মুশফিকের ১০৫: কেবল তার জন্যই দরকারি

একটাই সেঞ্চুরি। সেটাও থেমে গেল শতকের খানিক পরই, ১০৫ রানে।

কিন্তু এতেই জন্ম হলো হাজারটা আলোচনার, তর্ক-পাল্টা তর্কের। বিতর্কের অংশ হলেন মুশফিকুর রহিমের স্ত্রী-ও। ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লিখলেন,

‘আমরা হাসিমুখেই বিদায় নিবো ইনশাআল্লাহ। তবে আপনাদের রিপ্লেসমেন্ট আছে তো? সেদিকেও একটু নজর দিলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন হতো!’

Image: Instagram

মুশফিকুর রহিমও সংবাদ সম্মেলনে হাজির ‘কেমন দিলাম’ গোছের ভাবভঙ্গি নিয়ে। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম পাঁচ হাজার টেস্ট রান করা ব্যাটার হলেন তিনি। একটু এদিক-ওদিক হলে রেকর্ডটা যেতে পারত তামিম ইকবালের ঝুলিতেও; সেটা যে গেল না, এর পেছনে ভাগ্যের কোনো হাত আছে কি না, প্রশ্ন হয়েছিল এরকম। উত্তরে মুশফিকের কণ্ঠ বেশ ঝাঁঝালো,

‘আমি যখন অনুশীলনে যাই, আপনারা তখন ঘুমে থাকেন।’

মুশফিক যে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার, এ নিয়ে তর্কের সুযোগ তিলমাত্রও নেই। এবারকার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগের উদাহরণটাই সামনে টানুন। ফিফটি পাচ্ছিলেন বটে, তবে সেঞ্চুরি ছুঁতে পারেননি ৩১ ইনিংসেও। স্পিনের বিপক্ষে এমনিতে সাবলীল হলেও করোনা-বিরতির পর থেকে যে ১৭ টেস্ট ইনিংস খেলেছেন, তাতে ১১ বারই কাটা পড়েছিলেন স্পিনারদের বলে। সিরিজ শুরুর আগে তাই নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সঙ্গে খাটলেন বেশ কয়েক ঘণ্টা। টুকটাক কিছু ভুল শুধরে নিলেন, মনটাকে তৈরি করলেন বড় ইনিংস খেলতে। ফলটা পেলেন হাতেনাতে। দেখা পেলেন অষ্টম টেস্ট সেঞ্চুরির, দুই বছরের ভেতরে প্রথম।

একটু ভালো করে মুশফিকের ব্যাটিংটা দেখলে ধরা পড়বে, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকে এই সিরিজে সামান্য দুটো বদল এনেছেন। এই যেমন, আগে প্রাথমিক ট্রিগার মুভটা শেষে একটু খাড়া হয়ে দাঁড়াতেন, ব্যাটটাও শরীর থেকে দূরে সরে যেত কিছুটা। এখন আরও একটু বেশি কুঁজো হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, ব্যাটটাকেও শরীরের কাছাকাছি রাখতে চাইছেন, যেন অফ স্টাম্পের বাইরের বলগুলোতে তাড়া করতে না যায় ব্যাট।

ইনিশিয়াল ট্রিগার মুভমেন্টের পরে মুশফিক, এখন (বাঁয়ে) আগের চেয়ে সামান্য একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। Image: T Sports

কুঁজো হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে উইকেটের নিচু বাউন্সের যোগাযোগ খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে হাতটাও যেহেতু নিচে নামছে, লো বাউন্সের বলগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারার কথা তাই।

নিচু স্ট্যান্সের কারণে নিচু হওয়া বল খেলতে সহজ। তুলনামূলক ফুল লেংথের বলগুলোকে কাট করতেও সহজ। Image: T Sports

