“এমনও মায়াবী রাতে রাত আসে শুধু নেমে…”
সত্যিই তো। একজন মানুষের সারাজীবনের অপূর্ণতায় সমাপ্তি টানার রাত, একটা দেশের ছত্রিশ বছরের দুঃখ মোচনের রাত, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ভক্ত-সমর্থকের স্বপ্নপূরণের রাত, এই রাত তো মায়াবী রাতই। অনিঃশেষ গল্পের উপলক্ষ্য তৈরি করে, অনির্বচনীয় অনুভূতি ছড়িয়ে, অনন্ত আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিয়ে নেমে এসেছিল এউ রাতটা, আঠারো ডিসেম্বরের এই রাতটা, যে রাতে আক্ষরিক অর্থেই ফুটবলীয়-অমৃতসুধায় শেষ চুমুক দিয়েছেন লিওনেল মেসি নামের এক জাদুকর।
অমৃতের স্বাদটা তিনি পেয়েছেন অনেক আগেই। পঁচিশ পেরোতে না পেরোতেই অর্জন করেছেন সম্ভাব্য ব্যক্তিগত আর দলীয় সকল স্বীকৃতি। পরে ব্যালন ডি’অর, ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার, গোল্ডেন বুট, সেরা প্লেমেকারের পুরস্কার, অথবা ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে সম্ভাব্য সকল দলীয় শিরোপা জিতেছেন মেসি। তবুও গলার কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপার অভাব। সেই অভাবও পূরণ হয়ে গেলো এই শতাব্দীর একুশ আর বাইশতম বছরে এসে। ’১৪ থেকে ’১৬ এর টানা তিনটা ফাইনালে পরাজয়ের দুঃখটা মুছে গেল টানা দুই বছরে পরপর তিন ফাইনালে কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমা আর বিশ্বকাপ জয়ে। শোকগাথা হাতে বহুদূর গেলে তাহলে আসলেই একদিন হাসিমুখের দেখা মেলে!
বিশ্বকাপের আগের সাড়ে তিন বছর কোনো ম্যাচ না হেরে, টানা ছত্রিশ ম্যাচে অপরাজিত থেকে, সমর্থকদের প্রত্যাশার বেলুনে পর্যাপ্ত বাতাস ভরেই কাতারের বিমানে উঠেছিলেন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা। কিন্তু প্রত্যাশার ঐ বেলুনে ফুটো হতে সময় লাগলো মাত্র একটা ম্যাচ। প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের বিপক্ষে হোঁচট। শুধু হোঁচট নয়, রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়লো ‘মহাপরাক্রমশালী’ আর্জেন্টিনা। ২-১ ব্যবধানের ঐ পরাজয়ে হঠাৎ যেন আর্জেন্টিনার সব দুর্বলতা উন্মোচিত হয়ে পড়লো। স্ট্রাইকার লাউতারো মার্টিনেজ তাঁর ফর্ম হারালেন, চোটের কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়া জিওভান্নি লো চেলসো, নিকো গঞ্জালেস, আর হোয়াকিন কোরেয়ার অভাবটা আরো বেশি করে চোখে পড়তে লাগল। ‘বুড়ো’ আনহেল ডি মারিয়া ছাড়া দলে কোনো নিয়মিত উইঙ্গার নেই, বিশ্বমানের ফুলব্যাক নেই, মাঝমাঠে পরীক্ষিত ব্যাকআপ খেলোয়াড় নেই। এতদিনের ফিসফিসানিগুলো যেন চিৎকারে রূপ নিল, বিশ্বমঞ্চে অনভিজ্ঞ স্কালোনিও পড়লেন তোপের মুখে। আসলেই তিনি পারবেন তো দুর্গম হয়ে যাওয়া এই পথে তার ‘লা স্কালোনেতা’কে চালিয়ে নিতে!
