সে বছর বেশ এক শোর উঠেছিল। প্রাচীন মায়া ক্যালেন্ডারে বিশ্বাসীরা বলতে শুরু করেছিল, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে ওই বছরেরই ২১ ডিসেম্বর। কয়েকজন তো ধ্বংসের তারিখ এগিয়ে এনেছিলেন আরও। ‘নিবিরু’ নামে কোনো এক গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর নাকি সংঘর্ষ ঘটবে ২৩ সেপ্টেম্বর, আর তাতেই পৃথিবীর ধ্বংস।
ক্ষণকাল আগে শোর তো উঠেছিল এদেশের ক্রিকেটেও। জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়ে হেরেটেরে একাকার হয়ে ক্রিকেটাররা ফিরেছিলেন দেশে, সাকিব-তামিম হারিয়েছিলেন নেতৃত্ব। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে ৫৮ আর ৭৮ রানে অলআউট হবার স্মৃতি তো তখনও টাটকাই। তামিম ইকবালের ব্যাটটাও যুদ্ধ করছিল ফর্মের সঙ্গে। দলে তার থাকা-না থাকা নিয়ে হয়ে গিয়েছিল একপ্রস্থ নাটক, যে নাটকে জড়িয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীও। সব দেখে-শুনে কেউ কেউ মন্তব্য করে ফেলেছিলেন, দেশের ক্রিকেটও ধ্বংস!
আজ আট বছর বাদে পেছন ফিরে তাকিয়ে অবশ্য ধ্বংসের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং স্মৃতি হাতড়ে যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে কষ্টের এক দগদগে ক্ষতের সঙ্গে প্রবলভাবে মিশে রয়েছে নতুন দিনের আগমনী গান। দেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের সূচনা তো হয়েছিল সেই বছরই।
আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ২০১২ এশিয়া কাপে।
১.
নির্ধারিত হয়েছিল ২০১০ সালের ডিসেম্বরেই, এক যুগ বাদে এশিয়া কাপের আসর বসবে বাংলাদেশে। সেই থেকে যে দুই বছর অন্তর অন্তর বাংলাদেশের ক্রিকেটসূচির এক অংশ হয়ে যাবে এশিয়া কাপ, কে জানতো! ২০১২ সালের পর ২০১৪, তারও পরে ২০১৬, এশিয়া কাপের ভেন্যু ছিল বাংলাদেশই।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত আর শ্রীলঙ্কা – তখন অবধি টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া এশিয়ার এই চার দল নিয়েই বসেছিল এশিয়া কাপের একাদশতম আসর। প্রাথমিকভাবে মার্চ মাসের ১-১২ তারিখ আয়োজনের তারিখ স্থির হলেও যা পরে পিছিয়ে যায় পাক্কা ১১ দিন। কারণ অবশ্য ছিল, অস্ট্রেলিয়ায় চলছিল ভারত-শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ, যা কি না শেষ হবার কথা ছিল ৮ মার্চ। ভারত-শ্রীলঙ্কাকে বাদ দিয়ে তো আর এশিয়া কাপ হয় না! আসরের সূচনাই তাই হয় ১১ মার্চ, বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ দিয়ে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড অবশ্য ওই ১১ দিনের বিরতিতে সংবাদের কোনো কমতি রাখেনি। এশিয়া কাপের বাকি তিন দল স্ব স্ব দল ঘোষণা করেছিল আগেই, বাংলাদেশ তাদের দল জানিয়েছিল ৫ মার্চ রাত দশটায় পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, এবং সে দলটি নির্বাচকেরা দেননি। তৎকালীন প্রধান নির্বাচক আকরাম খান কোনো রাখঢাক না রেখেই যা জানিয়ে দিয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমে,