মুশফিকের ব্যাটিংয়ের দৃশ্যমান আরেকটা পরিবর্তন, অনেক বেশি সংখ্যক বল ব্যাকফুটে গিয়ে খেলতে চাইছেন এখন। মুশফিকের ওয়াগন হুইলটাই বোধ হয় পরিষ্কার ধারণা দেবে এক্ষেত্রে। ‘ভি’ বলে পরিচিত মিড-অন থেকে মিড অফ অঞ্চলে রান নিয়েছেন খুব কম। রানের বেশির ভাগই এসেছে কভার, পয়েন্ট, স্কয়ার লেগ কিংবা ফাইন লেগ দিয়ে।

মুশফিক ভি-তে খুব কম রানই পেয়েছেন। Image: BDCrictime

এর পেছনেও বোধহয় আগের আউটগুলোরই ভূমিকা। স্পিনারের বিপক্ষে আগের ১১টা ডিসমিসালের ১০টিই তো হয়েছিলেন সামনের পায়ে খেলতে গিয়ে।

তার ব্যাকফুট প্লে-টা আরও ভালো হয়েছে ফরোয়ার্ড প্রেসের কার্যকর ব্যবহারে। রিকি পন্টিং যেমন প্রথমে আলতো একটা ফরোয়ার্ড ট্যাপ করে নিজেকে ঠেলে দিতেন পেছনের পায়ে, একই জিনিস দেখতে পাওয়া গেছে মুশফিকের ক্ষেত্রে। ক্রিজেরও ব্যবহার করেছেন পুরোপুরি। নিচের ছবিটাতে দেখুন, কতটা ভেতরে গিয়ে তুলনামূলক ফুল লেংথের বলগুলোকেও খাটো লেংথের বানিয়ে নিয়েছেন তিনি।

আগে যে বলগুলো ফ্রন্ট ফুটে খেলতে চাইতেন, সে বলগুলোতে এখন ব্যাকফুটে যাচ্ছেন। Image: T Sports

কিন্তু এ সবই তো মুশফিকের ব্যক্তিগত তৃপ্তি, ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। দলের কতটা লাভ হলো এতে? খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত অর্জন দলের উপকার না করে ক্ষতি করেছে, এমন কথা বললে সত্যের অপলাপই হবে। মুশফিকের সেঞ্চুরি না হলে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম টেস্ট হেরে যাচ্ছে, এমনটাও হতে পারত। কিন্তু প্রশ্ন যদি হয়, মুশফিকের ইনিংসটাই বাংলাদেশের জয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কি না, সেখানটায় কী উত্তর পাওয়া যাচ্ছে?

চট্টগ্রামের মন্থর পিচে ৪০ উইকেটের পতন মোটামুটিরকম অসম্ভব, সে ধারণা একদম প্রথম দিনই পাওয়া গিয়েছিল। দিন যত গড়িয়েছে, এই ধারণা প্রমাণিত সত্যের রূপ নিয়েছে তত। শেষে তো এক ঘণ্টা আগেই ড্র মেনে নিল দুই দল।

Image: AFP via Getty Images

 

নিকট অতীতে এমন মরা পিচে অবশ্য পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজেও খেলা হয়েছে। প্রথম তিন দিনে রান উঠেছে ওভারপ্রতি মাত্র পৌনে তিন করে, জয়ের সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে এক দল ব্যাট করছে ১৮৭ ওভার অব্দি, কিংবা উইকেটে বাউন্সার উঠছে না বুকের ওপরে, এমন দৃশ্যগুলো গত মার্চ-এপ্রিলেরই। তবে ওইসব উইকেটেও যাদের জয়ের আকাঙ্ক্ষা বেশি, খেলার গতি বাড়াতে ঠিকই উদ্যত হয়েছিল তারা। অস্ট্রেলিয়া যেমন দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে দিয়েছিল ২ কিংবা ৩ উইকেট পড়তেই, অ্যান্টিগা আর ব্রিজটাউনে ইংল্যান্ড আবার রান তুলেছিল ওভারে চার-সাড়ে চার করে। পিচ সমর্থন দিচ্ছে না বলে জেতার চেষ্টাটাও করা যাবে না, তেমনটা তো হতে পারে না!