পরের ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে যখন প্রথমার্ধটা থেকে গেল গোলশূন্য, আর্জেন্টিনা ভক্তরা তখন মোটামুটি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি ফেরার মনস্থির করে ফেলেছেন। এমনই এক ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে পাল, ভুলিতেছে মাঝি পথ’ মুহূর্তে আগুয়ান হয়ে আর্জেন্টিনাকে পথ দেখাতে এলেন কাণ্ডারী স্বয়ং, লিওনেল মেসি। মেক্সিকোর রক্ষণের মুহূর্তের অসচেতনতায় বক্সের বাইরে ফাঁকায় বল পেলেন মেসি, তারপরই বুম! তীব্রগতির শটটা যখন গিয়ের্মো ওচোয়াকে পরাস্ত করছে, আর্জেন্টিনার নৌকাও তখন ছুটতে শুরু করেছে নিজের পথে।
আর্জেন্টিনাকে গত এক দশকে অনুসরণ করছেন, এমন যে কারোর জন্য এই দৃশ্য অতি পরিচিত। যখনই বিপদে পড়েছেন আকাশি-সাদারা, যখনই হুমকির মুখে পড়েছে তাদের সম্মুখ পথচলা, তখনই ত্রাতা হয়ে এসেছেন মেসি। নিজের কাঁধে বয়েছেন আর্জেন্টিনাকে, বাছাইপর্বে, কোপা আমেরিকায়, বিশ্বকাপে। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও। ইকুয়েডরের বিপক্ষে বাছাইপর্বের বাঁচামরার ম্যাচে যেমন হ্যাটট্রিক করে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছেন, তেমনি বোর্ডের তীব্র আর্থিক সংকটের সময়ে সাহায্য করেছেন নিজে। আবার দলকে যেমন তুলেছেন কোপা আমেরিকা আর বিশ্বকাপের ফাইনালে, তেমনি লাভেজ্জির বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে আসা মিথ্যা অভিযোগের প্রতিবাদে সদলবলে বয়কট করেছেন মিডিয়াকে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে গোল করে বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়ের লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে, আবার বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া শীতল সম্পর্কের মধ্যেও নিজে দাঁড়িয়েছিলেন যোগসূত্র হয়ে।
সেই লিওনেল মেসিও বারবার মাথা নিচু করেই বিদায় নিচ্ছিলেন আন্তর্জাতিক আসরগুলো থেকে। তবে ’১৮ বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর যখন কোচের আসনে বসলেন মেসিরই একসময়ের সতীর্থ লিওনেল স্কালোনি, মেসি হয়তো শেষবারের মতো আশার আলো দেখতে পেলেন। স্কালোনিও দলে থাকা ‘বৃদ্ধ’দের ধীরে ধীরে সরিয়ে সঞ্চালন করতে লাগলেন নতুন রক্ত। মেসি, আনহেল ডি মারিয়া, সার্জিও আগুয়েরো আর নিকোলাস ওটামেন্ডি ছাড়া সরে যেতে হলো পুরনো প্রায় সবাইকেই।
এতে করে দুটো লাভ হলো। একে তো স্কালোনি নতুন করে দল গড়ার কাজ শুরু করতে পারলেন। আবার নতুন প্রজন্ম হিসেবে যারা দলে এলেন, তাদের প্রত্যেকেই যেহেতু মেসিকে আদর্শ মেনে ফুটবল খেলছেন, সেই মেসিকে ড্রেসিংরুমের নেতারূপে পেয়ে তারা উদ্বুদ্ধ হলেন নতুনভাবে। রদ্রিগো ডি পল তো মেসির জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন, এমিলিয়ানো মার্টিনেজ প্রস্তুত হয়ে গেলেন মেসির জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে। যেন থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের সেই অমর আপ্তবাক্যই হয়ে গেল আর্জেন্টাইনদের মূলমন্ত্র, ‘ওয়ান ফর অল, অ্যান্ড অল ফর ওয়ান’।
এর ফলাফলটা পাওয়া গেল দুই-তিন বছর পরে। ২০২০ সাল থেকেই আর্জেন্টিনা দল হিসেবে ভালো ফলাফল পেতে শুরু করে, এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ এর কোপা আমেরিকার শিরোপাও উঠে পড়ে বুয়েনোস আইরেসের বিমানে। গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুটজয়ী মেসিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার আটাশ বছরের শিরোপাখরা ঘোচানোর কাজে, কিন্তু রদ্রিগো ডি পল, লাউতারো মার্টিনেজ, এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, নিকোলাস ওটামেন্ডি, ক্রিস্টিয়ান রোমেরোরাও রেখেছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আত্মবিশ্বাসী, অপরাজিত আর্জেন্টিনা পরের বছর জিতে নেয় ফিনালিসিমাও। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মেসির ওপর অতিনির্ভরতা কাটিয়ে মেসির কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে থাকেন কোচ স্কালোনি।
এই ব্যাপারটাই দেখা যায় বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে। মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করে বসেন মেসি। একটু সন্দেহ আর সংশয়ের মেঘ হয়তো তখন ঘিরে ধরছিল আর্জেন্টিনার শিবিরকে, কিন্তু সেই দোলাচলের মেঘকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিলেন আলেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টার আর জুলিয়ান আলভারেজ। প্রথম পর্ব থেকে বিদায়ের শঙ্কায় থাকা আর্জেন্টিনা পরের রাউন্ডে উঠে যায় গ্রুপসেরা হয়েই, সাথে একটা ঘোষণাও চলে আসে সবার অলক্ষ্যে, “এই আর্জেন্টিনা পথ হারাবে না!”
