ফুটবল বিশ্বকাপের উত্তেজনা শেষ হতে না হতেই শুরু হতে যাচ্ছে ফুটবলের নিয়মিত আসর ক্লাব ফুটবলের আমেজ। এই আগস্ট মাসেই শেষ হয়ে যাবে ২০১৮-১৯ মৌসুমের ক্লাব ফুটবলের প্রায় সব সেরা লিগগুলোর দল-বদলের সময়সূচী। ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ লিগ প্রিমিয়ার লিগের জমজমাট লড়াই শুরুর পূর্বে সব দলই সামর্থ্য অনুযায়ী সাজিয়ে নিচ্ছে নিজেদের সেরা দল। কিংবদন্তি স্যার ফার্গুসনের বিদায়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত লিগ জিততে পারেনি লিগের সবচেয়ে সফল দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, দলের দায়িত্ব হাত বদল হয়েছে বেশ কয়েকবার।
ময়েস ও ভ্যান গালের পর রেড ডেভিলরা আস্থা রেখেছেন অন্যতম সেরা কোচ জোসে মরিনহোর উপর। ফার্গুসন পরবর্তী কোচদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মরিনহোই সবচেয়ে সফল বলা চলে, তার অধীনে ইউনাইটেড জিতেছে উয়েফা ইউরোপা লিগ, লিগ কাপ ও কমিউনিটি শিল্ড। যদিও এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে আস্থার প্রতিফল ঘটাতে সক্ষম হয়নি মরিনহোর ইউনাইটেড, কিন্তু বিগত পাঁচ মৌসুমের মধ্যে গত মৌসুমে লিগে রেড ডেভিলদের অবস্থান ছিল সবচেয়ে ভালো।
গত মৌসুমে দ্বিতীয় হলেও নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ও গত আসরের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে তারা ১৯ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল। প্রাকমৌসুমের প্রস্তুতি ম্যাচে বায়ার্নের বিপক্ষে ১-০ গোলে পরাজিত হওয়ার পর এবারে ‘কঠিন মৌসুম’ হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন মরিনহো, নিজের মনমতো খেলোয়াড় কিনে দল সাজাতে না পারার কারণেই এমনটা মনে করছেন মরিনহো।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সর্বোপরি স্কোয়াড যাই হোক না কেন, এই মৌসুমে মরিনহোর মিশন পরিষ্কার; লিগ জিততে না পারলেও প্রিমিয়ার লিগে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সিটির সাথে গত মৌসুমের বিস্তর ব্যবধান ঘোচানো।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বর্তমান স্কোয়াড
গোলরক্ষক
ডি হেয়া, রোমেরো, লি গ্র্যান্ট
ডিফেন্ডার
লিন্ডলফ, বেইলি, জোনস, রোহো, স্মলিং, ইয়ং, লুক শ, ভ্যালেন্সিয়া, ডার্মিয়ান, ডালট, টিমোথি
মিডফিল্ডার
পগবা, মাতা, লিনগার্ড, হেরেরা, ফেলাইনি, মাতিচ, স্কট, ফ্রেড, পেরেইরা
ফরোয়ার্ড
সানচেজ, লুকাকু, মার্শিয়াল, রাশফোর্ড
নতুন মুখ
২০১৮ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ইউনাইটেডে যোগ হয়েছে তিনজন নতুন খেলোয়াড়। শাখতার থেকে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার ফ্রেড, স্টোক সিটি থেকে গোলরক্ষক লি গ্র্যান্ট এবং পোর্তো থেকে রক্ষণে যোগ হয়েছে ডালট।
ফর্মেশন ও লাইন আপ
মৌসুমের শুরুতে প্রস্তুতি হিসেবে দলকে ঝালিয়ে নিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন্স কাপে মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল ও রিয়াল মাদ্রিদের। লিভারপুলের বিপক্ষে ১-৪ গোলে পরাজিত হওয়ার ম্যাচটিতে মরিনহো তার দলকে খেলিয়েছিলেন ৩-৫-১-১ ফর্মেশনে এবং রিয়ালের বিপক্ষে রেড ডেভিলরা নেমেছিল ৩-৫-২ ফর্মেশনে। এই ম্যাচটিতেও ১-২ গোলে পরাজিত হয় ইউনাইটেড।
সহজেই অনুমেয় রক্ষণাত্মক মনোভাবের মরিনহোর এই ফর্মেশন পরিবর্তনের নিরীক্ষা কোনো কাজেই আসেনি। সর্বশেষ ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে দলটি খেলেছিল ৪-৩-৩ ফর্মেশনে, যদিও হারের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি দলটি। ম্যাচটিতে ০-১ গোলে পরাজিত হলেও, এই মৌসুমে খুব সম্ভবত এই ৪-৩-৩ বা বিগত মৌসুমের মতো ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে দল সাজাবেন এই পর্তুগীজ।