”এটা আমাদের দল নয়। আমরা যে দল নির্বাচন করেছিলাম, সেটি বদলে দেওয়া হয়েছে।”
আকরাম খানের এমন ক্ষুব্ধ কণ্ঠের কারণ, স্কোয়াডে তামিম ইকবালের অনুপস্থিতি। তামিমকে ১৫ জনের দলে রেখেই নির্বাচকেরা দল পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন বোর্ড সভাপতির কাছে, তার অনুমোদনের জন্যে। বোর্ড সভাপতি পাকিস্তান থেকেই অনুমোদন দেন সে দলের, তবে চূড়ান্ত স্কোয়াডে ১৫ জনের বদলে ঠাঁই পান ১৪ জন। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেই কেটে দিয়েছিলেন তামিমের নাম, বদলে তাকে রেখেছিলেন পাঁচজনের স্ট্যান্ডবাই তালিকায়।
বোর্ড সভাপতির এই অন্যায্য হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে আকরাম খান পদত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে। এর আগেও যে স্বাধীনভাবে কাজ করায় বাধা আসছিল বোর্ডের তরফ থেকে, জানিয়ে দেন তা-ও।
বোর্ডের এই অন্তর্দ্বন্দ্বে ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আকরাম খানকে অনুরোধ করেন প্রধান নির্বাচকের পদে ফিরে আসতে, তামিমও ফিটনেস টেস্টে পাস করবার ‘অজুহাতে’ সুযোগ পেয়ে যান এশিয়া কাপের দলে। অজুহাতই বলতে হচ্ছে, কেননা তৎকালীন অধিনায়ক আর কোচ তামিমের ফিটনেস টেস্টে উত্তীর্ণ হবার খবর জানিয়ে দিয়েছিলেন এরও আগেই।
মাঠের বাইরের এমন ঘটনার ঘনঘটায় আড়ালে চলে যায় মাঠের ক্রিকেটই, বাংলাদেশ দল এশিয়া কাপের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে আসর শুরু হবার মাত্র চারদিন আগে।
২.
শুরুর আগের ওই বিতর্ককে ভুলিয়ে দিতে মাঠের ক্রিকেটে দারুণ কিছু করতেই হতো। তবে তৎকালীন ফর্ম আশা জাগাতে পারছিল কই! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট হার, সাথে ওয়ানডে সিরিজেও পরাজয়ে বদল এসেছিল অধিয়ানকত্বে। মুশফিক অধিনায়ক হয়েও অবশ্য বদলাতে পারেননি দেশের ক্রিকেটের ভাগ্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারতে হয়েছিল ২-১ ব্যবধানে, পাকিস্তান তো করেছিল ধবলধোলাই।
এশিয়া কাপ শুরু হচ্ছিল সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই ম্যাচ দিয়েই। ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ শুরুটা করেছিল দারুণভাবেই, শুধু পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটাই ঠোকা হয়নি।
মিরপুরের ওই ম্যাচে টসে জিতেছিল বাংলাদেশই, নিয়েছিল ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত। ব্যাটে নেমে পাকিস্তানের দুই ওপেনার মোহাম্মদ হাফিজ আর নাসির জামশেদ যেন ফিরে গিয়েছিলেন প্রস্তরযুগের ক্রিকেটে। গড়লেন ১৩৫ রানের জোট, তবে ওভারপ্রতি রান তোলার হার পাঁচ ছাড়ায়নি কখনোই। নাসির জামশেদ পঞ্চাশ পেরিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ২৮তম ওভারে, পাকিস্তানের ইনিংসটিও গতি পেতে শুরু করলো এরপরই। অবশ্য রানের গতির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে পড়তে শুরু করেছিল উইকেটও। উদ্বোধনী জুটির পরে তেমন একটা স্থায়ীত্ব পায়নি কোনো জুটিই, শহীদ আফ্রিদিও ফেরত গিয়েছিলেন অদ্ভুতুড়ে এক ক্যাচের শিকার হয়ে। পাকিস্তানের রান তখন ২৫০-য়ের মাঝেই থাকবে বলে অনুমান। তবুও যে রানটা শেষ অব্দি ২৬২-তে পৌঁছালো, সে কৃতিত্ব উমর গুলের। ৪২তম ওভারে ব্যাটিংয়ে নেমে খেলেছিলেন ২৫ বল, তাতেই পাঁচ চার আর এক ছক্কায় করেছিলেন ৩৯।
