প্রিয় মানুষটির সাথে ঝগড়া করে কেঁদে বালিশ ভেজানো মেয়েটিও প্রিয় দলের ব্যর্থতায় ব্যথিত। লা লিগা, বুন্দেস লিগা কিংবা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব পর্যায়ের কোনো খেলার খোঁজ না রাখা ছেলে-মেয়েরাও মিনিটের পর মিনিট বিশ্বকাপ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে। নেইমার, মেসি, রোনালদো কোন ক্লাবে খেলে এটা বলতে না পারা মেয়েটিও “লাভ ইউ মেসি/নেইমার/রোনালদো” স্ট্যাটাসে ফেসবুকে ঝড় তুলে দিচ্ছে।
হ্যাঁ, এটিই বিশ্বকাপ। ৪ বছর অপেক্ষা শেষে আসে ফিরে। মাঝখানে রেখে যায় অনেক স্মৃতি, বিস্মৃতি। নিজের প্রিয় দলকে সবার সামনে সেরা দেখাতে কারোরই যেন চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। নিজের প্রিয় দলের জয়টা না যত বড়, তার থেকেও চিরশত্রু দলের হার উদযাপনটা যেন এ প্রজন্মের ভক্তদের কাছে বেশি গৌরবের।
প্রতিপক্ষের সমর্থকদের মানসিকভাবে হয়রানি কিংবা ট্রল করাতেও যেন এক অদ্ভুত পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া যায়। অনেক সময় এই ট্রলের মাত্রা যায় ছাড়িয়ে। দুর্বলচিত্তের সমর্থকদের কাছে যা অনেক সময় হয়ে ওঠে আত্মঘাতী।
কিন্তু তাদের এই কষ্ট কি তাদের প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের থেকেও বেশি? কতটা রাস্তা পেরিয়ে, কতটা বাধা ডিঙিয়ে অর্জন করতে হয় বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা। যে যোগ্যতা অর্জন করতে গিয়ে কত দেশের, কত মাঠের ঘাসে লুকিয়ে আছে খেলোয়ারদের মাথার ঘাম কিংবা প্রতিপক্ষের ফাউলের শিকার হয়ে ঝরে পড়া তার রক্ত- সেই খবর কি আদৌ ভক্তরা রাখে?
মাঠে খেলে ১১ জন। কিন্তু এই ১১ জনের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে বিশ্বজুড়ে তাদের কোটি ভক্তরা। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আছে বলেই হয়তো লাতিন আমেরিকার ফুটবল নিয়ে মানুষের এত মাতামাতি। কিন্তু লাতিন আমেরিকার সেই নান্দনিক আর শৈল্পিক ফুটবলের দেখা মেলাই তো আজ ভার। ২০০২ এর পর পর লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ অর্জন করতে পারেনি বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব। গত বিশ্বকাপে সুযোগটা এসেছিল আর্জেন্টিনার কাছে। কিন্তু ভাগ্যটা তাদের সহায় হয়নি।
এবারের বিশ্বকাপের শুরু থেকেই অঘটন। বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার উতরাতেই পারেনি চিলি, নেদারল্যান্ডস এবং চারবারের বিশ্বকাপজয়ী দল ইতালি। অঘটনের শুরুটা ছিল বিশ্বকাপের শুরুতেই।
কথায় বলে, এক দল ম্যাচ জেতে আর এক দল জেতে হৃদয়। কথাটা নেহায়েত সান্ত্বনামূলক বাক্য ছাড়া কিছুই না। দিন শেষে বন্দনার জোয়ারে তারাই ভাসে যারা ম্যাচ জেতে। হেরে যাওয়া দলটির জন্য থাকে আফসোস এবং সমবেদনা।
ম্যাচ জিততে তো একটি গোলই অনেক সময় যথেষ্ট। হোক না সেই গোলটি আত্মঘাতী, তাতে কি? বল নিয়ন্ত্রণ, দখল, পাস, কিংবা শট এগুলোর আর মূল্য কোথায়, যদি ম্যাচই না জেতা যায়? একজনের স্বপ্ন ভাঙে বলেই তো তৈরি হয় আরেকজনের স্বপ্ন দেখার গল্প। এই প্রথম বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ছিলো না ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা স্পেন। ম্যাচ হেরে সবার চোখে-মুখে ছিল বিষাদের চিহ্ন, ছিল হতাশা এবং ব্যর্থতা। দলগুলোর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি নিয়েই এই আয়োজন।
১. জার্মানি
গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি, রাশিয়া বিশ্বকাপে যাদের শুরুটাই ছিল অঘটনের জন্ম দিয়ে। অবশ্য অঘটনই বা কেন হবে, প্রতিপক্ষ হিসেবে তো ছিল উত্তর আমেরিকার ফুটবলের সেরা দল মেক্সিকো। মেক্সিকোর রক্ষণভাগ ভেঙে গোল দেওয়াটা অতটা সহজ ছিল না জার্মানদের পক্ষে। কিন্তু দলগত, সুশৃঙ্খল ফুটবল খেলা জার্মানি কি সেই আগের জার্মানি আছে?