গোলরক্ষক
স্পেনের হয়ে সম্প্রতি শেষ হওয়া বিশ্বকাপ একেবারেই ভালো যায়নি ডি হেয়ার, কিন্তু বিগত মৌসুমগুলোতে ক্লাবের হয়ে পার্ফরম্যান্স বিবেচনায় ইউনাইটেডের অন্যতম সেরা এই খেলোয়াড় খুব স্বাভাবিকভাবে এইবারও দলটির গোলবার সামলাতে যাচ্ছেন নিয়মিতভাবে, বিগত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি (১৯) ক্লিন শিট এই স্প্যানিশ খেলোয়াড়েরই।
আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক রোমেরো রয়েছেন বিকল্প হিসেবে, ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি যিনি। তাছাড়া দলে এবার নতুন মুখ হিসেবে স্টোক সিটিতে যোগ দিয়েছেন গোলরক্ষক গ্র্যান্ট, ইউনাইটেড বেঞ্চে দেখা যাবে তাকেও। খুব বড় রকমের কোনো অঘটন না ঘটলে লিগ ম্যাচগুলোতে ডি হেয়া ছাড়া এই দুইজনকে দেখার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
রক্ষণভাগ
গত মৌসুমে সবচেয়ে কম গোল হজম করা দলের তালিকায় দ্বিতীয় (২৮ গোল) ও সর্বোচ্চ ক্লিন শিট ছিল রেড ডেভিলদের। কোচ মরিনহো তার দলের রক্ষণভাগ বেশ দারুণভাবে গুছিয়ে নিয়েছিলেন এবং রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। সেন্টারব্যাক পজিশনে মরিনহোর হাতে দারুণ কিছু ডিফেন্ডার থাকায় তাকে মধুর সমস্যায় পড়তে হলেও, ফুলব্যাক হিসেবে নিজেদের জায়গা একরকম পাকা করে রেখেছেন ইয়ং ও ভ্যালেন্সিয়া। ডানে ভ্যালেন্সিয়া ও বামে ইয়ং, অন্তত মৌসুমের শুরুতে অভিজ্ঞ এই দুই খেলোয়াড়কেই নিয়মিত দেখতে চাইবে ভক্তরাও। তবে পরিস্থিতি ও সময় বিবেচনায় লুক শ ও নতুন মুখ ডালটকেও রক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ দুই পাশ সামাল দিতে দেখা যাবে।
রক্ষণের হৃদপিন্ড সেন্টার-ব্যাকের জন্য ইউনাইটেডে রয়েছে রোহো, স্মলিং, জোনস, বেইলি, লিন্ডলফের মতো খেলোয়াড়েরা। গোলবারে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা হিসেবে মরিনহো তার সেরা অস্ত্রই নামাবে, এখানে নিশ্চিত করে বলা কষ্টকর ঠিক কোন জুটি সেন্টার-ব্যাকে খেলতে যাচ্ছে। গত মৌসুমে বেশিরভাগ ম্যাচেই একাদশে ছিলেন স্মলিং, এবারেও তেমন একটা ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা নেই।
মাঝমাঠ
এবারে মাঝমাঠে সবার চোখ থাকবে ইউনাইটেডের নতুন খেলোয়াড় ব্রাজিলিয়ান মিউডফিল্ডার ফ্রেডের দিকে। বিগত মৌসুমগুলোতে দলটির মাঝমাঠ কখনই বলার মত করে ভক্তদের আশা পূরণ করতে পারেনি, কোথাও না কোথাও একটা অপূর্ণতা থেকে গেছে। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে তিনজনের মিডফিল্ডে ফ্রেড ইউনাইটেডের সবচেয়ে দুর্দান্ত সংযোজন বলা চলে।
ইউক্রেনের শাখতারে ফ্রেড ছিল মাঝমাঠের প্রাণভোমরা। তার অসাধারণ কৌশল, দুর্দান্ত পাসিং এবং আক্রমণভাগের সাথে একটা নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরির দুর্দান্ত সক্ষমতা ইউনাইটেডে পুরোটাই কাজে লাগাতে চাইবেন কোচ। সেক্ষেত্রে পগবা ও মাতিচের সাথে ফ্রেড সবচেয়ে ভালো সুবিধা পাবে। মাঝমাঠের ডান দিকে ফ্রেডের সাথে দুই পায়েই শক্তিশালী পগবা যদি বাম দিকে খেলেন এবং তাদের সাথে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে মাঝে মাতিচকে খেলাতে পারেন কোচ। এক্ষেত্রে ৪-৩-৩ থেকে অনায়াসে ৪-১-২-৩ বা ৪-২-১-৩ ফর্মেশনে সহজেই পরিবর্তন সম্ভব।
পগবা যদি বিশ্বকাপের পারফর্মেন্স ধরে রাখতে পারেন তাহলে ইউনাইটেডের মাঝমাঠে অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ও ফুটবল দেখার একটা দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া মাঝমাঠে মরিনহোর হাতে রয়েছে ফেল্লাইনি, হেরেরা, পেরেইরা ও স্কতের মতো খেলোয়াড়, যারা বদলি কিংবা ম্যাচ অনুযায়ী বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে।
