রোমাঞ্চকর এজবাস্টন টেস্ট ম্যাচে বিরাট কোহলি করেছেন ২০০ রান এবং ভারতের বাকি ব্যাটসম্যানরা করেছেন ২১৪ রান। ইংল্যান্ডের মাটিতে চার বছর আগের ব্যর্থতা কাটিয়ে অসাধারণ ব্যাটিং করা কোহলি সতীর্থদের যোগ্য সমর্থনের অভাবে শেষপর্যন্ত পরাজিত দলের সদস্য ছিলেন। তিনি এবারই প্রথম বিদেশের মাটিতে একা লড়াই করেননি, বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও একা লড়াই করেছিলেন বিরাট কোহলি।
বিদেশের মাটিতে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা নিজেদের ছায়া হয়ে থাকেন। ঠিক যেমনটা গত শতকের নব্বই দশকে শচীন টেন্ডুলকারের সাথে ঘটতো। এমনটাই ঘটছে কোহলির সাথেও। দেশের মাটিতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ধাওয়ান, রাহুলরা ইংল্যান্ড কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে নিজেদের হারিয়েও খোঁজার চেষ্টা করেন।
শচীন টেন্ডুলকার পরবর্তী যুগে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির অবস্থাও টেন্ডুলকারের মতো ছিলো। সতীর্থদের ব্যর্থতায় বারবার পরাজিত দলের সদস্য হতে হয়েছিলো তাদের।
১
দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৯৯০ সালের নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শচীন টেন্ডুলকার ২৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। এই ২৩ ম্যাচে টেন্ডুলকার ৫২.৩৯ ব্যাটিং গড়ে নয়টি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১৯৯১ রান করেছিলেন। ঐ ম্যাচগুলোতে দলের মোট রানের ২০.২% রান করেছিলেন টেন্ডুলকার।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত একই দেশে বিরাট কোহলির পরিসংখ্যানও টেন্ডুলকারের অনুরূপ। এইসময়ে কোহলিও দলের ২০.২% রান সংগ্রহ করেছিলেন।
বিরাট কোহলি ১৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলে আটটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫৪.৪৮ ব্যাটিং গড়ে ১,৭৯৮ রান করেছেন।
বিরাট কোহলির ব্যাটিং গড় তুলনামূলক একটু বেশি হলেও দুজনের শতক এবং অর্ধশতকের সংখ্যা প্রায় একই। দুইজনেই দলের ব্যাটিংয়ে মূল স্তম্ভ ছিলেন। তবে জয়-পরাজয়ের দিক দিয়ে বিরাট কোহলির ভারত এগিয়ে আছে। এই ১৭ ম্যাচের মধ্য দিয়ে দুটি জয়ের বিপরীতে দশটি টেস্টে পরাজিত হয়েছিলো ভারত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে টেন্ডুলকারের ভারত ২৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ১৩টি পরাজয়ের বিপরীতে কোনো টেস্ট ম্যাচে জয় পায়নি।
২
দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে ঐ দশ বছরে ধারাবাহিকভাবে রান করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। টেন্ডুলকারের সবচেয়ে ভালো দিক ছিলো তার ধারাবাহিকতা। তিনি ঐ সময়ে কমপক্ষে দুটি টেস্ট ম্যাচের সিরিজ খেলেছিলেন সাতটি। ঐ সাতটি সিরিজে কমপক্ষে একটি করে শতক হাঁকিয়েছিলেন। এরমধ্যে ছয়টি সিরিজে তার ব্যাটিং গড় চল্লিশের বেশি ছিলো।
অন্যদিকে বিরাট কোহলিও ধারাবাহিকভাবে রান পেয়েছেন। শুধুমাত্র ২০১৪ সালে ইংল্যান্ড সিরিজ ছাড়া সব সিরিজেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন তিনি। ঐ সিরিজে দলের মোট রানের মাত্র ৬% এসেছিলো তার ব্যাট থেকে। এই সিরিজ বাদ দিয়ে অন্যসব সিরিজে দলের মোট রানের ২৫.৪৫% রান করেছিলেন তিনি।
বিরাট কোহলি ২০১৩-১৪ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ৬৮ ব্যাটিং গড়ে এবং নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ৭১.৩৩ ব্যাটি গড়ে রান করেছিলেন। এরপর ২০১৪ সালে দুঃস্বপ্নের ইংল্যান্ড সিরিজে তার ব্যাটিং গড় ছিলো মাত্র ১৩.৪।
