বছর খানেক আগের কথা। লিটন কুমার দাস শুরুতে যে চমক দেখিয়েছিলেন, সেই চমক ম্লান হতে সময় নেয়নি। পারফরম্যান্সের বেহাল দশায় ছিটকে গেলেন জাতীয় দল থেকে। সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে বললেন, “বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়। আমি যেদিন পারফরম্যান্স করতে পারব, ভালো রান করব সেদিন সাক্ষাৎকার দেব।”
লিটনের সেই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। তিনি কয়েক দফা যেমন ফিরেছেন, তেমনই হারিয়ে গেছেন। আবার কখনো মনে রাখার মতো ইনিংস খেলে মন ভরিয়েছেন সমর্থকদের। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে, প্রয়োজনের তুলনায় তা বেশ নগণ্য।
শুধু লিটন দাস নয়। বাংলাদেশের একমাত্র টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট সাব্বির রহমান কিংবা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, সৌম্য সরকার থেকে এনামুল হক বিজয়; শুরুটা দারুণ ঝলমলে হলেও দিন শেষে তাদের ব্যর্থতার সূর্য ডুব দিয়েছে অস্তাচলে। বল হাতে মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজরা নিজেদের নামের ‘মুখ রক্ষা’ করলেও, কখনো কখনো তাদেরকেও ভুগতে হয়। তরুণরা যেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে সুবিধাই করতে পারছে না। দিন শেষে কেবল একাদশ মেটানোর দায়ে নির্বাচকদের ভুগতে হচ্ছে। যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলুক না কেন, ভরসা সেই পঞ্চ পাণ্ডবে।
পঞ্চ পাণ্ডব? মাশরাফি বিন মুর্তজা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। এই পাঁচে মিলে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পঞ্চ পাণ্ডব। তিন ফরম্যাটেই যাদের কাঁধে চড়ে যেন বেঁচে আছে দলের বাকি সদস্যরা। অথচ, তরুণদের যে সামর্থ্য নেই তেমনও নয়। ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিজেদের প্রমাণ করেই এই প্রতিযোগিতার লড়াইয়ের সব ধাপ পার করে এসেছেন তারা। কিন্তু দেশের জার্সিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গিয়ে ফুল ফোটানো শুরুর পর ঝরে যেতে হচ্ছে অচিরেই।
অবস্থাটা এমন যে দলের এই পাঁচ জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার ব্যর্থ হলেই যেন হারটা নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য। এভাবে চলতে থাকলে পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের বিদায়ের পর কী করুণ অবস্থা হবে বাংলাদেশের, তা অনুমান করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
১
শেষ ১০ ওয়ানডের পরিসংখ্যান বলছে, কেবল তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিব আল হাসান মিলে যে রান করেছেন, সেই রান বাকি সবাই মিলে কোনো ম্যাচেই পার করতে পারেনি। মাশরাফিসহ এই পাঁচজনের বাইরে সেঞ্চুরি আছে কেবল একটি। সেটি এসেছিল লিটনের ব্যাটে। হাফ সেঞ্চুরি একটি যা এসেছে ইমরুল কায়েসের কাছ থেকে। যদিও তাকে তরুণদের কাতারে ফেলা যায় না। অন্যদিকে, সমান ম্যাচে বড়দের ব্যাটে এসেছে ১৪ হাফ সেঞ্চুরি, ৩ সেঞ্চুরি! অর্থাৎ, বড়দের ধারে কাছেও নেই তরুণ ব্যাটসম্যানরা। যদিও বোলিংয়ে এই চিত্রটা একটু হলেও ভালো অবস্থায় আছে।
