ইউরোপিয়ান ফুটবলে বারো মাস খেলা চলে না। সকল মৌসুম শেষে যখন বিরতি চলে, তখন থাকে জাতীয় ফুটবলের আমেজ। কিন্তু অনেকে আবার ক্লাবে ফুটবলের রোমাঞ্চ জাতীয় দলের ফুটবলের মাঝে খুঁজে পান না। কিন্তু তাই বলে কি ক্লাবের খেলা মাঠে না গড়ালে তারা হতাশ হয়ে দিন পার করেন? হয়তো না। মাঠের ফুটবলে যখন বিরতি, তখন খেলোয়াড় কেনাবেচার সময় শুরু। আর এখানেই অনেকে খুঁজে পান অন্যরকম রোমাঞ্চ। আর গত কয়েক বছর ট্রান্সফার উইন্ডোগুলো যেমন থ্রিলার সিনেমার মতো টানটান উত্তেজনার ভেতর দিয়ে শেষ হচ্ছে, ফুটবলের বিরতির মাঝেও সমর্থকরা থাকেন ভিন্ন আমেজে। এই ট্রান্সফার উইন্ডোও অনেকটা মাঠের ফুটবলের মতোই। হারজিতের মতো এখানেও খেলোয়াড় হারানো বা কিনতে না পারার কষ্ট অথবা নতুন কোনো খেলোয়াড়কে আনন্দে বরণ করে নেবার মতো বিষয়গুলো এখানে দেখা যায়।
২০২১-২২ মৌসুমের ট্রান্সফার উইন্ডো শুরু হয়েছিল ৯ জুন, টানা বারো সপ্তাহ সময় থাকার পর তা শেষ হয় ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে। বরাবরের মতোই এবারও প্রিমিয়ার লিগের প্রথম সারির ক্লাবগুলো তাদের পছন্দের খেলোয়াড়ের পেছনে ইচ্ছেমতো অর্থ ঢেলেছেই, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে খেলোয়াড় কেনার লড়াইয়ে নেমেছিল অ্যাস্টন ভিলা ও ওয়েস্টহ্যামের মতো দলগুলোও। তবে বলতে গেলে, প্রিমিয়ার লিগে প্রথম বড় সাইনিং করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তাদের আক্রমণের ডানপাশে সমস্যা নিজে বেশ কয়েক বছর ভুগেছে তারা। অনেকদিন যাবৎই তাদের পছন্দ ছিলেন ইংলিশ উইঙ্গার জ্যাডন স্যাঞ্চো। কিন্তু কয়েকবার তাকে কেনার চেষ্টা করেও স্যাঞ্চোকে দলে ভেড়াতে পারেনি। কিন্তু সুযোগ এসেছিল এবার, আর দলবদল চালু হবার সাথে সাথে স্যাঞ্চোকে পুরো ৮৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভিড়িয়েছে তারা।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রক্ষণ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাদের কোচ ওলে গানার সলশার। তাই রাফায়েল ভারান যখন নতুন চ্যালেঞ্জের আশায় রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি। ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বিশ্বকাপজয়ী এ ফরাসি ডিফেন্ডারকে দলে ভিড়িয়েছে তারা। এরপর তারা চেষ্টা করেছে একজন মিডফিল্ডারকে দলে ভেড়াতে। কানাঘুষো চলল কামাভিঙ্গা, সাউল, রুবেন নাভাস ও ডেক্লান রাইসকে নিয়ে। তবে একদম শেষ মুহূর্তে এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোর যে স্মরণীয় ঘটনা ঘটল, সেটার জন্য হয়তো ক্লাবটি নিজেও প্রস্তুত ছিল না।
তুরিনের বুড়িদের হয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বেশ অখুশি ছিলেন। হয়তো সেখানে তার মনমতো কোনো পরিকল্পনা তিনি দেখতে পাননি, কিংবা হয়তো তার মনে হয়েছিল, অন্তত ক্যারিয়ারের কথা ভেবেও এখানে তার আর থাকা উচিত নয়। তাই নতুন মৌসুম শুরু হবার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, যে করেই হোক, ক্লাব ছাড়তে চান। এমন এক ক্লাবে যেতে চান, যেখানে সাফল্যের সম্পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। নিজের এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেসকে জানালেন তাকে নতুন ক্লাব খুঁজে দিতে। তাই মেন্ডেস প্রথমে কথা বললেন ম্যানচেস্টার সিটির সাথে।