ফলাফল ১-০ ব্যবধানে হার। সুইডেনের বিপক্ষে নিজেদের ২য় ম্যাচটি ছিল বিশ্বকাপে তাদের টিকে থাকার লড়াই। ১-০ তে এগিয়েই ছিল সুইডেন। ৪৮ মিনিটে গোল করে ১-১ এ সমতায় ফেরান প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা মার্কো রিউস। অতিরিক্ত সময়ে কর্ণার থেকে টনি ক্রুসের এক অবিশ্বাস্য গোলে জয় পায় জার্মানি।
কিন্তু এরকম জয় কি চেয়েছিল জার্মান ভক্তরা? ৩য় ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২-০ গোলের হারে বিদায়ঘন্টা নিশ্চিত হয় জার্মানির। পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নিচু রাখতে হয় গেলবারের চ্যাম্পিয়নদের। তবে ম্যাচ জিতে মাথা উঁচু রেখেই রাশিয়া থেকে বিদায় নেয় দক্ষিণ কোরিয়া।
২. আর্জেন্টিনা
পঁচা শামুকে পা কাটা প্রবাদটি বাংলা ভাষায় অনেক জনপ্রিয়। রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে র্যাংকিংয়ে ২২ নাম্বারে থাকা আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পঁচা শামুকে পা কাটে আর্জেন্টিনার। অবশ্য র্যাংকিংয়ের বিচার করে আইসল্যান্ডকে ছোট করাটা অন্যায়ের শামিলই হবে। যারা ম্যাচটি দেখেছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন আর্জেন্টিনাকে রুখে দিতে কত মরিয়া ছিল আইসল্যান্ড। এই ড্র আইসল্যান্ডের কাছে ছিল জয়েরই সমান।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে হারের ফলে আর্জেন্টিনার ২য় রাউন্ডে খেলাটা ছিল বলতে গেলে অনিশ্চিতই। তবে সেই অনিশ্চিত যাত্রায় খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস আসে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে নাইজেরিয়ার ২-০ গোলে জয়ের ফলে। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচটি ছিল আর্জেন্টিনা এবং নাইজেরিয়া দুই দলের জন্যই অনেকটা নক আউট ম্যাচের মতো। জিতলে ২য় রাউন্ডে, হারলে কাটতে হবে দেশে ফেরার টিকিট।
ঠিক সময়ে জ্বলে উঠলেন মেসি। ১৪ মিনিটে নাইজেরিয়ার গোলরক্ষককে একা পেয়ে তাকে বোকা বানাতে বেগ পেতে হয়নি তাকে। ৫১ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা ফেরান মোজেস। শেষপর্যন্ত মার্কো রোহোর গোলে ২-১ এ জয় পায় আর্জেন্টিনা। গ্রুপ অব ডেথ থেকে ক্রোয়েশিয়ার সাথে ২য় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয় তারা।
একঝাঁক তরুণ প্রতিভা দিয়ে গড়া ফ্রান্সের মুখোমুখি মেসিরা। শুরু থেকেই আধিপত্য ছিল ফরাসিদের। ২-১ গোলে এগিয়ে থেকেও এমবাপ্পের জোড়া গোলে ৪-২ এর লিড নেয় ফ্রান্স। অতিরিক্ত সময়ে বদলি হিসেবে নামা অ্যাগুয়েরো গোল করে ব্যবধান কমান মাত্র। ফলে ৪-৩ এ হেরে রাশিয়া বিশ্বকাপের ২য় রাউন্ড থেকে বিদায় নেয় গতবারের রানার্স আপ আর্জেন্টিনা।
৩. স্পেন
