ইতালি নাম শুনলে সৌন্দর্য্য-পিপাসু মানুষদের চোখে ভাসে দেশটির অপূর্ব সৌন্দর্য্যের বর্ণনা। কিন্তু একজন ফুটবলপ্রেমীর কাছে এ নামটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে। ইতালি শুনলে তাদের কাছে মনে হয় একসময়ের সেই পরাশক্তির দলটির কথা। যাদের বিপক্ষে লড়াই করার আগেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ত বড় দলগুলো। কারণ, একসময় পুরো ফুটবল বিশ্ব শাসনের পাশাপাশি তারাই ছিল সাফল্যের শীর্ষে। সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছে জার্মানির সাথে।
কিন্তু সেই ইতালির রূপ-জৌলুস ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছিল কালের গর্ভে। যে ইতালি ছাড়া বিশ্বকাপ কল্পনাও সম্ভব ছিল না, সেই ইতালি দল ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়া বিশ্বকাপ। যদিও তাদের এই হারিয়ে যেতে বসার পেছনে প্রচুর কারণ আছে। তার অনেকটাই আলোচনাতে ধারাবাহিকভাবে আসবে, তবে শুরু করা যাক ২০০৬ সালের সেই মাতাল করা বিশ্বকাপ থেকে।
জার্মানির সেই ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ। জার্মানি থেকে ফ্রান্স বা আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিল প্রত্যেক দলে তাদের দেশের রত্নে ভরপুর। আর ইতালি? তাদের একাদশ যেন স্বর্ণখচিত। গোলবারের বুফন, এরপর জামব্রোত্তা, নেস্তা, ক্যানাভারো, গাত্তুসো, ইনজাগি, পিরলো, টট্টি, দেল পিয়েরো, ডি রসি… কে নেই সেই বিশ্বকাপে ইতালির দলে! বলা হয়ে থাকে, তাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি দল ছিল সেটি। অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন, জার্মানি ও ফাইনালে জিদানের ফ্রান্সকে হারিয়ে সেই ঐতিহাসিক পরাশক্তিদের ঘরেই শিরোপা গিয়েছিল সেবার। কিন্তু ঐ ফাইনাল, ঐ ঐতিহাসিক জয়ের পরই যেন ইতালির পতনের শুরু। যদিও তা ছিল ধীর গতির। প্রতিটা সময়ে বোঝা না গেলেও পরবর্তী ইউরো কাপ ও পরের বিশ্বকাপগুলোর মতো বড় মঞ্চে ঠিকই বোঝা যাচ্ছিল, ইতালি তাদের সুদিন হারাচ্ছে।
২০০৮ এর ইউরোর সময় ইতালির সেই ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জেতা দলের অনেকেই ছিলেন না। কিন্তু আকুইলানি, ডি রসি, আমব্রোসিনি, ক্যাসানোদের ইতালি শেষ পর্যন্ত স্পেনের কাছে হেরে সেমিফাইনালের আগেই থমকে যায়।
২০১০ বিশ্বকাপ ছিল আরও হতাশার। ইতালি ক্রমে ক্রমে হারাচ্ছিল তাদের তারকাদের। কিন্তু সেবার গাত্তুসো ও পিরলো দলে ফিরলেও মার্কিসিও, জামব্রোত্তা, কিয়েলিনিদের ইতালি গ্রুপ পর্বই পার করতে পারেনি, জিতেছিল একটিমাত্র ম্যাচ।
২০০৬ থেকে ২০১৮ বিশ্বকাপের মাঝে আজ্জুরিদের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ২০১২ এর ইউরো ফাইনালে ওঠা। কিন্তু জাভি-ইনিয়েস্তাদের স্পেন ছিল দুর্ভেদ্য পরিখা। ফাইনালে সে পরিখা ভেদ করা সম্ভব হয়নি ইতালির।
