মেসি-রোনালদোর দশ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ব্যালন ডি অর জিতলেন ক্রোয়েশিয়া ও রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠের কাণ্ডারি লুকা মদ্রিচ। অবশ্য অনুমিতই ছিলো যে, এবার পুরষ্কারটি উঠতে যাচ্ছে মদ্রিচের হাতেই। তার আগে ফিফা বেস্টের পুরষ্কারটিও বগলদাবা করেছিলেন মদ্রিচ।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফিফা বেস্ট ও ব্যালন ডি অর পুরষ্কারটি এক করে পুরো বছরের সেরা খেলোয়াড়ের হাতে তুলে দেওয়া হতো ফিফা ব্যালন ডি অর সম্মাননা। তবে ২০১৭ সাল থেকে আগের মতো আবার ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন ও ফিফা আলাদাভাবে এই পুরষ্কারটি দেওয়া শুরু করে। ২০১৭ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো এ বছরও দুটি পুরষ্কারই ওঠে মদ্রিচের হাতে। তবে বেশ কয়েকবার এর ব্যতিক্রমও দেখা গিয়েছে। ফিফা বেস্ট পুরষ্কার জিতলেও কিছু ফুটবলার সেই বছরই জিততে পারেননি ব্যালন ডি অর। এই রকম সাত ফুটবলার সম্পর্কেই জানানো হবে আজ।
লোথার ম্যাথিউস (জার্মানি) – ১৯৯১
১৯৯১ সালে প্রথমাবারের মতো ফিফার সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি স্বরুপ ফিফা বেস্ট পুরষ্কারটি জিতেন জার্মান কিংবদন্তী লোথার ম্যাথিউস। ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর ফরাসি খেলোয়াড় জাঁ পিয়েরে পাপিনকে হারিয়ে এই খেতাব অর্জন করেন বিশ্বকাপজয়ী এই অধিনায়ক। ম্যাথিউস পান সর্বোচ্চ ১২৮ পয়েন্ট। ১১৩ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হন পাপিন। ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার ৪০ পয়েন্ট পেয়ে অর্জন করেন তৃতীয় স্থান।
তবে এর কিছুদিন পরেই ২৪ ডিসেম্বর লোথার ম্যাথিউসকে হারিয়ে ব্যালন ডি অর জিতে নেন পাপিন। ১৪১ পয়েন্ট নিয়ে পাপিন পেছনে ফেলেন ৪২ পয়েন্ট পাওয়া ম্যাথিউসকে। সেই বছর মার্শেইয়ের হয়ে লিগ ও ইউরোপিয়ান কাপ দুই প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন জাঁ পিয়েরে পাপিন। যদিও সেবার ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে স্টার বেলগ্রেডের কাছে হেরে গিয়েছিলো মার্শেই।
রোমারিও (ব্রাজিল) – ১৯৯৪
২০ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ সালে নিজের প্রথম ব্যালন ডি অর জেতেন রিস্টো স্টইচভ। দ্বিতীয় হওয়া ইতালিয়ান স্ট্রাইকার রবার্তো ব্যাজ্জিও থেকে বিশাল ব্যবধানে এই পুরষ্কার জিতে নেন এই বুলগেরিয়ান। ২১০ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম হন স্টইচভ। ১৩৬ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হন রবার্তো ব্যাজ্জিও। তৃতীয় স্থান অধিকার করেন আরেক ইতালিয়ান পাওলো মালদিনি। মালদিনির সংগ্রহে ছিলো ১০৯ পয়েন্ট।
তবে পরবর্তী বছরের ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়া ফিফা বেস্ট অনুষ্ঠানে সব পাল্টে যায়। ব্রাজিলকে চতুর্থ বিশ্বকাপ জেতানোর মূল নায়ক রোমারিওর হাতে ওঠে ফিফা বেস্ট পুরষ্কারটি। যদিও সেখানে দ্বিতীয় স্থানটি দখল করেন স্টইচভ। তবে দুজনের মাঝে ব্যবধান ছিলো বিস্তর। রোমারিওর ৩৪৬ পয়েন্টের বিপরীতে স্টইচভ পেয়েছিলেন মাত্র ১০০ পয়েন্ট।
রোনালদো (ব্রাজিল) – ১৯৯৬
ব্যালন ডি অরের ইতিহাসে প্রথম ডিফেন্ডার হিসেবে সেবার এই পুরষ্কারটি জেতেন ম্যাথিয়াস সামার। পরে এই তালিকায় নাম লেখান ইতালিয়ান বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ফ্যাবিও ক্যানাভারো। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সালে ন্যূনতম ব্যবধানে ব্রাজিলিয়ান তরুণ সেনশেসন রোনালদোকে হারিয়ে ব্যালন ডি অর জিতে নেন সামার। তার ১৪৪ পয়েন্টের বিপরীতে রোনালদো পান ১৪৩ পয়েন্ট।
১ পয়েন্টের ব্যবধানে পুরষ্কারটি হাতছাড়া করার জ্বালা রোনালদো মেটান কিছুদিন পরেই। ২০ জানুয়ারি, ১৯৯৭ সালে ঘোষণা করা হয় ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের নাম। সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে পুরষ্কারটি জিতে নেন রোনালদো। তবে এবার আর প্রথম তিনেও জায়গা হয়নি ম্যাথিয়াস সামারের। ৩২৯ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম হওয়া রোনালদো পেছনে ফেলেন ১৪০ পয়েন্ট পাওয়া এলান শিয়েরার ও ১২৯ পয়েন্ট পাওয়া জর্জ উইয়াহকে।
