মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগের দিন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মহেন্দ্র সিং ধোনি, ভারতের ‘ক্যাপ্টেন কুল’। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর এবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের দিকে চোখ তার।
কিন্তু এ কি! অধিনায়ক যে ক্ষেপে গেলেন প্রথম প্রশ্নেই। বাংলাদেশেরই এক সিনিয়র সাংবাদিকের প্রশ্নটা ছিল এমন,
‘আবারও বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ, আপনারা কি প্রেশারে থাকবেন?’
ধোনির হাসিমাখা মুখটা এক নিমিষে কালো হয়ে গেল। ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
‘আরে ভাই! আপনারা কি সাথে সবসময় প্রেশার কুকার সাথে নিয়ে ঘুরেন? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো সব ম্যাচেই চাপ থাকে। এটা খুব স্বাভাবিক, এই ম্যাচও তেমনই। এটা আলাদা কিছু নয়!’
হ্যাঁ, ম্যাচটা সত্যিই আলাদা কিছু ছিল না ভারতের জন্য। ভারতের সামনে সেবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। ভারতের ৩৭০ রানের পাহাড়ের সামনে বাংলাদেশ থামে ২৮৩ রানে গিয়ে।
তবে, সেই ম্যাচটা দিয়েই ভারতের বুকের ওপর থেকে বিরাট এক পাহাড়সমান বোঝা নেমে যায়। সেই বোঝাটা ভারতের বুকে জমে ছিল চারটা বছর। ঠিক ওই সময় থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ক্রিকেট-বৈরিতা।
দিনটা ছিল ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ। একদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন নদীর ওপারে চলে যান মানজারুল ইসলাম রানা। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুটায় সেদিন জ্বরে কাতরাতে থাকা মাশরাফি বিন মুর্তজাকে এতটাই তাঁতিয়ে দিয়েছিল যে, ম্যাচের আগের দিনই তিনি ভারতকে বলে রেখেছিলেন,
‘ধরে দিবানি!’
বাকিটা ইতিহাস। সত্যিই সেদিন মাশরাফি-সুমনরা ‘ধরে দিতে’ পেরেছিলেন ভারতকে। ভারতের সে কী বিখ্যাত লাইনআপ! বীরেন্দর শেবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলী, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, যুবরাজ সিং – সবাইকে সেদিন মাটিতে নামিয়ে আনেন মাশরাফি, আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিকরা।
ভারতের দেওয়া ১৯২ রানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নয় বল আর পাঁচ বল হাতে রেখেই পৌঁছে যায়। তামিম ইকবাল সেদিন ডাউন দ্য উইকেটে এসে জহির খানকে ছক্কা হাঁকিয়ে নিজের আগমনী বার্তা জানান দেন। মুশফিক-সাকিবদের ব্যাটে বাংলাদেশ দেখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেবারই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে পা রাখে বাংলাদেশ দল।
তবে সেইদিনই দক্ষিণ এশিয়ান ক্রিকেটের নতুন এক দ্বৈরথের বীজ বপন করা হয়ে গিয়েছিল। আর তার প্রভাবটাই গিয়ে পড়েছিল ২০১১ বিশ্বকাপের সেই সংবাদ সম্মেলনে। ভারত এই যাত্রায় জিতে যায়। শুধু তাই নয়, সেবার ধোনি-যুবরাজরা ভারতকে বিশ্বকাপের শিরোপাও এনে দেয়।
বাংলাদেশ সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারালেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অলআউট হয়ে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়। এরপরের চার বছর অনেকরকম পালাবদলই হয় দেশের ক্রিকেটে। সাকিব থেকে মুশফিক, মুশফিক থেকে মাশরাফির হাতে আসে সীমিত ওভারের নেতৃত্ব। এর মধ্যেই ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ, ফাইনালে যাওয়ার পথে ভারতকে হারায় মুশফিক বাহিনী।
মাশরাফি দল নিয়ে যান বিশ্বকাপে। এখান থেকেই বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশের সূচনা হয়। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পৌঁছায় বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের সামনে আবারও সেই ভারত। মহেন্দ্র সিং ধোনি এবার ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন’।
সেই ম্যাচটায় বড় ব্যবধানেই হারে বাংলাদেশ। কিন্তু সেদিনের পরই ক্রিকেটবিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় হয় বাংলাদেশের। প্রতিপক্ষ দেশটির বিপক্ষে সেই ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। কিন্তু, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সেই ম্যাচের সেই রোমাঞ্চে এসে হানা দেয় বেরসিক এক ‘নো বল’।
শুরুতে ভারতের ব্যাটসম্যানদের লাগাম টেনে ধরতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। কিন্তু, সব কিছু এলোমেলো করে দেয়, প্রশ্নবিদ্ধ এক ‘নো বল’-এর ডাক। সেটা ভারতের পক্ষে যাওয়ায় মনোবল হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ।
ভারতীয় ওপেনার রোহিত শর্মা তখন ৯০ রানে ব্যাট করছিলেন। ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেনের এক ফুলটসে সজোরে ডিপ মিড উইকেটে বল তুলে দিয়েছিলেন ডানহাতি রোহিত। ইমরুল কায়েস ক্যাচ ধরতে ভুল করেননি। বিরাট এক ব্রেক-থ্রু বাংলাদেশের জন্য!
