গনসালো রামোস নিজেও হয়তো ভাবেননি, রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি মাঠে থাকবেন। আগের ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে তাকে নামানোই হয়নি। গ্রুপপর্বের দুই ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমে খেলেছিলেন মিনিট বিশেকের মতো। তবে বিশ্বকাপে যে তিনি নিয়মিত খেলতে পারবেন, এমনটা রামোস নিজেও আশা করেননি। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থাকবেন ঐ স্ট্রাইকারের পজিশনে। অনেক বছর হলো, ডান পাশ থেকে সরে এসে রোনালদো বনে গেছেন পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার। তার বদলি হিসেবে আন্দ্রে সিলভা আছেন। এরপর জোয়াও ফেলিক্স, রাফায়েল লিয়াও, তারপর হয়তো আসবে রামোসের নাম।
স্ট্রাইকার হিসেবে বিশ্বকাপে রোনালদো সেভাবে ঝলক দেখাতে পারেননি। কিন্তু তাকে ছাড়া পর্তুগাল দল হয়তো কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু সময়টাই যেন রোনালদোর বিপক্ষে! পর্তুগাল দলে ঘটে আকস্মিক এক ঘটনা। বিভিন্ন সাংবাদিকের মতে, মাঠে ঘটা এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোনালদো এবং তার কোচ সান্তোসের সম্পর্ক ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। এরপর, সেই গুঞ্জন – সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে হয়তো রোনালদো একাদশে থাকবেন না। সান্তোস যখন ম্যাচের একাদশ ঘোষণা করলেন, গুঞ্জন তখনই সত্য হয়ে গেল। রোনালদো একাদশে নেই। আছেন বেনফিকার অখ্যাত এক স্ট্রাইকার – গনসালো রামোস। আমার, আপনার বা সাধারণ ফুটবল সমর্থকের কথা বাদ দেই; ‘গনসালো রামোস’ এই নামটি তো রিয়াল মাদ্রিদের কোচ কার্লো আনচেলত্তিও জানেন না।
রামোসের বেড়ে ওঠা বেনফিফার বয়সভিত্তিক দলে। এই কয়েক মৌসুম আগেও তিনি বেনফিকার মূল দলে ছিলেন না। কারণ সে সময়ে তাদের উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার দারউইন ন্যুনেজ ফর্মের তুঙ্গে। তবে গত মৌসুমে বেনফিকার হয়ে মূল দলের সাথে নিয়মিত খেলার সুযোগ হয় তার। ন্যুনেজের কাছে স্ট্রাইকার পজিশন থাকার রামোসকে ৪-২-৩-১ ছকে কখনো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অথবা সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে হতো। ২৯ ম্যাচে পর্তুগিজ লিগে ৭ গোল এবং ১ অ্যাসিস্ট, এজন্য স্ট্রাইকারসুলভ কোনো পরিসংখ্যান না। কিন্তু ন্যুনেজের লিভারপুল পাড়ি জমানোর পর চলতি মৌসুমে বেনফিকার মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে শুরু করেন তিনি। সেখানে ১১ ম্যাচে ৯ গোল এবং ১ অ্যাসিস্ট; এবারের পরিসংখ্যান মন্দ নয়।