জিনেদিন জিদান (ফ্রান্স) – ২০০০
ডিসেম্বরের ১১ তারিখ ২০০০ সালের ফিফা বর্ষসেরা পুরষ্কারটি ওঠে জিনেদিন জিদানের হাতে। ফ্রান্সকে ২০০০ সালের ইউরো জেতানোর কারিগর হিসেবে জিদানই ছিলেন যোগ্য দাবিদার। তবে পুরষ্কারটি পেতে জিদানের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় লুইস ফিগোর সাথে। ৩৭০ পয়েন্ট নিয়ে জিদান প্রথম হলেও ফিগো পান ৩২৯ পয়েন্ট। অন্যদিকে ২৬৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার রিভালদো।
তবে এর কিছুদিন পরেই ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে এবার জিদানকে হারিয়ে ব্যালন ডি অর জিতে নেন লুইস ফিগো। ৮ দিন পর ১৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া ব্যালন ডি অর গালা নাইটে ১৯৭ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম হন ফিগো। ১৮১ পয়েন্ট নিয়ে এবার দ্বিতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় জিদানকে।
লুইস ফিগো (পর্তুগাল) – ২০০১
জিদানের ভাগ্য ঠিক পরের বছরই বরণ করতে হয় লুইস ফিগোকে। ১৭ ডিসেম্বর, ২০০১ সালে ফিফা বর্ষসেরার খেতাব জেতেন লুইস ফিগো। এই সম্মাননা পাওয়ার দৌড়ে এই পর্তুগিজ পেছনে ফেলেন ডেভিড বেকহ্যামকে। ফিগোর ২৫০ পয়েন্টের বিপরীতে বেকহ্যাম পেয়েছিলেন ২৩৮ পয়েন্ট।
ঠিক পরদিনই অনুষ্ঠিত হওয়া ব্যালন ডি অরে চমকে যায় পুরো বিশ্ব। ফিফা বর্ষসেরার প্রতিযোগিতায় ৮ম হওয়া মাইকেল ওয়েন সেবার জিতে নেন ব্যালন ডি অর। অন্যদিকে ফিগো সেরা তিনেও জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হন। ১৭৬ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম হন ইংলিশ স্ট্রাইকার ওয়েন। ১৪০ পয়েন্ট নিয়ে পরের স্থানটি দখল করেন রাউল। জার্মান গোলকিপার অলিভার কান ১১৪ পয়েন্ট পেয়ে তালিকায় তৃতীয়তে স্থান পান।
জিনেদিন জিদান (ফ্রান্স) – ২০০৩
দ্বিতীয়বারের মতো আবারও জিদানকে ব্যালন ডি অর ফেরায় খালি হাতে। সেই বছর রিয়ালের হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম কাটানোর পর তৃতীয়বারের মতো ফিফা বর্ষসেরার পুরষ্কার জেতেন এই ফরাসি মিডফিল্ডার। এই পুরষ্কার জয়ে জিদান পেছনে ফেলেন তারই স্বদেশী থিয়েরি অঁরিকে। তিনি পেয়েছিলেন ২৬৪ পয়েন্ট। অঁরির সংগ্রহে ছিলো বরাবর ২০০ পয়েন্ট। ১৭৬ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রোনালদো।
ঠিক এক সপ্তাহ পর ২২ ডিসেম্বর অঁরিকে হারিয়ে ব্যালন ডি অর জিতে নেন পাভেল নেদভেদ। তবে এবার সেরা তিনেও ঠাঁই হয়নি জিদানের। ১৮০ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় চেক খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি অর পান নেদভেদ। দ্বিতীয় হওয়া অঁরি পেয়েছিলেন ১২৮ পয়েন্ট। অন্যদিকে ১২৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হন পাওলো মালদিনি।
রোনালদিনহো (ব্রাজিল) – ২০০৪
২০০৪ সালই সর্বশেষ, যেবার ফুটবলের এই অন্যতম দুই পুরষ্কার জিতেছিলেন ভিন্ন দুজন।
১৫ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে ব্যালন ডি অর পুরষ্কারটি বগলদাবা করেন আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো। এসি মিলানের হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম কাটানোর পর এই পুরষ্কারটি জিতে নেন তিনি। শেভচেঙ্কো পেছনে ফেলেন পর্তুগিজ মিডফিল্ডার ডেকো ও ব্রাজিলিয়ান জাদুকর রোনালদিনহোকে। শেভচেঙ্কোর ১৭৫ পয়েন্টের বিপরীতে ডেকো ও রোনালদিনহো পান যথাক্রমে ১৩৯ ও ১৩৩ পয়েন্ট।
ঠিক ৫ দিন পরই উল্টে যায় সবকিছু। ফিফা বর্ষসেরার পুরষ্কারটি ওঠে রোনালদিনহোর হাতে। ৬২০ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম হন এই ব্রাজিলিয়ান সেনশেসন। তবে এবার ২৫৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হন শেভচেঙ্কো। ৫৫২ পয়েন্ট নিয়ে আবারো দ্বিতীয় স্থান দখল করেন অঁরি।