এরপর শেষ ষোলোতে আলভারেজের ঝলক, লিসান্দ্রো আর এমিলিয়ানোর সাহসিকতা, কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে এমিলিয়ানো-বীরত্ব, কিংবা সেমিফাইনালে আলভারেজের দুর্দান্ত দুই গোল, প্রতিটি ম্যাচের পরই একটা বিষয় ছিল সাধারণ – ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার গ্রহণ করছেন লিওনেল মেসি। আগে কোনো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গোল না পাওয়া মেসি এবার গোল পেয়েছেন প্রতিটি ম্যাচেই। এর সাথে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে নাহুয়েল মলিনাকে আর ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জুলিয়ান আলভারেজকে অ্যাসিস্ট করেছেন। প্রথমটা যদি হয় বন্দুকের গুলি করে আচমকা হতবুদ্ধি করে দেওয়া, দ্বিতীয়টা তবে বিষ মাখানো ছুরি দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে খুন করা। নাথান আকে আর ইয়োস্কো ভারদিওল, দু’জনেই নিশ্চয়ই কয়েক রাতে ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠেছেন স্বপ্নে, অথবা দুঃস্বপ্নে; মেসিকে ঐ অ্যাসিস্ট করতে দেখে।
তবুও, এসব রাস্তা তো মেসির চেনা। এই রাউন্ড অব সিক্সটিন, এই কোয়ার্টার ফাইনাল, এই সেমিফাইনাল পেরিয়েই তো ২০১৪ সালে উঠেছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেবারের অধিনায়কত্বের বাহুবন্ধনী পরা ‘ভালো ছেলে’ লিওনেল মেসি এবার অধিনায়ক ছাপিয়ে ‘নেতা‘। নকআউটে আগে কখনো গোলের দেখা না পাওয়া মেসি এবার গ্রুপপর্বের পরে ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন তিন গোল, তিন ম্যাচেই সেরা খেলোয়াড় তিনি।
শুধু মাঠের পারফরম্যান্সে না, মেসি রীতিমতো আগুন ঝরাচ্ছেন মাঠের বাইরেও। সতীর্থদের প্রতিনিয়ত উৎসাহ জোগাচ্ছেন, নেদারল্যান্ড ম্যাচে প্রতিপক্ষ কোচ লুই ফন হালকে উদ্দেশ্য করে উদযাপন করছেন, ডাচ ফরোয়ার্ড ওয়েঘোর্স্টকে রীতিমতো এক হাত নিচ্ছেন ম্যাচের পরে। সেই লিওনেল মেসিকে যখন প্রকৃতি দ্বিতীয় সুযোগ দিল, দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব আসরের সমাপনী মঞ্চে নামার ঐ সময়ে মেসি কি একটুও বাড়তি চাপ অনুভব করেননি? ফাইনালের আগের রাতটা কি অনন্তকালের সমান মনে হয়নি মেসির?
