২০১০ সালে রিয়াল মাদ্রিদের নিজস্ব স্টেডিয়াম সান্তিয়াগো বারনাব্যুতে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল ম্যাচের ভেন্যু স্থির হলো। রিয়ালে নতুন দফায় এসে পেরেজ তখন গ্যালাকটিকো-২ গড়ছেন। গ্যালাকটিকো মানে হলো বিশ্বের তারকা প্লেয়ারদের নিয়ে দল গড়ে তোলা। তাঁর আগের ৬ বছরে রিয়াল সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি একবার, টানা বাদ পড়ছিল শেষ ষোলয়। সেবারও লিওর কাছে হেরে শেষ ষোলোতে বাদ পড়ে যায় রিয়াল। ভয় চেপে বসল যদি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা রিয়ালের ঘরের মাঠেই জয়োৎসব করে, এটা যে ইতিহাসের কালিমা হয়ে থাকবে!
বার্সাও পারলো না। এক জোসে মরিনহোর ডিফেন্সে আটকে গেল বার্সার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের স্বপ্ন। হাফ ছেড়ে বাঁচে রিয়াল। অনেক গুজব তত্ত্ব প্রচলিত যে, আগে থেকেই রিয়াল প্রেসিডেন্ট পেরেজের গুডবুকে থাকলেও বার্সাকে আটকে দেয়ার পুরস্কারস্বরুপই নাকি মরিনহোকে নিয়োগ দেয় রিয়াল! গুজব আমাদের আলোচ্য বিষয় না। দেখার বিষয় হলো সেই সময় রিয়াল কতটা ভঙ্গুর আর বার্সা কতটা ভয়ংকর থাকলে বার্সার হারে রিয়ালের হাফ ছেড়ে বাঁচতে হয়! একটু ফিরে যাওয়া যাক পেছনে।
২০০৩ সালে লীগ জেতার পরেও ট্রান্সফারসহ আরো কিছু নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় রিয়াল ইতিহাসের অন্যতম সেরা কোচ ডেল বস্ককে আর রাখেননি পেরেজ। অথচ এই ডেল বস্কই রিয়ালকে চার বছরের মধ্যে দুটো চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতান। এরপর থেকেই রিয়ালের শনির দশার শুরু। এর আগের পাঁচ বছরে তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা দলটি এর পরের ছয় বছরে পার হতে পারেনি শেষ ষোলর গন্ডি। রোমা, বায়ার্ন, লিও, লিভারপুলের কাছে হেরেছে অ-রিয়াল সুলভভাবে, যার মধ্যে ছিল লিভারপুলের সাথে ৪-০ হারের লজ্জা।
সেই সময়টাতে বার্সেলোনা, রিয়াল পর্যায়ক্রমে লীগে আধিপত্য দেখাচ্ছিল। রোনালদিনহোর ছোঁয়ায় বার্সা বদলে গেলে ফিগো, রোনালদো, জিদানদের রিয়ালকে কেমন জানি ম্লান লাগতো। ইতো, মেসি, রোনালদিনহো, ডেকোদের আক্রমণাত্মক খেলার জবাব সেই দুই বছর রিয়ালের ছিলো না, সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ব্যর্থতা তো ছিলই। একে একে বিদায় নেন গ্যালাকটিকো-১ এর তারকারা। ফিগো, জিদান, রোনালদোরা ছেড়ে যাওয়ার পর ভাবা হচ্ছিল আরো দুঃসময় এলো বলে। কিন্তু তুলনামূলক কম তারকাখচিত দলটি টানা দুটি লীগ জিতে নেয়। তবে অবস্থা যতটা লিখতে সুখকর লাগছে ততটা সুখকর ছিনা।
