অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তার নেতৃত্বাধীন খেলা সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার কে? টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা, বিশ্বসেরা লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন নাকি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট? একাদশের প্রত্যেক সদস্য এবং শেন ওয়ার্ন ও গ্লেন ম্যাকগ্রাকে পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে তিনি বলেছেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার নেতৃত্বাধীন খেলা সব ক্রিকেটারের চেয়ে দামি এবং তার চেয়ে দ্রুত আর কেউ ম্যাচের দৃশ্যপট বদলাতে পারে না।
অ্যাডাম গিলক্রিস্টের মতো একজন ক্রিকেটারের অধিনায়ক হতে পেরে স্টিভ ওয়াহ নিজেকে গর্বিত মনে করেন। শুধু তা-ই নয়, শচীন টেন্ডুলকার, জ্যাক ক্যালিস, শেন ওয়ার্ন, মুরালির মতো ক্রিকেটারকে বাদ দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রিকেটার হিসেবে অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে প্রাধান্য দিয়েছেন স্টিভ ওয়াহ। অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ, অস্ট্রেলিয়াকে ৫৭ বার নেতৃত্ব দিয়ে ৪১টি জয় এনে দিয়েছিলেন, তার নেতৃত্বাধীন মাত্র নয়টি টেস্টে পরাজিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এছাড়াও ১০৭টি একদিনের ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৬৭টি ম্যাচে জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সাকিব কিংবা তামিম, ভারতের শচীন কিংবা কোহলি থেকে শুরু করে অনেক নামকরা ক্রিকেটারেরই ভালো এবং মন্দ বলা লোকের সংখ্যার অভাব নেই। শুধু তা-ই না, আপনি নতুন কোনোকিছু শুরু করলে মানুষজন ভালো এবং মন্দ দু’ধরনের মন্তব্যই করবে। ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, হাশিম আমলা এদের মতো, ক্রিকেটে যে কয়েকজন নিপাট ভদ্রলোক আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ‘জিরো হেটার’-এর তকমা তার নামের পাশে লাগালে খুব একটা বাড়াবাড়ি হবেনা।
জন্ম এবং শৈশবকাল
১৯৭১ সনের ১৪ই নভেম্বর, অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত শহর নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্মগ্রহণ করেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। হুট করেই গিলক্রিস্টের ক্রিকেটে আবির্ভাব হয়নি। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে নিজের প্রতিভার প্রমাণ রেখেই সাফল্যের উচ্চশিখরে উঠেছিলেন। গিলক্রিস্ট তার রাষ্ট্রের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেট দলে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে রিচমন্ড ক্রিকেট ক্লাব থেকে স্কলারশিপের অফার পান তিনি। সেসময় তিনি ওল্ড অ্যাক্টোনিয়ান্সের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও খেলেন। ১৯৯১ সালে অস্ট্রেলিয়ার তরুণ ক্রিকেটাররা টেস্ট এবং ওডিআই সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড সফরে যায়। ঐ সফরে অস্ট্রেলিয়া যুবদলের স্কোয়াডে গিলক্রিস্টও ডাক পান। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে একটি শতক এবং একটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ব্যাট হাতে ভালো সময় কাটান ইংল্যান্ডে।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর গিলক্রিস্ট অস্ট্রেলিয়ায় সফররত দলগুলোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখেন। এরপর তাকে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে গিলক্রিস্টের। নিজের প্রথম মৌসুমে শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেন তিনি। ৩০.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ২৭৪ রান করেছিলেন নিজের প্রথম মৌসুমে। পরের মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলসে তিনি খুব একটা সুযোগ পাননি নিজেকে মেলে ধরার। তাই ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান গিলক্রিস্ট। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় নিজের প্রথম মৌসুমে ২৬.৫৩ ব্যাটিং গড়ে ৩৯৮ রান করে ব্যাট হাতে তুলনামূলক ব্যর্থ হলেও উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে ৫৫টি ডিসমিসাল করেন তিনি, যা ঐ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড ছিলো।