রামোসের পজিশন অবশ্যই স্ট্রাইকার। কিন্তু ন্যুনেজ বেনফিকায় থাকাকালীন সময়ে তিনি ভিন্ন এক ভূমিকায় তাকে দেখা যেত। দ্রুত নিজের পজিশন পালটে ফেলা, মাঠে ফাঁকা জায়গা পেলে সেটার ব্যবহার করা, ডিফেন্ডারকে বুঝতে না দেওয়া যে তিনি কোনদিকে যাবেন – এরপর তার গতি ব্যবহার করে ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলাই ছিল ন্যুনেজের থাকাকালীন ম্যাচের ঘটনা। রামোস যেন ন্যুনেজর গোল করার রাস্তা আরও সহজ করে দিতেন। সোজা কথায় এইটাই ছিল সেবারের রামোস ও ন্যুনেজকে নিয়ে বেনফিকার কৌশল। এরপর ন্যুনেজ লিভারপুলে পাড়ি জমানোর পর রামোসের গোল করার দক্ষতা বের হতে শুরু করল। তার বুলেট শট এবং দুর্দান্ত হেড করতে পারার সক্ষমতা নিয়ে এখন বেনফিকার ‘মেইনম্যান’ ২১ বছর বয়সী এই পর্তুগিজ।
পর্তুগালের কোচ ফার্নান্দো সান্তোস আর সব কোচের মতো কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই দল সাজান। তবে তার দলের একাদশ প্রায়সময়ই একই ধরনের হয়ে যায়। আনকোরা কোনো খেলোয়াড় বাজিয়ে দেখা অথবা ভিন্ন কোনো কৌশল প্রয়োগ করার মতো ঝুঁকি তিনি সেভাবে নিতে চান না। এবারের বিশ্বকাপেও সেই একই গল্প। এসি মিলানের হয়ে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন রাফায়েল লিয়াও। কিন্তু পর্তুগাল দলে তার জায়গা হয়েছে বেঞ্চে। কারণ স্ট্রাইকারের ঐ পজিশন রোনালদোর দখলে। কিন্তু বর্তমান ফুটবলে একজন স্ট্রাইকারের কাজ শুধুমাত্র কি গোল করা? একজন স্ট্রাইকার যদি পুরো দলের সাথে তাল মিলিয়ে না খেলেন, ডিফেন্ডারদের নিচে টেনে নামিয়ে অথবা তাদের পজেশন নষ্ট করে অন্য আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য জায়গা না করে দিতে পারলে, সমস্যা তো সেখান থেকেই শুরু হয়। চলতি মৌসুমে এরিক টেন হাগের অধীনে রোনালদো ঠিক এই কাজটি এবার ঠিকঠাকভাবে করে দেখাতে পারেননি। এজন্য রোনালদোকে ছাড়াই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ভালো ফুটবল খেলছিল। কোচের সাথে বিবাদ তৈরি হবার আগে রোনালদোর মূল একাদশে সুযোগ না হবার কারণ মূলত এটাই।
অবশ্য বিশ্বকাপে সান্তোস এত কিছু ভাবেননি। রোনালদোর অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে একাদশে রেখেছেন। কিন্তু কৌশলগত দিক ছাড়াও রোনালদো এবারের বিশ্বকাপ শুরু করলেন ফর্ম হারিয়ে। এরপর রোনালদোর সাথে সান্তোসের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা তৈরি, যে সমস্যাকে কেন্দ্র করে রোনালদোর স্থান হলো বেঞ্চে। আর তার স্থানে নামলেন বেনফিকার গনসালো রামোস। তবে সান্তোস যদিও বলেছেন, রোনালদোকে তিনি বেঞ্চে রেখেছিলেন কৌশলগত কারণে। যদি সেটাও হয়, তাহলে রামোসকে সুযোগ দেওয়া ছিল সান্তোসের নেওয়া অন্যতম সাহসী সিদ্ধান্ত।
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে রামোসের সাথে আক্রমণভাগে ছিলেন ব্রুনো এবং জোয়াও ফেলিক্স। এবং এই ম্যাচে পর্তুগিজ আক্রমণকে আদতেই ভয়ানক মনে হয়েছে – যার শুরুটা হয়েছিল রামোসকে দিয়ে। তার গতি এবং চকিতে পজিশন পালটে ফেলার দক্ষতাগুলোতে সুইস ডিফেন্ডাররা বরাবরই বিভ্রান্ত হয়েছেন, এবং আরও আক্রমণ করার জায়গা দিয়ে ফেলেছেন। হাফ-স্পেসের সেই ফাঁকা জায়গাগুলো কাজে লাগিয়েছেন ফেলিক্স এবং ব্রুনো।
