আঞ্চলিক ফুটবলে ধ্রুপদী দ্বৈরথ বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ ডার্বি বা ক্লাসিকো ইউরোপীয় আমদানি। তবে তা কি কেবল ইউরোপেই প্রাসঙ্গিক? ডার্বির মানে তাই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যানচেস্টার সিটি কিংবা ইন্টার মিলান বনাম এসি মিলান যেমন নয়; তেমনি ক্লাসিকো মানে কেবল রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সেলোনা কিংবা বায়ার্ন মিউনিখ বনাম বরুশিয়া ডর্টমুন্ড নয়।
ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে সাফল্য ওভাবে না থাকলেও এশিয়ানদের ফুটবল আবেগের যে কমতি নেই, এর প্রমাণ হলো এশিয়াতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল ক্লাবগুলোর দ্বৈরথসমূহ। যে দ্বৈরথের ঝাঁঝে আন্দোলিত হয় গোটা একটি অঞ্চল, গোটা একটি দেশ। এশিয়ার তেমন তিনটি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতার গল্প নিয়েই আজকের লেখা।
১) তেহরান ডার্বি (এস্তেগলাল এফসি বনাম পারসেপোলিস এফসি)
তাজ বনাম শাহীন ক্লাবের দ্বৈরথ ছিল সে সময় তেহরানের সবচাইতে জনপ্রিয় দ্বৈরথ। ফেডারেশনের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে শাহীন ক্লাব হয় লুপ্ত। তখন শাহীনের খেলোয়াড় আর সমর্থকেরা জোট বেঁধে স্থানান্তর হয় পারসেপোলিস ক্লাবে। পারসেপোলিস ও তাজের সর্বপ্রথম মোকাবেলা হয়েছিলো ১৯৬৮ সালের ৫ এপ্রিল। এই তাজই হচ্ছে অধুনা এস্তেগলাল এফসি। তাজ মানে মুকুট। কিন্তু রাজমুকুটের পতন হয়ে ইরান ইসলামি বিপ্লব যখন এলো, তখন ‘তাজ’ হয়ে গেলো ‘এস্তেগলাল’ অর্থাৎ ‘স্বাধীনতা’।
রাজনীতির মেরুকরণে এস্তেগলাল ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় তেহরানের শ্রমজীবী মানুষের ভালোবাসার ক্লাবে। অন্যদিকে পারসেপোলিস তদানীন্তন সরকার ব্যবস্থার আজ্ঞাবহ ও তেহরানের অভিজাত শ্রেণীর প্রিয় ক্লাবে। খেলার দিন পুরো শহর তেহরান ভাগ হয়ে যায় আবি-হা (নীল) আর গারমেজ-হা (লাল) শিবিরে। প্রথমটি এস্তেগলাল ও পরেরটি পারপোলিসের রঙ। ইরানে কোনো একটি দলের সমর্থকের বাড়ি গিয়ে যদি বলেন আপনি ঐ দলের সমর্থক, নিশ্চিত থাকুন, বড়রকমের খাতির-আপ্যায়ন পেতে চলেছেন!
দু’দলের খেলা হলেই উত্তেজনা ছড়িয়ে যায় তেহরান পেরিয়ে নিরপেক্ষ ভেন্যু তাবরিজেও। উত্তেজনা অল্পের ওপর দিয়ে গেলে সমর্থকেরা গ্যালারির চেয়ার ভেঙে আর মাঠে বোতল-খোসা ছুঁড়েই ক্ষান্ত থাকেন। ১৯৯৫ সালে পার্সিয়ান গালফ লিগের ম্যাচে শেষ মুহূর্তে দু’গোল খেয়ে ড্র করাটা ঠিক হজম হয়নি পারসেপোলিস সমর্থকদের। তাদের দাবি, রেফারিং হয়েছে পক্ষপাতমূলক! ব্যস, শুরু হয়ে গেলো খেলোয়াড়-দর্শকদের মারপিট-রক্তারক্তি। সেটা ছিলো ইতিহাসের ৩৮ নম্বর তেহরান ডার্বি। এরপর থেকে বিতর্ক এড়াতে ফেডারেশন কেবল এই ডার্বিতেই আনে বিদেশি রেফারি! ২০০০ সালের ডিসেম্বরে উত্তেজনায় ছাড়ায় সকল মাত্রা। এস্তেগলালের স্টপার পারভিজ ব্রৌমান্দ পারসেপোলিসের পায়ান রাফাতকে ও পারসেপোলিসের মিডফিল্ডার হামিদ রেজা এস্তিলি এস্তেগলালের নওয়াজিকে ঘুষি মারেন একই ম্যাচে। এ নিয়ে উত্তেজিত সমর্থকদের দাঙ্গায় ভাঙা হয়েছিলো ২০০ বাস, আহত হয়েছিলেন অর্ধশত, গ্রেফতার হয়েছিলেন ৩ ফুটবলার সহ ৬৩ জন।