২০১৪-১৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৮৬.৫ ব্যাটিং গড়ে এবং চলতি বছরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪৭.৬৬ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন কোহলি।
৩
দুই যুগেই শচীন টেন্ডুলকার এবং বিরাট কোহলি তাদের সতীর্থদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাননি। এই ১৭ ম্যাচে বিরাট কোহলি ৫৪.৪৮ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন। কিন্তু ১-৭ পজিশনে ব্যাট করা বাকিদের মোট ব্যাটিং গড় ২৮.১৩। রানের পাশাপাশি শতক হাঁকানোর দিক থেকেও অন্য ব্যাটসম্যানদের সম্মিলিত শতক সংখ্যার সমান শতক হাঁকিয়েছেন কোহলি।
শচীন টেন্ডুলকারও নব্বইয়ের দশকে একা প্রতিপক্ষের বোলারদের সামনে ব্যাট প্রশস্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি ছাড়া টপ অর্ডারের প্রথম সাতজনের ব্যাটিং গড় মাত্র ২৬.৪৮। কিন্তু শচীনের ব্যাটিং গড় টপ অর্ডারে ব্যাট করা অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের থেকে প্রায় দ্বিগুণ (৫২.৩৯)।
নব্বইয়ের দশকে টেন্ডুলকারের পাশে ব্যাট করতেন রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, লক্ষণ, আজহারউদ্দীনরা। এদের মধ্যে গাঙ্গুলী, দ্রাবিড় এবং লক্ষণের ব্যাটিং গড় চল্লিশোর্ধ্ব হলেও বাদবাকি সবার ব্যাটিং গড় ছিলো হতাশাজনক। দেশের মাটিতে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান আজহারউদ্দীনের ব্যাটিং গড় ছিলো ২৫.২৪। সঞ্জয় মাঞ্জেকারের ব্যাটিং গড় ২৩.৯৪। সিধুর ব্যাটিং গড় ২৩.৪৫ এবং দিলিপ ভেংসরকারের ব্যাটিং গড় ছিলো মাত্র ১৭.৫৫।
বিরাট কোহলির ক্ষেত্রেও তা ঘটছে। চেতেশ্বর পূজারা, শিখর ধাওয়ান, মুরালি বিজয়, রোহিত শর্মা এবং আজিঙ্কিয়া রাহানের মতো দুর্দান্ত সব ব্যাটসম্যান থাকলেও তারা এইসব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এসে বারবার পরাস্ত হচ্ছেন। এসব দেশে রাহানের পরিসংখ্যান তার পক্ষে কথা বললেও অন্যদের পরিসংখ্যান শোচনীয়। রাহানে ছাড়া টপ অর্ডারে আর কোনো নিয়মিত ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড় চল্লিশের উপর নেই। রানের দিক দিয়ে কোহলির পরে আছেন মুরালি বিজয়। তিনি ৩৪ ইনিংসে ৩৫.৫২ ব্যাটিং গড়ে ১,২০৮ রান করেছেন। বিদেশের মাটিতে ধারাবাহিকতার দিক দিয়ে কোহলির পরে অবস্থান করছেন রাহানে। তিনি ৪৩.৯৬ ব্যাটিং গড়ে ১,১৪৩ রান করেছেন।
এজবাস্টন টেস্টে ইনজুরির কারণে দলে না থাকা ভুবেনেশ্বর কুমারের ব্যাটিং গড়ের চেয়েও পূজারা, ধাওয়ান, রাহুল এবং রোহিতের ব্যাটিং গড় কম।
৪
শচীন টেন্ডুলকারের একক লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে ২০০২ সাল থেকে। এরপর নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে শুরু করেন দ্রাবিড়, গাঙ্গুলি, লক্ষণ এবং শেহওয়াগ-গম্ভীররা। যার ফলে টেন্ডুলকারের উপর অধিক নির্ভর করার মাত্রাটা কিছুটা কমে।
২০০২ সাল থেকে শচীন ঐ চারটি দেশে দলের মোট রানের ১৬.৬৭% রান সংগ্রহ করেছেন। তার মানে এই নয় যে এসময় শচীন অফ ফর্মে ছিলেন।
২০০২ সাল থেকে শচীন ৩৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫১.৪২ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন, যা সেই সময় বিদেশের মাটিতে আলোচিত ব্যাটসম্যান দ্রাবিড়ে গড়ের চেয়ে বেশি। দ্রাবিড়ের ব্যাটিং গড় ছিলো ৫০.৫০।
বর্তমানে ভারতীয় দর্শকরাও এটা আশা করবেন যে কোহলি যে গতিতে রান করছেন, তা বজায় থাকুক। কিন্তু দলের মোট রানে তার শতাংশ কিছুটা কমে যাক। যেভাবে শচীনের কমেছিলো। এরকম ঘটার উপযুক্ত সময় এখন। রাহানে, ধাওয়ানরা নিজেদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করলে কোহলির উপর অধিক নির্ভর করা কিছুটা কমবে।
ফিচার ইমেজ: BCCI