ইদানিংকালের তামিমকে দেখে এটিকেই মনে হয় স্বভাবজাত, তবে তৎকালীন প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে তো তামিমের জন্যে স্বভাববিরুদ্ধই। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো তামিম নেমেছিলেন ‘ধরে খেল’ নীতি নিয়ে, শুরুর পাওয়ারপ্লে’তে অর্ধেক বল খেলে করেছিলেন ১৪ রান, অপরপ্রান্তে নাজিমউদ্দিন কিছুটা আক্রমণাত্মক মেজাজে থাকায় শুরুর দশ ওভারে তবুও এসেছিল ৪৩ রান।
নাজিমউদ্দিন ফিরেছিলেন পাওয়ারপ্লে শেষেই। জহুরুলও পারেননি বড় ইনিংস খেলতে, জহুরুলের পিছু পিছু ফিরেছিলেন মুশফিকও। বোর্ড সভাপতিকে জবাব দিয়ে তামিম করেছিলেন ৬৪। তবুও ৩০ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ছিল পাঁচ উইকেট হারিয়ে ১৪১।
সাকিব আর নাসির মিলে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছিলেন কিছুক্ষণ, তাতে হুট করেই ম্যাচের হাওয়া বইতে শুরু করলো বাংলাদেশের দিকে। ৫ উইকেট হাতে রেখে ৪০ বলে দরকার ৩৯ রান, এই ম্যাচ কি কেউ হারে!
নাসির হোসেন আউট হলেন সেক্ষণে, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ধ্বস নামলো আরেকটিবার। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব যখন আউট হয়ে ফেরত আসছেন, তখনও দুই দলের মাঝে ব্যবধান ২১ রানের।
৩.
পাকিস্তানকে হারানো যায়নি ১৯৯৯-য়ের নর্দাম্পটনের ম্যাচের পর থেকেই। খুব কাছে গিয়ে ফিরতে হয়েছিল ২০১২-এর ১১ মার্চেও। তবে সাম্প্রতিক অতীতের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সময়কে পেছনে ফেলবার জ্বালানি যুগিয়েছিল ওই ম্যাচ। যে জ্বালানিকে সঙ্গী করে ১৬ মার্চ বাংলাদেশ নেমেছিল ভারতের মুখোমুখি হতে। ওই ম্যাচ ভারতীয়দের ভুলে যাবার কোনো উপায় নেই, শচীন করেছিলেন ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’। বাংলাদেশিদেরও সে ম্যাচ ভুলবার কোনো কারণ নেই, জয়ের হাসি যে হেসেছিল বাংলাদেশই।
পাকিস্তান ম্যাচের মতোই টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নিয়েছিলেন মুশফিক, তবে প্রথম ম্যাচের মতো এদিন আর লম্বা হয়নি প্রতিপক্ষের প্রথম জুটি। যা হয়েছিল দ্বিতীয় উইকেটে, কোহলি আর টেন্ডুলকার মিলে জুড়েছিলেন ১৪৯ রানের জোট।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শচীনের সেঞ্চুরি-খরার বছরপূর্তি হয়েছিল তার দিনচারেক আগেই, আর শচীন ম্যাচ খেলতে নামলেই তো তখন ধুনা উঠছিল, ‘আজকেই বুঝি শতকের শতক হলো’। ৬৩ বলে অর্ধশতক তুলে শচীন তাই হয়ে গিয়েছিলেন সাবধানী, আর বোধহয় অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন না। এতটাই ধীরস্থির ব্যাটিং করেছিলেন যে, দ্বিতীয় পঞ্চাশ তুলতে বল খেলে ফেলেছিলেন ৭৩টি। অপরপ্রান্ত থেকে রায়না-ধোনিরা তাই রান বাড়াবার চেষ্টা করলেও স্কোরটা ২৮৯-য়ের ওপরে যায়নি।
