“বিশ্বকাপ খুবই জটিল একটা টুর্নামেন্ট। যদি ফাইনালে যাও তাহলে সাতটি ম্যাচ খেলতে পারবে। সেরা দলটিও বাদ পড়তে পারে, শুধুমাত্র একটি ম্যাচ হেরেও।”
– পেলে
বিশ্বকাপ জিততে আসলে কী লাগে? ফুটবল গোলের খেলা। কিন্তু কখনো কখনো ভুরি ভুরি গোল করেও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে অনেক দলকে। অন্যদিকে অনেক কম গোল করেও সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছে অনেকে। আজ আমরা দেখবো বিশ্বকাপের দুই টিমের দুই মেরুর চিত্র। অনেক গোল করেও খালি হাতে ফেরা দলের সাথে কম গোল করে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট পরা দুই দলের গল্প। অভাগা দলটি হলো হাঙ্গেরির ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স আর অন্য দলটি টিকিটাকার স্পেন।
ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স: বিশ্বকাপের চিরন্তন আক্ষেপ
ককসিস, পুসকাস, জিবর, হিদেকুটি- পুরো হাঙ্গেরি টিম ছিলো তারকায় ঠাসা। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে পুরো টুর্নামেন্টে গড়ে প্রতি ম্যাচে ৫ এর উপর গোল করে মোট ২৭ গোল করে হাঙ্গেরি, যা এখনো রেকর্ড বুকে অক্ষুন্ন রয়েছে। তবুও মিরাকল অফ বার্নে খালি হাতেই ফেরে হাঙ্গেরির সোনালি প্রজন্ম। চলুন দেখে আসা যাক সেই অভেদ্য টিমের গল্প।
হাঙ্গেরির এই ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স ১৯৫০– ৫৬ ফুটবল বিশ্ব দাপটের সাথে শাসন করে গেছে। এই সময়ের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক ৪২টি ম্যাচ জিতেছে পুসকাসের দল। ড্র করেছে ৭টি ম্যাচে। আর কাকতালীয়ভাবে একমাত্র ম্যাচটি হেরেছে সুইজারল্যান্ডের বার্নে, পশ্চিম জার্মানির কাছে, ’৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে।
টোটাল ফুটবল মূলত প্রথম মাঠে প্রয়োগ করে এই হাঙ্গেরির দলটিই, যা পরে পূর্ণরুপ দান করে ক্রুইফের নেদারল্যান্ড। ২-৩-৩-২ ফর্মেশনের আবিষ্কারক এই অপ্রতিরোধ্য হাঙ্গেরি টিমের কোচ গুস্তাভ সেবেস, যার ফলে দ্রুতগতিতে আক্রমণ ও ডিফেন্স দুটোই করতে সক্ষম ছিলো হাঙ্গেরি, যা নিয়ে পরে ফেরেঙ্ক পুসকাস বলেন, “টোটাল ফুটবলের প্রোটোটাইপ ছিলো ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্সের হাঙ্গেরি।” পুসকাস, ককসিস, জিবর, হিদেকুটি, গ্রোসিক্স, বসিক- এই ছয় প্রধান খেলোয়াড়েই আবর্তিত হতো পুরো দল। আর এই হাঙ্গেরি দলের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিলো বহুমুখী খেলোয়াড়দের আধিক্য। কোচ সেবেস প্রতিটি খেলোয়াড়কেই ভার্সেটাইল হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যেকোনো পজিশনে খেলতে পারদর্শী ছিলো হাঙ্গেরির বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই।
তবে মাঠের খেলায় হাঙ্গেরির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিলো আক্রমণভাগ। পুসকাস, ককসিস, জিবর এই ত্রিফলা যেকোনো প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারের জন্য ছিলো আতঙ্কের নাম। হাঙ্গেরির ইতিহাসে ৮৭ ম্যাচে ৮৪ গোল করা পুসকাস কিছুদিন আগপর্যন্ত ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড ধরে রেখেছিলেন, যা এখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দখলে। পুসকাস তখন খেলতেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। অন্যদিকে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন স্যান্ডর ককসিস ও জোল্টান জিবর।
অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জয়
