২০১৭ সাল, ২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ম্যাচে শক্তিশালী রংপুর রাইডার্সকে ৯৭ রানে অলআউট করে দেয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ২২ রানে চার উইকেট নিয়ে অফ স্পিনার মেহেদী হাসানই বড় সর্বনাশটা করেছিলেন রংপুরের।
ওই ম্যাচের পর কুমিল্লার কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে করা প্রশ্নটা ছিল এমন, ছেলেটা ছিল ওপেনার, একটা ব্যাটসম্যান। আপনি পুরো বদলে দিলেন ওকে, এখন অফস্পিনার হয়ে গেল ছেলেটা!
সালাউদ্দিনের জবাবটা ছিল,
‘আপনার কি মনে হয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ও জাতীয় দলে খেলতে পারবে? এখন জাতীয় দলে ব্যাটসম্যান হিসেবে সুযোগ কতটা কঠিন। ব্যাটিং তো আছেই, সঙ্গে যদি বোলিংটাও ভালো করতে পারে, ওর সুযোগ থাকবে।’
মেহেদী হাসান, খুলনার ক্রিকেটার। বিপিএলে প্রতিনিয়ত নিজের পরিচয়কে নতুন করে তুলে ধরছেন এই তরুণ। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেই পরিচিত তিনি। বরিশাল বুলসের হয়ে ২০১৬ সালে বিপিএলে অভিষেক। কিন্তু সেভাবে বিপিএলে নজর কাড়তে পারেননি। ২০১৭ সালে সালাউদ্দিনের অধীনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সে যোগ দিয়েই নতুন পরিচয় নিয়ে হাজির হন মেহেদী। অফ স্পিনার হিসেবে চমকে দেন সবাইকে।
ওই বছর ১৮ নভেম্বর রংপুর রাইডার্সের বিরুদ্ধে কুমিল্লার হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলেন মেহেদী। প্রথম ম্যাচে ৪ ওভারে ১৫ রানে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন তিনি। পরের দুই ম্যাচ উইকেটশূন্য ছিলেন। চতুর্থ ম্যাচে ২ ওভারে ১ মেডেনসহ ৮ রানে নেন ১ উইকেট। ওই আসরে রংপুরের বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচে আবারও মেহেদীর স্পিন ভেল্কি দেখা যায়। ২ ডিসেম্বরের ওই ম্যাচই মূলত মেহেদীর ‘অফ স্পিনার’ পরিচয়টাকে স্বীকৃতি এনে দেয়। ২২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন এই তরুণ। সালাউদ্দিনের ‘ট্রাম্পকার্ড’ মেহেদীর অফ স্পিন বাম্পার ফলনই দিয়েছিল ওই আসরে। ১০ ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করেছিলেন মেহেদী।
তারপর থেকে ঢাকার ক্রিকেটে মেহেদীর পরিচয়টা অফস্পিনার। নামের পাশে খোদাই হয়ে যাওয়া এই পরিচয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জার্সিতে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও অভিষেক হয়েছিল তার। সিলেট স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওই এক টি-টোয়েন্টি খেলেই তিনি আবার বাদ পড়েছিলেন জাতীয় দল থেকে। এবার বঙ্গবন্ধু বিপিএলে নিজের পরিচয়টা নতুন করে লিখছেন মেহেদী।
স্পিনারের মূল ভূমিকার পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও ঝড় তুলছেন ২৫ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। ঢাকা প্লাটুনের হয়ে চট্টগ্রামে রীতিমতো বিধ্বংসী এক ব্যাটসম্যান রূপে ধরা দিয়েছেন তিনি। কোচ সালাউদ্দিনের আস্থা পেয়ে ব্যাট হাতে চমক দেখিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম পর্বের শেষ দুই ম্যাচে ঢাকা প্লাটুনের জয়ের নায়ক ‘ব্যাটসম্যান’ মেহেদী।
গত ২৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে ২৯ বলে ৫৯ রান করেছেন তিনি, যেখানে ছিল ২টি চার ও ৭ ছয়ের মার। এর মধ্যে রবিউল ইসলাম রবিকে এক ওভারেই মেরেছেন ৪টি ছক্কা। গত ২৪ ডিসেম্বর সিলেট থান্ডারের বিরুদ্ধেও চট্টগ্রামের দর্শকরা দেখেছে মেহেদীর ব্যাটের অগ্নিমূর্তি। তিনে নেমে ২৮ বলে ৫৬ রান করেছেন মেহেদী। ম্যাচ শেষ করে আসতে না পারলেও তার ইনিংসে ছিল ৫টি চার, ৩টি ছক্কা। দুই ম্যাচেই তামিম ইকবালের সঙ্গে বড় জুটি হয়েছে তার।
