ফুটবলে সবাই সৌন্দর্যের পূজারী হলেও দিনশেষে গোলটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য পাঁচ-ছ’জনকে ড্রিবল করা গোলের চেয়ে মাঝে মাঝে ট্যাপ-ইন গোলের মাহাত্ম্য অনেক বেশি থাকে। তবে সুন্দর গোলের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার জন্য তৎকালীন ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার একটি পুরস্কার চালু করার চিন্তা করেন। ২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর ফিফায় সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনো লিগের সবচেয়ে সুন্দর গোলটির গোলদাতার হাতে দেওয়া হবে এই পুরস্কার। দর্শকদের ভোটেই নির্ণয় করা হবে বছরের সেরা গোলটি। মনোনয়ন পাওয়া দশজন থেকে দর্শকেরা ভোট দিয়ে একটি গোলকে সেরা হওয়ার স্বীকৃতি দিবে। পুরস্কারের নামকরণ করা হলো রিয়াল মাদ্রিদ ও হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তী ফেরেঙ্ক পুসকাসের নামানুসারে।
২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সর্বমোট নয়জন জিতেছে এই পুরস্কার। অনেক আনকোরা খেলোয়াড়েরা যেমন জিতেছেন, তেমনি নামীদামী প্লেয়াররাও বাগিয়ে নিয়েছেন এই পুরস্কার। সময়ের অন্যতম সেরা তিন ফুটবলারের মধ্যে রোনালদো, নেইমার জিতলেও পাঁচবারের নমিনেশনে একবারও জিততে পারেননি লিওনেল মেসি। চলুন দেখে আসা যাক এই পুরস্কারজয়ী ফুটবলার আর তাদের করা সেই গোলগুলো।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (২০০৯)
প্রথম বছরেই পুরস্কারটি বগলদাবা করেন সেই সময়ের ব্যালন ডি অর জয়ী ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে পোর্তোর বিপক্ষে গোলটি করেন তিনি। গোলপোস্ট থেকে চল্লিশ গজ দূর থেকে নেওয়া শটটি গোলকিপারকে কোনো সুযোগ না দিয়ে ডানদিকের কোণা দিয়ে জালে জড়ায়। বুলেট গতির এই গোলের জন্য প্রথম পুসকাসটি ঘরে তোলেন এই পর্তুগিজ সেনসেশন। জয়ের দৌড়ে চেলসির সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে করা ইনিয়েস্তার গোলটিকে পেছনে ফেলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। রোনালদো পান ১৭.৬৮% ভোট আর ইনিয়েস্তা পান ১৫.৬৪%।
হামিত আলটিন্টপ (২০১০)
২০১২ ইউরো কোয়ালিফায়ারে কাজাখস্তানের বিপক্ষে করা এই গোলটি বিপুল ব্যবধানে প্রথম হয়। যেখানে তুরস্কের খেলোয়াড় হামিত পান ৪০.৫৫%, সেখানে দ্বিতীয় হওয়া গোলটি পায় সবেমাত্র ১৩.২৩%। কর্নার থেকে উড়ে আসা বলটি ডিবক্সের বাইরে থেকে ভলি করেন হামিত। রিসিভ না করে সরাসরি শটে গোল করায় গোলটির মাহাত্ম্য বেড়ে যায় অনেক।
নেইমার (২০১১)
