১.
সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্রিকেট বিশ্লেষকরা সবার আগে নির্দিষ্ট ঐ ব্যাটসম্যানের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। বিরাট কোহলি অভিষেকের পর থেকেই ওয়ানডে ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছিলেন, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে শুরুতেই নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। এরপর দ্রুতই টেস্ট ক্রিকেটে রানের দেখা পেতে শুরু করলেন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দুর্দান্ত সময় কাটানোর পর টেস্ট ক্রিকেটে তার সামর্থ্য বা পরিপক্বতা নিয়ে যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিলো সেটা দূর হয়ে যায়। কিন্তু তখনও বিদেশের মাটিতে তার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষ করে পেস-সহায়ক উইকেটে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলগুলোতে তার দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৪ সালে নিজেদের মাটিতে জেমস অ্যান্ডারসন রীতিমতো ছেলেখেলা করেন বিরাটকে নিয়ে। অ্যান্ডারসনের সামনে তার দুর্বল দিকগুলো একেবারে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
বিরাট নিজের দুর্বল দিকগুলো নিয়ে পড়ে থাকেননি, কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান হতে হলে এমন স্পষ্ট দুর্বলতা থাকলে চলবে না, সেটা সবার আগে তিনিই উপলব্ধি করেছেন। এরপর থেকে বিদেশের মাটিতে সব সিরিজেই দাপটের সাথে ব্যাটিং করেছিলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার বিপরীত স্রোতে তিনি ১৫৩, ৫৪ এবং ৪১ রানের কার্যকরী ইনিংস খেলেন।
এরপর ইংল্যান্ডের মাটিতে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলার জন্য আসে ভারত। ২০১৪ সালের টেস্ট সিরিজে বিরাট ব্যাট হাতে রান না পেলেও এইবার নিজের ব্যাটিং দুর্বলতা কাটিয়ে পাঁচ ম্যাচে দুইটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতক হাঁকান তিনি। দশ ইনিংসের একবারও অ্যান্ডারসনকে উইকেট দেননি তিনি।
২.
২০০৮ সালে ভারতকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতানোর পর থেকেই বিরাট কোহলির উত্থান শুরু হয়। এরপর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর নিয়মিত পারফর্ম করছিলেন তিনি। কিন্তু অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেন। এখন পর্যন্ত ভারতকে ৪২টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১৭টি শতক এবং নয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৫.১২ ব্যাটিং গড়ে ৪,২৩৩ রান সংগ্রহ করেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসাবে তো তিনি আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য। ৫৭ ম্যাচে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে ব্যাট হাতে ১৬টি শতক এবং ১৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৮৭.৮০ ব্যাটিং গড়ে ৩,৫১২ রান সংগ্রহ করেছেন।
বিরাট কোহলি যখনই ব্যাট হাতে নামেন, তখনই নতুন কোনো না কোনো কীর্তি গড়েন। ব্যাট হাতে সিংহভাগ রেকর্ডের মালিক থাকা শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ডগুলো ক্রমান্বয়ে নিজের দখলে এনে তার সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানোর রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার জন্য দ্রুত ছুটছেন তিনি। সদ্যসমাপ্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম তিনটি ওয়ানডেতে শতক হাঁকিয়ে প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড গড়েন তিনি।
প্রথম ওয়ানডেতে ১৪০ রান, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অপরাজিত ১৫৭ রান এবং তৃতীয় ওয়ানডেতে ১০৭ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন তিনি। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা বিরাট কোহলি ২০১৮ সালে মাত্র ১৪ ম্যাচে ছয়টি শতক এবং তিনটি অর্ধশতক হাঁকান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার টানা তিনটি শতক হাঁকানো ম্যাচে ভারত একটিতে জয় পেয়েছে, একটি টাই হয়েছে এবং একটিতে পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০ জন ব্যাটসম্যান ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক সেঞ্চুরি করেছেন। এর মধ্যে বিরাট কোহলিই প্রথম ক্রিকেটার, যার তিন ম্যাচে তিনটি ভিন্ন ফলাফল এসেছে। এই রেকর্ডটি উল্লেখযোগ্য কোনো রেকর্ড নয় বটে, তবে এই ‘অভিনব’ রেকর্ডটিও সহজে কেউ ভাঙতে পারবেন বলে মনে হয় না।
৩.