ম্যাচ-পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে মুশফিক দাবি করেছিলেন,
“আমার মনে হয়, তাদের(ভারতের) বোলিং পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো অতটা ভালো না।”
তা প্রমাণ করবার তাড়না তার মধ্যে থেকে থাকবে নিশ্চয়ই। অধিনায়কের সে তাড়না সঞ্চারিত হয়েছিল পুরো দলের মাঝেই। তামিম আবারও করেছিলেন সাবধানী এক অর্ধশতক, বিপরীতে জহুরুল ইসলাম অমি-নাসির হোসেনরা চেষ্টা করেছিলেন প্রয়োজনীয় রানরেটের সঙ্গে পাল্লা দিতে। তবে এরপরেও সাকিব যখন নেমেছিলেন, ওভারপ্রতি রানের চাহিদা বেড়ে পৌঁছেছিল প্রায় সাড়ে আটে।
সেখান থেকে সাকিব খেলেছিলেন ৩১ বলে ৪৯ রানের এক ম্যাচজয়ী ইনিংস। শেষ মরণকামড়টা এসেছিল অবশ্য মুশফিকের ব্যাটে, পাঠান-দিন্দা-প্রাভিন কুমারদের ভারতীয় বোলিংকে ছত্রখান করে ২৪ বলে করেছিলেন ৪৫। শেষ অব্দি মাহমুদউল্লাহ ম্যাচের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছিলেন চার বল বাকি থাকতেই।
৪.
সে টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান লড়াইতে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সমর্থনটা পাকিস্তানই পেয়েছিল। পাকিস্তানের কাছে ভারত হেরে গেলেই তো অনেক রকম সমীকরণ সঙ্গী করে বাংলাদেশও খেলে ফেলতে পারতো এশিয়া কাপের ফাইনালে। নইলে এতদিন যে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’ নীতি নিয়ে খেলে এসেছে!
বিরাট কোহলির এক বিরাট শতকে বাংলাদেশের যে আশা চুরমার হয়ে যেতে সময় লাগেনি। পাকিস্তানের ৩২৯ ভারত পেরিয়ে গিয়েছিল ১৩ বল আগেই, শচীন তার ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডেতে ফিরিয়ে এনেছিলেন পুরোনো উচ্ছ্বলতা, আইজাজ চিমাকে আপার কাটে মারা ছক্কায় তো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপকেই। তবে সব ছাপিয়ে নায়ক বিরাট কোহলিই; ১৪৮ বল খেলে করেছিলেন ১৮৩, দু’টি সংখ্যাতেই অনেকটুকু বলা হয়ে যায়। যে ইনিংসের পরে ভারত পেয়েছিল টুর্নামেন্টে টিকে থাকার লাইফলাইন, আর বাংলাদেশ পেয়েছিল এক সরল সমীকরণ, ‘শ্রীলঙ্কাকে হারাও, ফাইনালে যাও!’
আসরের প্রেক্ষিতে বিচার করলে সেটা খুব সম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় মাস দেড়েক কাটিয়ে এসে শ্রীলঙ্কা যেন ভুলে গিয়েছিল উপমহাদেশের জল-হাওয়া, হেরেছিল ভারত-পাকিস্তান দু’দলের কাছেই। তবুও ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ নীতি মেনে জয়াবর্ধনে চেয়েছিলেন, টুর্নামেন্টটা তার দল শেষ করুক জয় দিয়ে।
যে চাওয়ার পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলন নাজমুল হোসেন, শফিউলের চোটে টুর্নামেন্টে প্রথমবার সুযোগ পেয়েই যিনি তুলে নিয়েছিলেন জয়াবর্ধনে-দিলশান-সাঙ্গাকারার উইকেট। শুরুর পাওয়ারপ্লেতে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে সেই যে নাজমুল সুর বেঁধে দিয়েছিলেন, শ্রীলঙ্কার পুরো ইনিংস সে সংগীতেই সঙ্গত। এক থারাঙ্গা ছাড়া ধুঁকেছিল শ্রীলঙ্কার পুরো ব্যাটিং লাইনআপই, ৫০তম ওভারের পঞ্চম বলে অলআউট হবার পূর্বে শ্রীলঙ্কা করতে পারলো মোটে ২৩২।
৫.
বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের রোমান্টিকতার ইতিহাস তো পুরোনো। তা বৃষ্টি নেমেছিল সেদিনও। অবশ্য তাতে স্বস্তির চাইতে শঙ্কাই জাগলো বেশি, ওভারের খাতায় দশটি ঘর কাটা গেলেও রান যে কমেছিল মাত্র বিশ!
তার উপরে লাসিথ মালিঙ্গা তো ছিলেনই। সেদিন অবশ্য মালিঙ্গাকে সামলানো গেল ভালোই, সমস্যা করলেন বাকিরা। নাজিমউদ্দিন ফিরলেন কুলাসেকারার প্রথম ওভারেই, লাকমল ফেরালেন জহুরুলকে। পরের ওভারে মুশফিকও ফিরে যেতেই ফাইনাল খেলার স্বপ্ন তখন মিথ্যে মরীচিকা হবারই আশঙ্কা। সাকিব-তামিম হাল ধরলেন আবার, প্রতিরোধের চেয়ে মন দিলেন পাল্টা আক্রমণে। বাংলাদেশের শতরান পূর্ণ হয়েছিল ঠিক একশ বলেই, দু’জনে জুটি গড়েছিলেন ৭৪ রানের। তবে সেনানায়েকে দু’জনকে টপাটপ তুলে নিতেই আরও একবার ভয় ধরেছিল মনে। মাহমুদউল্লাহ-নাসির মিলে ৭৭ রানের জুটি গড়ে যা সত্যি হতে দেননি।
সাকিব আল হাসানের সত্যি হওয়া তখন মাত্র এক ম্যাচের অপেক্ষা। এশিয়া কাপ শুরুর আগের দিনের সংবাদ সম্মেলনে লক্ষ্যের কথা জানতে চাওয়ায় তিনি হাসতে হাসতেই তো বলেছিলেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হওয়া!’ তবে চিরকালই এশিয়ার তিন বড় ভাইয়ের দাপটে চতুর্থ হয়ে আসা বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে বড় সত্যি হয়ে দেখা দিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী,
‘অলৌকিক এইভাবে ঘটে।
হঠাৎ একদিন ফাঁক হয়ে যায় সাদাসিধে ঝিনুক,
ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোয় সাদা জ্যোৎস্না।’
বাংলাদেশ এই প্রথমবার ফাইনালে… অলৌকিক নয় তো কী!
৬.
গুলশানের এক বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত হাফিজুর রহমান কিনলেন রেডিও, মহাখালী বাস টার্মিনালের চায়ের দোকানদার লিটন কিনলেন টিভি। টিএসসিতে সেদিন মিনি স্টেডিয়াম বসলো, স্কুল-কলেজে অনুপস্থিতির হার বেড়ে গেল, সবই ওই এক ম্যাচের জন্য।
তা সেদিন তো সব ঠিকঠাকই চললো। ফ্লাডলাইটের আলোয় ব্যাটিং করা সহজ হয়ে যায় বলে টস জিতে ফিল্ডিং নেয়া দরকার ছিল, বাংলাদেশ তা-ই করলো। টুর্নামেন্টের পুরোটা জুড়েই পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের ভিত্তি হয়ে থাকা উদ্বোধনী জুটিকে দ্রুত ফেরাতে হতো, সেদিন উদ্বোধনী জুটি টিকলো মাত্র ২৬ বল। সঙ্গী হারিয়ে মোহাম্মদ হাফিজ ঢুকে গেলেন খোলসে, এতটাই যে ৮৭ বল খেলে করলেন মোটে ৪০ রান। বাকিরা মিলে চেষ্টা করলেন, তবে খুব একটা দাঁড়াতে পারলেন না কেউই। ৪৯ ওভার শেষে ধুঁকতে ধুঁকতে পাকিস্তান তুললো ২১৭। আফসোস কেবল, শাহাদাত যদি ওই ওভারটা না করতেন!