তবে ম্যাচের আগে যতই চিন্তা আসুক, ম্যাচের মধ্যে ওসব চিন্তার ছিঁটেফোঁটাও দেখা গেল না মেসির মধ্যে। বড় মঞ্চের বড় তারকা আনহেল ডি মারিয়া আর নতুন তারকা জুলিয়ান আলভারেজকে সাথে নিয়ে ফ্রান্সের রক্ষণে রীতিমতো ছেলেখেলা খেলতে লাগলেন মেসি। তাতে প্রথমার্ধেই দুইবার জাল থেকে বল কুড়িয়ে আনতে হলো হুগো লরিসকে, আর্জেন্টিনার শিরোপাজয় তখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিল।
খেলা ঘুরে গেল দ্বিতীয়ার্ধে, আরো স্পষ্টভাবে বললে শেষ পনেরো মিনিটে। পুরো ম্যাচে নিশ্চুপ ফ্রান্স তখন আক্রমণের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে আর্জেন্টিনার সীমানায়। আর আর্জেন্টিনার রক্ষণও তাতে ভেঙে পড়লো এক সময়ে, এই বিশ্বকাপে চতুর্থবারের মতো। সৌদি আরবের বিপক্ষে পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল হজম করে পরাজয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লিসান্দ্রো-এমিলিয়ানোর অসামান্য সাহস আর প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের অনভিজ্ঞতা, নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে গোল হজমের পরও টাইব্রেকারে এমি-বীরত্বে জয়ের গল্প তো আগেই বলা হয়েছে। তাই ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপে যে মুহূর্তের মধ্যে দুই গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরাবেন, ব্যাপারটা আকস্মিক হলেও অননুমেয় ছিল না একেবারেই। শিরোপায় এক হাত রেখে দেওয়া আর্জেন্টিনা কি তবে এবারও ফিরবে খালি হাতে?
ম্যাচটা স্বাভাবিকভাবেই গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে, ম্যাচের ১০৮তম মিনিটে আবারও নায়ক মেসি। এবার লাউতারো মার্টিনেজের শটটা হুগো লরিস ফেরালেও ফিরতি শটে বলকে গোললাইন পার করে দেন মেসি। সাথে সাথে শুরু হলো তুমুল উদযাপন। দর্শকেরা আনন্দে ফেটে পড়লেন, সতীর্থরা ছুটে এলেন ডাগআউট থেকে, আর সেই আনন্দের মধ্যমণি হলেন মেসি। বাকি বারোটা মিনিট নিশ্চয়ই ভুলচুক ছাড়াই কাটিয়ে দেবে আকাশি-সাদারা!
না, ভুল হলো। গঞ্জালো মন্তিয়েল ভুল করলেন। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, কর্নার থেকে বল পেয়ে এমবাপের নেওয়া শটটা লাগল মন্তিয়েলের কনুইয়ে। অতঃপর রেফারির পেনাল্টির বাঁশি, এমবাপের গোল, এবং ম্যাচে ফিরে এলো সমতা। ঐ সমতায়ই শেষ হলো বাকিটা সময়, সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাইনালের বিজয়ী খুঁজতে আশ্রয় নিতে হলো টাইব্রেকারের।
ম্যাচে দুটো পেনাল্টি থেকে গোল করা এমবাপেই নিতে এলেন প্রথম শট। তার প্রচণ্ড গতির শটে হাত লাগালেও ফেরাতে পারলেন না গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। আর্জেন্টিনার হয়ে শট নিতে এলেন, যিনি সবসময়েই প্রথম শট নেন – লিওনেল মেসি। ‘কোপার ফাইনালে পেনাল্টি মিস করেছেন’, ‘পেনাল্টি নিতে পারেন না’, ‘পোল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস’ – এমন হাজারো চিন্তা হয়তো মেসির মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু একই টুর্নামেন্টে তো মেসি একই ভুল দুইবার করেন না! পোল্যান্ডের বিপক্ষেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল পেনাল্টি মিসের কোটা, হুগো লরিসকে বোকা বানাতে তাই ভুল হলো না মেসির। ১-১।