২০১৪ বিশ্বকাপে আবারও তারা গ্রুপপর্বেই বাদ। কিন্তু আন্তোনিও কন্তের ইতালি ২০১৬ এর দিকে নতুন ভাবে জেগে ওঠার আভাস দিয়েছিল। ততদিন ইতালি থেকে বিদায় নিয়েছে প্রায় সকল তারকারা। যারা দলে খেলছেন, তাদের সবাই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেন না। তাই সেবার স্পেনকে হারিয়ে ২০১২ এর ইউরো ফাইনালের প্রতিশোধ নিলেও জার্মানির কাছে হেরে বাদ পড়ে তারা।
এরপর আসে তাদের ইতিহাসের সব থেকে কঠিন সময়। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে স্পেন ও ইতালি ছিল একই গ্রুপে। স্পেন গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপে জায়গা করে নিলেও সেরা চারে স্থান হয়নি ইতালির। ফলাফল, সুইডেনের সাথে প্লে-অফ ম্যাচ। কিন্তু সেখানেও পেরে ওঠেনি মার্কো জামপাওলোর শিষ্যরা। ১৯৫৮ সালের পর প্রথমবারের মত ইতালিকে ছাড়া অনুষ্ঠিত হয় রাশিয়া বিশ্বকাপ। দীর্ঘ ৬০ বছর পর ইতালির দর্শকেরা আদতেই দর্শক হয়ে থাকে রাশিয়া বিশ্বকাপের সময়ে। দলের পরিস্থিতি নড়বড়ে, পর্যাপ্ত খেলোয়াড় নেই দলে, যেমনটা থাকা উচিত। মড়ার উপর খাড়ার ঘা, জামপাওলোর দুর্বল কোচিং। ফলে জামপাওলোর চাকরিও টিকে থাকল না। আজ্জুরিদের দায়িত্ব নিলেন রবার্তো মানচিনি। যেখান থেকে ইতালির নতুন যুগের সূচনা শুরু।
আন্তোনিও কন্তে বা মার্কো জামপাওলোদের আমলে ইতালিতে সে রকম খেলোয়াড় পর্যাপ্ত ছিল না, যেমনটা দেখে অভ্যস্ত ইতালির সমর্থকেরা। মধ্যমাঠে পিরলো ও গাত্তুসো, আক্রমণে টট্টি বা লুকা টনি, রক্ষণে নেস্তা, ক্যানাভারো বা জামব্রোত্তা – প্রত্যেকের শূন্যস্থান সেভাবেই ছিল। এটা সত্য যে, দ্বিতীয় পিরলো বা টট্টিদের পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাদের উত্তরসূরী বের করা আবশ্যক। ২০১২ থেকে ২০১৮ এর মাঝে এরকম কোনো খেলোয়াড়ই ছিল না ইতালি জাতীয় দলে। থিয়াগো মোত্তা, মার্কো পারোলো, আন্তোনিও কান্দ্রেভা বা সিমোনে জাজা কখনোই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি নিজেদের দেশের জন্য।
রবার্তো মানচিনি যখন ইতালির হাল ধরেন, ইতালির আনাচেকানাচে বা ইউরোপের অন্য কোনো ক্লাবে অসংখ্য তরুণ তুর্কির জন্ম হয়েছে, দলে যাদের আগে তেমন কোনো সুযোগ হয়নি। মানচিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন, জামপাওলোর রেখে যাওয়া ইতালি নয়, তিনি নতুন ইতালি গড়বেন তার মতো করে। আর এই নতুন ইতালিকে গড়তে তিনি ব্যবহার করলেন ইতালির ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের। এ জন্যই ২০২০ ইউরো কাপ বাছাইপর্বে তিনি ২৯ জনের প্রাথমিক দলে অর্ধেকের বেশি ব্যবহার করেছেন তরুণ আনকোরা খেলোয়াড়। তার দলে মাত্র ১১ জন খেলোয়াড় ছিল ২৫ বছরের উপরে।
সবসময়ই আজ্জুরিদের একটি বড় ধরণের শক্তি ছিল স্কোয়াড-ডেপথ। তাই প্রথম থেকেই মানচিনির প্রধান লক্ষ্য ছিল ইতালি দলের এই ডেপথ ফিরিয়ে আনা, যেখানে তিনি শতভাগ সফল। মূলত ৪-৩-৩ ফর্মেশন বেশি ব্যবহার করলেও মানচিনি মাঝেমাঝে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনও ব্যবহার করেছেন, যেখানে মধ্যমাঠে ডাবল পিভট রোলে থেকেছেন ভেরাত্তি ও জর্জিনহো।
