ক্রিকেট খেলাটা আমরা যেমন দেখি আজকাল, সবসময় এমন ছিলো না। অনেক বদল এসেছে, সময়ের সাথে সাথে এই খেলার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত অনেক স্মৃতি হারিয়েও গেছে। সেরকমই কিছু স্মৃতিময় ব্যাপারের গল্প শোনা যাক।
বিশ্রাম দিবস
মাত্রই শেষ হলো বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যারা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা মনে করতে পারেন, তারা হয়তো এই বিশ্রাম দিবসটাও মনে করতে পারবেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্টের মধ্যে নির্বাচন উপলক্ষে একটা বিরতির দিন রাখা হয়েছিলো। সেটাই ছিলো টেস্টের মধ্যে বিশ্রাম দিবসের শেষ ঘটনা।
আজকের দিনে এটা একটু অবিশ্বাস্য শোনালেও একসময় টেস্ট ক্রিকেটের নিয়মিত ব্যাপার ছিলো এই বিশ্রাম দিবস। খেলার মাঝে একটা দিন ছুটি থাকতো। দিনটা সাধারণত রবিবার হতো এবং টেস্টের তৃতীয় দিনের পরদিন এটা করা হতো। সেই কালের ক্রিকেটাররা এই দিনে অনুশীলনেও যেতেন না। সাধারণত মাছ ধরা, গলফ খেলা, এসব করে কাটিয়ে দিতেন তারা।
১৯৮০ সালে বোম্বে টেস্টে এই বিরতি রাখা হয়েছিলো সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে। তবে ইতিহাসে এই বিরতিটাকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছিলেন বোধহয় ক্লাইড বাটস। ১৯৮৫ সালে জর্জটাউন টেস্টে অভিষেকেই বিরতি পেয়েছিলেন এই অফস্পিনার, আর বিরতির দিনে বিয়ে করে ফেলেছিলেন!
স্মৃতিমুখর সব স্টেডিয়াম
এই আমাদের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের কথাই ধরুন! বাংলাদেশের ক্রিকেটের কত ইতিহাসের সাক্ষী এই স্টেডিয়াম। এখানেই বাংলাদেশ খেলেছিলো ঐতিহাসিক অভিষেক টেস্ট। এখানে খেলে গেছেন দুনিয়ার নামকরা সব খেলোয়াড়রা। কিন্তু সেই স্টেডিয়ামটিই এখন হারিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূচী থেকে। সেই জায়গা করে নিয়েছে ঢাকার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। একইভাবে চট্টগ্রামের ক্রিকেট থেকেও হারিয়ে গেছে সেখানকার ইতিহাসের সাক্ষী এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, তার পরিবর্তে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন হচ্ছে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। এমনই দুনিয়ার নানা প্রান্তে অনেক স্মৃতিবিজড়িত স্টেডিয়াম এখন আর ক্রিকেটের সূচীতে নেই। নানা কারণে ক্রিকেট সরে গেছে সেসব স্টেডিয়াম থেকে। ডানেডিনের কারিসব্রুক, চন্ডীগড়ের সেক্টর-১৬ স্টেডিয়ামের কথা বলা যায়, বলা যায় সেন্ট জোন্সের অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের (এআরজি) কথা। এআরজি খুব পরিচিত ছিলো এখানে খেলার মাঝে ও আগে গানবাজনা আয়োজনের জন্য। গ্রাভি নামে এক দল নৃত্যশিল্পী নাচ পরিবেশনা করতেন, আর চিকি নামে গায়ক দল বিখ্যাত ছিলেন খেলার বিভিন্ন মুহুর্ত নিয়ে গান করার জন্য।
ব্যাটসম্যানের পেছনের দৃশ্য
