সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দিয়েছেন বর্তমান সময়ে ট্রান্সফার মার্কেটে সবচেয়ে বড় ‘হটকেক’-এ পরিণত হওয়া আর্লিং হালান্ড। হালান্ডকে কেনার দৌড়ে ম্যানসিটির পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এমনকি বায়ার্ন মিউনিখের নামও শোনা গেছে, তবে এই নরওয়েজিয়ান দিনশেষে বেছে নিয়েছেন নিজের বাবার সাবেক ক্লাবকেই।
সময়ের সবচেয়ে ‘রোমাঞ্চকর’ ফুটবলারকে মাত্র ৫১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে স্বাক্ষর করাটা অবিশ্বাস্য রকমের ভালো চুক্তি। বেতন, সাইনিং বোনাস, এজেন্ট ফি’সহ আরো কিছু বাড়তি খরচের কারণে হালান্ড ট্রান্সফারের প্রকৃত খরচ নিঃসন্দেহেই ৫১ মিলিয়নেরও অনেক বেশি হবে; কিন্তু সময়ের সেরা গোলমেশিনকে এই দামে সামর্থ্যবান যেকোনো ক্লাবই পেতে চাইবে বৈকি!
খুব কম ফুটবলারই আর্লিং হালান্ডের মতো এত অল্প সময়ে নিজেকে দৃশ্যপটে নিয়ে আসতে পেরেছেন। তার ক্ষিপ্রতা, বুদ্ধিদীপ্ত মুভমেন্ট এবং দুর্দান্ত ফিনিশিং দক্ষতা মাত্র ২১ বছর বয়সেই তাকে সময়ের অন্যতম সেরা তারকা ফুটবলারে পরিণত করেছে।
তবে এতকিছুর পরও পেপ গার্দিওলার খেলার ধরনের সাথে হালান্ড নিজেকে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন, সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সার্জিও আগুয়েরো দলে অনিয়মিত হয়ে পড়ার পর থেকে গত দুই মৌসুমে ম্যানসিটি কোনো প্রথাগত স্ট্রাইকার খেলায়নি। এর সবচেয়ে বড় কারণ, পেপ গার্দিওলা তার স্ট্রাইকারদের থেকেও একজন মিডফিল্ডারের মতো পাসিং দক্ষতা দাবি করেন। এজন্য গত মৌসুমে তিনি খুব করেই টটেনহ্যামের হ্যারি কেইনকে চেয়েছিলেন; কিন্তু ম্যানসিটির ১৫০ মিলিয়নের লোভনীয় অফারও টটেনহ্যাম বোর্ডের মন গলাতে পারেনি।
হালান্ড হচ্ছেন একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার, যিনি কি না মিডফিল্ডে নেমে বিল্ডআপে অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে বক্সের আশেপাশে অবস্থান করে বলের অপেক্ষায় থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। এ কারণে পেপ গার্দিওলা তার সিস্টেমে হালান্ডকে কোন ভূমিকায় ব্যবহার করেন, সেটা নিয়ে বড় একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রিয় পাঠক, আজ আমরা আলোচনা করব ম্যানসিটিতে হালান্ডের সম্ভাব্য খেলার ধরন এবং হালান্ডকে তার টিমে শক্ত অবস্থান করে দেওয়ার জন্য পেপ গার্দিওলা তার ট্যাকটিক্সে সম্ভাব্য কী কী পরিবর্তন আনতে পারেন তা নিয়ে।
হালান্ড সিটির সিস্টেমে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন, সেটা বোঝার জন্য সর্বপ্রথম আমরা পেপ গার্দিওলার অধীনে সিটিজেনদের আক্রমণের ধরন নিয়ে আলোচনা করব।