একদম গোলরক্ষক পজিশন থেকে শুরু করা যাক। বুফন বিদায় নিয়েছেন, এরপরও মানচিনির চিন্তা করতে হয়নি আরেক ‘জিয়ানলুইজি’, অর্থাৎ জিয়ানলুইজি ডোনারুমা থাকার কারণে। তারপরও তিনি ফর্ম বিচারে ডেকেছেন পুরনো সৈনিক সেরেগুকে। আর তরুণ তুর্কি অ্যালেক্স মেরেটকে রেখেছেন এদের পাশে, তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে।
মানচিনির আমলে রক্ষণে কিয়েলিনি খুব একটা সুযোগ পাননি ইনজুরির কারণে। কিন্তু আসন্ন ইউরোতে মানচিনির একাদশের রক্ষণের দায়িত্ব কিয়েলিনি ও বোনুচ্চি বুঝে নেবেন, তা নিশ্চিত। আর তাদের পরিবর্তিত ও দলের ভবিষ্যৎ হিসেবে থাকবেন জিয়ানলুকা মানচিনি ও রোমানগলির মতো তরুণেরা। ফুলব্যাকেও তারকাদের কমতি নেই। এমারসন আছেন লেফটব্যাক পজিশন সামলানোর জন্য। আর রাইটব্যাক হিসেবে ডাক পেয়ে নজর কেড়েছেন ডি লোজানো।
নিভে যাওয়া ইতালি হুট করে কীভাবে আবার লড়াইয়ের মাঠে ফিরে এসেছে, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে তাদের শিহরণ জাগানো মধ্যমাঠের দিকে। পুরানো সৈনিক জর্জিনহো ও ভেরাত্তি তো আছেনই। তাদের সাথে যোগ হয়েছে নিকোলো জানিওলো, নিকোলো বারেল্লা,স্টেফানো সেনসি, ব্রায়ান ক্রিস্তান্তে, স্যান্দ্রো তোনলির মত খেলোয়াড়েরা। প্রথমে আসা যাক স্টেফানো সেনসির ব্যাপারে, মানচিনির আবিষ্কারদের মধ্যে যার নাম সবার প্রথমে থাকবে। মিলানে খেলা এ মিডফিল্ডার মূলত ‘রেজিস্তা’ ঘরানার, অনেকটা জাভি হার্নান্দেজের মতো খেলোয়াড়ের আপডেটেড সংস্করণ। মধ্যমাঠ শাসনের পাশাপাশি গোলও করতে পারেন নিয়মিত।
অপরদিকে, ফুটবল দুনিয়ায় বারেল্লা বর্তমানে বেশ পরিচিত নাম। গত দুই মৌসুমে সিরি ‘আ’তে বেশ নাম কুড়িয়েছেন তিনি। আর রোমার মিডফিল্ডার নিকোলো জানিওলা গত মৌসুমে সিরি ‘আ’তে সেরা তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি ১৯ বছর বয়সী স্যান্দ্রো তোনলির খেলার ধরনে আন্দ্রে পিরলোর সাথে বেশ মিল আছে। ৩-৪ জনের মধ্যমাঠ গড়তে মানচিনির হাতে ৫ থেকে ৬ জন প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়। তারপরও মধ্যমাঠে ব্যবহার করার মতো এতগুলো অস্ত্র নিয়ে ভুগতে হবে না মানচিনির জন্য। কারণ, প্রথম থেকে যে মধ্যমাঠত্রয়ীই ব্যবহার করুন না কেন, তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন সাবস্টিটিউটও খেলার ফলাফল বদলে দিতে পারে। তাই ভেরাত্তি, জর্জিনহো ও সেনসি ম্যাচ শুরু করলেও বাকিরা বেঞ্চে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
