২৬ মে, ২০১৮। প্রায় অভাবনীয় কাজটিই করে বসে রিয়াল মাদ্রিদ। টানা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার হ্যাটট্রিক করে ফেলে তারা। গ্যারেথ বেলের জয়সূচক গোলের পর উদ্বেল মাদ্রিদিস্তারা ভুলে যাওয়ার মতো একটি মৌসুমের পরও ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা আবার ঘরে তোলার আনন্দে বিভোর।
রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর থেকেই একের পর এক শেল আসতে থাকে রিয়াল ফ্যানদের দিকে! রোনালদো ইঙ্গিতে মাঠেই বলেন তার সম্ভাব্য রিয়াল ছাড়ার কথা, একই কথা বলেন সেই ফাইনালের নায়ক বেলও। রোনালদো এমন আগেও কয়েকবার করেছেন বিধায় প্রথমে তেমন গা করেননি মাদ্রিদিস্তারা।
কিন্তু ২৮ মে, ভালভাবে ৭২ ঘন্টাও যায়নি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের । সবচেয়ে বড় বোমাটি ফাটলো। আচমকা প্রেস ব্রিফিং ডেকে মাদ্রিদ ছাড়ার ঘোষণা দেন জিদান। সম্ভবত রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে এত চমক আর দেখা যায়নি। পাশে বসে থাকা বিহ্বল পেরেজের মুখাবয়বই বলে দিচ্ছিল কোচ বরখাস্ত করে অভ্যস্ত মাদ্রিদ এই চমকের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
চাপ আসছিল রোনালদো, গ্যারেথ বেলের তরফ থেকেও। রোনালদো কখনোই চাপা স্বভাবের নন, নেতৃত্ব থেকে আবেগ- সবই প্রকাশ করে ফেলেন। তাই ক্লাবের সাথে আগেও হালকা মনোমালিন্য হলে তার কথায়, আচরণে সেটা ফুটে উঠতো। অতীতেও এমন ক্লাব ছাড়ার গুজবে অভ্যস্ত সমর্থকরা জিদানের ছেড়ে যাওয়ার ধাক্কায় তেমন পাত্তাই দিচ্ছিলেন না রোনালদোর ক্লাব ছাড়ার সম্ভাবনাটা। মাঝখান দিয়ে প্রায় ‘শূন্য সম্ভাব্য’ ক্লাব হিসেবে জুভেন্টাস রোনালদোকে নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। রিয়াল একধাক্কায় হারায় তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় ও কোচকে।
প্রিয় পাঠক, মোটাদাগে এবং আদতেই এতে রিয়াল মাদ্রিদের ক্ষতি চোখে পড়ে এবং তা-ই সত্য। কিন্তু আজকের এই লেখায় কিছুটা ভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে- কেন এ দুজনের একত্রে বিদায় আদতে শাপেবর হয়ে আসতে পারে রিয়ালের জন্য।
যদি বিদায়টা আলাদা আলাদা হতো!