দু’বারই লীগ জয় আসে শেষ ম্যাচের দিন, কাপেলোর আমলের লীগ জেতাটা তো ছিল সিনেম্যাটিক। সে যা-ই হোক, কোচ ‘হায়ারিং এন্ড ফায়ারিং’ চলছিলোই। লীগ জেতার পরেও বরখাস্ত হন কাপেলো, সুস্টাররা। সাথে কোপা ডেল রে আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ব্যর্থতা চলছিলোই। রিয়াল এমন একটি ক্লাব যেখানে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সবসময়ই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। ধরা যাক, যদি রিয়াল চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শেষ ষোলতে বাদ পড়ে লীগ জেতে আর একবার সেমিতে বাদ পড়ে লীগ জেতে, তবে অনেক ফ্যানই প্রথমটিকে ব্যর্থ সিজন হিসেবেই দেখে; এতটাই গুরুত্ব চ্যাম্পিয়ন্স লীগের। বারবার ফেব্রুয়ারি মাসেই বাদ পড়ে যাওয়াটা মেনে নিতে রিয়াল ফ্যানদের কষ্ট হতো। আসল সমস্যা তো এর পরে শুরু।
অখ্যাত এক পেপ গার্দিওলা তাঁর গুরু ক্রুয়েফের দেখানো পথে লা মাসিয়া থেকে পাওয়া এক ঝাঁক দারুণ ট্যালেন্টেড পিকে, জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস, মেসিদের নিয়ে বিশ্বকে দেখালেন টিকিটাকার অনবদ্য এক প্রদর্শনী। বার্সেলোনার এই পাসিং ফুটবলের জবাব রিয়াল বা ইউরোপ কারোরোই ছিল না। এল ক্লাসিকোগুলোয় রিয়াল দাঁড়াতেও পারছিল না, ছিল বারনাব্যুতে ৬-২ গোলে হারার লজ্জা। কাকা, রোনালদো, বেনজেমা, আলোনসোদের নিয়ে পেরেজ ২য় গ্যালাকটিকো গড়ে তুললেও পেপ-এর বার্সার জবাব দেয়া হচ্ছিলো না কোনোভাবেই। প্রথম মৌসুমেই বার্সা জিতে নিলো হেক্সা, মানে সম্ভাব্য ছয়টি ট্রফির সব। এরপরের বারও লীগ বার্সার। কেউ যখন বার্সাকে আটকাতে পারছিল না, তখন মরিনহোর ইন্টার মিলান বার্সাকে আটকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতায় রিয়াল বোর্ড তাঁর হাতেই তুলে দেয় বার্সা ডমিনেন্স ভাঙার দায়িত্ব।
মরিনহো জমানা
মরিনহো শর্টটার্মে দল গড়ার মোক্ষম লোক। তিনি এসেই নতুন রক্তের জোগান দেন রিয়ালে। উঠতি তরুণ ডি মারিয়া, ওজিল, খেদিরাদের নিয়ে আসেন রিয়ালে। শুরুটা ভালোই ছিল, বার্সার সমানেই এগোচ্ছিলেন। তাল কেটে যায় ক্যাম্প ন্যুতে ক্লাসিকোর পরে। বার্সার টিকিটাকার কাছে রিয়াল অসহায় আত্মসমর্পন করে ৫-০ ব্যবধানে হেরে। এরপর ইঞ্জুরি সহ নানা ঝামেলায় লীগ রেস থেকে ছিটকে যায় রিয়াল। সিজনের শেষভাগে টানা চারটি ক্লাসিকোর সামনে দাঁড়িয়ে রিয়াল। মরিনহো এক অদ্ভুত কৌশল নিলেন। সেন্টারব্যাক পেপেকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলালেন, কাজ ছিল সবসময় ফুট চারেক দূরত্ব রেখে কেবল মেসিকে মার্ক করা। কৌশল খাটলো, লীগের অগুরুত্বপূর্ণ ক্লাসিকো ড্র হয় ১-১ এ। এরপরের ম্যাচ কোপা দেল রের ফাইনাল। রোনালদোর দেয়া একমাত্র গোলে ফাইনাল জিতে নেয় রিয়াল। মেসিকে আটকানো গেল বেশ ভালোভাবেই। সেবার ৭ বছর পর রিয়াল প্রথম সেমিতে ওঠে। বার্সার সাথে প্রথম ম্যাচে রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পেপে লাল কার্ড পান। এর আগ পর্যন্ত স্কোর লাইন ছিল ০-০। মেসির মার্কার হিসেবে খেলা পেপে লাল কার্ড খাওয়ার পরই মেসির জোড়া গোলে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায় রিয়ালের।
