ফুটবলে গোলটা মূলত আসে ঐ ফরোয়ার্ডদের পা থেকেই। আরও ভেঙে বললে দলে থাকা স্ট্রাইকারই গোল এনে দেবার প্রধান ভরসা। কিন্তু দলে যদি স্ট্রাইকার না থাকে? স্ট্রাইকারের ভূমিকায় যদি এমন একজন থাকে, যিনি আসলে প্রতিপক্ষের কাছে ধরা দেন দোধারি তলোয়ার হয়ে? একবার তিনি স্ট্রাইকারের ভূমিকায় থাকেন, আবার পরক্ষণে নিচে নেমে এসে মিডফিল্ডারদের সাথে সন্ধি করেন… দোধারি তলোয়ারই তো!
কিছুদিন আগেও অসম্ভব এক চিন্তা বলেই মনে হতো এটাকে। কিন্তু এই চিন্তাই আসলে ফুটবলের এক অতি জনপ্রিয় কৌশল – ফলস নাইন; যে কৌশলে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভিসেন্তে দেল বস্কের স্পেন, আর বার্সেলোনায় পেপ গার্দিওলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একচ্ছত্র রাজত্ব। তবে অতি শক্তিশালী রাজত্বেরও একদিন পতন ঘটে, পতন ঘটে কৌশলেরও। স্পেন যে পাসিং ফুটবলের সাথে ফলস নাইন কৌশল মিলিয়ে ঐতিহাসিক এক ফুটবল ঘরানার সূচনা করেছিল, সেই কৌশলেরও পতন ঘটেছিল কয়েক বছর পরই। মরিনহো আটকে দিয়েছিলেন ফলস নাইনে থাকা মেসিকে। আর পাসিং ফুটবল আটকে দেবার জন্য বর্তমানে অনেক কৌশল রয়েছে কোচদের হাতে।
কিন্তু ফুটবলে কৌশল কি একেবারেই মরে? আসলে মরে না, ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে আবার পুনরায় জন্ম দেয়। আর এই জন্ম দেবার কাজটা করেন গার্দিওলার মতো ফুটবল কৌশল নিয়ে কাটাকুটি খেলায় মেতে থাকা মানুষেরা। গার্দিওলা কিন্তু এখনও পাসিং ফুটবলটাই খেলান। কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বার্সার ব্যবহার করা তার পাসিং ফুটবলের কৌশল আর বর্তমান কৌশলের ভেতর বিস্তর ফারাক।
কিন্তু টিকিটাকা আর ফলস নাইনের আঁতুড়ঘর তো এই স্পেন আর কাতালুনিয়ার ঐ ক্লাবটি। তাই এরাও পাসিং ফুটবল ভুলতে পারে না। লোপেতেগি থেকে জাভি বা লুইস এনরিকে – সবার কথা ঘুরেফিরে একই। বল পায়ে রাখতে হবে আর দিতে হবে নিখুঁত পাস।
২০১০ বিশ্বকাপে স্পেনের হয়ে এই ফলস নাইনের ভূমিকায় দুর্দান্ত খেলা দেখিয়েছিলেন ডেভিড ভিয়া আর ফার্নান্দো তোরেস। এরপর একই কৌশল ব্যবহার করে ইউরো জয়। তারপর এলো ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। পাসিং আর ফলস নাইন কৌশলে খেলা স্পেন হোঁচট খেল গ্রুপপর্বেই। দলে ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়, বিশ্বকাপজয়ী কোচ। তবুও পাসিং ফুটবলের পসরা বসানো স্পেনকে নিয়ে ছেলেখেলা করলো ডাচবাহিনী। কৌশলের মারপ্যাঁচে হারিয়ে দিল চিলি। স্পেন সেবার ঠিক ফলস নাইন ফুটবলটা খেলেনি বটে, কিন্তু ডিয়েগো কস্তা তো গোলের খাতাই খুলতে পারলেন না।