চিত্রকল্প-১
২০০৬-০৮ এর রোনালদোর মৌসুমে গোলসংখ্যা আর ২০১১-১৮ অবধি তার গোল সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় সময়ের সাথে সাথে রোনালদোর খেলার ধাঁচ বদলেছে। উইংগার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু হলেও গোলমুখে এত দক্ষতার কারণে রিয়ালে সব কোচই এমনভাবে ট্যাকটিক্স ঠিক করতেন যাতে আদতে কাগজে-কলমে রোনালদো বামে খেলা শুরু করলেও সময়মতো যেন ঠিকই ডি-বক্সে আসতে পারেন।
এই গেমপ্লে সেট করা এতটা সহজ না যতটা ভাবা হয়। যেহেতু রিয়ালের পুরো আক্রমণের লক্ষ্যই থাকে, ফাইনাল পাসে রোনালদোকে পাওয়া, তাই তাকে ছাড়া যেকোনো কোচেরই ভুগতে হতো। ধরা যাক, এবার জিদান থেকে গেলেন, কিন্তু রোনালদো ক্লাব ছাড়লেন। তিন বছরের গড়ে তোলা রোনালদো-কেন্দ্রিক গঠন জিদানের ভাঙতে হতো। এখনকার নতুন কোচ যে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন তাতে জিদানকেও পড়তে হতো। অর্থাৎ যেকোনো সময় যেকোনো কোচের জন্যই রোনালদোর বিদায় একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিতো।
চিত্রকল্প-২
এবার ধরা যাক, জিদান চলে গেলেন, কিন্তু রোনালদো থেকে গেলেন! জিদান কেবল একজন কোচ নন, এর চেয়ে বড় ছিল তার ব্যক্তিত্ব। অর্জন, প্রভাব সব মিলিয়ে জিদানের সমান ফুটবল বিশ্বে বেকেনবাওয়ার, পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো ছাড়া তেমন কেউ নেই।
এই মহীরুহ-সম ব্যক্তিত্ব মাঝমৌসুমে টালমাটাল এক রিয়ালকে পেয়ে সেবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতান। এরপর টানা তিনবার একই ট্রফি, সাথে লিগ সহ অন্যান্য ট্রফি। জিদানের সাফল্যের ছায়া তার উত্তরসূরী যেকোনো কোচকেই তাড়া করবে। এখন দেখা গেল, নতুন কোচ এলেন। জিদানের সাফল্যের চাপ মাথায় নিয়েও রোনালদোকে কেন্দ্র করে দল সাজালেন।
যেকোনো দলকে গড়ে তুলতেই একটু সময় লাগে। এক বছর ধরে দল গড়ার পর যদি দেখতেন রোনালদো ক্লাব ছেড়ে গেছেন পরের বছর, তখন আবার দলের কাঠামো ভাঙতে হতো। উল্টো ভোগান্তির সময়টা একবছর পেরিয়ে দুই বছর বা এর চেয়েও বেশি সময়ে যেত। তাই আলাদা আলাদাভাবে রোনালদো এবং জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার চেয়ে এক চিন্তায় দুজনেরই একসাথে ক্লাব ছাড়াটা নতুনভাবে শুরু করার জন্য সহায়ক। ক্লাবের প্রতি রোনালদো ও জিদানের যা অবদান এবং তাদের যা ব্যক্তিত্ব, এতে প্রত্যেকের ছেড়ে যাওয়াটাই একেকটা ধাক্কা। আর দুবার ধাক্কা খাওয়ার চেয়ে একবার সহ্য করে নতুন করে শুরু করা ভাল নয় কি?
অপ্রিয় বাস্তবতা
ফুটবল বিশ্ব প্রচন্ড রকম নিষ্ঠুর। ফর্মে থাকা একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে মাতামাতির যেমন শেষ থাকে না, তেমনই ফর্ম পড়ে গেলে তার আর কিছু থাকে না। একসময়ের ভয়ানক স্ট্রাইকার তোরেস ফর্ম হারানোর সাথে সাথেই হয়ে যান ট্রলভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শিকারের বস্তু।