ম্যানসিটি সাধারণত স্লো ট্রানজিশনাল পজেশননির্ভর ফুটবল খেলে থাকে। প্রতিপক্ষের রক্ষণদেয়াল ভেদ করতে গার্দিওলা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেন হাফস্পেসের উপর, এজন্য তার দলের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল দুই ফুটবলার ডি ব্রুইনা এবং বার্নাডো সিলভা হাফস্পেসে অবস্থান করে। সেখান থেকে তারা প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাক এবং ফুলব্যাকের মধ্যকার ফাঁকা জায়গা দিয়ে আড়াআড়ি থ্রু পাস বাড়ায়; তখন ম্যানসিটির উইঙ্গাররা টাচলাইন এরিয়া থেকে সেই পাস বরাবর ফরোয়ার্ড রান নেয়। বল রিসিভ করে তারা প্রতিপক্ষের ফুলব্যাককে পরাস্ত করে বক্সে ঢুকে পড়ে। কর্নার দাগের কাছাকাছি জায়গা থেকে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের সামনের ফাঁকা জায়গায় মিডফিল্ডার কিংবা স্ট্রাইকার বরাবর কাটব্যাক পাস বাড়ায় এবং মিডফিল্ডার/স্ট্রাইকার সেখান থেকে গোলে শট নেওয়ার চেষ্টা করে।
উপরের উদাহরণটির দিকে খেয়াল করা যাক। এখানে ডি ব্রুইনা হাফস্পেস থেকে মাহরেজ বরাবর থ্রু পাস বাড়ান। মাহরেজ কাটব্যাক রান নিয়ে বক্সের কিছুটা বাইরে থেকে গুন্ডোয়ান বরাবর পাস বাড়ায় এবং সেখান থেকে গুন্ডোয়ান গোলে শট নেন।
আমরা যদি ম্যানসিটির সুযোগ তৈরির হিটম্যাপের দিকে লক্ষ্য করি, তবে আমরা দেখতে পাব তাদের বেশিরভাগ গোলের সুযোগই তৈরি হয়েছে বক্সের বাইরে কিংবা বক্সের একপ্রান্ত থেকে উইঙ্গারদের কাটব্যাক পাসের মাধ্যমে। নির্দিষ্ট কোনো টার্গেট ম্যান না থাকায় গার্দিওলা তার মিডফিল্ডারদের লেট রানকেই গোল করার কাজে ব্যবহার করেছেন। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তাদের মূল স্কোরারদের কেউই প্রথাগত ফিনিশার না হওয়াতে প্রচুর গোলের সুযোগ মিস করতেন। গত মৌসুমে ম্যানসিটির ফুটবলাররা ম্যাচপ্রতি ১.৭টি নিশ্চিত গোলের সুযোগ মিস করেছেন। কে জানে, রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সিটির খেলোয়াড়রা গোল মিসের মহড়া না চালালে হয়তো বা প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা তাদের ঘরেই শোভা পেত।
ম্যানসিটির গোলের সুযোগ তৈরির আরেকটি মাধ্যম ছিল হাফস্পেস কিংবা উইং এরিয়া থেকে বক্সের ভেতর ক্রমাগত ক্রস করে যাওয়া। গত মৌসুমে ম্যানসিটি লিগে প্রতি ম্যাচে গড়ে ১৬টি করে ক্রস করেছে, যেটা পেপ গার্দিওলার অধীনে তাদের খেলা অন্যান্য যেকোনো মৌসুমের চেয়েই অনেক বেশি। নির্দিষ্ট কোনো স্ট্রাইকার না থাকায় একেক সময় একেক ফুটবলার ‘বিহাইন্ড দ্য ডিফেন্সে’ রান নিয়ে ক্রস থেকে গোল করার চেষ্টা করতো। কিন্তু ফাইনাল থার্ডে হেডারে দক্ষ ফুটবলারের অভাবে প্রচুর ক্রস করেও তারা খুব বেশি গোলের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেনি। হালান্ড আসার পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ পেপ গার্দিওলা এমন ক্রসনির্ভর ট্যাকটিক্স বেছে নিয়েছেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
এবার চলুন হালান্ডের প্রোফাইল এবং হালান্ডকে দলে শক্ত জায়গা করে দিতে ম্যানসিটির কী ধরনের ট্যাকটিক্স আয়ত্ত করা প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোচনা করি।