‘পরিপূর্ণ’ ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার জন্য কিছু বাকি নেই। তবে শতভাগ পূর্ণতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যাট করার সামর্থ্য থাকা উচিৎ। এই ক্ষেত্রে বিরাটের কিছুটা হলেও অপূর্ণতা রয়ে গেছে। তিনি এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে ৩৮টি শতক হাঁকিয়েছেন, যার মধ্যে ২৩টি এসেছে ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে। এর মধ্যে ভারত ২০টি ম্যাচে জয় পেয়েছে, আর বাকি তিনটিতে পরাজিত হয়েছে। এই তিনটি ম্যাচের মধ্যে একটি ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে।
পুনেতে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে প্রথমে ব্যাট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮৩ রান সংগ্রহ করেছিলো। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই রোহিত শর্মার উইকেট হারায় ভারত। এরপর ক্রিজে আসেন বিরাট কোহলি। শিখর ধাওয়ান, আম্বাতি রায়ডু, রিশাভ পান্টের সাথের ছোট জুটি বেধে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তার সাথে কেউই বেশিক্ষণ থিতু হতে পারেননি। এই ম্যাচে ভারত কোনো অলরাউন্ডার নিয়ে খেলেনি, দলের পাঁচজন বোলার-ই স্পেশালিষ্ট বোলার। যার ফলে মহেন্দ্র সিং ধোনি পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফিরলে লম্বা টেল এন্ড উন্মোচিত হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে।
পাঁচ উইকেট হাতে রেখে ভারতের জয়ের জন্য ১৪ ওভারে ৯০ রান প্রয়োজন ছিল। ইতিমধ্যে শতক হাঁকিয়ে ফেলা বিরাট কোহলি এমন পরিস্থিতি থেকে ভারতকে বহু ম্যাচে জয় এনে দিয়েছেন। তবে এই ম্যাচে দলকে জয় এনে দিতে হলে তাকে টেল-এন্ডারদের আগলে রেখে ব্যাট করতে হতো। কিন্তু তিনি তা পারেননি। এই ম্যাচে সাত নাম্বারে ব্যাটিং করেছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। সাধারণত এই পজিশনে ব্যাট করে থাকেন হার্দিক পান্ডিয়া কিংবা রবীন্দ্র জাদেজা। নিজের উপর অতিরিক্ত চাপ নিতে গিয়ে আউট হয়ে যান তিনি, দলের সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসাবে যখন সাজঘরে ফেরেন তখনও ৫১ বল বাকি ছিলো। পার্টটাইমার মারলন স্যামুয়েলসের বলে পরাস্ত হয়ে তিনি ১০৭ রান করে সাজঘরে ফেরেন, যার ফলে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় ভারত।
৪.
