ফাইনাল ম্যাচ। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে তামিম ইকবাল যখন উইকেটে, তখনও তিনি এবারের বিপিএলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে। খেললেন ১৪১ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। পাঁচ থেকে উঠে এলেন শীর্ষ দুইয়ে। ফাইনাল ম্যাচটি ঠিক ফাইনালের মতোই ছিল। দর্শকরাও উপভোগ করেছেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। এবারের বিপিএলে প্রথমদিকে ব্যাটসম্যানদের ব্যাট একটু মন্থর গতিতে চললেও পরবর্তীতে রানের বেশ ফুলকি ছড়িয়েছে। মোটকথা, পুরো বিপিএলই মাতিয়ে রেখেছিলেন দেশি-বিদেশি সব ক্রিকেটার।
শেষ হলো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ষষ্ঠ আসর। বরাবরের মতো এবারের আসরটিও বেশ জাঁকজমক, আনন্দ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো। দেশসেরা ক্রিকেটার ছাড়াও বিদেশি সব নামি-দামি ক্রিকেটারদের ভিড়িয়েছিল সাতটি দলের ফ্রাঞ্চইজি। ব্যাট হাতে বিদেশি ব্যাটসম্যানদের পাশাপাশি দেশীয় ব্যাটসম্যানরাও বেশ দাপট দেখিয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিপিএলের ছয়টি আসরে মোট ১৮টি শতকের দেখা পেয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতকের মালিক ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং দানব ক্রিস গেইল। তবে এবারের আসরে গেইল কোনো চমক না দেখাতে পারলেও অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা ঠিকই তাদের ব্যাটিং নৈপুণ্যে তুলে নিয়েছেন নিজেদের শতক। চলুন দেখে নিই বিপিএলের ষষ্ঠ আসরে হওয়া সব শতক।
লরি ইভানস (১০৪* রান)
ইংল্যান্ডের প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেট থেকে এবারের বিপিএলে ডাক পান লরি ইভানস। এবারের আসরে রাজশাহী কিংসের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। ষষ্ঠ আসরের ২৩ নম্বর ম্যাচে সর্বপ্রথম শতকটি আসে তার ব্যাট থেকেই। আসর জুড়ে রাজশাহী কিংসের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার বিপরীতে তিনিই একমাত্র চমক দেখিয়েছেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই বিপর্যয়ে পড়লে ধীর গতিতে খেলতে থাকেন তিনি। ৪০ বল খেলে অর্ধশত রান পূর্ণ করার পর চতুর্থ উইকেট জুটিতে টেন ডাস্কেটকে নিয়ে বেশ আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাট চালাতে থাকেন তিনি। পরে মাত্র ৬১ বলেই শতক পূর্ণ করেন ইভানস। ইনিংস শেষে ১৬৭ স্ট্রাইক রেটে ৬২ বলে ১০৪ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। ম্যাচটিতে একাই ৬টি ছক্কা ও ৯টি চার হাঁকিয়েছিলেন ইভানস। তার অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে ম্যাচটিতে ৩৮ রানের জয় পেয়েছিল রাজশাহী কিংস, এবং ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনিই।
অ্যালেক্স হেলস (১০০ রান)
ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান অ্যালেক্স হেলস। বিপিএল ছাড়াও বিগ ব্যাশ, আইপিএলের মতো বড় বড় আসরে খেলে থাকেন তিনি। এবারের বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে মাঠে নামেন হেলস। এবার রংপুর রাইডার্সের ব্যাটসম্যানরা বেশ দাপটের সাথে ব্যাট হাতে রানের ফুলকি ঝড়িয়েছেন। পুরো আসরে ছয়টি শতকের মাঝে তিনটিই রংপুরের ব্যাটসম্যানদের দখলে। রংপুরের হয়ে সর্বপ্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান এই হেলসই।
আসরের ৩০তম ম্যাচে চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই উইকেট হারায় রংপুর। এরপর রাইলি রুশোকে নিয়ে দ্রুত রান তোলার মাধ্যমে বেশ ভালো একটি জুড়ি গড়েন অ্যালেক্স হেলস। মাত্র ২৩ বলেই অর্ধশত রান পূরণ করেন তিনি। এরপর ৪৭ বলে ব্যক্তিগত শতক পূরণ করেন। ঠিক পরের বলেই আউট হন তিনি। ২০৮ স্ট্রাইক রেটে ৫টি ছয় ও ১১টি চারের সুবাদে তার সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ১০০ রানে। সেই ম্যাচে রাইলি রুশোও একশত রান পূর্ণ করেছিলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ইতিহাসে এক ইনিংসে দুটি সেঞ্চুরির ঘটনা এর আগে মাত্র দুবার ঘটেছিল। দুজনের সেঞ্চুরিতে রংপুর রাইডার্স ২৩৯ রানের বিশাল টার্গেট দাঁড় করালে চিটাগাং ভাইকিংস ৭২ রানের ব্যবধানে পরাজিত হয়। অনবদ্য সেঞ্চুরির সুবাদে ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন অ্যালেক্স হেলস।
রাইলি রুশো (১০০* রান)
দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান রাইলি রুশো। বিপিএলে এসেও ব্যাট হাতে প্রথম থেকেই বেশ আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। বিপিএলের এবারের আসরের তৃতীয় শতকটি আসে তার ব্যাট থেকেই। ঐ একই ম্যাচে আরেক ব্যাটসম্যান অ্যালেক্স হেলসও সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। ষষ্ঠ এই আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটসম্যানও এই রাইলি রুশো।