এবং বলা বাহুল্য, দুই ম্যাচেই মেহেদীর ব্যাটের দ্যুতিতে আড়াল হয়ে গিয়েছিলেন তামিম। যেন ২২ গজে এই তরুণকেই সঙ্গ দিচ্ছিলেন অভিজ্ঞ তামিম। কুমিল্লার বিপক্ষে ৮৩ রান, সিলেটের বিরুদ্ধে ৮৭ রানের জুটি গড়েছেন তারা। দুই ম্যাচেই কোচের লাইসেন্স পেয়ে উপরে এসে প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিয়েছেন মেহেদী, এক প্রান্তে তোপ দাগিয়েছেন। উভয় ম্যাচে বল হাতেও উইকেট নিয়েছেন; কুমিল্লার বিরুদ্ধে ৯ রানে ২টি, সিলেটের বিপক্ষে ৩৩ রানে ১টি উইকেট নেন তিনি। ম্যাচসেরার পুরস্কারও গিয়েছে তার দখলে।
মেহেদীর ‘পরিচয়’ বদল
নামের সাথে স্থায়ী হয়ে যাওয়া অফ স্পিনার পরিচয়কে সামনে রেখেই ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের সামর্থ্য দেখিয়েছেন মেহেদী। চট্টগ্রামের রানস্বর্গ তার পরিচয় বদলানোর মঞ্চ হয়েই থাকবে। যদিও এই তরুণ বলছেন, বদলে ফেলার কিছু নেই। সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে বদলে ফেলা সম্পর্কে মেহেদী বলেছেন,
‘আসলে বদলে ফেলার কিছু নাই। আমরা তরুণ ক্রিকেটার। আমাদের প্রমাণ করার অনেক জায়গা আছে। আমরা এখনও শিখতেছি। যত উন্নতি করতে পারব তত আমাদের জন্য ভালো। শেখার কোনো শেষ নেই।’
উপরে ব্যাটিংয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন মেহেদী। আর ব্যাট হাতে ঘরোয়া ক্রিকেটের অভ্যাসটা সাহায্য করেছে তাকে। এই তরুণ বলেছেন,
‘দেখেন, আমি যখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কিংবা লিস্ট-এ ক্রিকেট শুরু করি তখন কিন্তু আমি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানই ছিলাম। খেলতে খেলতে বোলার হয়ে যাওয়ায় আমাকে সব জায়গায় খেলানো হয়। বিপিএলে আমি যেসব দলে খেলেছি, ব্যাটিং লাইনআপ অনেক ভালো ছিল দেশি-বিদেশি মিলিয়ে, যে কারণে তেমন সুযোগ হয়নি। যেটা বললাম, আমাদের দলে ইনজুরির সমস্যা আছে। সেজন্য আমাকে এই জায়গায় পাঠানো হয়েছে, এবং আমি সফল হয়েছি। সামনে মনে হয় এখান থেকে আরও ভালো কিছু করতে পারব।’
চার আসর বিপিএল খেলার অভিজ্ঞতাও সাহস যুগিয়েছে মেহেদীকে। তিনি বলেছেন,
‘প্রথমত দেখেন, আমি বিপিএল খেলছি চার বছর ধরে। আমার একটু অভিজ্ঞতা আছে। সবসময় একই রকম যাবে না এই উইকেটে। এই উইকেট বেশি ভালো ছিল। বোলারদের জন্য এটা খুব চ্যালেঞ্জিং। ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে খুব চ্যালেঞ্জ করে বোলিং করতে হয়।’
আক্রমণাত্মক ব্যাটিংটা মেহেদীর সহজাত
পাওয়ারপ্লে’র সময়টাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন মেহেদী। অথচ তার উইকেট ‘মূল্যহীন’ মনে করেই ঢাকা তিনে পাঠিয়েছিল তাকে। সালাউদ্দিনের বাজিটাও সফলতার মুখ দেখেছে। মেহেদী ঝড়ের বেগে রান তুলেছেন। এই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং নাকি মেহেদীর সহজাত। এমনটাই বলছেন এই তরুণ,
‘এটা আমার জন্মগতই। আমি খেললে এরকমই খেলি। আমার প্রথম শ্রেণির ম্যাচ দেখেন। ঘরোয়া ম্যাচ দেখেন, আমি খুব পিটাইতে পারি, বিপিএল একটু ভিন্নরকম জায়গা। এই জায়গায় সুযোগ আমি ওভাবে পাই না, সত্যি বলতে। আপনি দেখবেন আমার ইনিংসগুলো, আমি সবসময় একই জায়গায় ব্যাটিং করতে পারি না। কখনো ১০ নম্বর, কখনো ৯ নম্বর, সেই ক্ষেত্রে শেষের দিকে আমার জন্য খুব কঠিন। যখন স্লগের বোলাররা থাকে, ইয়র্কার করে, বাউন্সার করে, তো আমার জন্য শক্তিটা… তখন একটু কঠিন হয়ে যায়। নতুন বলের জন্য আমি ঠিক আছি। পাওয়ারপ্লে ব্যবহার করতে পারি, কোচেরও সেই পরিকল্পনাটা ছিল আরকি।’