সান্তোসে থাকাকালীন ফ্ল্যামেঙ্গোর বিরুদ্ধে করা গোলটির জন্য পুসকাস পুরস্কার জেতেন নেইমার। আর্সেনালের সাথে করা লিওনেল মেসির গোলকে হারিয়ে পুরস্কারটি বগলদাবা করেন ব্রাজিলিয়ান এই পোস্টার বয়। প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে ড্রিবল করে বল বের করে নিজের প্লেয়ারের সাথে ওয়ান টু ওয়ানে ফাঁকা জায়গায় বল আনেন তিনি। তারপর আরো তিন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে চিপ করে বল জালে জড়ান তিনি। যদিও ম্যাচটি সান্তোস হেরে যায় ৩-৪ গোলে। কিন্তু অসম্ভব সুন্দর গোলটির জন্য ঠিকই পুসকাস জিতে নেন সাবেক এই বার্সেলোনা প্লেয়ার।
মিরোস্লাভ স্টচ (২০১২)
নয়বারের বিজয়ীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার কৃতিত্ব মিরোস্লাভ স্টচের করা গোলটি। তুরস্কের সুপার লিগে ফেনারবাচের হয়ে গোলটি করেন স্টচ। স্টচের করা গোলটি অনেকটা আল্টিন্টপের করা গোলের মতোই। কর্নার থেকে ভেসে আসা বল রিসিভ না করেই সাইড ভলিতে গোল করেন স্টচ। তবে আল্টিন্টপের করা গোল থেকে স্টচের গোলের দূরত্ব বেশি থাকায় জনপ্রিয়তাও বেশি পায় এই গোলটি। এই পুরস্কার জয়ে তিনি পুসকাস থেকে বঞ্চিত করেন লিওনেল মেসি, নেইমার, রাদামেল ফ্যালকাওদের মতো বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের।
জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ (২০১৩)
চল্লিশ গজ দূর থেকে নেওয়া বাইসাইকেল কিকটি নিঃসন্দেহে সে বছরের সেরা গোল হওয়ার যোগ্য দাবিদার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচে অতিমানবীয় গোলটি করে বসেন সুইডিশ এই কিংবদন্তি। ৪-২ গোলে জেতা ম্যাচটিতে সবগুলো গোলই করেন ইব্রাহিমোভিচ। তবে সব ছাপিয়ে যায় ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে করা ইব্রাহিমোভিচের ওভারহেড কিকে করা গোলটি। লারসনের লং বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে জো হার্ট ডি বক্সের বাইরে চলে আসেন। কিন্তু বিপজ্জনক এলাকা থেকে বল সরাতে পারেননি তিনি। সেই সুযোগে বল রিসিভ না করেই ওভারহেড কিকে দর্শনীয় গোলটি করেন ইব্রাহিমোভিচ। সাথে জিতে নেন সে বছরের পুসকাস অ্যাওয়ার্ডটিও। তিনি পেছনে ফেলেন নেমানজা ম্যাটিচ ও নেইমারের গোল।
হামেস রদ্রিগেজ (২০১৪)
২০১৪ ছিলো বিশ্বকাপের বছর। স্বভাবতই বিশ্বকাপের গোলগুলোই ছিলো লাইমলাইটে। সে লাইমলাইটে এগিয়ে ছিলো কলম্বিয়ান তারকা হামেস রদ্রিগেজের গোলটি। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে উরুগুয়ের সাথে করা গোলটি সে বছরের সেরা গোলের সম্মাননা পায়। ডি-বক্সের বাইরে পাওয়া বলটি বুক দিয়ে রিসিভ করে নামিয়ে ভলি করেন হামেস। উরুগুয়ের গোলপোস্টের ক্রসবারে লেগে জালে প্রবেশ করে চোখজোড়ানো সেই ভলিটি। এই গোলটি পেছনে ফেলে গ্রুপ পর্বে স্পেনের সাথে করা ভ্যান পার্সির ফ্লাইং হেডে করা গোলকে। ৪২% ভোট পেয়ে পুসকাস জেতেন রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক এই তারকা খেলোয়াড়।
ওয়েন্ডেল লিরা (২০১৫)
