[২য় পর্ব পড়ুন]
কুইন’স গ্যাম্বিটের সুবাদে দাবা না জানা মানুষটাও গুগল করতে শুরু করেছে ‘How to play chess’। করোনার কারণে দাবা লকডাউন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত গেম হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করেছে শহুরে ছেলেমেয়েদের অনেকের কাছেই। পাশাপাশি, শতাব্দী-প্রাচীন এই খেলার বুদ্ধিবৃত্তিক উপকারিতা তো আছেই। বলা হয়, ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক গঠন, মনন এবং সৃজনশীলতা বিকাশে দাবা বেশ কার্যকরী নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রিরই সমৃদ্ধ একটি অতীত থাকে, থাকে কিছু স্বার্থত্যাগী মানুষের দল, যারা সেই ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে নিতে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। খেলা হিসেবে দাবাও এর ব্যতিক্রম নয়। আবার কিছু কিংবদন্তিও থাকেন, যাদের দেখে বাকিরা সেই বিষয়ে আগ্রহী হয়।
দাবার জগতে রয়েছেন এমনই কিছু বিশ্ববিজেতা, ঠিক সংখ্যায় গুনে বের করতে বললে তা হবে ১৬ জন (ক্লাসিক্যাল দাবায়)। ব্র্যাড অ্যাশলক নামের এক অস্ট্রেলীয় দাবার কোচ এই সব বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের মনোহারিণী ছবি তৈরি করেছেন। আমাদের চলমান সিরিজে আমরা তাদেরই ধারাবাহিকভাবে দেখছি। প্রথম পর্বে দেখেছিলাম প্রথম আটজনকে, দ্বিতীয় পর্বে নবম থেকে বারোতম, আর আজ তৃতীয় ও শেষ পর্বে থাকবে শেষ চারজন।
১৩. গ্যারি ক্যাসপারভ (১৯৮৫-২০০০)
চেস ডট কমের সম্প্রতি করা এক জরিপ অনুযায়ী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হলেন গ্যারি কিমোভিচ ক্যাসপারভ। তার সম্পর্কে আলোচনা করা কঠিন, কারণ তার কোনো খুঁতই নেই বলতে গেলে। গ্যারি কনিষ্ঠতম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে তালের রেকর্ড ভেঙে দেন ১৯৮৫ সালে। তাছাড়া ৬টি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জিতে তিনি ইম্যানুয়েল ল্যাসকারের সাথে যুগ্মভাবে সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের রেকর্ড গড়েন, শেষ দুটি অবশ্য ফিদে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের দ্বারা।
ক্যাসপারভের উপর চাইলে ভলিউমের পর ভলিউম লেখা যাবে। তিনি অনেক পরিশ্রমীও ছিলেন, ফিশারের থেকেও। শৈশবে ভালো কোচ, শেখার প্রবল আগ্রহ, অদম্য ইচ্ছাশক্তি- সম্ভাব্য সকল ভালো সুযোগ-সুবিধার ফলাফল ক্যাসপারভ। ইচ্ছাশক্তির দিক থেকে গ্যারি বতভিনিকের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম, আর অন্যান্য গুণাবলীর সমন্বয়ে তার গুরুকেও টেক্কা দিতে পারঙ্গম!
ভ্লাদিমির ক্রামনিক এই বিশ্বসেরার শিখনক্ষমতার ব্যাপারে বলেন,
আমার মতে, কারপভের থেকেও তিনি বিভিন্ন কিছু শিখেছেন। তাদের প্রথম ম্যাচের আগে কারপভের শক্তিমত্তা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতেন না ক্যাসপারভ। পরের ম্যাচেই তিনি ভিন্নরূপে হাজির হয়েছেন। তার শিখনক্ষমতা ছিল অসাধারণ, অন্য যে কাউকে তিনি এই দিক থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার উপমা স্পঞ্জের মতো, যেকোনো কিছু শুষে নিতে সক্ষম। যেকোনো পরিবর্তনে মানিয়ে নিতে পারতেন ক্যাসপারভ। তিনি ছিলেন ফ্লেক্সিবল। একসময় এমন হয়ে গিয়েছিল যে, তার পক্ষে কোনোকিছুই আর অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। তার দুর্বলতা ছিল না যে এমন নয়। তবে এগুলো ছিল আপেক্ষিক। তিনি দ্রুতই নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে পারতেন। যেকোনো সমস্যা খুঁজে বের করে ২-৩ মাসের মধ্যে তা ঠিক করে ফেলার সক্ষমতা ছিল তার। এ কারণেই তিনি ফাস্ট-চেঞ্জিং।