ইদানিং তো সৌজন্যতার ‘ওভারডোজ’ হিসেবে দু’দলের খেলোয়াড়দের ম্যাচের আগের রাতে বাধ্যতামূলকভাবে একসাথে খেতে বসতে হয়। এতে সম্প্রীতির বার্তা যতটা না থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে দাঙ্গা এড়াবার তটস্থতা। ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনের ২০০৮ এর জুন সংখ্যা বলছে, এশিয়ার ক্লাব ফুটবলের সেরা ডার্বি বা আঞ্চলিক দ্বৈরথ এটিই, পুরো বিশ্ব মিলিয়ে যেটির অবস্থান ২২ নম্বরে।
২) কলকাতা ডার্বি (মোহনবাগান বনাম ইস্ট বেঙ্গল)
দুপুরের খররৌদ্র। কানপুরের ধুলো ঊড়োনো পিচে হয়ত রবিচন্দ্রন অশ্বিন আগুন ঝরাচ্ছেন বল হাতে অথবা নাগপুরে বোলারদের কচুকাটা করছেন বিরাট কোহলি। ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের যেন ঠিক ওদিকটায় মনযোগ নেই, অন্যরকম উত্তেজনা বিরাজ করছে যুবভারতী স্টেডিয়াম পাড়ায়, আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ফুটবল। বুঝতেই পারছেন কোন দিনের কথা বলছি। হ্যাঁ, দ্য গ্রেট কলকাতা ডার্বি – মোহন বাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল। এ দিন যেন বাঙালি সব ভুলে ফিরতে আকুল হয় ফুটবলের কাছে, এ যে বাঙালির প্রথম প্রেম! ফুটবলে বাংলাদেশেও এমন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটি নাম ছিলো মোহামেডান ও আবাহনী। কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশে এই দ্বৈরথের তেজ স্তিমিত হয়ে গেলেও কলকাতা ডার্বি এলেই ওপারের বাঙালিদের ফুটবল আবেগ এখনো চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
১৯২১ সালের ৮ আগস্ট থেকে চলছে এই ডার্বি। দু’দলেরই আছে গৌরবময় ইতিহাস। মোহনবাগান তো বয়সে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের থেকেও বড় ক্লাব। ১৯১১ সালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো ‘ভারতীয়’দের ক্লাব হিসেবে মোহনবাগান জেতে গৌরবময় আইএফএ শিল্ড। আর সেই আইএফএ শিল্ডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৮ বারের চ্যাম্পিয়ন ক্লাবটির নাম ইস্টবেঙ্গল।
দু’দলের সমর্থকেরা একে অপরকে বিদ্রুপের জন্য রেখেছে ঐতিহাসিক ডাকনামও! ইস্ট বেঙ্গলকে বাগান-সমর্থকেরা বলেন ‘লোটা’ আর মোহনবাগানকে ইস্ট বেঙ্গল-সমর্থকেরা বলেন ‘মাচা’। শব্দগুলোর বুৎপত্তি ওভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, বাঙালদের খাদ্য ‘লোটে’ (লইট্টা) থেকে ‘লোটা’ আর মোহনবাগানের লোগো পালতোলা নৌকার অংশবিশেষ থেকে এসেছে ‘মাচা’ শব্দটি। উদযাপনের ক্ষেত্রে এ দ্বৈরথ পেয়েছে আরেক মাত্রা- ইলিশ বনাম চিংড়ি। মোটাদাগে বাঙালদের প্রিয় ইলিশ আর ঘটিদের প্রিয় চিংড়ি। তাই ইস্ট বেঙ্গল সমর্থকের জয়োৎসবের অনুষঙ্গ থাকে ইলিশ আর বাগান সমর্থকের চিংড়ি। এমনকি ভেন্যুর আশেপাশে এদের খেলার দিন জার্সি-পতাকার সাথে ইলিশ-চিংড়ি বিক্রির ধুম পড়ে যায়!