১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়া তরুণ দলের সাথে ইংল্যান্ড সফরে যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। সেখানে তিনি ইংলিশ কাউন্টি দলের বিপক্ষে ৭০.০০ ব্যাটিং গড়ে ৪৯০ রান করেন। এরপর ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে ৫৮টি ডিসমিসাল করে আবারও রেকর্ড গড়েন গিলি। ঐ মৌসুমে ব্যাট হাতেও রানের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। ৫০.৫২ ব্যাটিং গড়ে ৮৩৫ রান করে নির্বাচকদের নজরে আসেন গিলক্রিস্ট। সেইসময় অস্ট্রেলিয়ার নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলির সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছিলো না। তাই মিডিয়াতে হিলির বদলি গিলক্রিস্টকে সুযোগ দেয়ার কথা উঠেছিল। ঠিক সেইসময়েই হিলি তার ক্যারিয়ার সেরা ১৬১* রানের ইনিংস খেলে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার রক্ষা করেন।
আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গনে গিলক্রিস্ট
ঘরোয়া ক্রিকেটে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করার পরেও অস্ট্রেলিয়া দলে সুযোগ মিলছিল না অ্যাডাম গিলক্রিস্টের। সেসময়কার নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলির দরুন দলের আশেপাশে থাকলেও একাদশে জায়গা ডাক পাননি গিলি। অতঃপর ১৯৯৬ সালের ২৫শে অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার ১২৯তম ক্রিকেটার হিসাবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের। নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলি ইনজুরির কবলে পড়লে তার পরিবর্তে গিলক্রিস্টকে দলে ডাক দেয়া হয়। সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে দুটি একদিনের ম্যাচে সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচে অ্যালান ডোনাল্ডের বলে আউট হওয়ার আগে ১৮ রান করার পর দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম বলেই রানের খাতা খোলার আগে রান আউট হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয়েছিলো গিলক্রিস্টকে। নিজের পরবর্তী ম্যাচ খেলতে প্রায় পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হয় গিলক্রিস্টকে। এবার ইয়ান হিলি দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হলে সুযোগ মেলে গিলির। এবারও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি তিনি। প্রথম ম্যাচে এক রান করে রান আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে গিলক্রিস্ট ব্যাটিং করার আগেই ম্যাচ নিজেদের করে নেয় অস্ট্রেলিয়া। একদিকে প্রথম চার ম্যাচের দুটোতেই রান আউট হয়ে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে পারেন, অন্যদিকে ইয়ান হিলির নিষেধাজ্ঞা কাটানোর পর মার্ক ওয়াহর ইনজুরিতে পড়ার কারণে পুরো সিরিজে স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলার সুযোগ পাওয়াতে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন গিলক্রিস্ট। এবার আর ভুল করেননি, দলীয় সর্বোচ্চ ৭৭ রান করে দলের জয়ে অবদান রাখেন গিলি।
