ক্রিকেটবিশ্বে বড় দল হয়ে উঠতে হলে জয়ের অভ্যাস তৈরি করতে হবে সেইসাথে বিদেশের মাটিতে ভালো খেলতে হবে। শুধুমাত্র ঘরের মাঠে ভালো খেললেই ক্রিকেট বিশ্বে বড় দল হয়ে উঠা যায় না। নিজেদের হাতে থাকা ম্যাচগুলোকে ঠাণ্ডা মাথায় শেষ করে আসাটাই বড় দলের লক্ষণ, বাংলাদেশ এই কাজটুকু করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে ব্যাটসম্যানসের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ে সহজ জয় হাতছাড়া হয়ে বাংলাদেশের। কিউইদের দেওয়া ২৫২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সাব্বির রহমান এবং ইমরুল কায়েসের ব্যাটে চড়ে সহজ জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো বাংলাদেশ। ২৩ ওভার শেষে ১ উইকেটে ১০৫ রানে বেশ এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। তারপর শুরু হয় ব্যাটসম্যানদের যাওয়া আসার মিছিল। ইমরুল কায়েসের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে সাব্বির রহমান ৩৮ রান করে রান আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান। অর্ধশতক করলেও ইমরুল কায়েস অন্যপ্রান্তে ছিলেন বেশ অস্বস্তিতে, দুয়েকবার আউট হতে হতে বেঁচে যান।
মুশফিকুর রাহিমের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ গত ৬ বছরে কোনো ম্যাচ জিতেনি, মিডল অর্ডারে দলের হয়ে বেশ কয়েক ম্যাচ জিতানো মুশফিকের অনুপস্থিতিতে দলের মিডল অর্ডারে ভরসার অন্য নাম মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ লুকি ফার্গুসেনের অসাধারণ ইয়র্কারের আউট হওয়ার আগে মাত্র ১ রান করেন। বাংলাদেশের পুরো ইনিংসে বাদবাকি সবাই নিজেদের উইকেট নিউজিল্যান্ডকে বড়দিনের উপহার হিসাবে দিয়ে এসেছেন। আর এভাবেই বাংলাদেশ ১ উইকেটে ১০৫ রান থেকে ১৮৪ রানে গুটিয়ে যায়। এতে করে নিউজিল্যান্ড ১ ম্যাচ হাতে রেখেই ৩ ম্যাচের ওডিয়াই সিরিজ নিজেদের করে নেয়। সেই সাথে দেশের মাটিতে টানা ৭ টি সিরিজ জয়ের নতুন রেকর্ড গড়ে কিউইরা। এর আগে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মাটিতে খেলা ৬ টি সিরিজই জিতেছিলো নিউজিল্যান্ড।
তবে নেলসন শহরের স্যাক্সটন ওভালের সকালটা দুর্দান্তভাবে শুরু করেছিলো বাংলাদেশ। এই মাঠে শেষ ৫ ম্যাচের সবকটিতে টার্গেটে ব্যাট করা দল জয় পেয়েছে এমন সমীকরণের সামনে গুরুত্বপূর্ণ টসে মাশরাফি জয় লাভ করে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করে ইনিংসের চতুর্থ বলেই শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মার্টিন গাপটিলকে।
অন্যপ্রান্তে অভিষিক্ত শুভাশিস রয় ভালো জায়গায় বল করে কিউই ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখেন। তৃতীয় পেসার হিসাবে বল করতে এসে কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসনকে ১৪ রানে আউট করেন তাসকিন আহমেদ। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান টম লাথামকে ২২ রানে আউট করেন সাকিব আল হাসান।
তখনো একপাশ আগলে রাখেন ছয় বছর পর দলে ডাক পাওয়া নেইল ব্রুম, ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া কিউইদেরকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দেয় ডানহাতি এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। লুক রংকি, জিমি নিশাম এবং টেইল এন্ডারদেরকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ২৫১ রানের সংগ্রহ এনে দেন অভিষেকের ৮ বছর পর সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ১০৭ বলে ১০৯* রানে অপরাজিত থাকা নেইল ব্রুম।