বলা হয়, মরিনহোর আসল সাফল্য নাকি তাঁর দ্বিতীয় মৌসুমে। সে মাফিকই পরেরবার রিয়াল অদম্যভাবেই খেলতে থাকে। সেবারও ঘরের মাঠে ক্লাসিকো হারলেও লীগ জয়ের পথে ঠিকই এগোতে থাকে ভালো পয়েন্ট ব্যবধান রেখে। কোপা দেল রের কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সার কাছে আবার হেরে বাদ পড়ে রিয়াল। সিজনের শেষভাগে টানা কিছু পয়েন্ট হারানোয় বড় লিডটা কমে এমন হয় যে, বার্সার মাঠের ক্লাসিকো হারলে লীগ বার্সাই জিতে জেতে পারে। সব ইন্ডিকেশন যখন বার্সার পক্ষে, তখনই রোনালদোর জয়সূচক গোলে বার্সাকে হারিয়ে লীগ জেতে মাদ্রিদ। তিন বছর পর প্রথম লীগ। আবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিতে উঠে রিয়াল। পেনাল্টি-ভাগ্যের কাছে হেরে বায়ার্নের সাথে বাদ পড়ে যায় রিয়াল।
খেলার স্টাইল বা লীগ সাফল্য সব মিলিয়েই মনে হচ্ছিল এবার হয়ত বার্সার একাধিপত্য ভাঙছে, ওদিকে পেপ বার্সা ছেড়ে দিয়েছেন। পরের মৌসুমের শুরুতে বার্সাকে হারিয়ে সুপারকাপ জিতলে এই ধারণা আরো শক্ত হয়। আদতে হলো উল্টো। ড্রেসিংরুমের সাথে ঝামেলার দরুণ সেই সিজনটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, শিরোপাশূন্য থাকে রিয়াল। আবার ঘিরে ধরে হতাশার বৃত্ত। তবে কি মরিনহো অসফল ছিলেন? খুবই বিতর্কিত একটি বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে অসফল মনে হলেও তিনিই প্রথম বার্সার সাথে যুঝতে পেরেছিলেন, তাও পেপ গারদিওলার সেই অদম্য বার্সার সাথে। তাঁর শেষ সিজনের ট্রফি না থাকলেও ক্লাসিকোগুলোয় ছিল রিয়ালের তুলনামূলক প্রাধান্য। তবে তাঁর নেগেটিভ স্টাইলের কারণে সমালোচনা নিয়মিতই ছিল তাঁর সঙ্গী।
আনচেলত্তি যুগ
সে সময় থেকেই রিয়ালের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। ভঙ্গুর এক ড্রেসিংরুমকে আনচেলত্তি করে তোলেন দারুণ সম্পর্কযুক্ত। কোচ-খেলোয়াড় বিবাদ মিটে যায়। কিনে আনা হয় বেল, ইস্কোদের। বেল, রোনালদো, ডি মারিয়াদের নিয়ে আনচেলত্তি গড়ে তোলেন দারুণ এক আক্রমণভাগ। সমস্যা হলো দর্শনীয় খেলা উপহার দিলেও লীগে রিয়াল অধারাবাহিকই ছিল। সেবার এটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে লীগ হারে রিয়াল। কিন্তু কোপা দেল রের ফাইনালে বার্সাকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় তারা। বায়ার্নকে তাদেরই মাঠে ৪-০ তে উড়িয়ে দিয়ে ১২ বছর পর ফাইনালে উঠে রিয়াল। নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এটলেটিকোর সাথে ১-০ তে পিছিয়ে পড়ে ফাইনালে। আর মাত্র মিনিট দেড়েক বাকি, সে সময় রামোসের দেয়া হেডে সমতা ফেরায় রিয়াল, আর সাথে যেন এতদিন বিমুখ হয়ে থাকা ইতিহাসকেও নিজেদের অনুকূলেই নিয়ে আসে। এক্সট্রা টাইমে ৪-১ এ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে নেয় রিয়াল! পরের সিজনে দলের কেমিস্ট্রি আরো শক্তিশালী হলেও ইনজুরি আর রোটেশন না করার কারণে ট্রফিহীন থাকে রিয়াল। তবে সমর্থকরা আনচেলত্তির কাজে খুশি। কিন্তু পেরেজ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বরখাস্ত করেন আনচেলত্তিকে। আবার রিয়ালে ঘনিয়ে আসে কালো মেঘ।
বেনিতেজ অধ্যায়