তৎকালীন অন্যসব উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের মতো গিলক্রিস্টকেও ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সাত নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে একজন স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যানের চেয়েও কম নন, সেটা বুঝতে খুব বেশি সময় অপচয় করেনি অস্ট্রেলিয়ারা হর্তাকর্তারা। ১৯৯৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি, প্রথমবারের মতো ওপেনিংয়ে নেমে ২৭ বলে ২০ রান করার পর ওপেনিংয়ে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ১০৪ বলে ১০০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন গিলক্রিস্ট, যার সুবাদে ওপেনিংয়ে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন তিনি। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন ১৯৯৯ সালে। এর আগে ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার সাথে ত্রিদেশীয় সিরিজে ৪৩.৭৫ ব্যাটিং গড়ে ৫২৫ রান করে বিশ্বকাপের আগে নিজের প্রস্তুতিটা ভালোভাবেই সেরে নেন গিলি। বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে খুব একটা ছন্দে ছিলেন না। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩৯ বলে ৬৩ এবং ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৬ বলে ৫৪ রানের দুটি সময়োপযোগী ইনিংস ব্যতীত পুরো টুর্নামেন্টেই ছিলেন নিষ্প্রভ। মাত্র ২১.৫৪ ব্যাটিং গড়ে করেছিলেন ২৩৭ রান।
টেস্ট ক্রিকেটে রাজকীয় অভিষেক
অ্যাডাম গিলক্রিস্টের কাছে বছর দুয়েক আগে লিমিটেড ওভারের ম্যাচে নিজের পজিশন হারিয়েছিলেন ইয়ান হিলি। নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের পর নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটেও গিলক্রিস্টের নিজের জায়গা হারান হিলি। জায়গা হারান বললে ভুল হবে! ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়ার মতো ক্যারিয়ার শেষে যোগ্য ব্যক্তির কাঁধেই দায়িত্ব তুলে দেন। লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটের পর টেস্ট ক্রিকেটেও শুরু থেকেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন গিলি। ১৯৯৯ সালের ৫ই নভেম্বর, পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্রিসবেনে টেস্ট অভিষেক ঘটে গিলক্রিস্টের। নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৮৮ বলে ৮১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে অভিষেক টেস্ট স্মরণীয় করে রাখেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে তার আর ব্যাট করার প্রয়োজন পড়েনি। তার আগেই দশ উইকেটের জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
হোবার্টে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট অভাবনীয় এক ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের দেয়া ৩৬৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১২৬ রানেই পাঁচ উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েব আক্তার, আজহার মাহমুদ এবং সাকলাইন মুস্তাকদের নিয়ে পাকিস্তানের বোলিং লাইনআপ ছিলো সময়ের সেরা। অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য তখনও ২৪৩ রান প্রয়োজন ছিল। সেসময়ে ব্যাটিংয়ে নামেন এর আগে মাত্র একটি টেস্ট খেলা গিলক্রিস্ট। জাস্টিন ল্যাঙ্গারের সাথে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ২৩৮ রান যোগ করে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছান গিলক্রিস্ট। ইনিংসের শুরু থেকেই গিলক্রিস্ট মারমুখী ছিলেন। চাপের মুখে থেকেও পাকিস্তানি বোলারদের পাল্টা আক্রমণ করে মাত্র ১৬৪ বলে ১৩টি চার এবং ১টি ছয়ের সাহায্যে ১৪৯* রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ তার ইনিংস দেখে বলেছিলেন, সে বোধহয় তার নিজের আঙিনায় ব্যাট করছিলো।
অ্যাডাম গিলক্রিস্টের কিছু সেরা নৈপুণ্য