আজকাল মাঠের কোনো ‘অ্যাঙ্গেল’ই আর দর্শকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। বড় খেলাগুলোতে ৩০টা বা তারও বেশি ক্যামেরা থাকে। নানা প্রান্ত থেকে, নানা দিক থেকে ছবি নেওয়া হয়। এছাড়াও মাঠে থাকে আল্ট্রা মোশন ক্যামেরা, স্পাইডার ক্যাম, স্ট্যাম্প ক্যামেরা, আম্পায়ার ক্যামেরা, এমনকি খেলোয়াড়দের কাছেও ক্যামেরা থাকে কোথাও কোথাও। কিন্তু প্রযুক্তির জয়যাত্রার মাঝেই কোন ফাঁকে একটা ব্যাপার হারিয়ে গেছে, ব্যাটসম্যানের ঠিক পেছন থেকে নেওয়াটা আর এখন দেখা যায় না। আগে টেলিভিশনের জন্য ক্রিকেট ম্যাচ সম্প্রচারকারীরা ব্যাটসম্যানের ঠিক পেছন বরাবর বাউন্ডারির বাইরে একটা ফিক্সড ক্যামেরা বসিয়ে রাখতেন। ওটাতে এক ওভার বাদে বাদে উল্টো দিক থেকে দৃশ্য দেখানো হতো। ১৯৮৩ সালে মহিন্দর অমরনাথ যখন ভারতের পক্ষে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে এনেছিলেন, কিংবা মাইকেল হোল্ডিং যখন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে বাউন্সারের পর বাউন্সারে জর্জরিত করে তুলতেন ব্যাটসম্যানকে, এমন দৃশ্য তখন ছিল নিয়মিত। কিন্তু এখন আর এভাবে ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় না।
গ্রিল ছাড়া হেলমেট
হেলমেট মাথায় দিলে এখন আর খেলোয়াড়ের মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় না। আইসিসির কড়াকড়ির জন্যই নিরাপত্তার কারণে এখন হেলমেটের সামনে গ্রিল থাকা বাধ্যতামূলক। একটা সময় এমন ছিল না। গ্রিল ছাড়া হেলমেট পরা ব্যাটসম্যানদের খোলা মুখ দেখেই অভ্যস্থ ছিলেন সবাই। অ্যালান বোর্ডার, অরবিন্দ ডি সিলভা, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, ব্রায়ান লারা, ড্যারিল কালিনান ছিলেন এই ধরনের হেলমেট পরা শেষ প্রজন্মের ব্যাটসম্যান। এরা কঠিন বাউন্স ও শর্ট বল ওই অবস্থায় খেলেও দেখিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে রবিন স্মিথ ও জিমি অ্যাডামস মুখে বলের আঘাত পেলে দুনিয়া জুড়ে ব্যাটসম্যানদের চিন্তা বদলাতে থাকে।
টেস্টের মাঝে ওয়ানডে
আজকালকের দ্বিপাক্ষিক সফরসূচী কত আগেই অনুমান করে ফেলা যায়। প্রথমে টেস্ট, তারপর ওয়ানডে এবং সফরের শেষ দিকে টি-টোয়েন্টি। অথচ একটা সময় এত পানসে ছিলো না ব্যাপারটা। টেস্ট সিরিজ চলতেই থাকতো। এর মাঝখানে মাঝখানে আয়োজন হতো ওয়ানডে সিরিজ।
একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ২৫ বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিলো, সেই সময়ের কথা। ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট খেলার পর ৬টা ওয়ানডের একটা ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ’ খেললো অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর অনুষ্ঠিত হলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেস্ট। তারপর অনুষ্ঠিত হলো একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ। আর সেই সিরিজ শেষে অনুষ্ঠিত হলো চতুর্থ ও পঞ্চম টেস্ট!
