১৯৪৬ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড জিতে গেলেও অর্থনৈতিক অবস্থা যুৎসই নয়। বছর ছয়েকের জন্য ক্রিকেটেও সবার চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল। এই সময়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হয়েছে খুব সামান্যই।
কেবল ১৯৪৫ মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হয়েছে মাত্র ১১টি। যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ হারান ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রতিভাবান ক্রিকেটার হেডলি ভেরিটি। সেই শোক বুকে নিয়েই ক্রিকেট আবারও একটু একটু করে নিজেদের জায়গা খুঁজতে শুরু করে ইংল্যান্ডের মাটিতে।
১৯৪৬ সালেই যুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক কাউন্টি ক্রিকেট শুরু হয়। যুদ্ধের প্রভাবে কাউন্টি ক্রিকেটের কাঠামোই যেখানে ভেঙে পড়েছিল, তা স্বাভাবিক হতে শুরু করে এই বছরে।
ভারতবর্ষে এই যুদ্ধের প্রভাব ছিল আরো গুরুত্ববহ। দীর্ঘ শ-দুয়েক বছরের শাসন শেষে বিদায়ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ রাজের। ইংল্যান্ড যুদ্ধ শেষে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উইন্সটন চার্চিলের বিদায় হওয়া মাত্রই ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।
ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ভারতবর্ষকে কীভাবে স্বাধীনতা দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে তার জন্য একটা তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন। সেটা হলো ক্যাবিনেট মিশন। তখনই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিয়ে ভারত গঠনের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কলকাতা, পাঞ্জাবে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। অথচ এই উপমহাদেশীয়রাই ইংল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে সেই বছর অসাম্প্রদায়িকতার অনন্য এক নজির স্থাপন করেছিল। ‘ভারত’ নাম নিয়ে টেস্ট খেলতে তারা গিয়েছিল ইংল্যান্ডে।
দলে যেমন হিন্দু ছিলেন, তেমনি ছিলেন মুসলমানও। তেমনি ছিলেন একজন পার্সি (রুসি মোদি) ও একজন খ্রিষ্টান (বিজয় হাজারে)। অবিভক্ত ভারত থেকে সেবারই শেষবারের মতো কোনো দল ব্রিটেন সফর করে।
দলের অধিনায়ক করা হয় ইফতিখার আলী খানকে। আসলে তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন ‘নির্বাচিত’ অধিনায়ক। সতীর্থদের ১০ ভোটের মধ্যে আটটিই পান তিনি। আর মাত্র দুই ভোট পান বিজয় মার্চেন্ট।
আসলে নেতা হিসেবে তখন এই ইফতিখার আলী খানই ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ। তিনিই যে উপমহাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ইংল্যান্ড ও ভারত দুই দলের হয়েই টেস্ট খেলেছেন।
‘পতৌদি পরিবার’– উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে এই দুটি শব্দের সাথে সবারই কম-বেশি পরিচয় থাকার কথা। এই রাজপরিবারের ঘরেই পাঞ্জাবে ১৯১০ সালের ১৬ মার্চ জন্ম হয় ইফতিখার আলী খানের।
১৯২৬ সালেই তিনি চলে আসেন ব্রিটেনে। উচ্চশিক্ষা নিতে। শৈশব থেকে খেলার মাঠ কিংবা ক্লাসরুম– সব জায়গাতেই সমান পারদর্শী তিনি। খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া– এর আদর্শ উদাহরণ তিনি।