রাফা বেনিতেজের বেড়ে ওঠা এই ক্লাবে হলেও তিনি সবচেয়ে বড় ভুলটি করে বসেন এসেই, ড্রেসিংরুমে নিজের একাধিপত্য নিতে গিয়ে খেলোয়াড়দের সমর্থন হারান। তার অদ্ভুতুড়ে ট্যাকটিক্সে ধুকছিল রিয়াল। লীগে ১৫ পয়েন্ট পিছিয়ে, নিষিদ্ধ প্লেয়ারকে খেলিয়ে কোপা দেল রে থেকে বাদ- সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন আবার সেই ২০০৮-২০১১ সময়টা ফিরে আসছে। সে মৌসুমের মাঝপথেই বরখাস্ত হন রাফা, আনা হয় জিদানকে।
জিদান রাজত্ব
শেষরাতে নাকি আঁধার গাঢ়তর হয়, বেনিতেজ অধ্যায় শেষরাত হলে জিদান জামানা হলো ভোর। মাত্র ছয় মাস কোচিং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জিদান দায়িত্ব নিয়েই তাঁর ঠাণ্ডা মেজাজ আর হাস্যোজ্জল ভঙ্গিতে প্রেস থেকে ড্রেসিংরুম সবার মন জিতে নেন। লীগকে অসম্ভব ভাবা রিয়ালকে ১৫ পয়েন্ট ব্যবধান কমিয়ে নিয়ে যান মাত্র ১ এ, লীগ প্রায় জিতেই গিয়েছিল তারা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিতে নেন চ্যাম্পিয়ন্স লীগ। রিয়াল শিবিরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে আবার। অযথা প্লেয়ার না কিনে নিজের বর্তমান প্লেয়ারদের উপরই আস্থা দেখালেন। তারাও এর প্রতিদান দিল।
এরপরের বার তাঁর সামনে টার্গেট ছিল পাঁচ বছর পরে লীগ জেতানো। তিনি সেটাও করে দেখান। সাথে অর্জন করেন এমন এক জিনিস যা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের বর্তমান ফরম্যাটে কেউ পায়নি- টানা দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা। মাত্র ১.৫ বছরে ভগ্ন মনোরথের এক রিয়ালকে করে দেন ইউরোপ সেরা ক্লাব। এবার সুপারকাপ তিনি বার্সাকে যেভাবে হারান তা ছিল স্পষ্ট ইঙ্গিত যে, এখন জামানায় বদল আসছে।
২০০৮ সালের পর যেসব ক্লাসিকোতে রিয়াল জিতত সেগুলোতেও অধিকাংশ সময় ডিফেন্ড করতো আর কাউন্টার অ্যাটাকে গোল দিত, অর্থাৎ খেলার ধরনে বার্সার প্রাধান্য ছিলই। এবার বলা চলে বার্সাকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে রিয়াল। কোনো সন্দেহ ছাড়াই রিয়াল মিডফিল্ড এখন বিশ্বসেরা। ইস্কো, ক্রুস, মড্রিচ, কোভাচিচ, ক্যাসেমিরোদের আটকানোর মতো মিডফিল্ড কারো নেই বললেই চলে। জিদান আসার পর ট্রান্সফার মার্কেটে রিয়াল এখন দারুণ গোছালো। একসময় রিয়ালের মূল লক্ষ্য থাকত প্রতিষ্ঠিত তারকা উচ্চমূল্যে কেনা। অথচ বর্তমান দলের আসেনসিও, ভাজকেজ, ইস্কো, ক্রুস, মড্রিচ, কোভাচিচ, লরেন্তে, ক্যাবায়োস, ক্যাসেমিরোকে যে দামে কিনেছে তা বর্তমান দলবদলের বাজারের তুলনায় নিতান্তই কম। সব জিদান কেনেননি, কিন্তু তাঁর তরুণদের সুযোগ দেয়ার দিকটা দারুণ। দলটাকে একটা অসাধারণ স্থিতিশীলতা দিয়েছেন তিনি।
এখন যে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক আত্মবিশ্বাসে টাইটুম্বুর, তাকে বছরের পর বছর বার্সেলোনার প্রাধান্য দেখতে হয়েছে। হারের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে যেন সুদিনের স্মৃতিই ভুলে গিয়েছিল। সেখান থেকে জিদানের হাত ধরেই পরিত্রাণ আর এখন জয়রথ। ফুটবলে ডমিনেন্সটা আসে চক্রাকারে, আবার চলেও যায়। বর্তমান সময়টা রিয়ালের, এটা যে তাদের প্রাপ্যই।