শেষদিকে বাংলাদেশের দুর্বল ফিল্ডিং এবং বোলিংয়ের সুবাদে ১০-১৫ রান বেশি যোগ করে নিউজিল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৫২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে বেশ খোশমেজাজেই ছিলো বাংলাদেশ দল। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ৪৯ রানে তিন উইকেট এবং সাকিব আল হাসান, তাসকিন আহমেদ ৪৫ রান খরচায় ২ উইকেট শিকার করে কিউইদের অল আউট করে বাংলাদেশ।
আজকের ম্যাচের আগে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ৮ ম্যাচের সবকয়টিতে হারের স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশের জয় ঝুলে ছিলো ব্যাটসম্যানদের সফলতা আর ব্যর্থতার মধ্যে। এই স্যাক্সটন ওভালেই নিজেদের একমাত্র ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৯ রানের টার্গেটে ৬ উইকেটের জয় পেয়েছিলো বাংলাদেশ। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড এই মাঠে নিজেদের শেষ ম্যাচে ২৭৮ রান করেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮ উইকেটে পরাজিত হয়েছিলো।
কোনোরকম চাপ ছাড়া ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ভুল করে বসে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল। সাউদিকে অহেতুক চার্জ করতে এসে নিজের উইকেট বিলিয়ে দেন ১৬ রান করেই। এরপর ইমরুল-সাব্বিরের ব্যাটে জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছিলো ঘোটা বাংলাদেশ। এই দুইজন দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৭৫ রান সংগ্রহ করে ঠিক পথেই হাঁটছিলেন।
সাব্বিরের রান আউটের মধ্য দিয়ে জুটি ভাঙ্গার সাথে সাথে জয়ের আশাও আস্তে আস্তে ভেস্তে যেতে থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সাকিব, মোসাদ্দেকরা অহেতুক শট খেলে পার্টটাইম বোলার উইলিয়ামসনকে নিজেদের উইকেট উপহার হিসাবে দিয়ে আসলে আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি বাংলাদেশ। এই বছর ভারত, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর এই নিয়ে চতুর্থ বার তীরে এসে তরী ডুবালেন ব্যাটসম্যানরা।
উইলিয়ামসনের ৩ উইকেট এবং দুই পেসার সাউদি ও বোল্টের দুই উইকেট শিকারে ১৮৪ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। স্রোতের বিপরীতে থেকে অভিষিক্ত সোহান ২৪ রান করে শুধু হারের ব্যবধান কমান। এভাবে বাংলাদেশকে ১৮৪ রানে অলআউট করে ৬৭ রানের সহজ জয় তুলে নেয় নিউজিল্যান্ড।
নিজের প্রথম শতকের পুরস্কাররূপ ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন নেইল ব্রুম। মূলত ঠাণ্ডা মাথায় তার দায়িত্বশীল ইনিংসের কারণেই লড়াকু সংগ্রহ পায় নিউজিল্যান্ড, ৬ বছর পর দলে সুযোগ পেয়ে ভালো কিছু করার অপেক্ষায় ছিলেন ব্রুম, আজকের ম্যাচের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন নেইল ব্রুম।
হোয়াইটওয়াশ এড়াতে বছরের শেষদিনে স্যাক্সটন ওভালেই নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড চাইবে বাংলাদেশের বিপক্ষে শেষ দুই সিরিজে হোয়াইটওয়াশের বদলা নিতে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
নিউজিল্যান্ড – ২৫২/১০ ; ওভার – ৫০ ( ব্রুম ১০৯*, রংকি ৩৫, নিশাম ২৮ ; মাশরাফি ৩/৪৯, সাকিব ২/৪৫, তাসকিন ২/৪৫)
বাংলাদেশ – ১৮৪/১০ ; ওভার – ৪২.৪ ( কায়েস ৫৯, সাব্বির ৩৮, সোহান ২৪ ; উইলিয়ামসন ৩/২২, বোল্ট ২/২৬, সাউদি ২/৩৩)
ফলাফল – নিউজিল্যান্ড ৬৭ রানে জয়ী।