রোনালদোর বয়স সাড়ে ৩৩, সামনের বছর প্রায় ৩৫ হতে যাওয়া রোনালদোর ব্যাপারে রিয়াল আর্থিক বিষয়টাও একটু বেশিই ভেবেছে। এটা ঠিক যে, রোনালদোর ফর্ম এত সহজে পড়বে না, কিন্তু যদি পড়ে যেত তবে এখন যে অঙ্কের অর্থ পেয়েছে তা রিয়াল পেতো না। রোনালদোর প্রসঙ্গে টাকা-পয়সা আসলেই অবান্তর, কিন্তু এর চেয়ে বড় সত্য একদিন না একদিন রিয়াল ছাড়তেই হতো তার। সেই দিনটা একটু বেশিই এগিয়ে এসে গিয়েছে। কিন্তু সুবিধা ঐ একটা দিকেই, জিদান ও রোনালদোর একসাথে বিদায়ের ধাক্কাটা একবারেই সামলানোর সুযোগ এসেছে রিয়ালের সামনে।
কোচ লোপেতেগির ধরনও বিবেচ্য
কিছু কোচ থাকেন যাদের নিজস্ব দর্শন থাকে, যারা একটা নির্দিষ্ট গঠনে দলকে খেলান। আপনি হঠাৎ সিমিওনের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে পেপ গার্দিওলার হাতে তুলে দিয়ে সাফল্য পাবেন না। প্রত্যেক কোচেরই পছন্দের ধাঁচের খেলোয়াড় থাকে। বর্তমান কোচ লোপেতেগির খেলা মাঝমাঠভিত্তিক, আর ঠিক এই জায়গাতেই বিশ্বের সেরা দল রিয়াল মাদ্রিদ।
ক্রুস, মড্রিচ, ক্যাসেমিরো, ইস্কো প্রত্যেকের মাঝমাঠ সামলানোর দক্ষতা অতুলনীয়। কোচ যেমন ধরনের খেলোয়াড় চান, মাঝমাঠে তার সবই পেয়েছেন। কারভাহাল-মার্সেলোর মতো উপরে উঠে আসতে পছন্দ করা উইংব্যাকই তার পছন্দের। তা-ও রিয়ালে আছে। এখন তার সামনে একটাই বড় কাজ- আক্রমণকে পুনর্গঠন করা। বর্তমান কোচের কৌশলের আরেকটি বড় দিক হলো কাউন্টার প্রেসিং। এর মানে, বল হারানোর সাথে সাথেই প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করে সাথে সাথেই বল উদ্ধার করে নতুন আক্রমণ শুরু করা। এই কৌশলে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়। বয়সের কারণে রোনালদো রিয়ালে এই কাজ করতেন না বা কোচেরাও এই কৌশল নিতেন না।
রোনালদো মানে মৌসুমে ৫০ গোলের নিশ্চয়তা। বর্তমানে মেসি ছাড়া আর কেউ কি আছে যে এর সমান গোল দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে? না। তাই রোনালদোর হুবহু বিকল্প রিয়াল পাবে না। রিয়ালের খুঁজতে হবে এমন একজন যে ২৫-৩০ গোল দিতে পারে এবং সেই সাথে বেল-আসেনসিওকে দলে আরো ভালো করে সক্রিয় করতে হবে। সোজা কথা, রিয়ালে একটা কাঠামো দাঁড় করাতে হবে যেখানে গোল-রক্ষণ-মাঝমাঠের আদর্শ ভারসাম্য থাকবে।
লোপেতেগির যে স্পেন দলকে বিশ্বকাপের জন্য ফেভারিট ভাবা হচ্ছিল সেই স্পেনের আদতে কোনো ভাল নাম্বার নাইনই ছিল না। কিছুদিন মোরাতা, কিছুদিন ফলস নাইন হিসেবে আসপাস বা শেষ দিকে কস্তা। সেই দলে রোনালদো ছিলেন না, কিন্তু দলের গোলগড় ছিল ম্যাচপ্রতি প্রায় ৩! অর্থাৎ একটা কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। ২০১৪ সালে সিমিওনের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ লিগ জিতেছিল, উঠেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। সেবার তাদের দলে মেসি-রোনালদোর মতো কোনো স্কোরার ছিল কি?