হালান্ডের সবচেয়ে বড় গুণাবলি হচ্ছে তার গোল করার দক্ষতা, যা তাকে ট্রান্সফার মার্কেটের সবচেয়ে বড় হটকেকে পরিণত করেছে। আরবি সালজবার্গে জয়েন করার পর থেকে তিনি ম্যাচপ্রতি গড়ে ১.১টি করে গোল করেছেন, এমন একজন স্কোরারকে যেকোনো দলই পেতে চাইবে, সেটা বলাই বাহুল্য। গত ৩ মৌসুমে হালান্ড লিগে ৬১টি গোল করেছেন, যা তার এক্সপেক্টেড গোলের চেয়ে প্রায় ১৩টি বেশি, এতে করেই একজন ফিনিশার হিসেবে হালান্ড কতটা দুর্দান্ত, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। ম্যানসিটি গত দুই সিজন ধরেই একজন পূর্ণাঙ্গ ফিনিশারের অভাবে ভুগছে, যে কারণে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েও তাদের বারবার খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। তাই হালান্ডের মতো একজন দুর্দান্ত ফিনিশার তাদের জন্য খুব করেই প্রয়োজন।
ফাইনাল থার্ডে হালান্ড সাধারণত দুই সেন্টারব্যাকের মাঝ বরাবর অবস্থান করেন। তিনি সবসময়ই ফার্স্ট বারপোস্টে অবস্থান করা সেন্টারব্যাকের ‘ব্লাইন্ড স্পটে’ অবস্থান করেন। ফলে সেই সেন্টারব্যাকের পক্ষে তাকে মার্ক করা সম্ভব হয় না। এজন্য দ্বিতীয় সেন্টারব্যাক তাকে টাইট মার্ক করে রাখে। তার টিমমেট তার দিকে ক্রস করার সময় তিনি তার মার্কারকে বিট করে সেকেন্ড বারের দিকে সরে যান এবং বল আসার সাথে সাথে বলের লাইনে গিয়ে হেড করে গোল করার চেষ্টা করেন। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির হালান্ডের সাথে এরিয়াল ব্যাটলে টক্কর দেওয়া বেশিরভাগ ডিফেন্ডারদের জন্যই অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার।
সিটির জন্য আরেকটি ভালো সংবাদ হচ্ছে, বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের আক্রমণের ধরনও সিটির সাথে অনেকটা মিলে যায়, তাদের উইঙ্গাররাও প্রচুর কাটব্যাক পাস বাড়ায়। এক্ষেত্রে হালান্ড ডিফেন্ডারদের কিছুটা সামনে অবস্থান করে কাটব্যাক পাসগুলো থেকে গোল করার চেষ্টা করেন। বামপায়ের হালান্ডকে সাধারণত বক্সের ডানদিকে অবস্থান করে কাটব্যাক পাস রিসিভ করে গোলে শট নিতে দেখা গেছে।
হালান্ডের আরেকটি চমৎকার দিক হচ্ছে তার স্পিড। এই ফরোয়ার্ড তার গতিশীল দৌঁড় এক নিমিষেই যেকোনো রক্ষণভাগ ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম। এজন্য প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের পুরো ম্যাচজুড়েই তার উপর বাড়তি নজর রাখতে হয়, তার স্পিডের কাছে পরাস্ত হওয়ার ভয়ে রক্ষণভাগ থেকে খুব বেশি উপরে উঠারও সুযোগ পায় না। এতে করে প্রতিপক্ষের মিডফিল্ড এবং ডিফেন্সলাইনের মধ্যে অনেকটা ফাঁকা জায়গার তৈরি হয়। যেখান দিয়ে ডি ব্রুইনা-বার্নাডো-ফোডেনরা খুব সহজেই বল পায়ে বক্সের কাছাকাছি এসে সরাসরি গোলে শট, অথবা ডিফেন্সচেরা পাস দিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারবে।
বল প্রোগ্রেসিংয়ে ম্যানসিটির ডিফেন্ডাররা নিঃসন্দেহে ইউরোপসেরা। এ কারণে প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকরা যদি উপরে উঠে আসে, তাহলে ম্যানসিটির সেন্টারব্যাকদের হালান্ডকে লক্ষ্য করে একটা ডিফেন্সচেরা পাসই তাকে প্রতিপক্ষের গোলকিপারের সাথে ‘ওয়ান-অন-ওয়ান’ পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে, যেখানে হালান্ড সময়ের সেরাদেরই একজন। তাই হালান্ডকে আটকাতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা অনেকটা উভয়সংকটে পড়বেন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
