প্রতিকূল অবস্থান থেকে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ স্বাভাবিক জয়ের চেয়ে একটু বেশিই হয়ে থাকে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান বনাম বোলারদের লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবে একটি পক্ষ জয়ী হয়। তবে জয়ের জন্য যখন শেষ ওভারে ২০ রান কিংবা শেষ বলে ৬ রান প্রয়োজন হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সম্ভাবনার পাল্লাটা বোলারদের দিকেই একটু হেলে থাকে। কিন্তু এরপরেও এরকম পরিস্থিতি জয় করার রেকর্ড কিছু কিছু ব্যাটসম্যানের রয়েছে। এ কারণেই ইনিংসগুলো এবং একইসাথে ম্যাচগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকে।
আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা এমন থাকে যে, শেষ ওভারে বোলারকে মাত্র ৬ রান আটকানোর কাজটি করতে হবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এমন পরিস্থিতি অনেক হলেও এমন পরিস্থিতিতে বোলিং পক্ষের জয় পাওয়ার ঘটনা অনেক কম।
আজ এখানে এমন কিছু ম্যাচের কথা বর্ণনা করা হলো, যেখানে কি না বোলাররা শেষ ওভারে ন্যূনতম ৬ রান আটকানোর উদ্দেশ্যে নেমেছিলেন, এবং সফলও হয়েছিলেন।
ক্রিস গেইল বনাম ইংল্যান্ড – ৫ রান
২০০০ সালে অনুষ্ঠিত ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ৯ম ম্যাচটি ইংল্যান্ডের জন্য অনেকটাই ওয়ার্ম আপ ম্যাচ ছিল, কারণ এর আগেই জিম্বাবুয়ের সাথে ফাইনাল ম্যাচ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র ১৯৬ রানের। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকলেও অন্য প্রান্তে অ্যালেক স্টুয়ার্ট টিকে যাওয়ায় লক্ষ্যের দিকে পৌঁছানোটা সমস্যা মনে হচ্ছিলো না। শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৫ রান, হাতে ছিল ৩ উইকেট।
ওভারের প্রথম বলেই পল ফ্র্যাঙ্কস ১ রান নিয়ে অ্যালেক স্টুয়ার্টকে স্ট্রাইক দেওয়ার চিন্তা করেন। কিন্তু পয়েন্ট অঞ্চল থেকে মহেন্দ্র নাগামুটূর সরাসরি থ্রোতে পল রান আউট হন। দ্বিতীয় বলে ১ রান নিয়ে স্টুয়ার্ট তার সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেও স্ট্রাইক হারাতে হয়। ক্ষতিপূরণটা দেন পরের বলেই। ৪ বলে ৪ রান বাকি থাকলেও ড্যারেন গফকে প্রথম বলেই বোল্ড করে ম্যাচের পাল্লাটা উইন্ডিজের দিকেই নিয়ে আসেন গেইল। শেষ ব্যাটসম্যান অ্যালান মুলালী প্রথম বল ঠেকিয়ে দিলেও পরের বলে এলবিডব্লিউ আউট হন এবং উইন্ডিজ পায় ৩ রানের এক জয়। অ্যালেক স্টুয়ার্ট অপরাজিত ১০০ রান করলেও ২২ গজের অপর প্রান্ত থেকে ইংল্যান্ডের হার দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় তার ছিল না।
ইমরান খান বনাম অস্ট্রেলিয়া – ৪ রান
ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। ১৯৯০ সালের ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপের সেই ম্যাচে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ছিল সেই সময়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াই। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোটা কঠিন কাজই, ৪৯ ওভারে ২২১ রানের টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে জয়ের পথেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। মাঝে স্বচ্ছন্দে খেলতে থাকা অ্যালান বোর্ডার আউট হবার পর একটা ছোট ঝড় আসলেও সেটাকে ভালোভাবেই সামলে নিয়েছিলেন অলরাউন্ডার সাইমন ও ডোনেল। শেষ ওভারে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল মাত্র ৪ রানের, হাতে উইকেট ছিল ৩টি।
সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিজে তখনও উপস্থিত ছিলেন ১টি ছক্কা আর ২টি চারের সাহায্যে ঝড়ো গতিতে ৩৯ রান করা ডোনেল। কিন্তু ইমরান খানের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে এই ছোট রানও অনতিক্রম্য হয়ে ওঠে। মাত্র ১ রানের বিনিময়ে আউট করেন সাইমন ও ডোনেল এবং র্যাকম্যানকে। শেষপর্যন্ত ২ রানের জয় পায় পাকিস্তান।
কার্ল লাঙ্গেভ্যাল্ট বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ৪ রান
৫০ ওভারে ২৮৫ রানের লক্ষ্যমাত্রাটা একটু বড়ই, তবে ক্রিস গেইলের সেঞ্চুরিতে সঠিক পথেই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দলীয় ২৫৮ রানে যখন ৬ষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে গেইল আউট হলেন, তখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকেই পাল্লাটা হেলে ছিল। শেষ ওভারে হাতে ৩ উইকেট নিয়ে মাত্র ৪ রান করতে পারাটা অসম্ভব ছিল না ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য।
প্রথম ২ বলে ২ রান নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয়ের দিকে আরেকটু এগিয়ে গেল। ৪ বলে আর ২ রান নিলে জয়, ১ রান নিলে টাই। এই অবস্থায় ব্র্যাডশকে বোল্ড আউট করলেন লাঙ্গেভ্যাল্ট। সবাইকে হতবাক করে পরের বলেও ড্যারেন পাওয়েলকে বোল্ড করে ম্যাচে উত্তেজনা ফিরিয়ে আনলেন লাঙ্গেভ্যাল্ট। শেষ ২ বলে ২ রান প্রয়োজন হলেও উইকেট মাত্র ১টি থাকায় পাল্লাটা দুদিকেই ছিল। ওদিকে হুট করে ট্র্যাকে ফিরে এসে আত্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও বেশি ছিল বোলারের। সম্ভবত এই কারণেই প্রথম বলেই কোলিমরকে এলবিডব্লিউ আউট করে হ্যাটট্রিক করে ফেললেন লাঙ্গেভ্যাল্ট। ইতিহাসের একমাত্র বোলার হিসেবে শেষ ওভারে হ্যাটট্রিক করে দলকে ১ রানের জয় এনে দিলেন লাঙ্গেভ্যাল্ট।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল বনাম পাকিস্তান – ২ রান
শেষ ওভারে মাত্র ২ রান করতে হবে, হাতে ২ উইকেট। যিনি বোলিং করবেন তিনি নিয়মিত বোলারও নন। ব্যাটিংয়ে যে ব্যাটসম্যান ছিলেন তাদের ব্যক্তিগত রানও দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল (সোহেল তানভীর ১০ রান, জুলফিকার বাবর ১৪ রান)। পাল্লাটা তাই ব্যাটিং দলের দিকেই হেলে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বলেই যখন সোহেল তানভীর আউট হলেন, তখন ম্যাচটা জমে উঠলো।
নতুন ব্যাটসম্যান ইরফান কি রানটা করতে পারবেন, নাকি ম্যাক্সওয়েল উইকেট নিতে পারবেন? পরের তিন বলেও ইরফান রান নিতে পারলেন না। শেষ বলে ২ রান নিতে গিয়ে উঠিয়ে মারলে ক্যাচ আউটে পরিণত হন ইরফান এবং অস্ট্রেলিয়া পায় মাত্র ১ রানের দুর্দান্ত এক জয়।
ক্রিস পিঙ্গল বনাম অস্ট্রেলিয়া – ২ রান
৫০ ওভারে মাত্র ১৯৫ রান করাটা কোনো যুগেই খুব কঠিন কাজ ছিল না। ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বেনসন এন্ড হেজেস কাপের ম্যাচটাতেও তাই রান তাড়া করতে নামা অস্ট্রেলিয়াই এগিয়ে ছিল। তবে কাজটি কঠিন করে দিল নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। একপ্রান্তে জিওফ মার্শ ধরে খেলতে থাকলেও অন্য প্রান্তে নিয়মিত উইকেট পড়তে থাকলো। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন মাত্র ২ রান থাকলেও হাতে উইকেট ছিল মাত্র ১টি। এর চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, ২৪ রান নিয়ে খেলতে থাকা ম্যাথিউস ছিলেন নন স্ট্রাইক প্রান্তে।
শেষ ওভার করতে আসলেন ক্রিস পিঙ্গল যিনি আগের ৯ ওভারে ৩৪ রান দিলেও কোন উইকেট পাননি। ব্যাটিং করছিলেন ৬ ফিট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার ব্রুস রিড। প্রথম ৫ বলে রিড কোন রান নিতে পারলেন না। শেষ বলে মরিয়া হয়ে দৌড় দিয়েছিলেন কিন্তু নিউজিল্যান্ড ফিল্ডারদের দক্ষতায় রান আউট হন। শেষ ওভারে মেইডেন সহ ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচটা জেতান ক্রিস পিঙ্গলই। সেই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীও ছিলেন পিঙ্গল।
মনোজ প্রভাকর বনাম শ্রীলংকা – ৫ রান
