“খেলোয়াড়রা মারা যান, টুর্নামেন্টের কথাও লোকে ভুলে যায়। কিন্তু শিল্পীদের শ্রেষ্ঠতম শিল্পগুলো চিরকালের জন্য বেঁচে থাকে।”
রশিদ নাজমুদ্দিনোভের স্মরণে বলেছিলেন মিখাইল তাল।
সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাটাকিং দাবাড়ু রশিদ গিবাতোভিচ নাজমুদ্দিনোভকে আশা করি পাঠকরা ভুলে যাননি। এর আগে আমরা তার জীবনী তিন পর্বে আলোচনা করেছিলাম। এখন আমরা আলোচনা করবো, তিনি কি আদৌ গ্র্যান্ডমাস্টার শক্তিমত্তার দাবাড়ু ছিলেন? যদি তাই হয়ে থাকেন, তবে কেন তিনি কখনও সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত খেতাবটি অর্জন করতে পারেননি? তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রের দাবা ফেডারেশনের সাইটে The Chess History of Tataria বইয়ের রিভিউতে মারাত খাসানোভ (Marat Khasanov) এই বিষয়টি আলোকপাত করেছেন।
১.
যেহেতু নাজমুদ্দিনোভের নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল তার অসাধারণ সব ম্যাচগুলোর জন্য, স্বভাবতই লোকমুখে প্রশ্ন এসে যায়, তিনি আদতে গ্র্যান্ডমাস্টার কেন ছিলেন না? এমনকি তার ভক্তরাও অনেকসময় সরাসরি তাকেই প্রশ্ন করে বসত এ ব্যাপারে। আমার মনে হয়, তিনি ভিতরে ভিতরে হাহাকার করে উঠতেন, ‘পর্যাপ্ত টুর্নামেন্ট কেন ছিল না আমার জন্য!’ হয়তো মনে মনে গুমরে উঠতেন তিনি। যদিও অতি অবশ্যই প্রেসের জন্য তার আলাদা বক্তব্য ছিল। আসুন, নিজেরাই আমরা প্রকৃত কারণটি ঢুঁড়ে বের করি।
নাজমুদ্দিনোভ তার ক্যারিয়ারের শিখরে ছিলেন ১৯৫৪-৫৮ সালের মধ্যকার সময়টায়, অনায়াসে এই সময়ে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে কতটি গ্র্যান্ডমাস্টার লেভেলের টুর্নামেন্ট হয়েছে সেই সময়ব্যাপ্তিতে? শুনতে হাস্যকর ঠেকলেও সংখ্যাটি মাত্র এক! হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, ঠিকই পড়েছেন, একটি – ১৯৫৬ সালে আয়োজিত অ্যালেখাইন মেমরিয়াল। দাবার চতুর্থ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অ্যালেক্সান্দার অ্যালেখাইনের মৃত্যুর দশ বছর পর তার স্মরণে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে পাঁচজন গ্র্যান্ডমাস্টার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা হলেন মিখাইল বতভিনিক, ভাসিলি স্মিস্লভ, পল কেরেস, ডেভিড ব্রন্সটেইন এবং মার্ক তাইমানোভ। শুধু মাস্টারদের এই টুর্নামেন্টে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, হেতু রশিদ সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন।
২.
এখন দেখা যাক, সেই সময়কালে (১৯৫৪-৫৮) কোন কোন দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করতে পেরেছেন।
-
১৯৫৪ – কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার হননি।
-
১৯৫৫ – শুধু একজন, বরিস স্পাস্কি; তিনি ইয়ুথ ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন এবং ইন্টারজোনালের জন্য কোয়ালিফাই করেন, যেখানে তিনি তার নর্ম পান।
-
১৯৫৬ – শুধু ভিক্টর কোর্চনোই।
-
১৯৫৭ – এবারও মাত্র একজন, মিখাইল তাল; সোভিয়েত চ্যাম্পিয়ন হবার সুবাদে।
-
১৯৫৮ – কেউ নন।
-
১৯৫৯ – এই বছরও কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পাননি।
তাহলে আমরা দেখতে পেলাম, এই ছয় বছরে মাত্র তিনজন সোভিয়েত দাবাড়ু এই খেতাব পেয়েছেন। তাদের মধ্যে দু’জনই পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। একটা বিষয় চিন্তা করলেই স্পষ্ট হবে যে, রশিদ যদি গ্র্যান্ডমাস্টার লেভেলের টুর্নামেন্টই খেলতে না পারেন, তবে তিনি কীভাবে নর্ম অর্জন করবেন!
৩.
এমতাবস্থায় এখন অর্বাচীন অনেকেই বলে বসতে পারেন, ‘রশিদ তার নিজ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি ইট’স ওকে, তিনি বিদেশে যেতে পারতেন খেলতে, বিদেশের টুর্নামেন্টগুলো থেকে সহজেই তো নর্ম অর্জন করতে পারতেন তিনি।’ এর একদম সিম্পল জবাব কী জানেন? সোভিয়েত দাবাড়ুগণ স্রেফ ‘আয়রন কার্টনের’ ভেতর থাকতেন। ‘আয়রন কার্টন’ পরিভাষাটি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন উইনস্টন চার্চিল। ১৯৪৬ সালের মার্চে ফুল্টনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন,
“পুরো মহাদেশজুড়ে এক আয়রন কার্টন নেমে এসেছিল।”
সোভিয়েত নাগরিকদের উপর বিদেশভ্রমণে মাত্রাতিরিক্ত কড়াকড়ি ছিল, যা ধারণার বাইরে। বর্ডার পেরিয়ে বিদেশে চলে গেলে সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে, এই মর্মে ৮ জুন, ১৯৩৫ সালে এক আইন পাস হয়, সেখানে এমনকি দোষীর আত্মীয়স্বজনকেও শাস্তির আওতায় আনা হবে বলা হয়। এই আইনের প্রয়োগে ১৯৬২ সালে রুডলফ নুরেয়েভ নামক এক ব্যক্তিকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে লেনিনগ্রাদ আদালত! বিদেশি যে কারও সাথে যেকোনো প্রকার যোগাযোগ রাখলেই তার বৃত্তান্ত রাষ্ট্রকে দিতে হত। কর্তৃপক্ষকে না জানালে এমনকি জেলে পুরে দেয়া হত। খুব সামান্য দাবাড়ুই তখন বিদেশে খেলতে যেতে পারতেন।
১৯৫৪ সালে বুকারেস্ত টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় হবার সুবাদে রশিদ ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার খেতাব পান, যেটি তার ক্যারিয়ারে সুযোগ পাওয়া টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে সব থেকে শক্তিশালী ছিল। ভিক্টর কোর্চনোই রশিদের স্মরণে বলেন,
“আমার প্রথম টুর্নামেন্ট আমি খেলি আমার বিয়ের পর সোচিতে, এটা ছিল রাশিয়ান এসএফএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ। এটা জিতেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম শক্তিশালী মাস্টার রশিদ নাজমুদ্দিনোভ। কিছু কারণে, তিনি কেন যেন বিদেশে খেলতে যাওয়ার সুযোগ খুব কমই পেতেন; আর একারণেই আর তার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া হয়ে ওঠেনি। “
৪.
রশিদ নাজমুদ্দিনোভ কি আদতে গ্র্যান্ডমাস্টার শক্তিমত্তার দাবাড়ু ছিলেন? আসুন, ১৯৫৮ সালে তথা তার ক্যারিয়ার পিকের শেষ বছরের খেলার ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করে দেখি।
কোর্চনোইয়ের বক্তব্য আগে দেয়া হয়েছে, ১৯৫৮ সালে সোচিতে আয়োজিত রাশিয়ান এসএফএসআর চ্যাম্পিয়নশিপের আঠারোতম আসরে রশিদ চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর তিনি স্পার্তাক স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন টিম চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তারপর রস্তভ অন দনে আয়োজিত সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ১৫তে ১০ পয়েন্ট পেয়ে জয়ী হন, এবং সর্বশেষ ভিলনিউসে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত টিম চ্যাম্পিয়নশিপেও অসাধারণ ফলাফল করেন।
সবকিছু বিবেচনায় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন হবে না আশা করা যায়। সবগুলোর পয়েন্ট তালিকা নিচে দেয়া হল:
ইউএসএসআর টিম চ্যাম্পিয়নশিপে আটের ভেতর সাড়ে চার পয়েন্ট খুব মাঝারি মানের মনে হতে পারে, কিন্তু লাইনআপটা শুধু দেখুন — খোলমোভ, কেরেস, কোর্চনোই, ব্রন্সটেইন, গেলের, বলেস্লাভস্কি — সবাই অন্য মাত্রার একেকজন দাবাড়ু, সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার! (২৭০০ বা তার বেশি ইলো রেটিংধারী দাবাড়ুদের সুপার জিএম বলে) এবং রশিদ তাদের সাথে চোখে চোখ রেখে খেলেছেন, যাকে বলে সমানে সমান টক্কর।
৫.
শীর্ষ ফর্মে থাকা অবস্থায় ফলাফলগুলো দেখিয়ে দেয়, ১৯৫৬-৫৮ সালের সময়কালে রশিদ গিবাতোভিচ গ্র্যান্ডমাস্টার শক্তিমত্তা অর্জন করেছিলেন নিঃসন্দেহে, এটি গাণিতিকভাবেও প্রমাণ করা যায়। চেসমেট্রিক্স (ChessMetrics) ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত দাবাড়ুদেরও ইলো রেটিং বের করেছে, তাদের মতে রশিদ গিবাতোভিচ নাজমুদ্দিনোভ তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে পুরো বিশ্বের ২১তম র্যাঙ্কিং ধারণ করতেন। তাদের মতে, রশিদের রেটিং হতো ২,৭০৬, অর্থাৎ তিনি সুপার জিএমও হয়ে যেতেন। গ্র্যান্ডমাস্টার সুয়েটিন বলেন,
“এটা নিশ্চিত যে রশিদ জিএম স্ট্রেংথের দাবাড়ু ছিলেন, শুধু তার জন্মটা হয়েছিল অনেক আগে।”
রশিদ কিন্তু তার সোভিয়েত রেজিমের উপর বরাবরই অনুগত থেকে এসেছেন, কখনও মুখ ফুটে তার সুযোগের অভাবের কথা বলেননি। বিনয়ী রশিদের মতে দাবার জগতে আসতে তার একটু বেশিই দেরী হয়ে গেছে। বেলোকোপিতোভ, রশিদের উপর লেখা বইয়ে এব্যাপারে বলেছেন। তিনি একবার রশিদকে ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারেননি কেন, এবিষয়ে তার কী মতামত। জবাবে রশিদ বলেন,
“অনেক ভক্তগণও আমাকে এটা প্রশ্ন করে থাকেন, কেন আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারিনি। তারা বিষয়টা ধরতে পারেন না, কিন্তু পার্থক্যটা স্পষ্ট। বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ু যেমন বৎভিনিক, তাল, স্পাস্কি, ফিশার প্রমুখ – তারা ১৫ বছরের মধ্যেই দেশে এবং বিদেশে ভালো ফলাফল অর্জন করেছেন; এবং ২০ বছরের মধ্যেই খেলাটাকে দারুণভাবে কব্জা করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের সাথে আমার পুরো ২০ বছরের একটা বিশাল ফারাক থেকে গেছে। আর এটিই নর্মটি পেতে আমার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এটা যৌক্তিক।”
৬.
