তাকে এটাও বলা হয়েছিল, রশিদকে নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশ। উল্টো সাকিব সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ক্রিকেটাররা বেশি চিন্তিত নাকি গণমাধ্যম? এক জিনিস যদি প্রতিদিন ক্রিকেটারদের জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে তারা এ ধরনের কথা বলবেই। তিনি সাথে এটাও যোগ করেন যে, গণমাধ্যমই রশিদকে বাংলাদেশের জন্য ভয় হিসেবে বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। হয়েছিলও তাই। বাংলাদেশ হেরেছিল রশিদের সামনে।
২
সাকিবের দ্বিতীয় দফার অধিনায়কত্বের দ্বিতীয় মিশন ছিল উইন্ডিজ সফরে। সেখানে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ, তিন ম্যাচের ওয়ানডে আর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টির পূর্ণাঙ্গ সিরিজ।
আফগানিস্তানের ব্যর্থতা টেস্টেও বজায় রেখেছিল সাকিবের দল। ৪৩ রানে গুটিয়ে গিয়ে গড়েছিল লজ্জার রেকর্ড। হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে। দুই ম্যাচেই তাদের এমন আত্মসমর্পণ দেখে উইন্ডিজ কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েড পর্যন্ত বলেছিলেন–
বাংলাদেশ এভাবে খেলবে তা আমি ভাবিনি। তারা এই সময়ে অনেক ভালো খেলছে। তাদের আরো ভালো করা উচিত ছিল।
সমালোচনাটা বারবার হচ্ছিল। কারণ সর্বশেষ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এখানে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে সফর করেছিল। সেখানে সব ম্যাচ জিতে স্বাগতিকদের হোয়াইটওয়াশ করেছিল। নায়ক ছিলেন সাকিব। এবার তার উল্টো ব্যাপার ঘটল। কিন্তু মাশরাফি এসে ওয়ানডেতে যেভাবে সবকিছু ঘুরিয়ে দিয়ে গেলেন, সেই ধারাবাহিকতা সাকিব আল হাসান ধরে রাখলেন টি-টোয়েন্টিতেও। ব্যস, পেয়ে গেলেন দ্বিতীয় দফার অধিনায়কত্বে প্রথম সাফল্য।
দেশে ফিরে তাই উচ্ছ্বাস তার চোখেমুখে। ঢাকায় বিমানবন্দরে নেমে বললেন, “হ্যাঁ সবমিলিয়ে বলতে গেলে এই ট্যুরটা সফল বলতে হবে। তিনটা ট্রফির মধ্যে দুইটা জিতেছি। দেশের বাইরে তো সাধারণত এরকম রেজাল্ট আমরা করতে পারি না। খুবই সন্তুষ্ট আমি।”
ব্যক্তিগতর হিসেবেও ঝলমলে ছিলেন সাকিব। ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিতেও তিনি নিজের নামের সঙ্গে সুবিচার করেছেন। একটি ৬০ রানের ইনিংসসহ তিন ম্যাচে তুলেছেন ১০৩ রান। বল হাতে নিয়েছেন ৩ উইকেট। সাকিব এ নিয়ে বলেছেন, “নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে অবশ্যই খুশি। হয়তো আরও অবদান রাখতে পারলে আরও ভাল হতো। ওভারঅল যে ধরনের পারফরম্যান্স হয়েছে তা নিয়ে খুবই আনন্দিত।”
পরিসংখ্যানে অধিনায়ক হিসেবে সাকিব উপরের দিকেই আছেন। ২০০৯-২০১১ সালের বাইরে গেল ছয় বছরে একাধিকবার সময়ে অসময়ে তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। টেস্টে ১১ ম্যাচের একটিতে সাকিব জিতেছেন। বাকি ১০টিতেই হার। ওয়ানডে ফরম্যাটে তার নেতৃত্বে ৫০ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। জয় এসেছে ২৩ ম্যাচে, হার ২৬ ম্যাচে। ফলাফল আসেনি এক ম্যাচে। টি-টোয়েন্টিতে ১৪ ম্যাচের তিনটিতে তিনি জয় এনে দিতে পেরেছেন। হেরেছেন বাকি সব ম্যাচে।
দলের নতুন হেডকোচ স্টিভ রোডস সাকিবে এক কথায় মুগ্ধ হয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে উইন্ডিজ সফর শেষে সাকিব প্রসঙ্গে বলেছেন,
আমরা টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির জন্য সাকিবকে অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছি। কৌশলগত দিক থেকে সে একজন অসাধারণ অধিনায়ক। সে নিজের খেলাটা যেভাবে খেলে তাতে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে। তবে টি-টোয়েন্টিতে তার ক্রিকেটিয় ভাবনা সত্যিই মনে রাখার মতো। এর কারণ এটা হতে পারে যে বিশ্বব্যাপী সে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে, অনেক বেশি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে। সে খেলাটা জানে, সে খেলোয়াড়দের বোঝে। তার মতো একজন ভালো অধিনায়ক পেয়ে আমরা ভাগ্যবান।
টি-টোয়েন্টিতে ঘুরে দাঁড়ালেও, টেস্টে ওভাবে মুখ থুবড়ে পড়াটা বেশ চোখে লাগার মতো। তাহলে কি অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারছেন না সাকিব? উত্তর দিলেন তার কোচ। রোডসের ভাষায়,
ক্রিকেটের সবকিছু নির্ভর করে প্রেরণার উপর। এমনকি বিশ্বের সেরা অধিনায়কের বেলাতেও যখন এই ব্যাপারটা নিচে নেমে যায়, তখন তার জন্যও সবকিছু কঠিন হয়ে পড়ে। প্রথম ম্যাচে যখন আমরা টসে হারলাম, ১০০ রানের নিচে গুটিয়ে গেলাম তখন সবকিছু আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। সাকিবের সঙ্গেও তাই হয়েছিল। আমার মনে হয় আমরা যদি টস জিততাম, যদি ভালো শুরু পেতাম তাহলে সবকিছু অন্যরকম হতে পারত। কারণ আগেই বললাম, সাকিব অনেক ভালো অধিনায়ক।
কেবল নিজের পারফরম্যান্স বা নেতৃত্ব নয়। বাজে সময়ে দলের পাশে থাকাটাও যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হয়তো এবার টের পাচ্ছেন সাকিব। তাই পুরো সিরিজ জুড়ে যখন তরুণ ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে, সাকিব দাঁড়াচ্ছেন ঢাল হয়ে। বড়রাই কেন বেশি রান পাচ্ছে, ছোটরা রান পাচ্ছে না। এমন প্রশ্নের উত্তরে সাকিব কারণ দেখাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘দেখুন আমরা ব্যাট করি খেলার শুরুর দিকে। ব্যাট করার সুযোগটা বেশি পাই, স্বাভাবিকভাবে অবদান রাখার সুযোগ আমাদেরই থাকবে এবং আমাদেরই করা উচিত। সে কারণে আমাদের কন্ট্রিবিউশনের পারসেন্টেজ বেশি হয়।
দিন শেষে এই সাকিব পরিণত। কেবল ক্রিকেটার হিসেবেই নয়, মানুষ ও অধিনায়ক হিসেবেও।
ফিচার ইমেজ- AFP