তরুণদের বেহাল দশার পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনা নতুন নয়। কিন্তু চলমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম বাংলাদেশ সিরিজে সাব্বির-বিজয়-মোসাদ্দেকদের নিষ্প্রভ ব্যাটিংয়ে দলকে যে পরিমাণ মূল্য দিতে হয়েছে, তাতে বিতর্কের আগুন উসকে গেছে। বিশেষ করে গায়ানার প্রোভিডেন্স স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিব-তামিম-মুশফিক-রিয়াদদের ব্যাটে জয়ের খুব কাছে টেনে নেওয়ার পরও সাব্বির রহমানের অসময়ে আউট হয়ে আসা বেশ চোখে লেগেছে। মাত্র ৩ রানে হেরেছে বাংলাদেশ দল। মোসাদ্দেক হোসেন তো আরও একধাপ এগিয়ে। শেষ ওভারে পরপর দুটি বলে কোনো রানই তুলতে পারেনি।
একই অবস্থা হয়েছিল নিদাহাস ট্রফিতে। সেখানেও ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল তরুণরা। সেবার দেশে ফিরে খালেদ মাহমুদ সুজন বলেছিলেন,
আমরা খুবই উদ্বিগ্ন যে আমাদের তরুণ খেলোয়াড়রা একেবারেই ধারাবাহিক হতে পারছে না। শেষ কয়েক বছর রিয়াদ, মুশফিক, তামিম যেভাবে পারফর্ম করেছে, জুনিয়র প্লেয়াররা সেভাবে করতে পারেনি। লিটন কুমার দাস, সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকাররা যদি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারত তাহলে আমরা পরের সিরিজে বড়দের মধ্যে দুয়েকজনকে বিশ্রাম দিতে পারতাম। এটা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার।
সৌম্য সরকারের অবস্থা মাঝে খুব একটা ভালো ছিল না। দল থেকেও বাদ পড়েছিলেন। তার জায়গায় ফিরলেন এনামুল হক বিজয়। যে কারণে বিজয়কে দলে নেওয়া হলো, তিনি তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ভরসা রাখছেন তার উপর। কারণ একটাই, তরুণ ক্রিকেটাররা দুয়েক ম্যাচ খারাপ করলেই তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশ ক্রিকেটে রয়েছে, সেটাকে বদলাতে চান অধিনায়ক। ভরসা রাখতে চান বিজয়ের উপর।
কিন্তু ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টি সিরিজে তাকে আর পাওয়া যাবে কিনা, সে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এরই মধ্যে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে বাদ পড়া সৌম্যকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দলের কাছে। টিম ম্যানেজমেন্ট নাকি তাকে খুব করে চেয়েছে। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু এ প্রসঙ্গে বলেন,
দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা ম্যানেজমেন্টের জন্য একটা জায়গা রাখি সব সময়। ওদের চাহিদা অনুযায়ীই দলে নেয়া হয়েছে সৌম্যকে। আমাদের আলাদা পরিকল্পনা ছিল তাকে নিয়ে। ‘এ’ দলের যথেষ্ট খেলা আছে সামনে। শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষেও খেলেছে সে। তারপরও আমি আশাবাদী সে ফর্মে ফিরে আসবে।
২
দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম ভয়। বিশেষ করে নতুনদের মধ্যে যেন এটা আরো বেশি। এর পেছনে নিজেদের যেমন অবহেলা আছে, তেমনই দায় আছে বোর্ডেরও। যে ক্রিকেটার আজ অভিষেক করছেন, তিনিও নিশ্চিত থাকেন যে আজ খারাপ করলে আগামীকাল দল থেকে ছিটকে যেতে হবে। শুধু তাই নয়, ছিটকে যাওয়ার পর দলে ফেরার যে রাস্তা; সেটাকে একরকম অসাধ্যই বলা চলে। বয়স বেশি হলেও রয়েছে সমস্যা, কম বয়স হলেও সমস্যা। তখন বোর্ডের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, এখনও বয়স কম তার সুযোগ আছে তাকে আমরা নজরে রেখেছি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই অবস্থার পরিবর্তন চাইছেন স্বয়ং নির্বাচকরাই। বিশ্বাস রাখতে চাইছেন নতুনদের উপর। তাতে করে সুবিধা হচ্ছে না। আফগানিস্তান সিরিজের আগেও এ নিয়ে তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল নান্নুকে। আফগানিস্তান সিরিজের আগেও সৌম্যকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। নিদাহাস ট্রফিতে বাজে পারফরম্যান্স করার পরও কেন তাকে দলে নেওয়া? উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