জোয়াও ফেলিক্সের অ্যাসিস্টে রামোসের প্রথম গোল। সুইসদের ডিফেন্ডার ফাবিয়ান শেয়া এবং আকাঞ্জির মার্ক করে রেখেছিল তাকে। ফেলিক্সের বল নিয়ে ডি-বক্সের দিকে ছুটে আসা দেখেই, ফাবিয়ান শেয়াকে ফাঁকি দিয়ে তিনি ঠিকই চলে এলেন এমন একটা জায়গাতে, যেখানে ফেলিক্স সহজেই পাস দিতে পারবেন। রামোসের সরে আসা দেখে ফেলিক্সও ভুল করেননি। এরপর ইয়ান সোমারকে ফাঁকি দিয়ে সেই দুর্ভেদ্য শটটা তো সবার দেখা। রামোস এই গোলে কাজে লাগিয়েছিলেন তার পজিশন সেন্স এবং বুলেট শট নেবার দক্ষতা। এবং সেটা এতটাই নির্ভুল ছিল যে ফাবিয়ান শেয়া এবং ইয়ান সমারের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ও বুঝে উঠতে পারেননি।
রামোসের দ্বিতীয় গোলটা হয়েছিল কিছুটা ভাগ্যের জোরেই। ইয়ান সোমার হয়তো ঠেকিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু পারেননি রামোসের চোখের পলকে জায়গা বদল করার দক্ষতার জন্য। দিয়েগো দালৌত ক্রস করতে পারেন বলে তিনি সেভাবে চকিতে ডানে সরে এসেছিলেন সেটা একদম প্রথাগত একজন স্ট্রাইকারেরই বৈশিষ্ট্য। রাফায়েল গারেরোর গোলের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে প্রথমেই চোখে পড়বে ফেলিক্সের প্লে-মেকিং, এরপর রামোসের দিকে তার পাস। গারেরোকে দেওয়া পাসটা ছিল খুবই সাধারণ, কিন্তু ফেলিক্সের পাসটা রামোস যেভাবে ধরেছেন, সেটা এক কথায় অভাবনীয়। নিজের তৃতীয় গোল রামোস যেভাবে দিয়েছিলেন, সেটাতে অবাক হবার হয়তো কিছু নেই। কারণ একজন স্ট্রাইকারের এমন দুর্দান্ত ফিনিশিং করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
বিশ্বকাপের তিন গোল রামোসকে হয়তো ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের গল্পের এই তো শুরু। কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে শুরু থেকে ছিলেন। কিন্তু পর্তুগাল হেরেছে একমাত্র গোলে। এই দলের চাপ আর ফুটবলের নিষ্ঠুরতা হয়তো এই বিশ্বকাপেই বুঝে গেছেন তিনি, যদিও তার কাছে প্রত্যাশা এখন অনেক অনেক বেশি। হুট করে দলের যে স্থান তিনি পেয়েছেন, সে স্থান এতদিন ছিল পর্তুগালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের। নিজের ফর্ম এবং ক্যারিয়ারের অগ্রগতি ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে এই স্থানের দাবিদার রামোসই। রোনালদোর জায়গা নেওয়ার বাড়তি চাপটা তাই তাকে যে বইতেই হবে।
আর রামোসের খেলার ধরন অনেকটা রোনালদোর সাথেও মেলে। গতি দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে বোকা বানানো, কঠিন অ্যাঙ্গেল থেকে নিখুঁত জোড়ালো শট, কর্নার কিকের সময় ডি-বক্সে লাফিয়ে ওঠা তো রোনালদোর ফেলে আসা রঙিন সময়কেই তো মনে করিয়ে দেয়।
তবে সময় এবং সুযোগের সাথে ভাগ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সুযোগটা রামোস পেয়েও গেছেন। বেনফিকার প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকারের সাথে পর্তুগাল দলে তার জায়গাটাও পাকা হয়ে গেল। বেনফিকার হয়ে তাকে এখন অতিরিক্ত প্রেস করেও খেলতে হয় না। তাই গনসালো রামোসের একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হিসেবে গড়ে ওঠাটা এখন শুধুই সময়ের হাতে।