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার একযুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৯৬টি টেস্টে ১৭টি শতকের সাহায্যে ৪৭.৬০ ব্যাটিং গড়ে ৫,৫৭০ রান এবং ২৮৭টি ওডিআইতে ১৬টি শতক হাঁকিয়ে ৩৫.৮৯ ব্যাটিং গড়ে ৯,৬১৯ রান করেছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে তার ১৭টি শতকের মধ্যে মাত্র একটিতে পরাজিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ওডিআইতে ১৬টি শতকের সবকটিতেই শেষ হাসি হাসে ক্যাঙ্গারুরা। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট পারফর্ম করা মানেই স্পেশাল কিছু। হোক সেটা স্ট্যাম্পের সামনে অথবা পেছনে।
১
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার ক্যারিয়ারের একমাত্র দ্বিশতক হাঁকান ২০০২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। অ্যালান ডোনাল্ড, মাখায়া এনটিনি, জ্যাক ক্যালিসদের তাদের নিজেদের মাঠ জোহানসবার্গে বেধড়ক পিটিয়ে সেইসময়ের দ্রুততম দ্বিশতক (২১২বল) হাঁকান গিলি। শেষপর্যন্ত গিলক্রিস্ট মাত্র ২১৩ বলে ১৯টি চার এবং ৮টি ছয়ের সাহায্যে ২০৪* রানে অপরাজিত থাকেন। কেপটাউনে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেও প্রোটিয়া বোলারদের তুলোধুনো করে ১০৮ বলে ২২টি চার এবং ২টি ছয়ের সাহায্যে অপরাজিত ১৩৮* রানের ইনিংস খেলেছিলেন। জোহানেসবার্গ, কেপটাউন, ডারবান- পুরো সিরিজেই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। পাঁচ ইনিংসে ১৫৭.৬৬ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৪৭৩ রান, মাত্র ৪৭৪ বল মোকাবেলা করে।
২
ভারতের মাটিতে গিলক্রিস্ট নিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেন, ২০০১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি। ভারতের মাটিতে নিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন অনবদ্য শতক হাঁকিয়ে। মুম্বাই টেস্টে মাঠে নামার আগে অস্ট্রেলিয়া একাধারে পনেরোটি টেস্ট ম্যাচে জয়লাভ করেছিলো। মুম্বাই টেস্টে ভারতকে দশ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে টানা ১৬টি টেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়ে অস্ট্রেলিয়া। দশ উইকেটের জয়! ফলাফল দেখে যে কেউ বলবে অস্ট্রেলিয়া সহজেই জয়ের মুখ দেখেছে। বলারই কথা। যা ঘটেছে তা বলা মাত্রাধিক্য না। জয়টা সহজ করে দিয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ভারতকে প্রথম ইনিংসে ১৭৬ রানে গুটিয়ে দিয়ে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯৯ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। হরভজন সিংয়ের ঘূর্ণিতে কুপোকাত হয় অজিদের টপ অর্ডার। সেখান থেকে ওপেনার হেইডেনের সাথে জুটি বেঁধে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ১৯৭ রান যোগ করেছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। নিজের স্বভাবসুলভ ব্যাটিং করে মাত্র ৮৪ বলে শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। তার ১১২ বলে ১৫টি চার এবং ৪টি ছয়ের সাহায্যে সাজানো ১২২ রানের ইনিংসের সুবাদে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে বড় লিড পায় এবং সহজেই ম্যাচ জিতে নেয়।
৩
২০০৫ সালের দোসরা জানুয়ারি পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলিয়া। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। ম্যাচের ফলাফলে চোখ বোলালে দেখা যাবে পাকিস্তানকে নয় উইকেটে পরাজিত করেছে স্বাগতিকরা। ম্যাচে আট উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। রিকি পন্টিংয়ের দ্বিশতকে রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া। পন্টিং, ম্যাকগিল কাগজে-কলমে ম্যাচের সেরা পারফর্মার, কিন্তু পাকিস্তানকে ম্যাচ থেকে সম্পূর্ণভাবে ছিটকে দিয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। গিলক্রিস্ট যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ছিল চার উইকেটে ৩১৮ রান। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের করা ৩০৪ রান গিলক্রিস্ট ক্রিজে আসার আগেই টপকে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। গিলক্রিস্ট এসে ওয়ানডে মেজাজে ১২০ বলে ১৪টি চার এবং ৫টি ছয়ের সাহায্যে ১১৩ রান করে দ্রুত লিড বাড়ান। যার ফলে পাকিস্তান নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসেও তিন শতাধিক রান সংগ্রহ করেও ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি।