দুই বছর অপরাজিত থেকে ১৯৫২ সালে অলিম্পিক ফুটবলে অংশগ্রহণ করে হাঙ্গেরি। গ্রুপপর্ব সহজেই পার হয়ে সেমিফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় ১৯৪৮ এর অলিম্পিক গোল্ড মেডেলধারী দেশ সুইডেনের। সেমিফাইনালে সুইডেনকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করে হাঙ্গেরি। ফাইনালে জিবর আর ককসিসের গোলে ২-০ গোলে যুগোস্লাভিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক স্বর্ণ জিতে নেয় হাঙ্গেরির এই সোনালি প্রজন্ম।
ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়
অস্ট্রিয়া, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া আর সুইজারল্যান্ড নিয়ে আয়োজিত সেই টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে হাঙ্গেরি। ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত সেই চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ইতালিকে হারায় হাঙ্গেরি। পুসকাসের জোড়া গোল আর হিদেকুটির এক গোলে ৩-০ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে পুসকাসের দল।
১৯৫৪ বিশ্বকাপ
সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৫৪ বিশ্বকাপ খেলতে টুর্নামেন্টে হাঙ্গেরি যায় শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার হয়ে। চার বছর ধরে টানা অপরাজিত থেকে টুর্নামেন্ট শুরু করে সেবেসের দল। প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ গোলে স্রেফ উড়িয়ে দেয় হাঙ্গেরি। ককসিস করেন তিন গোল। গ্রুপের শেষ ম্যাচে পশ্চিম জার্মানিকে হারায় ৮-৩ গোলে। এই ম্যাচে ককসিস করেন ৪ গোল। তবে গোড়ালির ফ্র্যাকচারে পরবর্তী দুই ম্যাচের জন্য ছিটকে যান দলের অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাস।
কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় ব্রাজিলের। ম্যাচের সাত মিনিটের মাথায় হাঙ্গেরি পুসকাস ছাড়াই এগিয়ে যায় ২-০ গোলে। তবে এর পরপরই মাঠের মধ্যেই ফাউল ও হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়, যা চলে পুরো ম্যাচ চলাকালীন সময়েই। ম্যাচটি হাঙ্গেরি জিতে নেয় ৪-২ গোলে। সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো উরুগুয়ে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে তখন দুবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে দুবারের চ্যাম্পিয়ন। ২-২ গোলে খেলা শেষ হলে অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় ম্যাচটি। তবে পুসকাস ছাড়াই ককসিস, জিবরের বদৌলতে ম্যাচটি বের করে আনে হাঙ্গেরি। ৪-২ গোলে ম্যাচটি জিতে ফাইনালে পৌঁছায় দলটি।
তবে মিরাকল অফ বার্নে পুসকাস সহই জিততে পারেনি ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স। প্রথমে জিবর আর পুসকাসের কল্যাণে ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও শেষপর্যন্ত ম্যাচটি তারা হারে ৩-২ গোলে। ৩১ ম্যাচের অপরাজেয় দৌড় থামে ফাইনালে, পশ্চিম জার্মানির কাছে।
পুরো টুর্নামেন্টে ২৭ গোল করেও সেবার শিরোপা জোটেনি হাঙ্গেরির কপালে। যে জার্মানিকে ৮-৩ গোলে গ্রুপপর্বে হারিয়ে এসেছিলো, তাদের বিপক্ষেই কপাল পোড়ে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্সদের। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি গোল করেও পরাজিতদের দলে থাকতে হয় পুসকাসদের।
টিকিটাকা যুগ: স্পেনের সোনালি প্রজন্ম
