আমি প্রার্থনা করছিলাম যেন শেষ ওভারটা আমাকে করতে দেয়।
সত্যিই তাকে শেষ ওভারটা দেয়া হয়েছিল। বেশিরভাগেরই মনে হয়েছিল চাপের মুহূর্তে অভিজ্ঞ হরভজন সিংকে শেষ ওভার দেবেন ধোনি। কিন্তু ধোনি ভরসা রাখলেন তার উপরই।
বলা হচ্ছে যোগিন্দর শর্মার কথা। ২০০৭ আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-২০-এর ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান। গ্রুপ পর্বে দুই দল যখন মুখোমুখি হয়েছিল তখন শ্বাসরুদ্ধকর ‘বোল আউট’-এ নিষ্পত্তি হয়েছিল ম্যাচের। ফাইনালও ইঙ্গিত দিচ্ছিল সেরকম সমাপ্তিরই।
শেষ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন ১৩ রান। হাতে ১ উইকেট। তবে পাকিস্তানের জন্য স্বস্তির কারণ ছিল স্ট্রাইক প্রান্তে মিসবাহ উল হকের উপস্থিতি। এমতাবস্থায় অভিজ্ঞ হরভজন নয়, অনভিজ্ঞ যোগিন্দর শর্মার উপর ভরসা রাখলেন ধোনি। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও শেষ ওভারে বল করেছিলেন যোগিন্দর। তবে পরিস্থিতি এবারেরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ার শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২২ রান, পাকিস্তানের প্রয়োজন ১৩। তার উপর ম্যাচটা ফাইনাল। একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেলেই পুরো দোষ চাপবে অধিনায়ক ধোনির ঘাড়ে।
শেষ ওভারের প্রথম বল করলেন যোগিন্দর। ঠিক প্রথম বল নয়। কারণ বলটা ওয়াইড সীমানার বাইরে দিয়ে গিয়ে জমা পড়েছে ধোনির হাতে। তবে কি ভুল করলেন ধোনি?
শেষ ওভারের প্রথম আইনসিদ্ধ বল করার জন্য বোলিং মার্কে ফিরে গেলেন যোগিন্দর। এবার বলটা ওয়াইডের সীমানা ছুঁই-ছুঁই করে ধোনির হাতে জমা পড়ল। ক্যামেরা ধরা হলো আম্পায়ারের দিকে। আম্পায়ার ওয়াইডের সংকেত দিলেন না। কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ধোনি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ভারত সমর্থকেরা। পাকিস্তানের প্রয়োজন ৫ বলে ১২।
এই স্বস্তি স্থায়ী হয়নি। যোগিন্দর শর্মার করা দ্বিতীয় বল তারই মাথার উপর দিয়ে সাইট স্ক্রিনের পেছনে ফেললেন মিসবাহ। ফাইনালের চাপ, প্রত্যাশার চাপ পেয়ে বসেছিল যোগিন্দরকে। ধোনির জুয়াটা কি তবে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল?
পাকিস্তানের প্রয়োজন ৪ বলে ৬। ধারাভাষ্য কক্ষে রবি শাস্ত্রী বললেন,
Pakistan is just one strike away.
পরের বল করলেন অফ স্টাম্পের বাইরে। মিসবাহ খেললেন স্কুপ শট। ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচেও ২০তম ওভারে একই শট খেলে বাউন্ডারি পেয়েছিলেন মিসবাহ। কিন্তু সেবার ফাইন লেগ বৃত্তের ভেতরে থাকলেও এবার ছিল বাইরে। বল জমা পড়লো শ্রীশান্তের হাতে। অলআউট হলো পাকিস্তান। যোগিন্দর শর্মা ভারতকে জেতালেন ইতিহাসের প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপ।
অবাক করা ব্যাপার, ভারতকে একটা বৈশ্বিক শিরোপা জেতানো যোগিন্দর শর্মা আর কখনোই খেলতে পারেননি ভারতের হয়ে। তবে ভারতের হয়ে মাত্র চার ওয়ানডে আর চার টি-২০ খেলা হরিয়ানার এই বোলারকে মনে রাখতে সেই শেষ ওভারের কীর্তিটাই যথেষ্ট।
অনেক বেশি সম্ভাবনা নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে আগমন ঘটেছিল যোগিন্দরের। ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেবের রাজ্য হরিয়ানা থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। হরিয়ানার হয়ে ২০০২-০৩ মৌসুমে মধ্য প্রদেশের বিপক্ষে অভিষেক হয় যোগিন্দরের। ব্যাট হাতে রান করেছিলেন ৮১। বেশ ভালো অভিষেক। তবে তার প্রাথমিক দক্ষতা বোলিংয়ে মধ্য প্রদেশের ব্যাটিং লাইনআপে নামিয়েছিলেন ধস। ম্যাচে ৮৪ রান দিয়ে ১১ উইকেট পান যোগিন্দর। হরিয়ানা ম্যাচ জেতে ১০৩ রানে।
অভিষেক মৌসুমে ১৭ বোলিং গড়ে ২৪ উইকেট নেন তিনি, ব্যাট হাতেও ৪৭ গড়ে করেন ২৮০ রান। পরের মৌসুমেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ২৩ বোলিং গড়ে ২৩ উইকেট নিয়েছিলেন। ব্যাট হাতেও ৬৮ গড়ে রান করেন ১৪৮।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের হয়ে টি-২০ ক্যারিয়ারও লম্বা হয়নি তার। মিসবাহকে আউট করা ডেলিভারিটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যোগিন্দরের করা শেষ ডেলিভারি ছিল।