১৪. ভ্লাদিমির ক্রামনিক (২০০০-০৭)
১৯২৭ সালে অ্যালিয়েইখিন, ১৯৩৫ সালে ম্যাক্স উ যা করেছিলেন, তেমনি নতুন সহস্রাব্দের প্রারম্ভে একইভাবে দাবা-দুনিয়াকে অবাক করে চ্যাম্পিয়ন হন ভ্লাদিমির বরিসোভিচ ক্রামনিক। দ্য গ্রেইট ক্যাসপারভকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজের আগমন জানান দেন এই রুশ। এরপর পিটার লেকো (২০০৪) এবং ভেসেলিন তোপালভ (২০০৬)-এর বিরুদ্ধে টাইটেল ডিফেন্ড করেন ক্রামনিক, শেষতক আনন্দের কাছে (২০০৮) পুরোপুরি হস্তান্তর করেন বিজয়ীর ব্যাটন। তিনি যেন ছিলেন এক বরফমানব, গ্লেসিয়ারের খাতের মতো ভয়ঙ্কর যার প্লেইংস্টাইল।
নিজের সেরা দিনগুলোতে ক্রামনিক ছিলেন প্রায় অজেয়, কিন্তু তার অর্জনগুলো বাকিদের থেকেও একটু বেশিই অনন্য। কেননা, তাকে লড়তে হয়েছে তার শারীরিক নানা জটিলতার সাথেও। মাসের পর মাস খাবার খেতে পারেননি- এমন সময়ও কেটেছে এই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিল ভ্লাদের সময়, কদর্য দাবা রাজনীতির ছোবলও সামাল দিতে হয়েছে তাকে।
২০০৬ সালেই তোপালভকে হারিয়ে দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ (ক্লাসিক্যাল দাবা এবং ফিদে দাবা) একীভূত করেন তিনি; এটা ছিল দাবার জন্য, পুরো বিশ্বের দাবাপ্রেমীদের জন্য অনেক দরকারি এক কাজ। এ ব্যাপারে ক্রামনিক চেস ডট কমের ডেভিড কক্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
এটা কঠিন এক সময় ছিল, তখন আমি ছিলাম সদ্য তরুণ। ভাবতে অবাক লাগে এতদিন পর এসে সেই দিনগুলোর কথা। অহংকারী শোনাতে পারে, কিন্তু দাবায় আজকের যে স্থিতাবস্থা, চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেল থেকে শুরু করে সবকিছু যে নিয়মের মধ্যে চলছে, এর অন্যতম কৃতিত্বও আমার। কোনো ব্যক্তিবিশেষকে দোষ দিতে চাই না, তবে নব্বইয়ের দশক থেকেই দাবার দুনিয়ায় বেশ কিছু সমস্যার উদ্ভব ঘটেছিল। বছরে মাত্র চারটা মেজর হতো, চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেল ভেঙে পড়েছিল ইত্যাদি। আর তখন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আমার জন্য জরুরি ছিল সবকিছু একটা কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসা। হ্যাঁ, অবশ্যই কাজটা সহজ ছিল না, এত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছে যা বলার মতো না। তবে এত কিছুর পরও আমি খুশি, কারণ আমার কাজটা আমি করতে পেরেছি। কালকে যদি দশটা পত্রিকাও ছাপে যে ‘ক্রামনিক নির্বোধ’, তাতেও আমি বিন্দুমাত্র টলে যাব না। কারণ, আমার পজিশন থেকে ঠিক কাজটাই আমি করেছি।
১৫. বিশ্বনাথন আনন্দ (২০০৭-১৩)
ক্রামনিক তার মুকুট হারান ২০০৭ সালে, সেবার এক টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নির্বাচনের জন্য। বিশ্বনাথন আনন্দ সেই টুর্নামেন্ট জিতে রাজমুকুট নিজের করে নেন। ইতিহাসে সেবারই প্রথম কোনো চ্যাম্পিয়ন টুর্নামেন্টের মাধ্যমে তার টাইটেল হারান, ফলত পরের বছর ক্রামনিক রিম্যাচ পান। কিন্তু সেটিও জিতে আনন্দ খেতাবটি পুরোপুরি নিজের করে নেন। আনন্দ সুপরিচিত তার খেলার স্পিডের কারণে, তার হাত ধরেই ভারতে দাবার জোয়ার আসে। এখনকার ভারত যে কোটি কোটি দাবাভক্তের দেশ, তার কৃতিত্ব আনন্দেরই।
ব্র্যাড অ্যাশলক বিশ্বনাথন আনন্দের অসাধারণ এক পোর্ট্রেট এঁকেছেন, যা মর্মার্থে ভরপুর। এই ছবির রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যেমন তার ভারতীয় উপমহাদেশকে নির্দেশ করে, তেমনি তার দাবার প্লেইংস্টাইলকেও বুঝায়। আবার তার নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক-বাহক অনন্য কিছু উপকরণও স্থান পেয়েছে ছবিতে। সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করা হয়েছে, তা হলো- প্রাচীন ভারতীয় দাবার ঘুঁটি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আধুনিক দাবায় বিশপ বলতে যাকে বোঝায়, ভারতীয় দাবায় সেটি হলো গজ, হস্তী, বা সোজা বাংলায় হাতি। এই সবের মিশেলে দারুণ এক পোর্ট্রেট এঁকেছেন অ্যাশলক।
১৬. ম্যাগনাস কার্লসেন (২০১৩-বর্তমান)
অনেকের মতেই, সর্বকালের সেরা দাবাড়ু বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সভেন ম্যাগনাস ওয়েন কার্লসেন। সদ্য তিরিশে পা দেয়া কার্লসেন এখন কেবলই ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে, আরও অনেক কিছু দাবায় দেয়ার আছে তার। আরও অনেক কীর্তি গড়ে শেষতক অবসর নেবার সময় হয়তো সবাই সেরাদের সেরা হিসেবেই মেনে নিবে তাকে। বালক ম্যাগনাস ছোট থেকেই ছিলেন প্রডিজি, গিফটেড চাইল্ড হিসেবে তার বাবা-মা শিশুকাল থেকেই তার বিশেষ যত্ন নিতে থাকেন। কার্লসেনের অর্জনের ফিরিস্তি বলা শুরু করলে শেষ করা মুশকিল।
১৩ বছর বয়সে ম্যাগনাস কার্লসেন গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম অর্জন করেন, মাত্র ১৫ বছর বয়সে নরওয়েজিয়ান চেস চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৮ সালে লেভন অ্যারোনিয়ানের সাথে যৌথভাবে টাটা স্টিল চেস চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফিদে রেটিং-এ ২৮০০ পয়েন্ট অর্জন করেন এবং ফিদে র্যাঙ্কিং-এ শীর্ষে আরোহণ করেন মাত্র ১৯ বছরেই! ম্যাগনাসের এই দুটি অর্জন (কনিষ্ঠতম ২৮০০ রেটিং এবং ফিদে র্যাঙ্কিং-এ ১ম) অদ্যাবধি বিশ্বরেকর্ড হয়ে আছে! ২০১৩ সালে বিশ্বনাথন আনন্দ হারিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবার রাজমুকুট নিজের হস্তগত করেন তিনি। পরের বছর দাবার র্যাপিড এবং ব্লিটজ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ইতিহাসে প্রথম এবং একক কোনো দাবাড়ু হিসেবে দাবার ৩ ফরম্যাটেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৯-এ এসে এ অর্জন আবারও পুনরাবৃত্তি করেন এই নরওয়েজিয়ান।
ম্যাগনাস সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ইলো রেটিং (দাবায় সেটিই ফিদে রেটিং) এর মালিক, যা (২৮৮৩) এমনকি গ্যারি ক্যাসপারভের থেকেও বেশি। ক্লাসিক্যাল দাবায় আজপর্যন্তও ম্যাগনাস কার্লসেন তার মুকুট ধরে রেখেছেন। ২০১৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে আনন্দের সাথে জয়ের পর, ২০১৪-তেও তার সাথেই জয় পান তিনি। ২০১৬ সালে রুশ দাবাড়ু সার্গেই কারিয়াকিন এবং ২০১৮ সালে মার্কিন দাবাড়ু ফাবিয়ানো কারুয়ানার বিরুদ্ধেও টাইটেল সফলভাবে ডিফেন্ড করেন ম্যাগনাস। দ্রুতগতির দাবায় ম্যাগনাসের দক্ষতা তাকে র্যাপিড ও ব্লিটজ টাইব্রেকগুলোতে জিততে সহায়তা করেছে, এবং তার মাধ্যমে মূল ম্যাচ ড্র হলেও ম্যাগনাস টাইটেল ডিফেন্ড করতে সক্ষম হয়েছেন টাইব্রেকে জিতে। এ বছর নভেম্বরে দুবাইয়ে রুশ দাবাড়ু ইয়ান নেপোমনিয়াশির সাথে ম্যাগনাসের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচের অপেক্ষায় এখন পুরো দাবাবিশ্ব।
ওপেনিং, মিডলগেম আর এন্ডগেমের মধ্যে মিডলগেমই বেশি পছন্দের ম্যাগনাসের কাছে। কারণ, এখানেই প্রকৃত সৃজনশীলতা দেখানোর সুযোগ আসে দাবাড়ুদের সামনে। এক সাক্ষাৎকারে ম্যাগনাস বলেন, “আমি মিডলগেম সবচেয়ে ভালবাসি, কারণ এখানেই আপনি খাঁটি দাবার স্বাদ পাবেন। “
ম্যাগনাস কার্লসেনের এই চিত্রে ব্র্যাড অ্যাশলক তার পাশাপাশি স্থান দিয়েছেন কিছু প্রাচীন ঘুঁটি, যেগুলো লুইস চেসম্যান নামে খ্যাত। এই দুইয়ে ভালো খাপ খেয়েছে, কেননা উভয়েরই যে রয়েছে অভিন্ন নর্ডিক অরিজিন। ভাইকিং পাওয়ার যেন সর্বশক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে দাবাবিশ্বকে অধিগ্রহণ করতে!