১৯২৭ সালে তিনি যোগ দেন অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে। তিনি অক্সফোর্ডের জোড়া ব্লু-ধারী। কারণ, ক্রিকেট ও হকি দুটোতেই তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। সাহসিকতায় তিনি যে ছিলেন অনন্য, এর প্রমাণ তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই দিয়ে গেছেন।
১৯৩১ সালের কথা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ম্যাচ। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটে এটা আজকের অ্যাশেজের মতো, কিংবা উপমহাদেশের পাক-ভারত লড়াই।
কেমব্রিজের হয়ে খেলতেন তখন সারের খ্যাতনামা ক্রিকেটার অ্যালান র্যাটক্লিফ। র্যাটক্লিফের ব্যাট থেকে প্রথম ইনিংসে আসলো ২০১ রান। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটের ইতিহাসে তখন সেটাই সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
ইফতিখার তখন মাঠেই, ঘোষণা দিলেন, পরের ইনিংসেই এই রেকর্ড ভেঙে ফেলবেন তিনি। ইফতিখার সেই কথা রাখলেন। সবার চোকে তাক লাগিয়ে খেললেন ২৩৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। রেকর্ডটা ২০০৫ সাল অবধি টিকে ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় দিনের সেই দাপট পতৌদি সিনিয়র দেখিয়েছেন কাউন্টি ক্রিকেটেও। সেখানে তার দল ছিল উস্টারশায়ার। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনি ছিলেন দানব।
সবাই ডাকতো প্যাট নামে। তো এই ‘প্যাট’ মশাই ১২৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন জীবনে। তাতে ২৯টি সেঞ্চুরি আর ৩৪টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন প্রায় ৫০ ছুঁই ছুই গড়ে। মোট রান ৮,৭৫০।
কাউন্টি ক্রিকেটের এত বড় এক পারফর্মারের আন্তর্জাতিক অভিষেকটাও হয়েছিল স্মরণীয়। ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’– এর বহুল প্রচলিত বাক্যের চেয়েও অতিমানবীয় ছিল তার অভিষেক।
সেটা ছিল ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের সেই কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ খেলতে যায় ইংল্যান্ড। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দুই ডিসেম্বর অভিষেক হয় পতৌদি সিনিয়রের।
অস্ট্রেলিয়ার করা ৩৬০ রানের জবাবে ৫২৪ রানের পাহাড় গড়ে ইংল্যান্ড। পতৌদি করেন ১০২ রান। ৩৮০ বলের ইনিংসে ছিল ছয়টি চার। ম্যাচটি ইংল্যান্ড জিতে যায় ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।
অভিষেক ইনিংসেই সেঞ্চুরি, দলের বড় জয়– এত কিছুর পরও পরের টেস্টে একাদশে জায়গা হারান পতৌদি। এর পেছনে ছিল বডিলাইন কৌশলের জন্য ‘কুখ্যাত’ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের হাত। হ্যারল্ড লারউডের মত নিখুঁত এক পেসার ছিল জার্ডিনের মূল অস্ত্র। তিনি লেগ সাইডে ছাতার মতো ফিল্ডারদের সাজিয়ে ব্যাটসম্যানদের শরীর বরাবর বল করতে নির্দেশ দিলেন লারউডকে। ব্যাটসম্যানরা এই কৌশলের সাথে পেরে উঠলো না।
ক্রিকেটের শুদ্ধবাদীদের মতো পতৌদিও মনে করতেন ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে এমন অখেলোয়াড়সুলভ কৌশল চলে না। জার্ডিনের চক্ষুশ্যূল হলেন পতৌদি। ব্যস, এক টেস্ট খেলেই তিনি চলে গেলেন একাদশের বাইরে।
১৯৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার ড্রামা ডকুমেন্টারি ‘বডিলাইন’-এ জার্ডিন আর পতৌদির কথোপকথন ছিল।
পতৌদি: আমি তোমার মতো করে খেলবো না, ডগলাস।
জার্ডিন: আমি তোমার অধিনায়ক। তুমি আমার সিদ্ধান্তে সহমত জানাতে বাধ্য।
পতৌদি: যদি আমি সেটা না করি?