টি-টোয়েন্টিতে আমরা যতগুলো খেলোয়াড়কে নিয়ে চিন্তা করি, তার কথাটা সবার আগে চলে আসে। বিষয়টি নিয়ে আমরা অধিনায়ক ও কোচের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। ওরা সৌম্যর ব্যাপারে ইতিবাচক ছিল। কোর্টনি ওয়ালশের সঙ্গে তো আমাদের কথা হয় সবসময়ই। যেহেতু ও নিদাহাস ট্রফিতে ছিল, ওর সাজেশনটাও আমরা নিয়েছি।
কিন্তু এভাবেই কি চলতে থাকবে সবকিছু? তরুণদের মূল সমস্যা কোথায়? এক্ষেত্রে বিসিবির গেম ডেভলপমেন্ট কমিটির ম্যানেজার ও কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম দায় দিচ্ছেন সিস্টেমকে। তার মতে, নতুনরা বড়দের ছায়ায় তৈরি হয়েছে, হচ্ছেও। কিন্তু তাদেরকে কোনো কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর নিয়মিত সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাদেরকে নেতা হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। রোর বাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন,
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, কেন যেন মনে হয় যারা নতুন এসেছে তাদেরকে আমরা লিডার হিসেবে গড়ে তুলিনি। ওদেরকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ রোল দিয়ে দিয়ে সেই দায়িত্বটা আমরা গড়ে তুলিনি। ওরা অন্যদের ছায়ায় বড় হচ্ছে। কিন্তু যখন ওদের নিজেদের উপর দায়িত্বটা বর্তাচ্ছে, তখন কিছুটা হলেও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ছে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। আমরা যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানটাকে (হেটমায়ার) দেখি, ওর শরীরী ভাষা; ওর মধ্যে যে দায়িত্ব নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে, সেটা কিন্তু আমাদের নতুন ছেলেদের মধ্যে পাচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন,
এটা প্লেয়ারদের দোষ না কিন্তু! আমি বলব আমাদের সিস্টেমই হলো এমন। ওরা স্বাধীনভাবে তৈরি হচ্ছে না। ওরা অন্যদের ছায়ায় তৈরি হচ্ছে। ওদেরকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিচ্ছি না, গুরুত্বপূর্ণ পজিশন দিচ্ছি না। আমরা বলছি না যে, তোমাদের উপর আমরা নির্ভরশীল। আমি কেবল জাতীয় দলের কথাই বলছি না, ঘরোয়ার কথাও বলছি, ইন্টারন্যাশনাল খেলার কথাও বলছি। তো ওদেরকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো সামলাতে দিতে হবে। ওদেরকে স্বাধীনতা দিতে হবে, দায়িত্ব দিতে হবে। তাহলে বোধ হয় আমরা নিজেদেরকে আরেকভাবে উপস্থাপন করতে পারব।
মাশরাফি অবসরে যেতে পারেন ২০১৯ বিশ্বকাপের পরই। বাকি যে চারজন; তারাও ব্যাট-প্যাড তুলে রাখবেন বছর পাঁচ কিংবা ছয়েকের মধ্যে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে যদি তরুণরা নিজেদের গড়ে তুলতে না পারে, নতুন প্রজন্মের সাকিব-মাশরাফি হতে না পারে তাহলে ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশ যে তিল তিল করে আজকের অবস্থানে, সেটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তাই, খুব দ্রুতই বোধ হয় আরেক পঞ্চ পাণ্ডব তৈরি করার সময় হয়েছে।
ফিচার ইমেজ- CWI