ক্লাব ফুটবলে স্পেনের আধিপত্য বোঝাতে স্প্যানিশ লিগই যথেষ্ট। ২০০৮ ও ২০১২ মৌসুমে স্পেন জিতেছে ইউরো ট্রফি। ২০১০ সালে জিতেছে বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব। রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথমদিনেই মুখোমুখি সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল স্পেন ও বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল। স্পেনের নেতৃত্বে রিয়াল মাদ্রিদের অধিপতি সার্জিও রামোস, অন্যদিকে পর্তুগালের নেতৃত্বে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্দো। কিছুটা ‘বন্ধু তুমি শত্রু তুমি’ ব্যাপার। তবে রোনালদোর হ্যাটট্রিকে ৩-৩ এ ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় দুই দলকে। ইরানের বিপক্ষে আসে ১-০ ব্যবধানের জয়। মরক্কোর সাথে ২-২ এ ড্রয়ের ফলে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছায় স্পেন। রাউন্ড অব সিক্সটিনে স্বাগতিক রাশিয়ার মুখোমুখি স্পেন। নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে ২ দলের স্কোর ১-১। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে ২ দলই গোল করতে ব্যর্থ হলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকে স্বাগতিকদের কাছে ৪-৩ ব্যবধানে হারের ফলে রাশিয়া বিশ্বকাপের ২য় রাউন্ডেই বিদায়ের সুর বাজে স্পেনের।
রামোস, ইনিয়েস্তার চোখে-মুখে এক অদেখা কান্না। সাইড বেঞ্চে বসে দলের হারের সাক্ষী হতে হয়েছে ইনিয়েস্তাকে। এক বুক কষ্ট নিয়ে তাই জাতীয় দলকে বিদায়ই জানালেন ইনিয়েস্তা, তবে রেখে গেলেন সমৃদ্ধ এক ক্যারিয়ার। সতীর্থ পিকের বাহুডোরে তাই লুকানোর চেষ্টা। পিকে হয়তো এটা বলেই সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, “কষ্ট পেও না ডন, বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ তুমি অনেক আগেই পেয়েছো।”
৪. পর্তুগাল
দেশের হয়ে একটি আন্তর্জাতিক ট্রফিতে ছোঁয়া বা চুমু দেওয়া একজন ফুটবলারের কাছে অনেক বড় এক প্রাপ্তি। গত ইউরোতে আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতার অপূর্ণতা ঘুচেছে রোনালদোর। বিশ্বকাপের ২১তম আসরের প্রথমদিনে স্পেনের মুখোমুখি পর্তুগাল। জেতার বাজিটা স্পেনের দিকেই বেশি ছিল। কিন্তু তাতে কি? পর্তুগালের যে আছে একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্দো। দলকে টেনে তুলতে তিনি একাই যথেষ্ট।
খেলা শেষে যেন ঘটলো সেটাই। দেশের জার্সিতে বড় দলের বিপক্ষে রোনালদোর হ্যাটট্রিক নেই- এমন অভিযোগ ছিল বহুদিন থেকে। স্পেনের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ৫১ তম হ্যাটট্রিকে ঘোচালেন সেই অপবাদ। ৩-৩ এর সমতায় শেষ হয় ম্যাচ।