ভয়ানক বৃষ্টি আইন
অনেকেই বলেন, ডাকওয়ার্থ-লুইস আইনটা তারা বুঝে উঠতে পারেন না। এই বৃষ্টি আইন খুবই জটিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আইনে আর কিছু না হোক, একটা সমতা তৈরি হয়েছে। আগে বৃষ্টি আইন ছিল রান তাড়া করা দলের জন্য একটা বিভীষিকা। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে ১৯৯২ সালের বিখ্যাত সেমিফাইনাল। বৃষ্টি যখন নামে, তার আগে ১৩ বলে ২২ রান দরকার ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। প্রথম দফা বৃষ্টি থামলে সেটা হলো ৭ বলে ২২ রান। এরপর আবার বৃষ্টি। শেষ দফায় এবার দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ালো ১ বলে ২২ রান! অন্তত স্কোরবোর্ডে তাই দেখানো হয়েছিলো, যদিও প্রকৃত হিসাব অনুসারে ১ বলে ২১ রান দরকার ছিল।
সাদা পোশাকের ওয়ানডে
এখন রঙিন ক্রিকেটের যুগ। টেস্ট অবধি গোলাপী বলে খেলা শুরু হয়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর মাঠে এখন বহুবর্ণ পোশাকের ছড়াছড়ি। এই সময়ে বসে কল্পনা করা কঠিন যে, কয়েক দশক আগেও আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলা হতো সাদা পোশাকে। ওয়ানডেতে রঙিন পোশাক আনার কৃতিত্ব মূলত কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজের। ওই সিরিজেই পৃথিবী প্রথম দেখলো, সীমিত ওভারের ক্রিকেট হচ্ছে রঙিন পোশাকে। পরে এটা সারা বিশ্বও মেনে নিলো, ঘটলো যুগান্তর।
রিচি রিচার্ডসন হ্যাট
একটা সময় চওড়া ছাউনিওয়ালা বড় বড় হ্যাট পরে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং করতে দেখাটা ছিল ক্রিকেট মাঠের নিয়মিত দৃশ্য। রোদের হাত থেকে মুখটা বেশি রক্ষা পেতো ওই হ্যাটের কল্যানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন এই হ্যাটকে বিখ্যাত করে ফেলেছিলেন। আজকালকার দিনে অবশ্য কোনো ব্যাটসম্যানকেই আর ওরকম হ্যাট করে ব্যাট করতে দেখা যায় না। ভারতীয় নারী ক্রিকেটার মিথিলা রাজই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম।
সাদা কোটের আম্পায়ার
সেই সময়ের আম্পায়াররা ছিলেন দেখার মতো একটা ব্যাপার। পরনে লম্বা সাদা কোট, কোটের পকেটে দুটো হাত; দেখে মনে হতো কোনো প্রফেসর বুঝি মাত্র কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এর সাথে এই সময়ের আম্পায়ারদের প্রত্যেকেরই ছিল কিছু ট্রেডমার্ক আচরণ। ডেভিড শেফার্ড যেমন ‘নেলসন নাম্বার’ হলেই এক পায়ে লাফাতেন; নেলসন মানে রান ১১১ বা ২২২ বা ৩৩৩ এরকম। ডিকি বার্ড আবার এক পা তুলে ছক্কার ইশারা দিতেন। পিলু রিপোর্টার চার হলে শূন্যে নিজের অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত দোলাতেন।
চারজাতি-পাঁচ জাতি সিরিজ
আশি ও নব্বই দশকে এই ধরণের টুর্নামেন্টগুলো ছিলো বিপুল জনপ্রিয় ব্যাপার। নেহরু কাপ, হিরো কাপ, স্বাধীনতা কাপ, অস্ট্রেলেশিয়া কাপ – এরকম সব নামে আয়োজন হতো এরকম চার দলের বা পাঁচ দলের টুর্নামেন্ট। বিভিন্ন ধরণের কোলা কোম্পানি এগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করতো। আরব আমিরাতের শারজাতে প্রায়শ’ এমন টুর্নামেন্ট আয়োজিত হতো।
পঞ্চান্ন ওভারের ওয়ানডে
ওয়ানডে ক্রিকেট এক সময় ৬০ ওভারেও হতো। কিন্তু এই ৫৫ ওভারের ওয়ানডেটা টিকে ছিল অনেকদিন। বলা ভালো, ইংল্যান্ড টিকিয়ে রেখেছিলো। বাকী দুনিয়া যখন ৫০ ওভারের ওয়ানডে খেলছে, ইংল্যান্ডের হোম ম্যাচ হতো ৫৫ ওভারের। ইংলিশ ব্যাটসম্যান রবিন স্মিথের ১৬৭ রানের রেকর্ড ভাঙতে পরের কোনো ইংলিশ ব্যাটসম্যানের ২৩ বছর সময় লেগেছিলো। আর এটার একটা কারণ হলো, ১৯৯৩ সালে রবিন স্মিথ সেই ইনিংসটা খেলেছিলেন ৫৫ ওভারের ম্যাচে।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়ে নিন এই বইগুলো
১) শচীন রূপকথা
২) নায়ক
৩) সাকিব আল হাসান – আপন চোখে ভিন্ন চোখে