এমন কিছুর ইঙ্গিত তো শাহাদাত আগেই দিয়েছিলেন। রান দেয়ায় বরাবরই উদারহস্ত তিনি উদারতার প্রমাণ রেখেছিলেন প্রথম তিন ম্যাচেও। কোনো ম্যাচেই রান দেননি ওভারপ্রতি ছয়ের কম, সে ধারা ভেঙে যাচ্ছিল ফাইনালে। তা তিনি হতে দেননি। প্রথম আট ওভারে ৪৪ রান বিলানো শাহাদাত শেষ ওভারে দিয়েছিলেন ১৯। যা হবার নয়, তা-ই হয়ে পাকিস্তান শেষ করলো ২৩৬ রানে।
৭.
নাজিমউদ্দিন এরপর আর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলেননি। সুযোগ থাকলে বাংলাদেশের সমর্থকেরা অনেকেই অবশ্য চাইতেন, তিনি যদি এশিয়া কাপের ফাইনালেও না খেলতেন!
উমর গুলের করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই তিনি পরাস্ত হয়েছিলেন চারবার, তার ৫২ বল স্থায়ী ইনিংসে এরপর যা ঘটেছে আরও বহুবার। রানের জন্যে হাঁসফাঁস করেছেন গোটা ইনিংসজুড়েই, ছিল না কোনো চার-ছক্কার মার, ৬০ মিনিট ব্যাপ্তির চূড়ান্ত অস্বস্তিকর ইনিংসে রানও করতে পারেননি ১৬-র বেশি। টু ডাউনে নেমে নাসিরও যাকে অনুসরণ করেছিলেন মাত্র, তিনি খেলেছিলেন ৬৩ বলে ২৮ রানের ইনিংস। যে কারণে শুরুতে ওভারপ্রতি ৪.৭৪ রানের চাহিদা ইনিংসের অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই ছাড়িয়ে গেল ছয়। তিন উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন বিষম চাপে।
সাকিব চেষ্টা করলেন আরও একবার। ভারতের বিপক্ষে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে আউট হয়েছিলেন ফিফটির দোড়গোড়ায়, নয়তো গ্রুপপর্বের বাকি দুই ম্যাচেই করেছিলেন পঞ্চাশ। অর্ধশতক হাকিয়েছিলেন ফাইনালেও, তার আগেই অবশ্য হাফসেঞ্চুরি করে ফিরে গিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। চার আঙুলে চার ফিফটির ওই উদযাপন আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি।
দু’জনের ব্যাটে বাংলাদেশ তাই ম্যাচ থেকে কখনোই ছিটকে যায়নি পুরোপুরি। সাকিব আউট হবার পর শেষ ছয় ওভারে দরকার ছিল ৫৬, মাশরাফির ছোট্ট ঝড়ে শেষ ওভারে মাত্র ৯।
৮.
“অঝোরে কাঁদছেন মুশফিকুর রহিম। অধিনায়ককে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সাকিব আল হাসান। ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসির রেখা। চিকচিক করতে থাকা চোখ আর ওই হাসি মিলিয়ে এমন একটা বেদনার্ত ছবি, যা হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। একটু আগেও প্রাণোচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা মিরপুর স্টেডিয়ামে তখন শ্মশানের নীরবতা। সারি সারি শোকস্তব্ধ মুখ। এত কাছে, তবু এত দূর…!”
মাহমুদউল্লাহ পারেননি আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে শেষ ওভারের লড়াইয়ে জিততে। অন্য সময় হলে হয়তো শাহাদাতের ব্যাটের কানায় লেগেও শেষ বলটা চলে যেত ফাইন লেগের সীমানা পেরিয়ে, সেদিন বলটা মিরপুরের পিচ পেরোয়নি। বাংলাদেশ পাকিস্তানের ২৩৬ পেরোতে পারেনি, দুই রানের জন্যে।
পূর্ণেন্দু পত্রী সত্যি হতে হতে শেষ দৃশ্যে তাই সত্যি হয়ে গেলেন হেলাল হাফিজ, ‘আলোর মাঝে কালোর কষ্ট লাইনটি তো তারই সৃষ্টি। সাকিবের টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার কি আর সে কষ্টে সান্ত্বনা হয়!