এরপর এলেন কিংসলে ক্যোমান। এমিলিয়ানো ততক্ষণে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী। ফলাফল, কোম্যানের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিলেন। আর সেই অ্যাডভান্টেজটা পুরো মাত্রায় কাজে লাগালেন বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ মিনিট খেলার সুযোগ পাওয়া পাওলো দিবালা। এক গোলে পিছিয়ে থেকে অরেলিয়েঁ চুয়ামেনি যখন পেনাল্টি নিতে আসছেন, এমিলিয়ানো তখন আত্মবিশ্বাসে ফুটছেন, রীতিমতো মানসিক দক্ষতার পরীক্ষা নিতে লাগলেন চুয়ামেনির। অনভিজ্ঞ চুয়ামেনি তাতে হয়তো মনোযোগ হারালেন, বল মেরে বসলেন পোস্টের বাইরে।
এরপর পারেদেসের শট ঠেকাতে ব্যর্থ হলেন লরিস, কোলো মুয়ানির শটটা জালে জড়ালো এমিকে ফাঁকি দিয়ে। ‘ম্যাচ পয়েন্ট’-এর সুযোগটা এলো গঞ্জালো মন্তিয়েলের সামনে। সেই মন্তিয়েল, যার হ্যান্ডবলের কারণেই দ্বিতীয়বার ম্যাচে সমতা ফেরানোর সুযোগ পেয়েছিল ফরাসিরা। তবে এবার আর কোনো সুযোগ দিলেন না মন্তিয়েল, লরিসকে অপরদিকে ঝাঁপাতে বাধ্য করে বল পাঠালেন জালে। আর সাথে সাথে নিজে ছুটলেন গোলরক্ষক এমিলিয়ানোর দিকে। ছুটলেন মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সতীর্থরা, ছুটলেন ডাগআউটে থাকা কর্মকর্তারা।
মেসি ছুটলেন না। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাঝমাঠেই। দীর্ঘদিনের দুঃখ মোচনের শান্তি, অপ্রাপ্তিকে পূর্ণতায় রূপান্তরের আনন্দ, বিজয়ের উল্লাস আর রাজ্যের স্বস্তি এসে জড়ো হলো তাঁর চোখেমুখে। লিয়ান্দ্রো পারেদেস কাছেই ছিলেন, সবার আগে তিনিই আলিঙ্গনে বাঁধলেন মেসিকে। এরপর ছুটে এলেন মার্কোস আকুনিয়া। একটা ছোটখাট স্তূপ জমে গেল মেসিকে কেন্দ্র করে।
এরপর? স্বস্তি, উল্লাস, উৎসব, আনন্দের কান্না আর মেসির হাতে স্বপ্নের বিশ্বকাপ শিরোপা। ওপার থেকে ম্যারাডোনাও হয়তো তখন চোখ মুছছিলেন উত্তরসূরীর এই বিশ্বজয় দেখে!
বুয়েন্স আইরেসের ‘প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি জানালায় হাসিমুখ, হাসিমুখের আনন্দধারা’ বইছে। যে রাস্তায় একটা সময়ে মেসির জার্সি পোড়ানো হয়েছিল, সেখানেই আজ চল্লিশ লাখ সমর্থক উপস্থিত হয়েছেন মেসিদের বরণ করে নিতে। ‘দেশের প্রতি মেসির আবেগ নেই‘ বলে মেসির প্রতি দোষারোপ করেছিলেন যে আর্জেন্টাইনরা, সেই আর্জেন্টাইনরাই আজ স্লোগান দিচ্ছেন, গান বাঁধছেন মেসির নামে। এছাড়া চলছে মেসির ছবি সম্বলিত স্মারক মুদ্রা তৈরির চিন্তা, মেসির নামে রাস্তার নামকরণের ভিডিও তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে।
এভাবেই বোধহয় ফিরে আসতে হয়। এভাবেই প্রতিকূলতার মুখে হাল না ছেড়ে বিশ্বাস, আশা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্বপ্নকে তাড়া করে নিজের কাজটা করে যেতে হয়। এভাবেই অমৃতের সুধাপাত্রে শেষ চুমুক দিতে হয়, শোকগাথা হাতে বহুদূর গেলে এভাবেই হাসিমুখ পাওয়া যায়!
অমরত্বের স্বাদ পেতে আসলে কেমন লাগে, লিওনেল মেসি?