ভিসেন্তে দেল বস্কের হাত ধরে স্পেনের টিকিটাকা যুগ শুরু। একঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড় নিয়ে স্পেনের দলও ছিলো ঈর্ষনীয়। ২০০৮–১২ এই চার বছরে একে একে লা রোহারা জিতে নেয় দুটি ইউরো সহ একটি বিশ্বকাপ। মাঝমাঠে জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস, ফ্যাব্রিগাস, আলোন্সোদের মতো বিচক্ষণ প্লেয়ার ছাড়াও আক্রমণভাগে ছিলেন ভিয়া আর তোরেসদের মতো পরীক্ষিত সৈনিকেরা। তাদের উপরে ভর করেই একে একে তিনটি বড় শিরোপা জিতে নেয় স্পেন।
ছোট ছোট পাসের সমাহারে মাঝমাঠে অর্কেস্ট্রার সুর তুলতো স্পেন। সেই টিকিটাকায় ভর করে দেল বস্ক গড়ে তোলেন অপ্রতিরোধ্য এক দল। ৪-১-২-৩ ফর্মেশনে খেলা স্পেনের মাঝমাঠের মূল কান্ডারী ছিলেন জাভি, ইনিয়েস্তারা। তাদের পেছনে থেকে মূল সংযোগ তৈরি করতেন জাভি আলোন্সো। সামনে ছিলেন ভিয়া, তোরেস আর পেদ্রো।
ইউরো জয়
২০০৮ এর ইউরোতে সব প্রতিপক্ষের উপর চওড়া হয়েই ফাইনালে আসে স্পেন। ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় জার্মানির। সেখানে ফার্নান্দো তোরেসের একমাত্র গোলে শিরোপা জিতে নেয় লা রোহারা। আর চার বছর পরের ইউরোতে ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে টানা দ্বিতীয় ইউরো জিতে নেন ক্যাসিয়াস, পুয়োলরা।
বিশ্বকাপ জয়
২০১০ বিশ্বকাপে স্পেনের আগমন ঘটে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় ফেভারিট হিসেবেই। তবে প্রথম ম্যাচেই সুইজারল্যান্ডের সাথে ১-০ হার দিয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করে স্পেন। তবে পরবর্তীতে চিলি আর হন্ডুরাসকে হারিয়ে পরবর্তী রাউন্ডের টিকেট কাটে স্পেন। গ্রুপপর্বে মাত্র চার গোল গোলমুখে স্পেনের দুর্দশার চিত্র বলে দেয়।
দ্বিতীয় রাউন্ডে পর্তুগালকে তারা হারায় ১-০ গোলে। মজার ব্যাপার হলো, নক আউটের সবগুলো ম্যাচই স্পেন জেতে ১-০ গোলের ব্যবধানে। কোয়ার্টার ফাইনালে প্যারাগুয়ের পর সেমিফাইনালেও জার্মানিকে হারায় একই ব্যবধানে। আর নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিয়েস্তার ১১৬ মিনিটের গোলের সুবাদে সেই ১-০ ব্যবধানেই শিরোপা জিতে নেয় স্পেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পুরো টুর্নামেন্টে স্পেন করেছে মাত্র ৮ গোল। ৭ ম্যাচে ৮ গোল করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি কোনো দলই। একমাত্র হন্ডুরাস ব্যতীত আর সব ম্যাচই স্পেন জিতেছে ন্যূনতম গোলের ব্যবধানে। ডেভিড ভিয়া একাই দলের হয়ে করেন ৫ গোল।
মূলত স্পেনের জয়ের পেছনে কাজ করেছে জমাটবাধা ডিফেন্স আর টিকিটাকার মিডফিল্ড। পুয়োল, পিকে, রামোস, ক্যাপডিভেলারা প্রতিপক্ষকে বারবার আটকে দিয়েছেন। সেজন্য ফার্গুসন বলেছিলেন, আক্রমণ ম্যাচ জেতাতে সাহায্য করে, কিন্তু শিরোপা জেতায় রক্ষণভাগ। গোলবারের নিচে থাকা ক্যাসিয়াসও বল জালে ঢুকতে দিয়েছেন মোটে দুবার। আর মিডফিল্ডে পাসের পসরা সাজিয়ে বল দখলে স্পেন প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষ থেকে অনেক এগিয়ে ছিলো। সেই সুবাদে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে কম গোল করেই চ্যাম্পিয়নদের খাতায় নাম ওঠাতে সক্ষম হয় স্পেন।
ফুটবল গোলের খেলা হলেও খেলতে হয় মস্তিষ্ক দিয়ে। গোল থেকেও মাঝে মাঝে বড় হয়ে ওঠে ট্যাক্টিস, মাঠে নার্ভ ধরে রাখার ছোট ছোট ব্যাপারগুলো। সেজন্যই হয়তো গড়ে প্রতি ম্যাচে ৫ এর উপরে গোল করেও বিশ্বকাপে এক আক্ষেপের নাম হয়ে থাকে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স খ্যাত হাঙ্গেরি। আর অন্যদিকে ৭ ম্যাচে মোটে ৮ গোল করেই সোনালি ট্রফির স্পর্শ পায় লা রোহা খ্যাত স্পেন।