মরক্কোর বিপক্ষে রোনালদোর একমাত্র গোলে ১-০ ব্যবধানে জয় পায় পর্তুগিজরা। শেষ ম্যাচে ইরানের সাথে ১-১ এ ড্র। ফলে বি গ্রুপ থেকে স্পেনের পর রাউন্ড অব সিক্সটিন নিশ্চিত হয় পর্তুগালের।
২য় রাউন্ডে তাদের সামনে আসে উরুগুয়ে। আগের রাতে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল মেসির আর্জেন্টিনা। তবে কি এবার পর্তুগালের পালা? সেই শঙ্কাটা বাস্তবে রূপ নিতে সময় লাগেনি। কাভানির জোড়া গোল যেন জোড়া তীর হয়ে আঘাত হানলো পর্তুগিজ খেলোয়ারদের ওপর। সেরা দুই তারকার বিদায়ে বিশ্বকাপের রং তো সেদিনই ফিকে হয়ে গিয়েছিল।
৫. ব্রাজিল
গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ এ হারের ক্ষতটা হয়তো এখনি কমেনি ব্রাজিল কিংবা ব্রাজিল সমর্থকদের। কমার কথাও না। সেই হারের ধাক্কায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে ২০১৬ সালের অলিম্পিকে। দল সেই জার্মানি। মারাকানার ৮০ হাজার দর্শকের সামনে সেই জার্মানিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ব্রাজিল জেতে তাদের প্রথম অলিম্পিক সোনা।
মিশন হেক্সার শুরুতেই বাধা হয় দানি আলভেজের ইনজুরি। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে সন্তুষ্ট থাকতে হয় সেলেসাওদের। কোস্টারিকার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গোল করে দলকে স্বস্তি এনে দেন কৌতিনহো এবং নেইমার জুনিয়র।
সার্বিয়ার বিপক্ষে ২-০ তে জিতে নিশ্চিত হয় ২য় রাউন্ড। নেইমার জুনিয়র এবং ফিরমিনোর গোলে মেক্সিকোকে ২ -০ তে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যায় ব্রাজিল। সেমিফাইনালে যাওয়ার পথে ব্রাজিলের বাধা হয়ে দাঁড়ালো এ বিশ্বকাপের অন্যতম ডাক হর্স বেলজিয়াম। একদিকে নেইমার, কৌতিনহো, জেসুস, অন্যদিকে ইংলিশ প্রিমিয়াম লিগ কাঁপানো ডি ব্রুইন, লুকাকু হ্যাজার্ড, কর্তোয়ারা। হেক্সা মিশনে সেলেসাওদের পথে যে তারাই বাধা হয়ে যাবে এমনটা অনুমিত ছিল। বাস্তবেও সেটাই হলো।
তবে এখানে খলনায়ক ফার্নান্দিনহো। ১৩ মিনিটে করা ফার্নান্দিনহোর আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে যায় বেলজিয়াম। ৩১ মিনিটে ডি ব্রুইনের গোলে ২-০ তে লিড নিয়ে প্রথমার্ধ শেষ হয়। দ্বিতীয়ার্ধে গোল পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে ব্রাজিল। কিন্তু একদিকে বেলজিয়ামের রক্ষণভাগ, অন্যদিকে কর্তোয়ার দুর্দান্ত সব সেভ। গোলবারে আসা শটগুলোকে বার বার প্রতিহত করেন কর্তোয়া। ৭৬ মিনিটে গোল করেন রেনেতো অগাস্তো। তবে সেটি ব্যবধান কমানো ছাড়া কিছুই হয়নি। বল দখল, পাস, শট অন টার্গেট সব কিছুই ছিল ব্রাজিলের পক্ষে, শুধু দিনটি ছিল বেলজিয়ামের।
কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। সেই সাথে বিশ্বকাপের আনন্দও শেষ হয় বাংলাদেশী সমর্থকদের।
ফিচার ইমেজ: review journal