আক্রমণভাগ
আক্রমণভাগে স্ট্রাইকার হিসেবে বেলজিয়ান লুকাকুর বাম উইঙ এ খেলতে পারে শীতকালীন দলবদলে যোগ দেওয়া চিলিয়ান তারকা সানচেজ। প্রাক-মৌসুমের ম্যাচগুলোতে আহামরি পারফর্মেন্স করতে না পারা সানচেজের যে নতুন দলে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। তবে সময়ের সাথে মানিয়ে নিলে ফ্রেড-পগবাদের সামনে সানচেজ হতে যাচ্ছে মরিনহোর অপ্রতিরোধ্য অস্ত্র।
ডান উইঙ্গের জন্য প্রথাগত রাইট উইঙ্গার না থাকায় খানিকটা সমস্যায় পরবে মরিনহো। সম্ভবত ডান দিকে মাতা বা রাশফোর্ডকে খেলাবে মরিনহো, তবে মাতার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি গতিশীল রাশফোর্ড মূল একাদশে প্রাধান্য পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। একই পজিশনের জন্য লড়াই করতে হবে লিনগার্ডকেও।
দুর্বলতা
সেরা একাদশ নির্বাচনের জন্য মরিনহোর হাতে অনেক খেলোয়াড় থাকলেও তার স্কোয়াডে প্রথাগত একজন রাইট উইঙ্গারের অভাব রয়েছে। প্রিমিয়ার লিগের মতো গতিময় ও শারীরিক শক্তি নির্ভর লিগে যেকোনো দুর্বলতাই বড় আকার ধারণ করতে পারে যেকোনো সময়। তাছাড়া নিজের পছন্দ মতো খেলোয়াড় দলে আনতে না পারায় মরিনহোও খুব একটা খুশি নন। ফ্রেডের সংযোজন দলের জন্য একই দিকে যেমন ইতিবাচক, অন্যদিকে প্রিমিয়ার লিগের সাথে মানিয়ে নিতে এই ব্রাজিলিয়ানের সময় লাগলে বেশ বিপদে পরবে ইউনাইটেড।
ধারণা করা হচ্ছে যে, মরিনহোর পরিকল্পনার বড় একটা অংশ জুড়ে থাকবে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার, সেক্ষেত্রে প্রিমিয়ার লিগের নতুন মুখ হিসেবে কতটা দ্রুত তিনি কার্যকরী হয়ে উঠেন সেটাই দেখার বিষয়। একই কথা প্রযোজ্য সানচেজের বেলায়ও, আর্সেনাল ও ইউনাইটেডের খেলার ধরণে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। প্রিমিয়ার লিগের একই মঞ্চে নতুন দলের হয়ে খেলতে কিছুটা সময় লাগতেই পারে, তবে বেশি সময় লাগলে তা সানচেজ ও দল উভয়ের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে।
সম্ভাবনা ও শক্তিমত্তা
বিগত মৌসুমে দ্বিতীয় হওয়ায় লিগে নতুন করে স্বপ্ন দেখতেই পারেন ইউনাইটেড ভক্তরা। কারণ ২০১২-১৩ মৌসুমে শিরোপা জয়ের পর এই ফলাফলই রেড ডেভিলদের সেরা অর্জন। আপাত দৃষ্টিতে অন্যতম সেরা রক্ষণ নিয়েই মৌসুম শুরু করতে যাচ্ছে দলটি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ইউনাইটেড কোচ ফুটবলের সৌন্দর্য বা আক্রমণাত্মক ফুটবলে তেমন একটা বিশ্বাসী নন। তার একমাত্র লক্ষ্য ইতিবাচক ফলাফল। এই ফলাফলের জন্য তিনি পুরো ম্যাচে বাস পার্ক কৌশলও অনুসরণ করতে পারতেন কিংবা প্রতি-আক্রমণেও খেলাতে পারেন। সামগ্রিক বিবেচনায় ওল্ড ট্রাফোর্ডে হয়তো কিছু নিরস ম্যাচের দর্শক হয়েই থাকতে হবে রেড ডেভিলদের।
তবে আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে ফ্রেডের অন্তর্ভুক্তি ও পগবার ফর্ম, সেই সাথে আপনি মাথায় রাখতে পারেন লুকাকুর গোলের সুযোগ কাজে লাগানোর দারুণ সক্ষমতাও। ফ্রেড অবশ্যই ইউনাইটেডের আক্রমণ ও মাঝমাঠের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। ফ্রেডের বলের নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণ ভেদ করা পাস এবং পরিশ্রমী মনোভাব মরিনহোকে তার পরিকল্পনায় অনেকটা বাড়তি সুবিধা দিবে।
দলটির সবচেয়ে পরীক্ষিত ও শক্তিশালী অংশ এখন পর্যন্ত অবশ্যই রক্ষণভাগ। প্রায় কমবেশি প্রত্যেক পজিশনের জন্য মরিনহোর হাতে একের অধিক বা কমপক্ষে একজন হলেও বিকল্প খেলোয়াড় রয়েছে। স্কোয়াডের এই গভীরতা প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়াও ইংল্যান্ডের অন্য আসরের ব্যস্ত সূচীতে দলকে আলাদা করে ভরসা যোগাবে।
ফিচার ইমেজ- strettynews.com