হা হতোস্মি! স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো আম্পায়ার আলিম দার বল কোমরের ওপর উঠেছে দাবি করে ‘নো বল’-এর ইশারা করলেন। নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা ইয়ান গোল্ডও সেটা তখনই গ্রহণ করে ‘নো বল’ ডেকে বসলেন। হৃদয়ভঙ্গ হলো বাংলাদেশের খেলোয়াড় ও কোটি কোটি ভক্তের।
রোহিত যখন ব্যাট দিয়ে বলটাতে আঘাত হানেন, তখন সেটা রোহিতের কোমর বরাবর। কিন্তু, রোহিত অনেকটা সামনে এগিয়ে এসে শট নিয়েছেন। তাই বলাই বাহুল্য যে, স্বাভাবিক অবস্থানে থাকলে অবশ্যই সেটা কোমরের নিচে নেমে যেত।
মাঠে থাকা আম্পায়াররা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতেও নারাজ ছিলেন। চাইলেই তারা টেলিভিশন আম্পায়ারের দ্বারস্থ হতে পারতেন। সেই সুযোগ তারা নেননি, অনেক বাংলাদেশি সমর্থকই তাই ‘ভিন্ন কিছু’র গন্ধ পেতে শুরু করেন।
মনোবল হারিয়ে বাংলাদেশ ম্যাচে আর ফিরতেই পারেনি। ভারতের ৩০২ রানের জবাবে অলআউট হওয়ার আগে করে ১৯৬ রান, হারে ১০৯ রানের বড় ব্যবধানে।
আইসিসির তখনকার চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশের আ হ ম মোস্তফা কামাল। তিনি গণমাধ্যমের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন যে, ফেবারিট দলকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্যই এটা করা হয়েছে। তিনি ম্যাচের দায়িত্বে থাকা অফিসিয়ালদের কাজের তদন্ত করারও দাবি জানান।
মোস্তফা কামালের বক্তব্যকে আইসিসিও সহজ চোখে দেখেননি। রেওয়াজ অনুযায়ী, বিশ্বকাপের ট্রফি বিজয়ী অধিনায়ককে তুলে দেন আইসিসি সভাপতি। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ায় সেই নিয়ম মানা হল না। ট্রফি তুলে দিলেন আইসিসি চেয়ারম্যান এন. শ্রীনিবাসন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সমর্থকরা চুপ হয়ে থাকলো না। মাঠের লড়াইয়ের সাথে যোগ হল স্যোশাল মিডিয়ার লড়াই। ক্রিকেটাররাও যে কতটা ক্ষোভ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, সেটা বোঝা গেল কয়েক মাস বাদেই, ২০১৫ সালের জুনে। বাংলাদেশ সফরে এলো ভারত। এই ধাপে লেখা হল বাংলাদেশ-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার দ্বিতীয় অধ্যায়।
মাশরাফি বিন মুর্তজার দল তখন উজ্জীবিত। নিজেদের সেরা বিশ্বকাপ কাটিয়ে দেশে ফিরেই তারা হোয়াইটওয়াশ করেছে পাকিস্তানকে। এবার ভারতের বিপক্ষে প্রতিশোধের মিশন।
তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শুরুতেই চমকে দিলেন মাশরাফি। এতদিনের স্পিনার-নির্ভরতা ভেঙে একাদশে রাখলেন চার পেসার। তরুণ বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান ওয়ানডে অভিষেকে পাঁচ উইকেট নিয়ে গড়লেন নতুন ইতিহাস। রূপকথাময় সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতলো ৭৯ রানের বড় ব্যবধানে।
কিন্তু সেই ম্যাচশেষে মুস্তাফিজের বোলিংয়ের চেয়েও আলোচিত ছিল ভারতের ব্যাটিংয়ের ২৫তম ওভারের এক ঘটনা। রান নিতে গিয়ে মুস্তাফিজের সাথে সংঘর্ষ হয় ভারতের অধিনায়ক ধোনির। টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, ধোনি কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছেন মুস্তাফিজকে। সেই ঘটনায় মুস্তাফিজকে মাঠের বাইরে গিয়ে ফিজিও’র সেবা নিয়ে ফিরতে হয়।
বাংলাদেশ সেই জবাবটা দেয় পরের ওভারেই। সাকিব আল হাসানের বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিমের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ধোনি। সাকিবের উন্মত্ত উল্লাস আর মুশফিকের চিৎকারে স্পষ্ট ছিল সেটা উইকেট প্রাপ্তির আনন্দ নয়, বরং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যাই হোক, ধোনি ও মুস্তাফিজ দু’জনকেই ম্যাচশেষে জরিমানা করা হয়।