টি-টোয়েন্টিতে এর আগে কখনোই এত ছক্কা মারেননি মেহেদী। বলেছেন,
‘এর আগে টি-টোয়েন্টিতে এতগুলো ছয় কখনো মারিনি। হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত এখানেই সবচেয়ে বেশি ছয়।’
ব্যাটিংয়ে ঝলক দেখালেও নিজেকে বোলিং অলরাউন্ডারই মনে করেন খুলনার এই ক্রিকেটার। তিনি বলেছেন,
‘প্রথমে তো ব্যাটিংটাই ভালো ছিল। কিন্তু এখন আমার প্রধান অস্ত্র বোলিং, সুতরাং এখন আমি বোলিং অলরাউন্ডার।’
দলের প্রয়োজনে যেকোনো পজিশনে খেলতে প্রস্তুত মেহেদী। তিনি বলেছেন,
‘আসলে অবস্থা বুঝে যেটা করতে হবে আমি তার জন্য প্রস্তুত থাকি; ১০ নম্বর হোক, আর ওপেন হোক। আমি আগেও বলেছি, আমার একটা পজিশন নির্ধারিত থাকলে আমার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ সহজ হয়। ৯-১০ নাম্বারে নামলে মোরাল একটু নিচে নামবে।’
ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কারগুলো উজ্জীবিত করে, আত্মবিশ্বাস যোগায় মেহেদীকে। ঢাকা প্লাটুনের এই ক্রিকেটার বলেছেন,
‘এটা তো সবসময়ই ভালো লাগে। কিন্তু আমি যদি শেষ করে আসতে পারতাম, তাহলে এটা আমার জন্য আরও ভালো হতো। বোলার হিসেবে বিপিএল শুরু করেছি, কিন্তু খুব বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছি না। সেদিকে নজর দিচ্ছি। যতটুকু সম্ভব, বোলিংটা রপ্ত করার চেষ্টা করছি। সবসময় চিন্তা করি, নিজের বোলিং স্কিল কীভাবে উন্নত করা যায়।’
শারীরিকভাবে পিছিয়ে দেশীয়রা
বিপিএলে চার-ছক্কার মিছিলে সবসময় এগিয়ে বিদেশি ব্যাটসম্যানরা। অবলীলায় ছক্কা হাঁকান বিদেশিরা। সে তুলনায় দেশীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে ছক্কা বেশি দেখা যায় না। মেহেদীর মতে, শারীরিক শক্তির দিক থেকে পিছিয়ে দেশীয়রা।
এই তরুণ বলেছেন,
‘আমরা আমাদের শরীরগত শক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছি। বিদেশিরা অনেক শক্তিশালী। আমরা যেটা চার মারি, তারা ওটা ছয় মারে। পার্থক্য ওখানেই। এজন্য ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বলব যে, দেশি ক্রিকেটার একদম খারাপও করছে না। যেরকম সুযোগ পাচ্ছে, ভালোই হচ্ছে। এই জায়গায় বোলারদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং। ব্যাটসম্যানদের জন্য বিপিএলের দ্বিতীয় রাউন্ড বেশ ভালো ছিল। দেশী ব্যাটসম্যানরা এই উইকেট থেকে অনেক শিখতে পারবে। মিরপুর আর সিলেট যা-ই বলেন, এরকম (চট্টগ্রামের মতো উইকেট) উইকেট পাওয়া মুশকিল বাংলাদেশে। এখানে বেশি ব্যাটিং সহায়ক উইকেট। এখান থেকে শিখতে পারলে আমাদের জন্য কাজে দেবে।’
তবে উন্নতি করার জন্য দেশীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং অর্ডারে উপরের দিকে সুযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন মেহেদী। সুযোগ পেলেই শিখতে পারবেন দেশীয়রা। ২৫ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বলেছেন,
‘আপনি যদি চান দেশী ক্রিকেটারের জন্য এই আসরে কিছু করতে, টপ দেশি ক্রিকেটাররা ওরকম কোনও সুযোগ পায় না। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো বিদেশি ক্রিকেটারের ওপর নির্ভরশীল থাকে। দেশীদের সুযোগ না দিলে আমরা শিখব কেমনে? আমাদের শেখার অপশন থাকতে হবে এই বড় ইভেন্টে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এই অপশন থাকে না। সবসময় বিদেশি ক্রিকেটারের ওপরেই বিশ্বাস করে বেশি।’