এবারের আসরের ৩০তম ম্যাচে চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে আসেন রুশো। অপরপ্রান্তে হেলস দ্রুতগতিতে রান তুলতে থাকলে তিনি একটু মন্থর গতিতেই ব্যাট চালাতে থাকেন। ২৯ বল খেলে অর্ধশত রান পূর্ণ করার পর হেলসও তার শতক পূর্ণ করেন। এরপর রুশোও খুব দ্রুত রান তুলতে থাকেন। মাত্র ৫১ বলে বিপিএলে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি। ৬টি ছয় ও ৮টি চার দ্বারা শত রানের ইনিংসটি সাজিয়েছিলেন রুশো।
ইভান লুইজ (১০৯* রান)
উইন্ডিজ দলের অন্যতম সেরা ওপেনার ইভান লুইজ। তিনি এবারের বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলতে আসেন। দলটির উদ্বোধনী জুটিতে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে খেলেছেন তিনি। এবারের বিপিএলের ৩৩ নম্বর ম্যাচে চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লুইজ।
খুলনার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ধীর গতিতে রান তুলতে থাকেন ইভান লুইজ। ৩১ বল খেলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি। এরপরই তিনি আরো আগ্রাসী হয়ে ব্যাট চালাতে থাকেন। মাত্র ১৬ বলে দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লুইজ। সব মিলিয়ে ৪৯ বল মোকাবিলা করে ৫টি চার ও ১০টি ছয়ের সুবাদে ১০৯ রান সংগ্রহ করেন তিনি। লুইজের ১০৯ রানের উপর ভর করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ২৩৭ রানের বিশাল স্কোর গড়ে। সেই ম্যাচে কুমিল্লা খুলনার বিপক্ষে ৮০ রানের জয় পায়। অনবদ্য সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন লুইজ।
এবি ডি ভিলিয়ার্স (১০০* রান)
‘৩৬০ ডিগ্রি’ খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান এই হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান এবারের বিপিএলে মাঝপথে এসে যোগ দেন রংপুর রাইডার্স শিবিরে। ডি ভিলিয়ার্স এসে যোগ হওয়াতে আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে পড়ে রংপুর রাইডার্স। যদিও মাত্র ৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। এ ছয়টি ম্যাচেই নিজের রূপ বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছিলেন তার ভক্তদের। চতুর্থ ম্যাচেই পূর্ণ করেন এবারের বিপিলের পঞ্চম ও তার ব্যক্তিগত প্রথম শতক।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ঢাকা ডায়নামাইটসের দেওয়া ১৮৭ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে প্রথমেই দুই উইকেট হারায় রংপুর। এরপর এবি ডি ভিলিয়ার্স ও অ্যালেক্স হেলস মিলে ভালো একটি জুটি গড়েন। ২৪ বল খেলে প্রথম অর্ধশত রান পূর্ণ করেন ডি ভিলিয়ার্স। সব মিলিয়ে ৫০ বল খেলে ৬টি ছক্কা ও ৮টি চারের সুবাদে শতক পূর্ণ করে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন তিনি। ডি ভিলিয়ার্স ও হেলসের অনবদ্য জুটির সুবাদে ৮ উইকেটের বড় জয় পায় রংপুর রাইডার্স। সেই ম্যাচে ম্যাচসেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন ডি ভিলিয়ার্স।
তামিম ইকবাল (১৪১* রান)
দেশসেরা এই ব্যাটসম্যান আসরের শেষ ম্যাচে এসেই বেশ বড় একটি চমক দেখিয়ে দিলেন। ষষ্ঠ আসরের প্রথমদিকে তামিম ইকবাল বেশ রান খরায় ভুগেছিলেন। মাঝপথ থেকে মোটামুটি রান পেলেও স্ট্রাইক রেট ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ কম। তবে শেষ ম্যাচে এসে যেন সবই পূ্রণ করে দিলেন তিনি। ওপেনিংয়ে নেমে শেষ বল অবধি মোকাবিলা করে গড়লেন বেশ কিছু রের্কড।
বিপিএল ষষ্ঠ আসরের ফাইনাল ম্যাচে ঢাকা ডাইনামাইটসের বিপক্ষে ব্যাট করতে নামেন তামিম ইকবাল। ম্যাচের প্রথমদিকে একটু মন্থর গতিতে ব্যাট চালাতে থাকেন তিনি। ৩১ বলে অর্ধশত রান পূর্ণ করেন। এরপর অপরপ্রান্তের ব্যাটসম্যানরা ধীর গতিতে ব্যাট চালালেও তামিম খুব দ্রুতই রান তুলতে থাকেন। ৫০ বলে খেলে ব্যক্তিগত শতক পূর্ণ করেন তিনি। শতক পূর্ণ করার পর তিনি যেন আরও জ্বলে উঠলেন। শেষে মাত্র ১১ বল খেলে করেন ৪১ রান। সব মিলিয়ে ৬১ বল খেলে ১৪১ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। অনবদ্য ইনিংসটি ১১টি ছক্কা ও ১০টি চারের মাধ্যমে সাজিয়েছেন। এবারের বিপিএলে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ও ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডটি নিজের নামের পাশে লিখিয়েছেন তিনি। তার অসাধারণ ব্যাটিংয়ের উপর নির্ভর করেই ফাইনাল ম্যাচে ঢাকা ডায়নামাইটসকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অজন করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন তামিম ইকবাল।