বিরাট কোহলি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ ইনিংসে রোহিত শর্মা এবং শিখর ধাওয়ানের সাথে জুটি বেঁধে রান তুলেছেন। টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের সাথে খেলতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
রোহিত শর্মার সাথে এখন পর্যন্ত ৬৬ ইনিংস ব্যাট করে ৬৬.৫৫ গড়ে ৪,০৬০ রান যোগ করেছেন বিরাট; শতরানের জুটি গড়েছেন ১৫ বার, অর্ধশত রানের জুটি ১০ বার। আরেক ওপেনার শিখর ধাওয়ানের সাথে ৪৫ ইনিংসে ৬২.৫০ গড়ে ২,৬২৫ রান যোগ করেছেন; শত রানের জুটি আটবার এবং অর্ধশত রানের জুটি ১৩ বার। এছাড়া গম্ভীবের সাথে ৩৫ ইনিংসে ২,০০০ রান, রাহানের সাথে ৩৩ ইনিংসে ১,৭১৭ রান এবং সুরেশ রায়নার সাথে ৪৩ ইনিংসে ২,২৩৮ রান যোগ করেছেন।
লোয়ার মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে রবীন্দ্র জাদেজা এবং হার্দিক পান্ডিয়ার সাথে আটবার করে জুটি বেধেছেন। একই ক্যাটাগরির অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইউসুফ পাঠানের সাথে পাঁচবার এবং ইরফান পাঠান, আক্সার প্যাটেল ও স্টুয়ার্ট বিন্নির সাথে একবার করে জুটি বেধেছেন। এদের মধ্যে জাদেজা, পান্ডিয়া, ইউসুফ পাঠান এবং প্যাটেলের সাথে একবার করে অর্ধশত রানের জুটি গড়েছিলেন তিনি।
এছাড়া রবিচন্দ্রন অশ্বিন, হরভজন সিং এবং ভুবনেশ্বর কুমারের সাথে তিনবার জুটি বেঁধেছিলেন। এদের সবাই স্পেশালিষ্ট নাম্বার এইট ব্যাটসম্যান। অশ্বিন এবং হরভজনের তো একাধিক সেঞ্চুরি রয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে। ভুবনেশ্বর কুমারও বেশ কিছু ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস খেলেছেন তার ক্যারিয়ারে। এদের ছাড়া বিরাট কোহলি প্রথমবারের মতো টেল-এন্ডারদের সাথে জুটি বাঁধেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। ১৫৭* রানের অনবদ্য ইনিংস খেলার পথে তিনি মোহাম্মদ শামির সাথে ব্যাট করেন, সাত বলের জুটিতে শামি মাত্র একটি বল মোকাবেলা করেছিলেন। এরপর তৃতীয় ওয়ানডেতে কুলদ্বীপ যাদবের সাথেও জুটি বাঁধেন তিনি।
৫.
বিরাট কোহলি তার ২১৬ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ভারতকে বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন। রান তাড়া করতে নেমে তার ২০টি সফল সেঞ্চুরিই প্রমাণ করে, ফিনিশার হিসাবেও অতুলনীয় তিনি। কিন্তু তিনি বেশিরভাগ সময় অপরপ্রান্তে পেয়েছিলেন টপ অর্ডার কিংবা মিডল অর্ডারে সুরেশ রায়না এবং ধোনির মতো ব্যাটসম্যানদেরকে। প্রথমবারের মতো টেল-এন্ডারদের সাথে ব্যাট করতে নেমেই ব্যর্থ হয়েছেন।
টেল-এন্ডারদের সাথে ব্যাট করার ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মহেন্দ্র সিং ধোনি আবার বেশ দক্ষ, এই রকম পরিস্থিতিতে ধোনি রীতিমতো অতুলনীয়। তার ক্যারিয়ারে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তিনি জাদেজা, অশ্বিন, ভুবনেশ্বর কুমার, হরভজন সিং-দের মতো লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদেরকে নিয়ে বেশ কয়েকবার ম্যাচ জেতানো জুটি গড়েছিলেন। বর্তমানে তার ফর্ম খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, তাতে করে বিরাট কোহলির টেল-এন্ডারদের সাথে ব্যাট করার ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। বিরাট কোহলি এমন একজন ব্যাটসম্যান, যিনি তার দুর্বলতা নিয়ে খুব বেশিদিন সংগ্রাম করেন না, পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সেটাকেই শক্তির জায়গা পরিণত করেন। কে জানে, হয়তো দেখা যাবে পরেরবার এমন পরিস্থিতিতে ঠিকই দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেবেন তিনি!