কিন্তু, মুস্তাফিজ তাতে থামলেন না। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে নেন ছয় উইকেট। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নেয়। সিরিজশেষে বৈশ্বিক মিডিয়াতে মুস্তাফিজ রীতিমত একটা ‘হট কেক’-এ পরিণত হন। তার কাটার আর ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। মুস্তাফিজ সেই আলোচনা নিয়ে পরেরবারই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খেলে আসেন, পান সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
সেই সময় থেকেই বাংলাদেশ আর ভারতের মানেই ভিন্ন একটা ব্যাপার। রাজনৈতিক বৈরীতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সিরিজ যখন বন্ধ, তখন একটু একটু করে সেই জায়গাটা নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ-ভারত লড়াই। যদিও, ২০১৫ সালের সেই সিরিজের পর থেকে পরিসংখ্যানে স্পষ্ট এগিয়ে ভারতই।
যদিও, ভারতের বিপক্ষে সীমিত ওভারের যেকোনো ফরম্যাটের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতেই একদম অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে সাকিব-মুশফিকরা ভারতকে স্তব্ধ করার দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল। শেষ অবধি নিজেদের নির্বুদ্ধিতা আর ধোনির অধিনায়কত্বে এক রানে হারে বাংলাদেশ। শেষ তিন বলে দুই রান করতে ব্যর্থ হন মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। জয় নিশ্চিত হওয়ার আগে উদযাপন করে মুশফিকুর রহিম বেশ সমালোচিতও হন।
দু’বছর বাদে শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালেও সেই একই দৃশ্য। এবার ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে বাংলাদেশ ছিল বোলিংয়ে। এবার শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে শিরোপা ছিনিয়ে আনেন দীনেশ কার্তিক। ছুরিবিদ্ধ হয় বাংলাদেশি সমর্থকদের হৃদয়। সেবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ফাইনালেও শেষ বলে গিয়ে জিতে নেয় ভারত।
এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ দলও আরো পরিণত হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলে আসে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। এটাই প্রথমবারের মতো কোনো আইসিসি ইভেন্টে বাংলাদেশের সেমিফাইনাল খেলার নজির। এবারও সেমিফাইনালে ভারত-বাধার সামনে আটকালো বাংলাদেশ।
দু’দলের এই ক্রিকেটীয় বৈরীতা কেবল ছেলেদের ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বলা উচিৎ, এই বৈরীতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের বিপক্ষে দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসসেরা সাফল্য পেয়েছে নারী দল ও অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল। ২০১৮ সালে ভারতকে ফাইনালে হারিয়ে মালয়েশিয়ার মাটিতে এশিয়া কাপের শিরোপা জয় করে নারী ক্রিকেট দল। এরপর ২০২০ সালে ভারতের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল জিতে প্রথমবারের মতো দেশকে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসায় অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ফাইনাল শেষে বাংলাদেশ ও ভারতের যুবাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
বোঝাই যাচ্ছে, ক্রিকেটীয় বৈরীতাটা তরুণ প্রজন্মের মাঝেও ছড়িয়ে গেছে। এখন দেখার বিষয়, বৈরীতার পিছনে লুকিয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভীড়ে সৌজন্যবোধের জায়গাটা ভবিষ্যতে নড়বড়ে হয়ে যায় কি না!