২০১২ সালে একটি ডার্বিতে ৪৩ মিনিটে হরমনজোত খাবরার গোলে এগিয়ে যায় ইস্ট বেঙ্গল। সে সময় রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে লাল কার্ড দেখেন মোহনবাগানের নাইজেরীয় স্ট্রাইকার ওদাফা ওকোলি। এ নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাগান সমর্থকেরা, মাঠে মিসাইলের মতো বোতল, পাথরসহ হাতের কাছে যা আছে ছুঁড়তে শুরু করেন তারা। ঘটনাক্রমে এতে চোয়াল ভাঙে মাঠে থাকা তাদেরই উইঙ্গার সৈয়দ রহিম নবীর। গ্যালারিতে ও মাঠের বাইরে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে আহত হন ২০ জন পুলিশসহ ৪০ জন! দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগান মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানালে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ গোলে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনায় শাস্তিস্বরূপ সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন মোহনবাগানকে ঘরোয়া ফুটবল থেকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। অবশ্য এক আপিলের সুবাদে এ নিষেধাজ্ঞা বাতিল হতে লেগেছিলো কেবল একটি মাস।
একে যদি দু’দলের দ্বৈরথের ইতিহাসের খারাপ অধ্যায় বলা হয়, তবে চূড়ান্ত নিকৃষ্ট অধ্যায় বলতে হবে ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্টকে। ইডেন গার্ডেন্সে কলকাতা লিগের ম্যাচটি শেষ হলো ম্যাড়মেড়ে গোলশূন্য ড্রতে। ব্যস, ফলাফল মানতে না পেরে দু’দলের সমর্থকেরা গ্যালারিতে জড়িয়ে পড়লেন মারামারিতে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ভীত-সন্ত্রস্ত দর্শকেরা ছোট ছোট গেট দিয়ে স্টেডিয়াম ত্যাগের চেষ্টা করলেন। এই হুড়োহুড়িতেই পদদলিত হয়ে প্রাণ যায় ১৬ জনের!
৩) ইন্দোনেশীয় ক্লাসিকো (পারসিব বান্দুং বনাম পারসিজা জাকার্তা)
২০১২ সালের মে মাসের কথা। মুখোমুখি পারসিব বান্দুং আর পারসিজা জাকার্তা। খেলা হচ্ছে পারসিজার হোম ভেন্যু জাকার্তার গেলোরা বাং কার্নো স্টেডিয়ামে। মোটামুটি ঠিকভাবেই ২-২ গোলে ম্যাচটি শেষ হয়েছিলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে আরেক জায়গায়। প্রথমার্ধের খেলা চলাকালে পকেটমার সন্দেহে পারসিজার এক সমর্থককে পিটিয়ে মেরে ফেলেন পারসিজার সমর্থকেরাই। এই থেকে খুনে মেজাজেই বোধ হয় ছিলেন পারসিজার সমর্থকেরা। ম্যাচ শেষে কার-পার্কিং এ পারসিবের দুই সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করেন তারা। এরপর থেকে পারসিজার ডাকাবুকো সমর্থকেরাও পারসিবের হোম ভেন্যু বান্দুং স্টেডিয়ামে যেতে ভয় পান! ভেন্যুর খুব কাছের বাসিন্দা না হলে এখনও কোনো সমর্থক অপর দলের হোম ভেন্যুর ছায়া মাড়ান না! এমনকি খেলোয়াড়দেরও মাঠ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় অস্ত্রসজ্জিত গাড়িতে করে। বোঝাই যাচ্ছে এই ডার্বির উত্তেজনাটার মাত্রা কোন পর্যায়ে গেছে। দুই দলের ৬৯ বারের সাক্ষাতে পারসিজার ২৪ জয়ের বিপরীতে পারসিবের জয় ১৬টিতে, ২৮টি হয়েছে ড্র।
‘পারসিবায়া সুরাবায়া’ ও ‘পারসেতোয়ান সেপাক্রাগা সেলেওরোয়েহ ইন্দোনেশিয়া (পিএসএসআই)’ এর মধ্যেও রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে ইন্দোনেশীয় ক্লাসিকো বা ডার্বি বলতে সবাই একনামে পারসিব বনাম পারসিজাকেই চেনে। দেশটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কখনোই উজ্জ্বল নয় পারফর্মেন্সের দিক থেকে। তবে এই দ্বৈরথগুলোই মূলত টিকিয়ে রেখেছে দেশটির ফুটবলের প্রাণ। এ কারণে জাতীয় দলের বড় মঞ্চে সাফল্য না থাকা সত্ত্বেও দেশটির ঘরোয়া ফুটবলে থাকে উপচে পড়া দর্শক। উত্তেজনা থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তবে তা-ই ভালো নয় কি? এমন দ্বৈরথ, উত্তেজনার প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ যদি পূর্বের ন্যায় আবারও কাঁপে আবাহনী-মোহামেডান জ্বরে, তবে তা আদতে তো দেশের ফুটবলেরই লাভ।
ফিচার ইমেজ: The Democratic Buzzer