৪
মেলবোর্নে ২০০৫ সালে ৭ অক্টোবর, বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া। শোয়েব আখতার, শন পোলক, মুত্তিয়া মুরালিধরন, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি এবং জ্যাক ক্যালিসদের নিয়ে বেশ শক্তিশালী বোলিং লাইনআপ ছিলো বিশ্ব একাদশের। ভিন্ন ভিন্ন দেশের তারকা ক্রিকেটাররা একসাথে খেলার খুব একটা অভিজ্ঞতা ছিলো না। প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও মাঠের খেলায় অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারেনি বিশ্ব একাদশের ক্রিকেটাররা। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের দিনে বিশ্বের যেকোনো বোলার কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পোলক, মুরালিদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হয়নি। গিলক্রিস্ট মাত্র ৭৯ বলে চারটি ছয় এবং আটটি চারের মারে ১০৩ রান করেন, যার ফলে বিশ্ব একাদশকে ৫৫ রানে পরাজিত করে অস্ট্রেলিয়া। শুধু এই ম্যাচেই না, সফরের সবকটি ম্যাচে বিশ্ব একাদশকে শোচনীয়ভাবে হারিয়েছিল অজিরা।
৫
২০০৫ সালের ৯ এপ্রিল, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মাটিতে টেস্ট ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলিয়া। ফতুল্লায় সিরিজের প্রথম টেস্টে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নামের একজন ব্যাটসম্যান না থাকলে অজিদের ফলো-অনে পড়তে হতো। বাংলাদেশের ৪২৭ রানের জবাবে মাত্র ৯৩ রান তুলতেই ছয় উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। ফলো-অন এড়াতে হলেও আরও ১৩৪ রান প্রয়োজন ছিলো সফরকারীদের।
অতীতের বহু ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও দলের হাল ধরেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। বাংলাদেশের স্পিনিং ট্র্যাকে নিজের স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং না করলেও ব্রেট লি, জ্যাসন গিলেস্পি এবং স্টুয়ার্ট ক্লার্কদের নিয়ে ফলো-অন এড়ায় গিলক্রিস্ট। তার ২১২ বলে ১৫টি চার এবং ৬টি ছয়ের সাহায্যে সাজানো ১৪৪ রানের ইনিংসের কারণে চালকের আসনে থেকেও জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ।
৬
২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর পার্থে অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দুই টেস্টে পরাজিত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের। পার্থ টেস্টের প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়াকে ২৪৪ রানে গুটিয়ে দিয়ে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলো বোলাররা। শেষপর্যন্ত অবশ্য হাসতে পারেনি ইংলিশরা। অস্ট্রেলিয়ার ২৪৪ রানের জবাবে ২১৫ রানের মধ্যে নিজেদের প্রথম ইনিংসের সবকটি উইকেট হারায় তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে অজি ব্যাটসম্যানরা নিজেদের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেনি। ম্যাথু হেইডেন ও রিকি পন্টিংয়ের অর্ধশতক এবং মাইকেল ক্লার্ক ও মাইক হাসির শতকের উপর ভর বড় সংগ্রহের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো অজিরা। ঐদিন মাইক হাসি এবং ক্লার্কের শতকের পাশাপাশি আরও একজন শতক হাঁকিয়েছিলেন। রীতিমত ইংলিশ বোলারদের উপর তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে মন্টি প্যানেসারের বলে রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফেরার পর দ্বিতীয় ইনিংসে প্যানেসারের এক ওভারে ২৪ রান নিয়েছিলেন গিলক্রিস্ট!
রেকর্ডের জন্য খেললে হয়তো সেদিন দ্রুততম টেস্ট শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের তালিকায় নিজের নাম সবার উপরে লেখাতে পারতেন। ড্রেসিংরুম থেকেও কোনো ম্যাসেজ যায়নি। তার সতীর্থরাও হয়তো বুঝতে পারেননি, তিনি করতে চলেছেন। ভিভ রিচার্ডসের চেয়ে ১ বল বেশি খেলে ৫৭ বলে সেঞ্চুরি করেন। শেষপর্যন্ত ৫৯ বলে ১২টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ১০২* রানে অপরাজিত ছিলেন।
৭
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার ক্যারিয়ারে তিনবার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শতভাগ সাফল্যের সাথে তিনটি আসরেই চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫৪ এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৫৭ রান করার পর ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেন গিলক্রিস্ট। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অজি কাপ্তান রিকি পন্টিং। বৃষ্টির কারণে পিচ অনেকক্ষণ ঢাকা ছিলো, সেইসাথে আউটফিল্ডও তুলনামূলক স্লো থাকবে প্রথম ইনিংসে। সবদিক বিবেচনায় পন্টিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে কানাঘুষো চলছিলো। বৃষ্টির কারণে খেলা নির্ধারিত সময় থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে শুরু হলে, পন্টিংয়ের আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিলো কিনা ভুল! সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার বাড়তি সময় মিলে যায়। তিনঘণ্টা দেরিতে খেলা শুরু হওয়ার কারণে ৩৮ ওভারের ম্যাচ মাঠে গড়ায়।
অধিনায়কের সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত হতে দেননি মারকুটে ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। বাড়তি সুবিধার জন্য গ্লাভসের মধ্যে স্কোয়াশ বল রেখে ব্যাটিং করেন তিনি। গ্লাভসে স্কোয়াশ বল রাখার কারণে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও আইসিসি থেকে গ্লাভস ব্যবহারে কোনও বিধি-নিষেধ ছিলো না। সেইদিন অ্যাডাম গিলক্রিস্টের প্রত্যেক শটে ছিলো আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া। চামিন্দা ভাস, মালিঙ্গাদের বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে কব্জির জোরে একের পর এক বল সীমানা ছাড়া করছিলেন। স্পিনারদের বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে একই কাজ করছিলেন। তার ধ্বংসাত্মক ব্যাটিংয়ের কাছেই শ্রীলঙ্কার শিরোপা জয়ের স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়।
ব্রিজটাউনে গিলক্রিস্ট কতটা আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছিলেন সেটা তার সঙ্গী হেইডেনের ইনিংস বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। এই দুজন উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ২২.৫ ওভারে ১৭২ রান যোগ করেছিলেন। তার মধ্যে হেইডেনের সংগ্রহ ৫৫ বলে মাত্র ৩৮ রান! দিলহারা ফার্নান্ডোর শিকারে পরিণত না হলে হয়তো মাত্র ৩৮ ওভারের ম্যাচেই দ্বিশতক হাঁকিয়ে বসতেন গিলি। তবুও তিনি যা করেছেন তা এখনও বিশ্বকাপের ফাইনালে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। গিলক্রিস্ট যখন আউট হন, তখন ৩০.৩ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ২২৪। গিলি একারই সংগ্রহ ছিলো ১০৪ বলে ১৪৯ রান! তার ইনিংসটি ১৩টি চার এবং ৮টি ছয়ের মাধ্যমে সাজানো ছিলো।
উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের দিনবদলের নায়ক
টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বগুলোর মধ্যে উইকেট কিপিং সবার উপরেই থাকবে। সারাদিন মনোসংযোগ ঠিক রাখার পাশাপাশি ফিটনেস লেভেলও যথাযথ হওয়া জরুরি এই দায়িত্ব পালন করার জন্য। গত শতকের শুরুর দিকে একাদশে স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান, বোলারের পাশাপাশি স্পেশালিষ্ট উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানও নেওয়া হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের সেরা দুই উইকেটরক্ষক বেশিরভাগ সময় এগারো নাম্বারে ব্যাট করতে নামতেন। টেস্ট ক্রিকেটে একটা ক্যাচ এবং একটা স্ট্যাম্পিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। একটা ক্যাচ হাত ফসকালে তার ফলাফল খুব একটা ভালো হয় না। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা খুব বেশি সুযোগ দেয় না। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা প্রচুর শট খেলে, সেখানে আউট হওয়ার সুযোগও বেশি থাকে। টেস্ট ক্রিকেটে সুযোগ কম আসে, যেগুলো আসে সেটার সদ্ব্যবহার করতে একজন স্পেশালিষ্ট উইকেটরক্ষকই দরকার। তাই স্পেশালিষ্ট উইকেটরক্ষক খেলাতে কোনো দলই সঙ্কোচ বোধ করে না। বর্তমানে শুধুমাত্র উইকেটরক্ষক হিসাবে দলে জায়গা করে নেওয়া কঠিন। উইকেট কিপিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও অবদান রাখতে হয়।
টেস্ট ক্রিকেটের শুরুর দিকে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান বেশিরভাগ আট থেকে এগারো নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতেন। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ৭০% ইনিংসে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানরা আট থেকে এগারো নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতেন। মাত্র ৮.৭% ইনিংসে সাত নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতো উইকেটরক্ষকরা। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সাত নাম্বার পজিশনে উইকেটরক্ষকরা ব্যাট করেছিলো ২১% ইনিংসে। শেষ চার পজিশনে ব্যাট করেছিলো ৪৫% ইনিংসে। ১৯৬০ সালের পর বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের দেখা পেয়েছিল ক্রিকেট বিশ্ব, যারা সাত নাম্বার পজিশন উইকেটরক্ষকদের জন্য বরাদ্দ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৩৮% ইনিংসে উইকেটরক্ষকরা সাত নাম্বার পজিশনে ব্যাট করেছিলো। শেষ চারে ব্যাট করেছিলো ৩৭% ইনিংসে। অ্যালান নট, রড মার্শ, জেফ ডুজন, ইয়ান হিলি, জ্যাক রাসেল, ডেরিক মুরি, কেন ওয়াডসওর্থ তাদের ক্যারিয়ারের সিংহভাগ ইনিংস সাত নাম্বার পজিশনে ব্যাট করেছিলেন।
১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হলো অ্যাডাম গিলক্রিস্ট শো। স্পেশালিষ্ট উইকেটরক্ষক এবং স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান দুটি একসাথেই পেয়ে গেলো অস্ট্রেলিয়া। গিলক্রিস্ট তার টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৩৭ ইনিংসের মধ্যে ১০০ ইনিংস ব্যাটিং করেছিলেন সাত নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে। তিনি এই পজিশনে ৪৬.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ৩,৯৪৮ রান করেছেন। তারপর থেকে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের নির্দিষ্ট ব্যাটিং পজিশন হয়ে দাঁড়ায় সাত নাম্বার। গিলক্রিস্টের অবসরের পর এই পজিশনে কমপক্ষে ২১ ইনিংস ব্যাট করা ১৮ জন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ১৭জন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। টেস্ট ক্রিকেটে একজন স্পেশালিষ্ট উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান খেলানো খুব বেশি বিলাসিতা নয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র উইকেটরক্ষক হিসাবে দলে জায়গা পাওয়া কঠিন। সুযোগ পেতে হলে সাত নাম্বারে ব্যাটসম্যান হিসাবেও নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়
সাদা পোশাকে হোক কিংবা রঙিন পোশাকে, ওপেনিংয়ে হোক কিংবা সাত নাম্বারে- অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই বোলারদের কোণঠাসা করে ব্যাটিং করতে পছন্দ করতেন। ওডিআইতে ইনিংসের প্রথম বল থেকেই নিজের স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে বোলারদের মনোবল শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতেন। আর টেস্ট ক্রিকেটে টপ অর্ডারদের প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে বোলাররা সবেমাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে যাবেন, এমন সময়ে ক্রিজে এসে পাল্টা আক্রমণ করতেন গিলক্রিস্ট। সব ফরম্যাটেই একই মেজাজে ব্যাট করতেন, টেস্ট ক্রিকেটে প্রতি ১০০ বলে প্রায় ৮২ রান করে করতেন গিলি। অভিষেকের পাশাপাশি অভিধানে অবসর বলেও একটা শব্দ আছে।