তবে হরিয়ানার হয়ে ২০১৬ পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে যান তিনি। মাঝে ২০১১ সালে এক দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পান তিনি। সার্জারির পর বেশ কিছুদিন আইসিইউতে চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। হরিয়ানা রাজ্য দলের ফিজিও অমিত তিয়াগির সহায়তায় ধীরে ধীরে সেরে উঠে ২০১২-১৩ মৌসুমে ক্রিকেটে ফেরেন।
আইপিএলে ২০১১ পর্যন্ত খেলেছেন এমএস ধোনির অধীনে, চেন্নাই সুপার কিংসে। ১৬ ম্যাচে ১২ উইকেট পেয়েছেন আইপিএল ক্যারিয়ারে।
হরিয়ানার অধিনায়কত্ব করেছেন, খেলেছেন ৭৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ। ২১ বোলিং গড়ে ২৯৭ উইকেট নিয়ে বেশ সফল তার প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার।
…
করোনাভাইরাসের এই সংকটের মুহূর্তে হরিয়ানার হিসার রাজ্যে জোর দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশের ডেপুটি সুপারইন্টেন্ডেন্ট। লকডাউনের সময় লোকজন যেন সঠিকভাবে নিয়মকানুন মেনে চলে সেজন্য মুখে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন তিনি। কিন্তু তাতে কী? নেমপ্লেটে নাম দেখে চিনতে ভুল হয় না, এ তো সেই ক্রিকেটার যোগিন্দর শর্মা! লোকজন সেলফি তুলতে চায়, অটোগ্রাফ চায়। বিনয়ের সাথে তাদের অনুরোধ ফিরিয়ে কাজে মন দেন যোগিন্দর। ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর চেয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যে তার সামনে।
“ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পর থেকে আমি একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি। অনেক কিছু দেখেছি, অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু এবারের চ্যালেঞ্জটা পুরো আলাদা। মানুষকে তো বোঝাতে হবে যে এই শত্রুকে মোকাবেলা করার কোনো অস্ত্র (ভ্যাক্সিন) নেই,” বলেন ডিএসপি যোগিন্দর শর্মা।
সকাল-সন্ধ্যা কাজ করার পরও প্রস্তুত থাকতে হয় রাতেও, যদি জরুরি কোনো প্রয়োজনে কল আসে। যে এলাকায় কাজ করছেন সেটা গ্রামের ভেতরেই পড়ে। তাই কাজটা বেশ কঠিন। অনেকের কাছ থেকেই প্রশ্ন আসে- “করোনাভাইরাস জিনিসটা কী?” “কীভাবে ছড়ায়?” “কী করলে আক্রান্ত হবো?”
সবকিছুর জবাব দেন যোগিন্দর। এতজন মানুষের সংস্পর্শে আসেন প্রতিদিন, ভয়টা যে কাজ করে না তা না। তবুও অবিচল চিত্তে কাজ করে যেতে হয়, কারণ ১৩ বছর আগে যেভাবে ভারতকে জিতিয়েছিলেন, এবারও যে জেতাতে হবে সেভাবে।
“ক্রিকেটের কথা তেমন মনে আসে না এখন। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি বেশিরভাগ সময়। এমনকি যে সময়টায় কাজ থাকে না সে সময়টাতেও করোনাভাইরাস বিষয়ক তথ্য পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করতে হয়। কোয়ারেন্টিনে থাকা কেউ যদি অসুস্থ বোধ করে তাহলে আমাকে যথাযথ জায়গায় তথ্য পাঠাতে হয়,” ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে বলেন যোগিন্দর।
রোহতাক থেকে দেড় ঘণ্টা দূরে থাকে তার পরিবার। কিন্তু যোগিন্দর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবারের সাথে দেখা না করবার। প্রতিদিন কত মানুষের সংস্পর্শে আসেন, যদি পরিবারের কোনো ক্ষতি হয়!
বাস্তব জীবনের নায়কেরা বোধহয় এমনই হন। নিজের দায়িত্ব পালন করে যান শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও। ভারতকে টি-২০ বিশ্বকাপ জেতানো যোগিন্দর শর্মা তেমনই এক নায়ক। বিশ্বের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে লড়ে যাচ্ছেন অবিচল চিত্তে। এই লড়াইয়ে জয় পেলে সেটা যে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে হাজারগুণ তৃপ্তি দেবে যোগিন্দরকে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
যোগিন্দর নাথ শর্মা, আপনাকে স্যালুট।