ম্যানচেস্টার সিটি এবার তেমন খরচ করেনি, অন্তত বিগত বছরগুলো থেকে বেশ কমই ব্যয় করেছে তারা। অ্যাস্টন ভিলা থেকে জ্যাক গ্রেলিশকে ১১৭.৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে দলে টেনেছে সিটিজেনরা। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের স্ট্রাইকার আগুয়েরোর বিদায়ের পর স্ট্রাইকার পজিশনে নতুন একজনের প্রয়োজন ছিল তাদের। এজন্য তারা চেয়েছিল টটেনহ্যামের ইংলিশ স্ট্রাইকার হ্যারি কেইনকে। ১০০ মিলিয়ন ইউরোর মতো প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু এই চুক্তি আর এগোয়নি। তাই মেন্ডেস যখন রোনালদোকে কেনার জন্য প্রস্তাব পাঠায়, তারা এক বাক্যে রাজি না হয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখার জন্য সময় নেয়।
সিটিজেনদের সাথে রোনালদোর চুক্তি নিয়ে বহুদূর কথা আগায়। চুক্তিপত্রে সই ব্যতীত মৌখিক সকল কথাবার্তায় চূড়ান্ত হবার পর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় জুভেন্টাস। তাদের সাথে রোনালদোর আরও এক বছরের চুক্তি বাকি, তারা তার পেছনে ১০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে। কোনোমতেই ফ্রি ট্রান্সফারে তারা রোনালদোকে ক্লাব ছাড়তে দেবে না। ম্যানচেস্টার সিটি যাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় রোনালদোর জন্য। আর তখনই ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনার চিন্তাভাবনা শুরু করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মেন্ডেসও রোনালদোকে অফার করে তাদের কাছে। আর ১২ ঘন্টার মাঝে রোনালদোর ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির বদলে হয়ে যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
প্রিমিয়ার লিগের অন্য দুই ক্লাব আর্সেনাল ও চেলসিও এবার দেদারসে অর্থ ঢেলেছে। বলতে গেলে প্রিমিয়ার লিগে এবার সব থেকে বেশি খরচ করেছে আর্সেনালই। খেলোয়াড় বিক্রি করে তাদের তেমন কোনো আয় নেই, তবে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩২ মিলিয়ন ইউরোর মতো। কিন্তু এই ট্রান্সফারগুলো তাদের অবস্থাকে পরিবর্তন করতে কতটা কাজে আসবে, তা এখন বলা মুশকিল।
বিপরীতে চেলসি দারুণ ঝলক দেখিয়েছে। ইন্টার মিলানের হয়ে লিগ জেতা ও ইউরোরে নজর কাড়া বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকুকে ক্লাবে ফিরিয়ে এনেছে ১১৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে। গত কয়েক মৌসুম ধরে দু’হাতে খরচ করা চেলসির এই মহামারীর পর ১১৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করার সাহস কীভাবে এলো, সেটা বুঝতে দেখতে হবে তাদের ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা। এ মৌসুমে তারা ক্লাব থেকে খেলোয়াড় বিক্রি করেছে মোট ১০ জন, এবং এখান থেকে তাদের হাতে এসেছে মোট ১৮২ মিলিয়ন ইউরো। এখন খেলোয়াড় বিক্রি করে এমন অর্থ হাতে পাবার পর ১১৫ বিলিয়ন ব্যয় করা কি অস্বাভাবিক?