জার্ডিন: তাহলে আমি চাইবো যে তুমি যেন খেলতেই না পারো।
পতৌদি: তাহলে সেটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু, ডগলাস, বন্ধু তোমার নিয়ম আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়।
জার্ডিন: তুমি আর কখনোই টেস্ট খেলার সুযোগ পাবে না।
ডগলাস জার্ডিন বিতর্কিত সেই কৌশলে ডন ব্র্যাডম্যানদের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাশেজ জিততে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু বিশ্বজুড়ে হয়েছিলেন সমালোচিত। সেই অ্যাশেজেই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আবারও মাঠে নামার সুযোগ হয়েছিল পতৌদির। তাতে, দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছিলেন ২০ রান।
তবে, ডগলাসের সাথে বনিবনা না হওয়ায় দল থেকে স্থায়ীভাবে জায়গা হারান পতৌদি। ফিরে যান উস্টারশায়ারে। সেখানে পারফর্ম করে বছর দুয়েক বাদে জাতীয় দলে ফেরেন আবার। এই দফায় ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেন আরো একটি শেষ। মাত্র তিন টেস্টেই ইংল্যান্ড অধ্যায় শেষ হয় পতৌদির।
১৯৩৬ সালেই অবশ্য তিনি ভারতের অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। এরপর যখন তিনি ‘ভারত’-এর হয়ে অভিষেক টেস্ট খেলেন, তখন কেটে গেছে আরো ১০টি বছর।
ওই ১৯৪৬ সালের ইংল্যান্ড সফরেই ভারতের হয়ে ক্রিকেটার কিংবা অধিনায়ক– দুভাবেই অভিষেক হয় পতৌদির। ক্যারিয়ারের প্রথম তিন টেস্ট তিনি খেলেন ইংল্যান্ডের হয়ে, আর শেষ তিন টেস্ট খেলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। যদিও, নবাব সাহেবের বয়স তখন ৩৬। তিন টেস্টে করতে পারেন মাত্র ৫৫ রান।
১৯৩১ সালেই পতৌদির নবাব হিসেবে অভিষেক হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি রাজকীয় দায়িত্ব ছেড়ে দেন, যোগ দেন ইন্ডিয়ান ফরেন অফিসে। ১৯৫২ সালে তার মৃত্যুটাও হয়েছে খেলার মাঠেই। দিল্লিতে তখন পোলো খেলছিলেন, খেলতে খেলতেই শেষ বিদায় নেন। খেলার মাঠের দাপুটে এক পথপ্রদর্শকের জীবনের শেষ বিদায় হয় মাঠ থেকেই।
পতৌদি সিনিয়রের স্ত্রী হলেন ভূপালের নবাব-কন্যা সাজিদা সুলতানা। মৃত্যুর সময় তিনি তিন কন্যা ও ১১ বছর বয়সী ছেলে মনসুরকে রেখে যান। এই মনসুর পরবর্তীতে বড় হয়ে কীর্তিতে, অর্জনে ছাপিয়ে যান বাবাকেও। ক্রিকেটে তিনি পতৌদিদের আসন আরো মজবুত করেন। এক চোখের দৃষ্টিহীনতার বাঁধা অতিক্রম করেই ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হন তিনি। লোকে তাকে ডাকতো টাইগার পতৌদি নামে। পরে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) প্রধান নির্বাচকও হন তিনি।
টাইগার পতৌদি বিয়ে করেছিলেন বলিউডের খ্যাতনামা বাঙালি অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরকে। তাদের ছেলে-মেয়ে সাইফ আলী খান ও সোহা আলী খান। সাইফের মেয়েও এখন ভারতীয় ছবির নিয়মিত মুখ।
পুরো পরিবারের স্থায়ী বাস ১৫০ ঘরের বিলাসবহুল প্রাসাদ পতৌদি প্যালেসে। প্রায় ৮০০ কোটি রুপির এই বাড়িটি সেই ১৯৩৫ সালে নির্মিত। কে বানিয়েছিলেন জানেন? ক্রিকেট কিংবদন্তি ও পতৌদি পরিবারের অষ্টম নবাব মোহাম্মদ ইফতিখার আলী খান পতৌদি আলী হোসাইন সিদ্দিক!