রক্ষণ ও মধ্যমাঠ থেকে বর্তমান ইতালির আক্রমণভাগই বলতে গেলে তুলনামুলক দুর্বল। ইতালি কোচ স্ট্রাইকার পজিশনে প্রথমেই সুযোগ দেন মইসে কিনকে। তবে তিনি ফর্ম হারিয়ে নিজের পজিশন হারিয়ে ফেলেছেন আন্দ্রে বেলোত্তি ও চিরো ইমোবিলের কাছে। তারা দু’জনই ইউরোপ সেরা স্ট্রাইকারের কাতারে না পড়লেও নিজ ক্লাবের হয়ে যথেষ্ট উজ্বল। তাই বেলোত্তি ও ইমোবিলের দুই পাশে মানচিনি সবসময় সৃজনশীল উইঙ্গার ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উইঙ্গার হিসেবে প্রথম পছন্দ হিসেবে আছেন চারজন – বের্নার্দেস্কি, কিয়েসা, এল শ্যারাউই ও লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে। তবুও মানচিনি বাজিয়ে দেখেছেন কয়েকজন তরুণকে। উইঙ্গার রিকার্দো অর্সোলিনি, মাত্তেও পলিতানো এবং ফরোয়ার্ড আন্দ্রে পিয়ামন্তি বেশ ভালো খেলেছেন তার অধীনে। তবে উইঙ্গার হিসেবে মানচিনি আগামী ম্যাচে ডাকতে যাচ্ছেন জিয়ানলুকা স্কামাকা, যিনি ইতালির যুব দলের হয়ে নজর কেড়েছিলেন।
মানচিনি দায়িত্ব নেবার পর প্রথম কয়েক ম্যাচে হার-জিত মিলিয়ে ইতালি আস্তে আস্তে জেগে উঠছিল। কিন্তু ইউরো কাপ কোয়ালিফিকেশন ম্যাচগুলো দিয়ে তারা যেন পুরোপুরি ফিরে পায় নিজেদের। আর বর্তমান আজ্জুরিরা খেলছেও প্রশংসনীয় ফুটবল। গ্রুপপর্বের ১০ ম্যাচে কোনো হার বা ড্র নেই তাদের। টানা ১০ ম্যাচ জয়ে ৩০ পয়েন্ট নিয়েই ইউরো কাপের মূল পর্বের টিকেট কেটেছে তারা। এই ১০ ম্যাচে কোনোটিতে ২ গোলের কম গোল করেনি মানচিনির শিষ্যরা। গোলও হজম করেছেন তুলনামূলক অনেক কম। আর ফিনল্যান্ড, গ্রিস ও আর্মেনিয়া রীতিমতো ধুঁকেছে মানচিনির ‘প্রেস অ্যান্ড পাসিং’ ফুটবলের সামনে।
নতুন একটি দল গড়তে সম্ভাব্য যতগুলো বাধার মুখোমুখি হতে হয়, আজ্জুরিরা হয়েছে। সেগুলো পার করেছেও সহজেই। তবে একটি জায়গায় তাদের পরীক্ষা এখনও বাকি। ইতালি অধিকাংশ সময়ে মধ্যমসারির দলের বিপক্ষে খেলেছে, বড় দেশের বিপক্ষে খুব কমই লড়েছে তারা। তবে মানচিনির দল নেশন্স কাপে পর্তুগাল ও প্রীতি ম্যাচে হল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেললেও জিততে পারেনি একটিতেও। তাই বদলে যাওয়া ইতালি কি আসলেই সব দিক থেকে বদলে গেছে, নাকি বড় দলের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকাতে ইউরোতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, তার উত্তর আপাতত রবার্তো মানচিনির কাছেও নেই। তবে তিনি মনে করেন, ইউরো শুরু হবার পূর্বেই এই নতুনেরা পরিণত হয়ে যাবে।
আগামী বছরের ইউরো কাপের জন্য আগে থেকেই ফ্রান্স-স্পেন-ইংল্যান্ড ফেভারিট। জার্মানি ও পর্তুগাল হয়তো ঠিক ফেভারিটদের তালিকার একদম প্রথম দিকে থাকবে না, তবে যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পর্বে তারা অবশ্যই শক্ত প্রতিপক্ষ। কিন্তু এবার নতুন করে ভাবতে হবে হল্যান্ড ও ইতালিকে নিয়ে। কারণ, রবার্তো মানচিনি খুব অল্প সময়ে ইতালির চিত্র পাল্টে দিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় পিছিয়ে থাকলেও আসন্ন ইউরোকে সামনে রেখে ইতালি বদলে গেছে। আর এই বদলই পুনরায় আজ্জুরিদের ফিরিয়ে আনছে লড়াইয়ের মঞ্চে।