কথা হয়তো উঠতে পারত, যদি তারা শেষমেশ সেভিয়া থেকে জুলেস কৌন্দেকে দলে ভেড়াতে পারত। চেলসির সাথে সেভিয়ার এই তরুণ ডিফেন্ডারের সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই কথাবার্তা চলেছে। ৫০-৬০ মিলিয়নের ইউরোর মতো অফার করেও চেলসি কৌন্দেকে দলে টানতে পারেনি। এমন অর্থের প্রস্তাব দেবার পরও কেন সেভিয়া কৌন্দেকে বিক্রি করেনি? এ প্রশ্নের উত্তর ক্লাবটির স্পোর্টিং ডিরেক্টর মনচি দিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, ক্লাবের এমন একজন তরুণ তারকাকে তারা রিলিজ ক্লজ ছাড়া বিক্রি করতে রাজি নন। আর সেই রিলিজ ক্লজের পরিমাণ ৭০-৭৫ মিলিয়ন ইউরো। হয়তো এজন্যই চেলসি আর পা বাড়ায়নি। তাই কৌন্দেরও আশা হয়নি চেলসির ডেরায়। লুকাকু ছাড়া তাই চেলসি এবার একজন মিডফিল্ডার কিনেছে মাত্র। তবে তার প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এবার বার্সেলোনা। স্প্যানিশ জায়ান্ট এই ক্লাবের বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। একে তো ঋণের বোঝা, তার উপরে করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু বন্ধ হবায় বেশ বিপদেই আছে ক্লাবটি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে লা লিগার তৈরি করা বেশ কিছু নিয়ম। যে কারণে ক্লাবটিকে হারাতে হয়েছে লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়কে। লা লিগার বর্তমান নিয়ম অনুসারে, কোনো ক্লাবের আর ও ব্যয়ের হিসাবে সাম্যতা থাকতে হয়। কিন্তু মহামারীর কারণে গত বছর বার্সার আয় তেমন না হওয়াতে সমস্যায় পড়ে গেছে ক্লাবটি। কারণ ব্যয় তো কমেনি! তাই তাদের ব্যয়ের পরিমাণ আয়ের থেকে অনেক বেশি ছিল। এজন্য ক্লাবটি তাদের পছন্দমতো খেলোয়াড় কিনতে পারেনি। শুধুমাত্র আগুয়েরো, এরিক গার্সিয়া ও মেমফিস ডিপাই এসেছেন ফ্রি ট্রান্সফারে। কিন্তু তাদের রেজিস্ট্রেশন করাতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের।
মেসির সাথে বার্সার চুক্তি শেষ হয়েছিল গত জুনেই। এরপর কোপা আমেরিকা শেষে স্পেনের ইবিজাতে তিনি ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এর মাঝে দু’পক্ষের সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। বার্সার সাথে নতুন ৫ বছরের চুক্তিতে সই করবেন তিনি। এজন্য ছুটি শেষ করে সরাসরি বার্সেলোনাতে চলে আসেন তিনি। কিন্তু যেদিন বার্সার সাথে তার নতুন চুক্তি সই করার কথা, সেদিনই গল্প নতুন দিকে মোড় নেয়। লা লিগার নিয়মের কারণে বার্সা মেসির সাথে নতুন চুক্তিতে যেতে পারেনি। কারণ তখনও তাদের আয় ও ব্যয়ে সমতা আসেনি। মাঝে একটা নতুন সুযোগ ছিল ক্লাবে অর্থ আনার। কিন্তু প্রেসিডেন্ট লাপোর্তা সেই চুক্তি ফিরিয়ে দেন। তাই ২০ বছর পর বার্সেলোনার সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় মেসির।