মনোজ প্রভাকর সেসব বিরল অলরাউন্ডারদের মাঝে একজন, যিনি কি না বোলিং এবং ব্যাটিং দুটোতেই ওপেন করেছেন। এই ম্যাচেও ব্যাটিংয়ে ওপেন করতে নেমে সিধুর সাথে ৭৭ রানের জুটি গড়েছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে করেছিলেন ৩৯ রান। এরপরেও দলীয় রান ২১২-তে আটকে যাওয়ার কারণ ছিল আজহার উদ্দিন (৫৩) বাদে বাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা।
শেষ ওভারে যখন হাতে ১ উইকেট নিয়ে মাত্র ৫ রান প্রয়োজন ছিল শ্রীলংকার, তখন অধিনায়ক বল তুলে দিলেন প্রভাকরের হাতেই। প্রথম বলেই মিড উইকেটে বল ঠেলে দিয়ে ৩ রান নিয়ে নিয়েছিলেন রুয়ান কালপাগে। পরের ৫ বলে প্রয়োজন ছিল মাত্র ২ রান। কিন্তু প্রভাকরের একটি সুইং ইয়র্কার ঠেকাতে ব্যর্থ হলেন বিক্রমাসিংহে। ফলাফল হিসেবে ৩ ম্যাচের সিরিজের প্রথম ম্যাচে ইন্ডিয়া ১ রানে জয়ী।
স্টিভ ওয়াহ বনাম ভারত – ৬ রান
১৯৮৭ বিশ্বকাপে ভারতের মাটিতে জিওফ মার্শের সেঞ্চুরিতে ২৭০ রানের এক বড় স্কোরই গড়ে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ভারতের শুরুটাও ভালোই হয়। কিন্তু বড় স্কোর তাড়া করতে গেলে দ্রুত রান তোলার সাথে সাথে উইকেটটাও টিকিয়ে রাখতে হয়। সেই কাজটা করতে ব্যর্থ হলেও শেষ ওভারে জয় পেতে ভারতের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৬ রান, হাতে ২ উইকেট।
২২ বছর বয়সী স্টিভ ওয়াহর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে এই রানটুকুও তুলতে ব্যর্থ হয় ভারত। শেষ ২ বলে যখন ২ রান প্রয়োজন, তখন শেষ ব্যাটসম্যান মানিন্দার সিংকে বোল্ড করে ১ রানের জয় এনে দেন স্টিভ ওয়াহ।
শচীন টেন্ডুলকার বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা – ৬ রান
হিরো কাপের সেমিফাইনালে ফেভারিট ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাই। প্রথমে ব্যাট করে ভারত যখন মাত্র ১৯৫ রানে অল আউট হয়ে গেলো, তখনও ম্যাচটি দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষেই ছিল। কিন্তু স্পিনে অস্বচ্ছন্দ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকলে ম্যাচ একপর্যায়ে ভারতের পক্ষে আসতে থাকে। শেষ ওভারে হাতে ২ উইকেট থাকলেও ডি ভিলিয়ার্স রান আউট হয়ে যান। শেষ ব্যাটসম্যান ডোনাল্ড ৪টি বল খেললেও মাত্র ১ রান নিতে সমর্থ হন। ম্যাকমিলান ৪৮ রান করে অপরাজিত থাকলেও ২ রানের হার মানতে হয়।
শচীন টেন্ডুলকার বনাম অস্ট্রেলিয়া – ৬ রান
১৯৯৬ সালের টাইটান কাপে ২৯০ রান তাড়া করতে গিয়ে মার্ক টেইলরের ৭৮ আর মার্ক স্ল্যাটারের ৩৮ বলে ৫২ রানের সুবাদে সঠিক পথেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকলে একটা পর্যায়ে শেষ ওভারে প্রয়োজন হয় ৬ রানের, হাতে ছিল মাত্র ১টি উইকেট। বোলিং করতে আসেন সেই ম্যাচের আগে কোনো বল না করা শচীন টেন্ডুলকার। প্রথম বলেই হগ রান আউট হলে অস্ট্রেলিয়া ৫ রানে পরাজিত হয়, এবং একমাত্র বোলার হিসেবে শেষ ওভারে ন্যূনতম ৬ রান আটকানোর কীর্তি গড়েন টেন্ডুলকার।
ডোনাল্ড তিরিপানো বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ৩ রান
প্রথমে ব্যাট করে ২৫৭ রানে অল আউট হয় জিম্বাবুয়ে। ৫৮ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২ উইকেট পড়ে গেলেও ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট এবং হোপ ১৬২ রানের একটি জুটি গড়ে ম্যাচে ফেরত আসেন। হোপ ১০১ রান করে আউট হয়ে গেলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩ রানের, হাতে ছিল ৫ উইকেট। দ্বিতীয় বলেই কার্লোস ব্র্যাথওয়েটকে আউট করলেও ম্যাচের পাল্লা তখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকেই হেলে ছিল। সমস্যা হয়ে গেলো পরের বলেও যখন নার্স আউট হলেন। পরের ২ বল থেকে ২ রান নিলে শেষ বলে প্রয়োজন ছিল ১ রানের। কিন্তু শেষ বলে কার্টার রান আউট হলে ম্যাচটা টাই হয়।