নিকিতা ক্রুশ্চেভের শাসনকালে পরিস্থিতি একটু শিথিল হয়, বাইরে খেলতে যাওয়ার উপর বিধি-নিষেধ কমে। নিজের ৫২ বছরে এসে, ক্যারিয়ার শিখরের ছয় বছর পর, রশিদ একটি নর্ম অর্জনের সুযোগ পান। সোচিতে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে ১০ পয়েন্ট অর্জন করতে পারলে তিনি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যেতেন। তখনকার সময়ে নর্ম অর্জনের শুধু একটা সুযোগই পাওয়া যেত। আট পয়েন্ট পাওয়ার পর ডিসাইসিভ একটা গেম তিনি খেলেন ভ্লাদিমির আন্তোশিনের সাথে। শেষ দুই গেমে দুই পয়েন্ট পেলেই নর্মটি পাবেন, এমন অবস্থায় উপনীত হন রশিদ। আন্তোশিনের সাথে খেলার এক পর্যায়ে বিশপ a8 এ না b7 এ চাল দেন।
b7 যদিও খারাপ ছিল না, তবে মেটিং অ্যাটাকের জন্য a8 এই দিতে হত। অন্যথায় ড্র তো তার কাছে হারেরই সমতুল্য এই পরিস্থিতিতে! পরে বিষয়টি বুঝতে পেরে রিজাইন করেন তিনি। শেষ গেমে উইনিং পজিশনে থেকেও ড্র করেন, কারণ সেই ম্যাচে জিতলেও নর্ম পেতেন না তিনি। তাই ৮.৫ পয়েন্ট নিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করতে হয় তাকে। ১.৫ পয়েন্টের জন্য গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন রশিদ। বলতে গেলে, আন্তোশিনের সাথের গেমটা জিততে পারলেই হয়তো গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারতেন তিনি। এটা দুঃখজনক যে, দাবা বোর্ডের একটি ঘরের জন্য কাঙ্ক্ষিত টাইটেলটি হাত ফসকে যায় এই কিংবদন্তির।
আসলে রশিদ গিবাতোভিচ নাজমুদ্দিনোভ দাবায় কখনও সত্যের অনুসন্ধান করেননি, সৌন্দর্য্য খুঁজেছেন। এটা তার উক্তিতেই প্রতিভাত হয়,
“আমি বুঝি না কেন নান্দনিক খেলার জন্য কোনো পুরষ্কারের ব্যবস্থা নেই। আমি যদি কোনো ফার্স্ট ক্যাটাগরির মাস্টার লেভেলের দাবাড়ুকে অসাধারণ স্যাক্রিফাইসিং খেলতে দেখতাম, তৎক্ষণাৎ তাকে টাইটেল দিয়ে দিতাম!”
সে কথার সপক্ষে ম্যাক্স উ দাঁড়িয়েছেন বটে। তিনি বলেছেন, রশিদ ছিলেন দাবার সবচেয়ে নান্দনিক গ্র্যান্ডমাস্টার। নাজমুদ্দিনোভের অন্তরঙ্গ বন্ধু, সমকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল তাল একবার এক ম্যাচে তার এক চোখ ধাঁধানো আক্রমণের কাছে হেরে গিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন,
“আজকের দিন আমার জীবনের সব থেকে আনন্দঘন দিন!”
এক মিনিট, এক মিনিট! ভুল দেখলাম? ম্যাক্স উ তাকে সবচেয়ে নান্দনিক ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বলেছেন? কিন্তু উনি তো গ্র্যান্ডমাস্টার নন! আসলে কী বলুন তো, সব গ্র্যান্ডমাস্টারদের ইতিহাস মনে রাখে না, আবার কেউ কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার না হয়েও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকেন। রশিদ নাজমুদ্দিনোভ যে ছিলেন এমনই একজন!
রশিদ নাজমুদ্দিনোভের জীবনী পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
রশিদ নাজমুদ্দিনোভ (পর্ব ১): দাবার ইতিহাসে এক মুকুটহীন সম্রাট
রশিদ নাজমুদ্দিনোভ (পর্ব ২): দাবার ইতিহাসে এক মুকুটহীন সম্রাট
রশিদ নাজমুদ্দিনোভ (পর্ব ৩): দাবার ইতিহাসে এক মুকুটহীন সম্রাট