তবে কস্তার এমন হতাশার গল্পটা তার একার না। স্ট্রাইকার ছাড়া ফুটবল খেলা স্পেনের জন্য যেন অভিশাপ হয়ে এসেছিল। প্রথাগত স্ট্রাইকার বলতে আমরা যেমন খেলোয়াড় বুঝি – স্পেনের ফুটবলে তেমন স্ট্রাইকারের যেন বড়ই অভাব। তাই টিকিটাকা আর ফলস নাইনের সময় ফুরিয়ে আসবার পর স্পেন যখন প্রথাগত স্ট্রাইকার নিয়ে ফুটবলটা খেলতে শুরু করার চেস্টা করছিল, তখন দেশটি দেখেছিল স্ট্রাইকারের খরা। আসপাস, কস্তা, মোরাতা, রোদ্রিগো, মোরেনো, আলকাসের – এই নামগুলো স্পেনের জন্য কখনোই ভরসাযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
অগত্যা কি আর করার। স্ট্রাইকার ছাড়াই খেলা হোক। লুইস এনরিকে এজন্য আবার হেঁটেছেন সেই পুরোনো পথে। কাতার বিশ্বকাপে নিয়েছেন মাত্র একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার – আলভিরো মোরাতা। আবারও আরেকটি নতুন বিশ্বকাপ এবং স্ট্রাইকার ছাড়াই স্পেন বিশ্বকাপের গল্প লিখতে প্রস্তুত।
লোপেতেগি আর হিয়েরোর পর এনরিকেকে আনা হয়েছিল স্পেনকে ঢেলে সাজানোর জন্য। এনরিকে স্প্যানিশ, খেলেছেন বার্সা এবং স্পেনে। কোচিংও করিয়েছেন বার্সাকে। তার রক্তে মিশে রয়েছে স্প্যানিশ পাসিং ফুটবল। বার্সেলোনাকেও খেলিয়েছিলেন একই কৌশলে। স্পেনকে ঢেলে সাজানোর মিশনে সেই একই কৌশলের ব্যবহার করার কথা। তবে বার্সেলোনায় এনরিকের হাতে প্রথাগত স্ট্রাইকার ছিলেন লুইস সুয়ারেজ। স্পেনে এখনও এমন কেউ নেই। তবে উপায়? উপায় তো হাতের কাছেই রয়েছে – ফলস নাইন। কিন্তু চাইলেই কি ফলস নাইন প্রয়োগ করা সম্ভব?
এনরিকের ফুটবল মানেই মাঠে বলের সাথে প্রেম। স্প্যানিশ ফুটবল মানেই পায়ে বল রাখতে হবে আর নিখুঁত পাস দিতে হবে। এনরিকে স্পেনের এই বৈচিত্রময় ফুটবলকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আর স্পেন মানে তো বল পায়ে রেখে খেলতে পারা মিডফিল্ডারদের ছড়াছড়ি। তবুও এনরিকে দলে কয়েক দফায় বাছাবাছি করে খেলোয়াড়দের ডেকেছেন, আর প্রাধান্য দিয়েছেন তরুণ রক্ত। তাই পেদ্রি-গাভি যখন দলের মধ্যমাঠের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছেন, তখনই স্থান ছেড়ে দিতে হয়েছে থিয়াগো এবং ফাবিয়ান রুইজকে।
এনরিকের ফুটবলটা পজেশন নির্ভর। বল নিজেদের পায়ে রেখে পাসিং ঝড় তুলে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে দিতে হবে। এজন্য তার খেলাটা শুরু হয়ে গোলরক্ষক থেকে। তাই পাসিং ফুটবলটা যে শুধু মিডফিল্ডাররা খেলবে, তেমন নয়। দলের স্ট্রাইকার থেকে ডিফেন্ডারদের বল পায়ে হতে হবে নিখুঁত। একই সাথে দলে থাকা উইঙ্গারেরাও মধ্যমাঠের আশেপাশে থেকে পাস দেবার সুযোগ আরও বাড়িয়ে দেবে।
স্পেনের এমন কিছু খেলোয়াড় রয়েছেন। যারা প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে বল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। উইঙ্গারের কাট-ইন করে ঢোকার সুযোগ তো থাকছেই। মাঝমাঠ থেকে বল উড়িয়ে পাঠানোর মতো কাজগুলো করতে স্প্যানিশ মিডফিল্ডারদের জুড়ি মেলা ভার। এনরিকের মাঝমাঠ প্রথম থেকেই এমন প্রাণবন্ত ফুটবল খেলে আসছেন। প্রচুর আক্রমণ এবং গোলের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু গোল হয়েছে কতগুলো?
