ছিলেন স্পেন জাতীয় দলের কোচ।
তার অধীনে বাছাইপর্বে স্পেন ছিলো অপরাজেয় এক দল। তাই স্পেনকে বিশ্বকাপে ফেবারিট মনে করা হচ্ছিলো। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র দুই দিন আগে সব ওলটপালট হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই স্পেন কোচ হুলেন লোপেতেগেকে নিজেদের পরবর্তী কোচ হিসেবে ঘোষণা করে দিলো রিয়াল মাদ্রিদ। এই ঘোষণা হজম করে ওঠার আগেই, পরদিন খেলোয়াড়দের সাথে বৈঠক করে লোপেতেগেকে দল থেকেই ছাটাই করে দিলেন স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি; বিশ্বকাপ শুরু হতে তখন আর একদিন বাকি!
এই নাটকীয়তার রেশ এখনও শেষ হয়নি। স্পেন বাজেভাবে বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে। এখনও স্প্যানিশরা মনে করেন, এই লোপেতেগে কান্ড না ঘটলে স্পেনের বিশ্বকাপে এমন ধ্বস নামতো না। এখনও এই ঘটনা নিয়ে অনেক আফসোস আছে। কিন্তু বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদ কোচ স্বয়ং লোপেতেগে বলছেন, এই ঘটনা নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই। বরং এরকম সুযোগ আবার আসলে তিনি এরকম কাজই করবেন বলে জানিয়ে দিলেন, “আমি খুব সরলভাবে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। আর এরকম সিদ্ধান্ত আবারও নেবো। আমি সততার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই।”
রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের প্রস্তাব পেয়ে কেন “না” বলতে পারেননি, সেটাই বলে দিলেন লোপেতেগে, “মাদ্রিদ সম্প্রতি আরও বড় দলে পরিণত হয়েছে। এটা সবসময়ই বিশেষ একটা দল ছিলো। এখন নতুন এসব ট্রফি দলটাকে আরও বিশেষ কিছুতে পরিণত করেছে। একুশ শতকের সেরা দল তারা।”
“আমার নিজের জন্য এখন দায়িত্বটা হলো এই দারুন দলটাকে জয়ের জন্য তৈরি করা। এখানে দায়িত্বটা স্পেন কোচের থেকে একেবারেই ভিন্ন।”
লোপেতেগে এখন রিয়াল মাদ্রিদে সুখে আছেন। কিন্তু স্পেন দলটা এখনও বিশ্বকাপের সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। স্পেনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাবেক বার্সেলোনা কোচ লুই এনরিকেকে।
স্পেন দলের বর্তমান অবস্থাও অবশ্য লোপেতেগেকে কোনোরকম আফসোসে ভোগায় না। তিনি বলছিলেন, “অবশ্যই না (আফসোস নেই)। আমি মাদ্রিদে অনুশীলন করাতে পেরে খুশি আছি। আমাদের এখন সামনে অসাধারণ চ্যালেঞ্জ আছে, দারুন লক্ষ্য আছে। আর আমি লুইস এনরিকের সাথে জাতীয় দল খুব ভালো করবে বলেই আশাবাদী।”
“আমি সবসময় স্পেন দলের একজন সমর্থক হয়েই থাকবো। কিন্তু ওই অধ্যায় আমার জন্য অতীত হয়ে গেছে। এখন আমি আমাদের (রিয়ালের) লক্ষ্য নিয়ে মনোযোগী, যেটা আসলে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা সবাই আসলে এখন আমাদের কী করতে হবে, সে নিয়ে মনোযোগী। অতীত আসলে অতীত হয়ে গেছে।”
হ্যাঁ, এর মধ্যেও হয়তো একটু দুঃখ লোপেতেগের আছে। যেভাবে তিনি বিদায় নিয়েছেন স্পেন দল থেকে, সেটা না হলেও পারতো। তারপরও এই কোচ বলছিলেন, “যেভাবে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা তো বদলানো যাবে না। আমি তাই পেছন ফিরে তাকাই না। আমি আমার এখানে প্রথম দিনেই বলেছিলাম যে, আমার কেমন লাগছে। এখনও তেমনই অনুভূতি হচ্ছে। আমি যা করেছি এবং যা বলেছি, এ নিয়ে আমার কোনো অস্বস্তি নেই। এখন আমি স্রেফ বর্তমান নিয়ে ভাবতে চাই। আমি বুঝি যে, আমরা সঠিক কাজটা করেছিলাম। মানে, আমি ও মাদ্রিদ দল এরকম পরিস্থিতিতে আবার এটাই করবো।”
এই সবকিছুর মধ্যে এখনও বড় একটা আগ্রহ থেকে গেছে, গোপনে গোপনে চলা রিয়াল মাদ্রিদের সাথে লোপেতেগের সেই আলাপ নিয়ে। এই ব্যাপারটা নিয়েই স্পেন ফেডারেশন সভাপতি বেশি আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু লোপেতেগে সেই অধ্যায় নিয়ে পরিষ্কার কিছু বলতে রাজী নন, “আমি এখন আবার পেছন ফিরে যেতে চাই না এবং ব্যাখ্যা করতে চাই না যে, প্রতিদিন কী ঘটেছিলো। যা ঘটেছে, ঘটেছে। এখন ওই পৃষ্ঠা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা বলেছি, কেন এটা করেছি। আমরা সবাই মনে করেছি, এটা সঠিক ছিলো।’