রিয়ালের গড়ে তুলতে হবে একটা শক্ত ভিত্তি। এখন মুহুর্মুহু হ্যাটট্রিক করার লোক আর দলে নেই। তাই অন্য অংশগুলোয় জোর দিতে হবে, বিশেষত রক্ষণ। লোপেতেগি স্পেনের হয়ে এটি করে দেখিয়েছেন স্বল্প সময়ের মাঝে ভাল একটি দল গড়ে তুলে। তার আরেকটি ভাল বিষয় হলো, তরুণ প্রতিভাদের ভালো করে গড়ে তোলা। আর রিয়ালের পাইপলাইনে এখন তরুণ প্রতিভার ছড়াছড়ি। ব্রাজিলের দুই প্রতিভা ভিনিসিয়াস-রদ্রিগো, নরওয়েজিয়ান ওডেগার্ড, ভালভার্দে, ভালেহোরা যোগ্য সাহায্যের হাত পেতে যাচ্ছে। আছেন নিজেকে আরো বড় পরিসরে প্রমাণ করতে প্রস্তুত আসেনসিও। যদি এখান থেকে দুজনও তাদের প্রতিভার পূর্ণতা পেতে পারেন, তবে রিয়ালের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
পরিবর্তিত ট্রান্সফার বাস্তবতায় পেরেজ বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে খেলোয়াড় কেনার পথ থেকে সরে এসেছেন। এখন রিয়ালের দর্শন অনেকটাই যুব প্রতিভাভিত্তিক। সামনে তাকাতেই হবে রিয়ালকে। আর সেই চিন্তায় একইসাথে দুই মহীরুহের প্রস্থান একই সময়ে নতুন যুগ শুরু করার জন্য এক অর্থে সহায়ক। তবে রিয়াল মাদ্রিদকে কিছু খেলোয়াড় কিনতেই হবে। আক্রমণে বিকল্প কম, জানুয়ারির দিকে বিকল্প দলে কাজে লাগবেই। রক্ষণ ও আক্রমণে ৭০ ম্যাচের এক মৌসুম রিয়াল চোটহীনভাবে সবাইকে পাবে- এ আশা সবচেয়ে আশাবাদী সমর্থকও করেন না। আমরা তাত্ত্বিকভাবে যতই সম্ভাবনা দেখাই না কেন, দলে ভালো বিকল্প খেলোয়াড় না পেলে কোচ এত বড় ধাক্কা সামাল দিতে পারবেন না। ভবিষ্যৎ প্রতিভা বিকাশের আশায় আর যা-ই হোক, রিয়ালের মতো ক্লাব বর্তমানকে অবহেলা করতে পারে না। বিশেষত যখন জিদান-রোনালদো ক্লাব ছাড়েন, সেই মধ্যবর্তী টালমাটাল সময়ে ক্লাবকে সক্রিয় হতেই হবে।
ইতিহাস বলে, রিয়াল-বার্সা বিপদে পড়ে, কিন্তু ভেঙে পড়ে না। দেল বস্ক বা গার্দিওলা কারো বিদায়েই রিয়াল বা বার্সা ভেঙে পড়েনি, ভেঙে পড়েনি রাউল বা রোনালদিনহো-জাভিদের বিদায়েও। রিয়ালকেও ভুগতে হবে। রোনালদো কেবল গোলস্কোরারই ছিলেন না, ছিলেন একজন নেতা। ড্রেসিংরুমে দলকে তাতানোর দায়িত্ব পালন করতেন, প্রতিকূল অবস্থায় দলকে টেনে তুলতেন, যখন বেশি দরকার তখনই জ্বলে উঠতেন। এতসব একজনের মধ্যে পাওয়া সম্ভব না কেবল অর্থ দিয়ে খেলোয়াড় কেনার মাধ্যমে।
কোনো ক্লাবই চাইতো না এমন দুজনের একত্রে চলে যাওয়া। রক্তমাংসের জিদান-রোনালদো চলে গেলেও তাদের প্রভাব রয়েই গেছে। কিন্তু এমন দুই মহীরুহের আলাদা বিদায়ের চেয়ে একইসাথে বিদায় ভিন্ন চিন্তায় ভালোও হতে পারে। পুরো দলকেই এখন অন্যভাবে তৈরি করতে হবে। আর সেটা এখন শূন্য থেকে করার সুযোগ এসেছে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও। এর উপরই নির্ভর করবে রিয়ালের পরবর্তী পাঁচ বছরের পথচলা। হয়তো নবসূচনার পথে একই সময়ে দুজনের চলে যাওয়াটা শাপেবরও হতে পারে।
ফিচার ইমেজ: gist community