২০০২ সালের উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার, ২০০৩ এবং ২০০৪ আইসিসির বর্ষসেরা ওডিআই ক্রিকেটার নির্বাচিত হওয়া অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ২০০৮ সালের মার্চের ৪ তারিখে ওডিআই ক্রিকেটে অবসর নেওয়ার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান। টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন একই বছরের জানুয়ারিতে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক কোচ জন বুকানন বলেন, গত বছর ড্যামিয়েন মার্টিন, শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, জাস্টিন ল্যাঙ্গার অবসর নেওয়াতে যে ক্ষতি হয়েছে তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের অবসরে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড, গিলক্রিস্টকে তার অবসরের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বলেছিলেন।
ক্যারিয়ার জুড়ে দুর্দান্ত সব ক্যাচ লুফে নেওয়া গিলক্রিস্ট লক্ষণের একটি ক্যাচ ধরতে না পারার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ২৮৭টি ওডিআইতে ৩৫.৮৯ গড়ে ও ৯৬.৯৪ স্ট্রাইক রেইটে ৯,৬১৯ রান করেছেন। সর্বোচ্চ ১৭২ রানের ইনিংস সহ ১৬টি শতক এবং ৫৫টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। ৯৬টি টেস্টে ৪৭.৬০ ব্যাটিং গড় এবং ৮১.৯৫ স্ট্রাইক রেটে ৫,৫৭০ রান করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ২০৪* রানের ইনিংস সহ ১৭টি শতক এবং ২৬টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। তার জন্য আদর্শ ফরম্যাটে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুব বেশিদিন খেলতে পারেনি। আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ১৩টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ১৪১.৬৬ স্ট্রাইক রেইটে ২৭২ রান করেছেন। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে টেস্ট ক্রিকেটে ৩৭৯টি ক্যাচ ও ৩৭টি স্ট্যাম্পিং করেছেন। ওডিআইতে ৪১৭টি ক্যাচ ও ৫৫টি স্ট্যাম্পিং করেছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।
ভারত ভ্রমণ
২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন গিলক্রিস্ট। ঐ বছরেই আইপিএলের যাত্রা শুরু হয়। আইপিএলের প্রথম আসরে ডেকান চার্জাসের হয়ে খেলেছিলেন গিলি। ঐ আসরে ডেকান পয়েন্ট তালিকার তলানিতে থেকে বিদায় নেয়। দ্বিতীয় আসরে গিলক্রিস্টকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একসময়কার তার সতীর্থ ড্যারেন লেম্যানকে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুইজনের মাঠে এবং মাঠের বাহিরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডেকান চার্জাস আইপিএলের শিরোপা লাভ করে। টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করার দরুন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জেতেন গিলক্রিস্ট। আইপিএলের চতুর্থ আসরে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে যোগদান করেন গিলি। প্রীতি জিনতার পাঞ্জাবের অধিনায়ক এবং কোচ দুটি দায়িত্বই একসাথে পালন করেন গিলক্রিস্ট। ২০১৩ সালে আইপিএলের পঞ্চম আসর খেলে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটকে বিদায় জানান গিলি। নিজের শেষ ম্যাচ খেলার আগের দুই ম্যাচে যথাক্রমে ৮৫* এবং ৪২ রান করে শুভাকাঙ্ক্ষীদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বয়স বাড়লেও ব্যাটের ধার কমেনি। ব্যাট হাতে বোলারদের তুলোধুনো, গ্লাভস হাতে দুর্দান্ত সব ক্যাচ লুফে নেওয়া- এই দুইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো গিলক্রিস্টের ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
আইপিএলে নিজের শেষ ম্যাচে হঠাৎ করে গ্লাভস ছেড়ে বল হাতে তুলে নিলেন গিলি। নিজের ওভারের প্রথম বলেই হরভজন সিংকে আউট করে ক্রিকেটে প্রচলিত সবরকমের উদযাপন করে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। আইপিএলে গিলক্রিস্ট ৮০ ম্যাচে দুটি শতক এবং ১১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ১৩৮.৩৯ স্ট্রাইক রেটে ২,০৬৯ রান করেছিলেন। সারা জীবন ক্রিকেটকে এতো কিছু দিলেন গিলক্রিস্ট, তাই ক্রিকেট বিধাতা তাকে উইকেট শূন্য রেখে বিদায় জানায়নি। তাকে অপছন্দ করে এমন ক্রিকেটপ্রেমীর সংখ্যা শূন্য থেকে গেলেও প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে তার উইকেট সংখ্যা শূন্য থাকেনি।