“আমি পরিস্থিতিটা সবাইকে বুঝিয়ে বলেছি। মাদ্রিদে আমাকে অনেক বড় একটা দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। আমাকে জাতীয় দলে যারা সহায়তা করেছেন সেই সব খেলোয়াড়, স্টাফ, সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ; এটুকু বলতে পারি।”
“সে সময় আমরা যা করেছি, যা ঘটেছে, তার কোনো কিছুই আর এখন বসে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তাই আমি মাদ্রিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই যে, আমরা সবকিছু খুব সততার সাথে এবং দায়িত্ববোধের সাথেই করেছি।”
“সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে গিয়েছিলো। খেলোয়াড়রা সে সময় তা-ই করেছে যা করা উচিত ছিলো- তারা বিশ্বকাপে মন দিয়েছে। খেলোয়াড়দের সাথে আমার কী কথা হয়েছে, সে আমি এখন বলতে চাই না। ওটা আমার আর খেলোয়াড়দের বিষয়। আমি আবারও বলতে চাই, তখন আমি মনে করেছি যে, যা করছি, এটাই সঠিক করছি। আমি মাদ্রিদকে ‘না’ বলতে চাইনি। আমি মাদ্রিদকে ‘হ্যাঁ’ বলতে চেয়েছি এবং তাই বলেছি।’
এত দৃঢ়তার সাথে সব কথা বললেও এটা লোপেতেগে অস্বীকার করতে পারলেন না যে, স্পেনের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে তার বিদায় নেওয়াটা খুব আবেগী একটা ব্যাপার ছিলো। তিনি বলছিলেন, “সব বিদায়ের মতোই আমি সবাইকে বিদায় বলেছিলাম। এটা খুব আবেগী মুহুর্ত ছিলো, অপ্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু জীবনে এসব সময় সামলাতে হয়। আমাকে তাই করতে হয়েছে। আপনার ভেতরে এই অনুভূতি থাকবে। লোকেদেরও অধিকার আছে ভেতরের কথাটা জানার। কিন্তু এগুলো খুবই ব্যক্তিগত অনুভূতি। তাই এগুলো আমি ব্যক্তিগতই রাখতে চাই। এখন নতুন করে এসব কঠিন করে তোলার আর কোনো অর্থ হয় না। এটা জীবনের অংশ।”
স্পেন দল ছেড়ে বিশ্বকাপের আগেই লোপেতেগে চলে এসেছিলেন মাদ্রিদে। বিশ্বকাপের মধ্যেই তার পরিচয়পর্ব শেষ হয়েছিলো। সেই প্রথম পরিচয়পর্বটা কেমন ছিলো, সেটাও বলছিলেন এই সাবেক স্পেন কোচ, “প্রেজেন্টেশন পর্বের পরই এখানকার ক্রীড়া সুবিধা দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা ১৫ আগস্ট যেসব খেলোয়াড় এখানে ছিলো, তাদের নিয়ে কাজ শুরু করলাম। যারা বিশ্বকাপে ছিলো এবং ধারে অন্যান্য ক্লাবে ছিলো, তাদের পাইনি। এটাই আসলে হয় শুরুতে। কেউ কেউ থাকে, কেউ কেউ থাকে না।”
“আমি প্রথম দিন যখন শুরু করলাম, তখন আসলে এদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমি কিভাবে কাজটা করতে চাই, আমি ফুটবল ব্যাপারটাকে কিভাবে দেখি এবং কিভাবে এই খেলোয়াড়দের সাথে মানিয়ে নিতে চাই। খেলোয়াড়রা আস্তে আস্তে সবাই পৌঁছে গেলো। কিছু খেলোয়াড় ছিলো, যারা আমাকে আগে থেকে চিনতো। এটা একটা সুবিধা হয়েছিলো।”
সব খেলোয়াড়কে পেলেও শেষ অবধি দলের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়টিকে পেলেন না লোপেতেগে। তার আসার শুরুতেই দল ছেড়ে চলে গেলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। লোপেতেগে বলছিলেন, তিনি রোনালদোর সাথে তার দলবদল নিয়ে আলাপ করার সুযোগ পাননি, “আমি তার সাথে এ নিয়ে কথা বলতে পারিনি। এরকম একটা অবস্থা ছিলো, আমি যখন এসেছি, তার আগেই সে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ক্লাব তার এই অসাধারণ খেলোয়াড়টির সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। তারা এই খেলোয়াড়ের ইচ্ছার পক্ষে থেকেছে।”
শেষ অবধি এখন মাদ্রিদ যেমন আছে, তা নিয়েই সুখে থাকতে চান লোপেতেগে। ভুলে যেতে চান স্পেন অধ্যায়। কিন্তু আসলেই ভুলতে পারবেন কি না, সেটা সময় বলবে।