মুশফিকের সেঞ্চুরিটা নিয়েও কি একই কথা বলা যাবে? রানের খাতা খুলতে সময় নিয়েছিলেন ৮ বল, দুই অঙ্কে পৌঁছেছিলেন ৩৪তম বলে। মাত্র ২ চারে ফিফটি ফিফটি পূর্ণ করা মুশফিক পরের পঞ্চাশ পূর্ণ করতেও মেরেছিলেন একই সংখ্যক চার। বাংলাদেশের হয়ে সেঞ্চুরি পাওয়া কোনো ইনিংসে এর চেয়ে কম বাউন্ডারি মারার রেকর্ড নেই, মুশফিকের ক্যারিয়ারেও এর চেয়ে মন্থর কোনো সেঞ্চুরি নেই।

পুরো ইনিংসে গতি ত্বরান্বিত করার ব্যাপারটা কই? Image: Arko Saha/Rezwan Rahman Sadid

সেঞ্চুরি নিয়ে হতাশা জাগার মুখ্য কারণটা অবশ্য চতুর্থ দিনের ব্যাটিং। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে ৭৯ রানে পিছিয়ে ছিল দিনের শুরুতে, প্রথম সেশনে হওয়া ২৭ ওভারে ৬৭ রান তোলার একটা ব্যাখ্যা না হয় এখান থেকে পাওয়া যায় যে আগে প্রথম ইনিংসের ঘাটতি মেটানোতেই মন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সেশনে মোটে ৪৯ রান তোলার ব্যাখ্যা কী? ক্রিজে পুরোপুরি শেকড় গেঁড়ে কেন এক সেশনে মাত্র ১৯ রান তুলবেন মুশফিক?

প্রশ্নটা উঠছে এ কারণেই। এই একই ছন্দে খেলে যাওয়া ইনিংসটা আসলে কী উদ্দেশ্য সাধন করল? শ্রীলঙ্কাকে শেষ পর্যন্ত অলআউট করা যায়নি, তবে পঞ্চম দিনের খেলা অর্ধেক বাকি থাকতেই প্যাভিলিয়নে ফেরত গিয়েছিলেন ছ’জন শ্রীলঙ্কান ব্যাটার; লিড ৬৭-এর বদলে ১৬৭ হলে কি শ্রীলঙ্কাকে আরও শক্তরকমে চেপে ধরা যেত? এমন প্রশ্নও বেশ যুক্তিযুক্ত।

মুশফিক নিজেই বলেছেন, উইকেটে তেমন কোনো জুজু ছিল না। চতুর্থ দিনও ব্যাটিংয়ের জন্য যথেষ্ট ভালো উইকেটই পাওয়া গেছে। এরপরও যখন ব্যাটিংয়ে ইন্টেন্টের ঘাটতি দেখা গেছে দিবালোকেই, তখন তো বলতেই হয়, জয়ের চেষ্টা দূরে থাক, জেতার ইচ্ছেটাই তার কিংবা দলের মাঝে ছিল না। ব্যাটিংয়ের এই ইতিবাচকতার অভাবকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন ক্রিকেট গুরু নাজমুল আবেদীন ফাহিমও। ‘আরেকটু ইতিবাচক হতে পারত বাংলাদেশ,’ নিজের লেখা কলামের শিরোনাম করেছেন এমনটাই।

তবু এই সেঞ্চুরিকে মুশফিকের স্ত্রী দেখছেন জবাব হিসেবে। অবশ্য তার তোলা ‘রিপ্লেসমেন্ট কোথায়’ প্রশ্নের জবাবও বোধহয় এই ইনিংসটাই।

এমন ইনিংসের রেপ্লিকা না হলেই ভালো।

This article is in Bangla language. This article is on Mushfiqur Rahim's 8th test century. Necessary hyperlinks are attached inside.

Featured Image © Shamsul Haque

Related Articles

Exit mobile version