যেদিন নতুন চুক্তি হবার কথা, সেদিন বার্সা ঘোষণা দেয় মেসির বিদায়ের। মেসি বার্সা ছাড়লে সম্ভাব্য ক্লাব হিসেবে নাম আসত পিএসজি ও ম্যানচেস্টার সিটির। কিন্তু গ্রেলিশকে কেনার পর সিটিজেনদের সামনে মেসিকে কেনার কোনো সুযোগ নেই। তাই মেসির সাথে যোগাযোগ শুরু করে পিএসজি। প্যারিস থেকে পিএসজির স্পোর্টিং ডিরেক্টর লিওনার্দো সরাসরি ফোন দেন মেসির বাবা এবং একই সাথে তার এজেন্ট হোর্হে মেসিকে, পরে সেদিন রাতে সভাপতি নাসের-আল-খেলাইফিও যোগ দেয় ফোনকলে। মেসিকে পার্ক দে প্রিন্সেসে আনার জন্য সকল প্রকারের চেষ্টা শুরু করে ক্লাবটি। মেসির বেতনভাতা, চুক্তি, সেখানে তার এবং পরিবারের থাকা ও নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ; প্রত্যেকটা বিষয়ে পিএসজি কোনো কমতি রাখেনি। তিনদিনের মাঝে চুক্তিও পাকা হয়ে যায়। সময়ের সেরা প্লেমেকারকে তাই প্যারিসিয়ানরা ক্লাবে ভেড়ায় বিনামূল্যে।
তবে পিএসজির গল্পটা এবারে ভিন্ন। নিজেদের ইতিহাসে তো বটেই, ট্রান্সফার উইন্ডো ইতিহাসেরই অন্যতম সফল একটি সময় কাটিয়েছে তারা। আর পুরো ১২ সপ্তাহ জুড়ে এই ক্লাবটি যেমন ছিল আলোচনা টেবিলের শীর্ষে, তেমনই পদে পদে নানা কাণ্ড ঘটিয়েছে তারাই।
পিএসজি এবার প্রথম খেলোয়াড় কেনে রাইটব্যাক আশরাফ হাকিমিকে। মাত্র আগের মৌসুমে ইন্টারে পাড়ি জমিয়েছিলেন এই মরোক্কান। প্রথম মৌসুমেই এসে ইন্টারের সাথে জিতলেন লিগ শিরোপা। অন্য সকল বড় ক্লাবের চোখ তার দিকে পড়েছিল বটে, কিন্তু এমন আকাশছোঁয়া দাম দেখে আর পা বাড়ায়নি কেউ। কিন্তু পিএসজি দমে যায়নি। ইন্টারের প্রয়োজন ছিল অর্থ, এজন্য ৬০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব আর ফেরাতে পারেনি। এটা সত্য যে, হাকিমিকে কিনতে পিএসজির ভালো পরিমাণ অর্থই খরচ হয়েছে। কিন্তু এরপরই তারা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়গুলোকে যে দলে ভিড়িয়েছে বিনামুল্যে!
গত মৌসুমের শেষের সাথে সাথে লিভারপুলের সাথে চুক্তি শেষ হয়ে যায় ডাচ মিডফিল্ডার ওয়াইনালদামের। এরপর নতুন ক্লাব হিসেবে কথা হচ্ছিল বার্সেলোনার সাথে। ইতালিয়ান সাংবাদিক ফাব্রিজিও রোমানোর মতে, বার্সেলোনার সাথে নাকি প্রায় চুক্তিবিষয়ক আলাপচারিতাও শেষের পথে ছিল তার। কিন্তু শেষ সময়ে পিএসজি তাকে বার্সেলোনার বলা বেতন থেকে দ্বিগুণ বেতনের প্রস্তাব দেয়। আর তাতেই ওয়াইনালদামের এজেন্ট স্পেনের বদলে তাকে নিয়ে যায় প্যারিসে।
সার্জিও রামোসের সাথে ক্লাবটির চুক্তি সংক্রান্ত নানান অসুবিধার কারণে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে আর নতুন চুক্তিতে যাওয়া হয় না তার। পরবর্তীতে তিনি কোন ক্লাবে গেলেন? প্যারিসে। ইতালির সময়ের সেরা গোলকিপার জিয়ানলুইজি ডোনারুমাও চুক্তি ও বেতন নিয়ে বনিবনা না হওয়াতে এসি মিলান ছেড়ে দেন। উচ্চ বেতন ও দারুণ ফুটবলের স্ট্রাকচার দেখিয়ে ডোনারুমাকেও দলে টেনে নেয় পিএসজি। এই চারজন খেলোয়াড় কেনার পর পিএসজির একটিমাত্র পজিশনে দুর্বলতা ছিল। ডেডলাইন ডে’তে বর্তমান সময়ের সেরা তরুণ লেফটব্যাক নুনো মেন্ডেসকে লোনে এনে সে দুর্বলতাকে ঢেকে দেয় তারা। মেন্ডেস যদি প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করেন, তবে লোনশেষে ৪০ মিলিয়ন ইউরোর মতো অর্থ দিয়ে তাকে পাকাপাকিভাবে কিনে নেবার সুযোগ থাকছে। তাই নিশ্চিতভাবে পিএসজি বর্তমানে এমন একটি দল, যে দলের প্রত্যেক পজিশন ও বেঞ্চে বিশ্বমানের তারকা খেলোয়াড় দিয়ে ভর্তি।
এ তো গেল খেলোয়াড় কেনার পেছনের গল্প। কিন্তু পিএসজি যে এবার দলের তারকা খেলোয়াড়দেরও ধরে রাখতে সফল! এমবাপের প্রতি রিয়াল মাদ্রিদের ভালোবাসা নতুন ঘটনা নয়। এমনকি কিলিয়ান এমবাপে নিজেও নাকি লস ব্লাংকোসদের হয়ে মাঠ কাঁপাতেই চান। খুব দ্রুতই হয়তো ক্লাব পরিবর্তন করতে চান, এজন্য পিএসজির তিন-তিনবার দেয়া নতুন চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। এদিকে দুই বছর ধরে নতুন খেলোয়াড় না কিনে রিয়াল মাদ্রিদ এবার আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে এমবাপেকে দলে টানতে।
স্পেনের ক্লাব থেকে প্রথম প্রস্তাব ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর। কিন্তু পিএসজির তরফ থেকে কোনো উত্তর নেই। প্রস্তাবে রাজি হবার কোনো লক্ষণ নেই, ফিরিয়ে দেওয়া নিয়েও কোনো কথা নেই। কয়েকদিন পর ক্লাবের তরফ থেকে জানা যায়, এমবাপে রিয়াল মাদ্রিদে যেতে চান। এই গুঞ্জন সত্য, তবে মাত্র ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাবে তাকে বিক্রি করতে পিএসজি কখনই রাজি হবে না।
পিএসজির কাছ থেকে এমন মন্তব্য পেয়ে রিয়াল মাদ্রিদ দ্বিতীয়বারের মতো প্রস্তাব পাঠায়। এবারের অর্থের পরিমাণ ১৭০ মিলিয়ন ইউরো, সাথে ১০ মিলিয়ন অতিরিক্ত। দ্বিতীয়বারের এই প্রস্তাব দেখে অনেকেই ভেবেছিল, এবার পিএসজি হয়তো রাজি হতে পারে। কারণ, ১৮০ মিলিয়ন অর্থের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিএসজি এবারও চুপ। তাদের ভাবভঙ্গী এমন যেন কোনো প্রস্তাবই আসেনি রিয়াল মাদ্রিদের কাছ থেকে।
আসলে পিএসজির কোনো ইচ্ছাই ছিল না এই মৌসুমে এমবাপেকে বিক্রি করতে। কারণ, বিগত কয়েক বছর প্রচুর অর্থ বিনিযোগ করেও ইউরোপিয়ান শিরোপা জেতা হয়নি তাদের। তবে এবার মেসি, রামোস, ডোনারুমা ও হাকিমি আসার পর তাদের শক্তিমত্তা যেমন বেড়েছে, সাথে আক্রমণভাগে মেসি, নেইমার ও এমবাপেকে ব্যবহার করার যে সুযোগ তাদের সামনে এসেছে, তা হাতছাড়া করতে রাজি নয় ক্লাবটি। এজন্য ডেডলাইন ডেতে রিয়াল মাদ্রিদের করা ২০০ মিলিয়ন ইউরোর মতো তৃতীয়বারের প্রস্তাবেও সাড়া দেয়নি ক্লাবটি।
নাছোড়বান্দার মতো প্রস্তাব দেবার পরও এমবাপেকে না পেয়ে রিয়াল মাদ্রিদ শেষসময়ে কিছুটা ভিন্ন চিন্তা করে। কারণ এমবাপেকে চাইলে পরেও পাবার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু মধ্যমাঠের জন্য তাদের পছন্দ কামাভিঙ্গাকে এবার না পেলে পরে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই খুব দ্রুত রেনে থেকে কামাভিঙ্গাকে দলে টানে তারা। দলবদলের অর্থ ৩১ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু এমবাপের ভবিষ্যৎ? রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সিতে খেলার স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে? উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে আগামী মৌসুমেই।
পুরো ট্রান্সফার উইন্ডো থেকে শেষ দিনেও কি নাটক কিন্তু কম হয়নি। সাউল নিগুয়েজ যে এবার অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ছাড়ছেন, তা এক প্রকার নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু বার্সার গ্রিজমানের সাথে সাউলের অদলবদল, চেলসি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটডের সাথে গুঞ্জন থাকার পরও শেষদিনে তার পরবর্তী ঠিকানা নিশ্চিত ছিল না। তবে তার ভাগ্য নিশ্চিত হয়েছে ত্রিমুখী এক ট্রান্সফারের পর।
মেসি চলে যাবার পর বার্সেলোনার এবারের অন্যতম চাওয়া ছিল খেলোয়াড়দের বেতন কাঠামো ঠিক করা। আর প্রায় ৩৫ মিলিয়নের মতো বেতন নেওয়া গ্রিজমানকে দল থেকে সরিয়ে তার বেতন বাঁচানোর পরিকল্পনা ক্লাবটি করছিল বেশ আগে থেকেই। কিন্তু সে চাওয়া পূরণ হয় শেষদিনে এসে।
গ্রিজমানকে ১০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে লোনে দলে ভেড়ায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। লোন চুক্তি শেষ হবার পর ৪০ মিলিয়নের বিনিময়ে তাকে পাকাপাকিভাবে কিনে নেবার সুযোগ থাকছে। কিন্তু এই দলবদল নির্ভর করেছে সাউলের উপরও। তাকে লোনে পাঠানো হয়েছে চেলসিতে, আর সেখানেও থাকছে লোন শেষ হবার পর ৪০ মিলিয়ন দিয়ে তাকে কিনে নেবার সুযোগ। তাই এখানে এই দুই দলবদল ছিল একই সুত্রে গাঁথা। ওদিকে বার্সেলোনা এই একই সুত্রে এনেছে সেভিয়ার স্ট্রাইকার লুক দি ইয়ংকে। কারণ, গ্রিজমান দল ছাড়ার পর ক্যোমান চেয়েছিলেন নতুন একজন স্ট্রাইকারকে। এজন্যই শেষদিনে বেশ কয়েকজন স্ট্রাইকারের পেছনে হন্যি হয়ে ঘুরে বার্সা পছন্দ করে ডাচ এই স্ট্রাইকারকে। কিন্তু গ্রিজমান দল না ছাড়লে তিনি আসতে পারবেন না, আবার সাউলকে লোনে না পাঠালে গ্রিজমানকেও নেবে না অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ।
তাই ডেডলাইন ডে’তে শেষ বিশ মিনিটের সরল দোলকের মতো দুলছিল এই তিন ট্রান্সফার। সময় শেষের দিকে, অথচ ক্লাবগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলছে না দেখে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম শেষ মুহূর্তে রটিয়ে দেয়, এই তিন দলবদল এবার হচ্ছে না। সময় শেষ হবার পরও দলবদলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসার পর তাই এই কাহিনী আরও নাটকীয়তায় মোড় নেয়। তবে মিনিট বিশেক পর লা লিগা জানিয়েছে, ক্লাবগুলো ঠিক সময়েই তাদের কাছে চুক্তিপত্র হস্তান্তর করেছে। তাই এই তিন খেলোয়াড়ের দলবদলের কোনো বাধা নেই।
করোনা মহামারীর ঠিক পরের মৌসুমে ফুটবল বিশ্ব এমন অবিশ্বাস্য একটি ট্রান্সফার উইন্ডো দেখল। সেখানে ছিল অর্থের ঝনঝনানি, পরতে পরতে গল্পের নতুন মোড়। এক মাসের ব্যবধানে মেসি ও রোনালদোর মতো মহাতারকারা পালটে ফেললেন তাদের নতুন গন্তব্য। রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে গেলেন তাদের দীর্ঘদিনের রক্ষণ কাণ্ডারি রামোস। এমনকি একটা ‘হ্যাঁ’ পালটে দিতে পারত এমবাপের ভবিষ্যৎও।
এমন অবিশ্বাস্য ট্রান্সফার উইন্ডো সামনে আরও আসতেই পারে, হতে পারে সেটা আগামী মৌসুমেই। কিন্তু রোনালদো ও মেসি যেভাবে ইতিহাস রচনা করে তাদের ক্লাব ছাড়লেন, এমন কাণ্ড হয়তো আর কখনোই হবে না। কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়। কারণ এবারই প্রমাণ হয়ে গেছে, ভুতুড়ে, অবিশ্বাস্য, অসম্ভব কাণ্ড আর কোথাও দেখা যাক আর না যাক, ফুটবল ট্রান্সফারের মাঠে সবই সম্ভব।