নেশন্স লিগের ফাইনাল ম্যাচ। ফ্রান্সের কাছে স্পেন হারল ২-১ গোলে। ৮০ মিনিটে জয়সূচক গোল এনে দিয়েছিলেন কিলিয়ান এমবাপে। সেদিন স্পেন পাস, বল দখল, গোল সুযোগ তৈরি – কোনো অংশেই ফ্রান্স থেকে পিছিয়ে ছিল না। স্পেনের আক্রমণভাগে সেদিন ছিলেন তোরে-ওয়ারযাবাল-সারাবিয়া। শেষের দিকে নেমেছিলেন ভিয়ারিয়ালের উইংগার পিনো। কিন্তু এই চারজনের কেউই সেদিন ফরাসিদের দেয়াল ভাঙতে পারেননি। কারণ এদের কেউই প্রথাগত ফিনিশার নন। কিন্তু অন্তিম সময়ে জাত ফিনিশার এমবাপে ঠিকই ভেঙে দিয়েছিলেন স্প্যানিশ ডিফেন্স।
ইউরোর সেমিফাইনাল। ১২০ মিনিটের পর পেনাল্টি শ্যুটআউটে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, যেখানে পেনাল্টি মিস করেন দানি অলমো এবং আলভিরো মোরাতা। এ ম্যাচেও স্পেন বল দখলে ইতালি থেকে ঢের এগিয়ে। গোলমুখে তারা শট নিয়েছে মোট ১৬টি, যেখানে ইতালি নিয়েছে মাত্র ৭টি। স্পেনের জন্য “বিগ চান্স” ছিল ৩টি, যেখানে একমাত্র গোল করেন মোরাতা। এই ম্যাচেও স্পেনের দুর্বলতা ছিল তাদের আক্রমণভাগ। তোরেস-অলমো-ওয়ারযাবালত্রয়ী হয়তো গোল সুযোগ তৈরি করেছেন অথবা নিজেদের আক্রমণের সামর্থ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। কিন্তু এদের কেউ প্রথাগত ফিনিশার নন, প্রতি ম্যাচে গোল করে ম্যাচ জেতানোর মতো খেলোয়াড় তারা নন। একই সাথে ফলস নাইন কৌশলও এদের খেলার সাথে যায় না।
তাই দারুণ রক্ষণ ও মধ্যমাঠে কারিকুরি থাকলেও স্পেন গোল সুযোগকে ঠিকভাবে গোলে রূপান্তর করতে পারছিল না। এই একমাত্র ব্যর্থতার কারনে ইউরোতে তারা ইতালির কাছে হেরে বাদ পড়েছে, খুইয়েছে নেশন্স লিগও। আবার নেশন্স লিগের শেষ ৬ ম্যাচে তাদের পারফরম্যান্স বলে, এনরিকের দল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে, ম্যাচও জিতেছে। কিন্তু বড় ব্যবধানে জেতা অথবা আগে থেকেই ৩/৪ গোল করে এগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে তারা কখনো পারেনি। কারণ স্পেন এ বছর প্রতিটা ম্যাচে সর্বোচ্চ গোল করেছে ২টি।
বিশ্বকাপের আগে প্রশ্নটা উঠছিলই, তাহলে স্পেন তাদের গোল না করতে পারার সমস্যা সমাধান করবে কীভাবে?
আক্রমণভাগে স্পেন এবার তাদেরই নিয়ে এসেছে, যারা এনরিকের দলে গত দু’বছর নিয়মিত মুখ ছিল। তোরেস, পিনো, আসেন্সিও, সারাবিয়া, অলমো রয়েছেন – যারা আক্রমণভাগের তিন পজিশনেই খেলতে পারেন। একমাত্র স্ট্রাইকার হিসেবে রয়েছেন মোরাতা। এবং নতুন যোগ হয়েছেন নিকো উইলিয়ামস এবং আনসু ফাতি।
গত দুই বছরে স্পেনের হয়ে সবথেকে বেশি গোল করেছেন বার্সেলোনার এই উইঙ্গার তোরেস। দুই উইং এবং ফলস নাইন পজিশনে খেলতে পারা এই ইনভার্টেড উইঙ্গারের অন্যতম সেরা দিক তারা ফিনিশিং। কিন্তু বার্সেলোনার হয়ে এই মৌসুমে তোরেস অবিশ্বাস্য সব গোল মিস করে গেছেন। অন্যদিকে সারাবিয়ার ফিনিশিং আশাব্যাঞ্জক কিছু না। এমনকি শিশুসুলভ গোল মিসের জন্য ভরসা করা যায় না মোরাতার উপরও।
লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা আনসু ফাতি পুরো বিশ্বকে অবাক করেছিলেন তার ফিনিশিং দিকে। বাম পায়ের উইঙ্গার হলেও ডি-বক্সের ভেতর বল পায়ে ফাতি বেশ বিপদজনক। কিন্তু হাঁটুর চোটে এক মৌসুম মাঠের বাইরে থাকা ফাতির সেই ম্যাজিক্যাল বুট এখনও ফেরত আসেনি, যেখানে স্পেনের ফাতির মতো ‘ক্লিনিক্যাল ফিনিশার’ খুবই প্রয়োজন। হাঁটুর ইনজুরির পর ফিনিশিং দক্ষতা হারিয়েছেন আসেন্সিও। আর দানি অলমো প্রথাগত ফিনিশার থেকে একজন প্লেমেকারের ভুমিকাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
শেষ পর্যন্ত কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচে কোচ এনরিকে মাঠে নামিয়েছিলেন ফেরান তোরেস-দানি অলমোর সঙ্গে মার্ক আসেন্সিওকে। এরপর? অলমো মাত্র ১১ মিনিটের মাথায় গোলমুখ খুললেন, এরপর ২১ মিনিটে গোল করলেন আসেন্সিও। ঠিক সময়ে গোলে ফিরলেন ফেরান তোরেস, করলেন জোড়া গোল। এরপর বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গোল করলেন গাভি, বদলি হিসেবে নেমে স্কোরবোর্ডে নাম তুললেন কার্লোস সোলের এবং আলভিরো মোরাতাও। কোস্টারিকার জালে রীতিমতো যেন গোলউৎসব করল স্প্যানিশরা।
তাহলে কি স্পেনের গোল না করতে পারার সমস্যা সমাধান হলো?
বলা কঠিন। তবে খুব সম্ভবত, হয়নি। আসলে এই সমস্যা দলে বিশ্বকাপে রয়ে গেছে এবং আগামী ২-৩ বছরও হয়তো থাকবে। কারণ প্রথাগত কোনো স্ট্রাইকার স্পেনের নেই। এছাড়া তোরেস, মোরাতা, এবং ফাতির গোল করতে পারাটা দলের জন্য খুবই প্রয়োজন। কারণ এই দল নিয়ে স্পেনের গ্রুপপর্ব খুব সহজেই উতরে যাওয়ার কথা, শুরুটাও হয়েছে রীতিমতো উড়ন্ত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সেমিফাইনালেও স্পেন খেলতে পারে। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে জিতে ফাইনাল পর্যন্ত যেতে হলে স্পেনের গোল করতে পারার কর্মদক্ষতা বাড়াতেই হবে।
স্পেন অতি স্বাভাবিকভাবেই মাঝমাঠ দখলে রাখবে। কিন্তু তোরেস-মোরাতারা গোল এনে দেবার ভরসা দিতে পারবেন তো সামনের ম্যাচগুলোতেও? বড় ম্যাচে গোল করতে না পাবার ফল ইতোমধ্যে দুইবার পেয়েছে তারা। বিশ্বকাপের বড় ম্যাচে গোল করতে না পারা বা গোল সুযোগকে গোলে রূপান্তর করতে না পারার ব্যর্থতা স্পেনের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে সামনেও।