ফিনিশিং দক্ষতার বাইরে হালান্ডের অন্যান্য গুণাবলির দিকে যদি আমরা নজর দেই, দলের বিল্ডআপ এবং রক্ষণে অবদান রাখার দিক থেকে হালান্ড এখনো বেশ দুর্বল, একইসাথে তার প্লেমেকিং সামর্থ্যও খুব একটা আশা-জাগানিয়া নয়। গত মৌসুমে হালান্ডের ৮ অ্যাসিস্ট তার দুর্বল প্লেমেকিং সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে। কিন্তু যখন আপনি জানবেন তার এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্ট মাত্র ৫.৭, পরিষ্কার বোঝা যায় তার অ্যাসিস্ট পাওয়ার পেছনে তার চান্স ক্রিয়েশনের চেয়েও সতীর্থদের দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের অবদানই বেশি ছিল।
হালান্ডের গত সিজনের হিটম্যাপ থেকে এটা স্পষ্ট, তিনি মিডফিল্ডে নেমে বিল্ডআপে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে বক্সের আশোপাশে অবস্থান করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু সিটি যেরকম ‘স্লো ট্রানজিশনাল’ ফুটবল খেলে, তাতে করে মিডফিল্ডে নিউমেরিক্যাল সুপিরিওরিটি অর্জনের জন্য এবং প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলার জন্য স্ট্রাইকারের তার লাইন ছেড়ে নিচে নেমে আসা বেশ জরুরি। ম্যানসিটির খেলার ধরণে নিজেকে মানিয়ে নিতে এই জায়গায় হালান্ডের অনেকটা উন্নতি করতে হবে।
হালান্ডের আরেকটা দুর্বল দিক হচ্ছে অফ দ্য বলে তার সক্রিয়তার অভাব। তবে তার প্রেসিং রেট দেখে এটা স্পষ্ট, যথেষ্ট কার্যকরী না হলেও ক্রমাগত প্রেস করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের সহজাত বিল্ডআপে বাধা দিতে তিনি যথেষ্টই সক্রিয়। তাই পেপ গার্দিওলা তার অফ দ্য বল পজিশনিং এবং মুভমেন্ট নিয়ে কাজ করলে প্রেসিংয়ে উন্নতি করা তার জন্য খুব একটা কঠিন ব্যাপার হবে না।
হালান্ডের ট্রান্সফার ম্যানচেস্টার সিটির জন্য কতটা কার্যকরী হবে, সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে প্রিমিয়ার লিগে শুরুটা করেছেন দুর্দান্ত; ওয়েস্টহ্যামের বিপক্ষে নিজের প্রথম ম্যাচেই জোড়া গোল করে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণটাও রেখেছেন পুরোপুরি।
হালান্ডের এমন কিছু গুণাবলি রয়েছে, যেটা ম্যানসিটির স্কোয়াডের আর কোনো ফুটবলারের নেই। হালান্ডের থেকে সর্বোচ্চটা বের করে আনতে পেপ গার্দিওলাকে তার সিস্টেমের কিছু জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে, একইসাথে হালান্ডকেও তার দুর্বল জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
হালান্ডের মাঝে বিশ্বসেরা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। পেপ গার্দিওলাও যেকোনো খেলোয়াড়ের থেকে সেরাটা বের করে আনায় সিদ্ধহস্ত। এই দুইয়ের সমন্বয়ে ম্যানসিটি তাদের বহু আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা রইল সময়ের হাতেই।