প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় বিভাগে খেলা কোনো ফুটবলার এই পুরস্কার জিততে সমর্থ হন। তা-ও আবার সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসিকে হারিয়ে। গোয়েনেসিয়া নামের ব্রাজিলের দ্বিতীয় বিভাগের এক দলের পক্ষ হয়ে গোলটি করেন তিনি। চিপ পাসকে বাইসাইকেল কিকে রূপান্তর করে গোলটি করেন ব্রাজিলের এই অখ্যাত ফুটবলার। ম্যাচটি দেখেছিলো গুটি কয়েকজন মানুষ। ভাগ্য ভালো যে, কেউ একজন গোলটি ভিডিও করেছিলেন। তা না হলে ওয়েন্ডেল লিরা দেখা করতে পারতেন না তার আদর্শ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাথে। প্রতিযোগিতা করতে পারতেন না লিওনেল মেসির সাথে।
৪৬.৭% ভোট পেয়ে তিনি হারান কোপা দেল রে ফাইনালে বিলবাওয়ের সাথে করা মেসির অবিশ্বাস্য গোলটিকে। মেসি পান ৩৩.৩% ভোট।
মোহাম্মদ ফাইজ সুব্রি (২০১৬)
প্রথমবারের মতো সেরা ফুটবলারের মুকুট পরতে পারেন কোনো এশিয়ান ফুটবলার। তা-ও এশিয়ান লিগে করা গোল দিয়েই। প্রথমবারের মতো কোনো ফ্রি কিক গোলও এই পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হয়। মালয়েশিয়ান ক্লাব পেনাঙ্গের হয়ে গোলটি করেন সুব্রি। প্রায় ৩৫ গজ থেকে নেওয়া ফ্রি কিকটি আক্ষরিক অর্থেই বোকা বানায় প্রতিপক্ষ গোলকিপারকে। ডান পায়ে নেওয়া শটটি অভাবনীয়ভাবে বাঁয়ে বাঁক খেয়ে জালে জড়িয়ে যায়। মালয়েশিয়ান সুপার লিগে পাহাঙ্গের সাথে করা গোলটি পায় ৫৯.৪৬% ভোট। দ্বিতীয় হওয়া গোলটি পায় ২২.৮৬% ভোট। কিংবদন্তি রোনালদো দ্যা ফেনোমেননের হাত থেকে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন মোহাম্মদ ফাইজ সুব্রি।
অলিভিয়ের জিরু (২০১৭)
গত বছরে ১ জানুয়ারিতে ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে প্রিমিয়ার লিগে করা গোলটি জিরুডকে এই সম্মাননা এনে দেয়। সানচেজের করা ক্রসকে স্করপিয়ন কিকের মাধ্যমে গোলে পরিণত করেন এই সাবেক আর্সেনাল স্ট্রাইকার। স্করপিয়ন কিক হচ্ছে পেছন দিক থেকে পাকে বাঁকিয়ে বলে কিক করা। জিরুডের কিকটি গোলকিপারকে পরাস্ত করে ক্রসবারে লেগে জালে প্রবেশ করে। সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা সত্ত্বেও অবিশ্বাস্য দক্ষতায় বলটিকে জালে জড়ানোয় পুসকাস জেতেন এই ফরাসি স্ট্রাইকার। অলিভিয়ের জিরুড পান ৩৬.১৭% ভোট, অন্যদিকে দ্বিতীয় হওয়া গোলটি পায় ২৭.৪৮% ভোট।
ট্রিভিয়া
-
সবচেয়ে বেশিবার নমিনেশন পান নেইমার (৫) ও লিওনেল মেসি (৫)। নেইমার একবার জিতলেও, মেসির জেতার সৌভাগ্য হয়নি এখনো।
-
দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন পায় ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা (১০)। তাদের পরেই রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা (৯)।
-
সবচেয়ে বেশি দুবার জিতেছে ব্রাজিলিয়ানরা (২০১১) ও (২০১৫)।
-
সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া গোলটি করেন মিরোস্লাভ স্টচ। ২০১২ তে পুসকাস পাওয়া গোলটি পায় ৭৮% ভোট।
-
নারী ফুটবলারদের মধ্যে একমাত্র নমিনেশন পান ভেনিজুয়েলার দানিউস্কা রদ্রিগেজ (২০১৬)। তৃতীয় হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে।